#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-২৭
সারাদিন একসাথে টুকটাক কাজ করা, রান্না করে খেতে খেতে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা দিনগুলো দিব্যি উড়ে উড়ে পার হচ্ছে দু’জনার। দু’জনের এখন অনেকটা সহজ একে অপরের সাথে। বেশির ভাগ সময় রাযীন কথা বলে আর রুহি শোনে। আমেরিকায় পড়ালেখা, চাকরি, জীবনযাপন নিয়ে অনর্গল কথা বলে যায় রাযীন আর রুহি মন দিয়ে শোনে। মাঝে কয়েকদিন নিজের কাজে বেরিয়েছিলো রাযীন। কাজ শেষ হতেই বাড়ি ফিরেছিলো রাযীন। সবচেয়ে সত্যি কথা হলো এই ক’দিন ওরা বাইরে খায়নি এমনকি বাইরের খাবারও অর্ডার করেনি। রুহিও আজকাল টুকটাক রান্না করছে। সেগুলো খেতে ভালো না লাগলেও রাযীন চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। সত্যি বলতে রুহির ভালো লাগছে এখানে থাকতে। চিটাগং এর বাড়িতে শুভর ভাবনা মাথায় তাড়া করে ফিরে। এখানে অন্তত শুভকে দেখতে হচ্ছে না এটাই শান্তি। বিকেলে চায়ের মগে চুমুক দিতে যেয়ে রুহি আচমকা প্রশ্ন করে রাযীনকে-
“সেদিন মা বলছিলো, একজন তো অকালে চলে গেলো। কার কথা বলেছে বলুন তো? আপনাদের ছাদে একটা ঘর সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। ওটা কার? কে থাকতো ওখানে?”
রাযীন চমকে উঠতে উঠতে নিজেকে সামলে নিলো। এ প্রশ্ম তো আসতোই আজ অথবা কাল৷ উত্তরটা এখন দেবে কিনা ভাবছে। কে যেন বলেছিলো, কৌতূহল সঠিক সময়ে দমন না করলে বিপদ। রুহি নিষ্পলক চোখে রাযীনকে দেখছে। রাযীন মুখ খুললো-
“উত্তর জানা কি জরুরি?”
রুহি বিরক্ত হলো-
“আপনাদের সবার মধ্যে রহস্য ধরে রাখার প্রবনতা আছে। আমাকে যদি নিজেদের একাংশ মনে করেন তাহলে তো নিজ উদ্যোগে সব কথা জানানো উচিত। তাই না বলুন?”
“কিসের রহস্য করছি বলো তো?”
“সবকিছু নিয়ে। ঝিলিক ভাবির সাথে আপনার সম্পর্ক, কেন আলাদা হলেন কিছুই তো বলেননি। প্রথমদিন ছোট মা বলেছিলেন, তাদের আরেকটা মেয়ে আছে মানে আরেকটা বোন আছে আপনাদের অথচ তাকে কোনোদিন দেখলাম না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাকে জানানো উচিত না বলুন?”
রাযীন রুহির পানে চেয়ে রইলো নির্নিমেষ-
“অতীত নিয়ে আলোচনা কে পচ্ছন্দ করে বলোতো? অতীতের ভুলগুলো কি কেউ মনে করতে চায়? ঝিলিক আমার প্রাক্তন ওকে নিয়ে কিছু বলতে আমার একদমই ভালো লাগে না। আসলে প্রয়োজন বোধ করি না। কারন ওকে পেছনে ফেলে আমি এগিয়েছি অনেক দূর। ও এখন আমার বড় ভাইয়ের বউ সম্মানের মানুষ। আর প্রয়োজন না হলে পারিবারিক ব্যাপার নিয়েই বা কি আলাপ করবো? তবে হ্যা তুমি যেহেতু আজ জানতে চাইলে তোমাকে জানাবো।”
রাযীন থামলো চায়ে চুমুক দিলো নিঃশব্দে। মনে মনে কথা সাজিয়ে নিচ্ছে।
“আমরা দুই ভাই আর এক বোন। আর শুভরা দুইভাই দুইবোন। তো আলিফ ভাইয়া একটু মা ন্যাওটা আর নরম সরম মানুষ। বাবার ইচ্ছে ছিলো ভাইয়া লন্ডন স্কুল অফ বিজনেস এ পড়ুক কিন্তু ভাইয়ার এক কথা সে দেশ ছাড়বে না। ভাইয়া চিটাগং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছিলো। ভাইয়াকে পাঠাতে পারেনি বলে আমার উপর একটা চাপ ছিলো। যদিও সৌরভ ভাই বাবার সে ইচ্ছে পূরণ করেছে। তবুও আমার এ লেভেল শেষ হতেই বাবা আমাকেও আমেরিকা পাঠিয়ে দিলেন। একটু কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছিলাম। আসলে আমাদের কারোই বাড়ি ছাড়তে মন চাইতো না। সাত ভাই বোন যথেষ্ট আনন্দ নিয়ে বড় হয়েছি তাই বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইতাম না কেউই। বছর দুয়েক পর হঠাৎ একদিন জরুরিভাবে দেশে ফিরতে হয়েছিলো আমাকে। কি কারনে জানো? আলিফ আমার বড়ভাই, আমার মায়ের সর্বপ্রথম সন্তান ওই ছাদের ঘরে তার লাশ পাওয়া যায়। এন্ড গেস হোয়াট? ইটস এ কেস অফ
সুইসাইড।”
রুহি আঁতকে উঠলো-
“কি বলছেন? কি কারনে এমন করেছিলেন?”
রাযীন জবাব দিলো না চুপচাপ বসে আছে সে, চায়ের মগে চা ঠান্ডা হচ্ছে। তার চেহারায় বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। সে এক দৃষ্টিতে চায়ের মগের দিকে তাকিয়ে আছে। রুহি অবাক হয়ে রাযীনকে দেখছে। মানুষটার এই রুপ একদমই অচেনা ওর কাছে। এরকম একটা দুঃখ আছে লোকটার এটাই তো জানতো না। রুহি তীব্র ভাবে মায়া অনুভব করলো। সে মায়াময় কোমল দৃষ্টিতে রাযীনের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাযীন যেন নিজেকে শুনাচ্ছে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলো-
“আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে নুরী আপু সবচেয়ে প্রানোচ্ছল হাসিখুশি মানুষ ছিলো। আমরা সবাই তার ইশারায় চলতাম। যে কোন অনুষ্ঠানে নুরী আপু মধ্যমনি। ভাইয়াও অনেক জলি মাইন্ডের। সবসময় মুখে হাসি ভাইয়ার সবচেয়ে বড় গুন। ভাইদের মধ্যে ভাইয়া বড় আর বোনদের মধ্যে নুরী আপু। এই দুইজন আমাদের আইডল। সবকিছুতে আমরা তাদের ফলো করার চেষ্টা করতাম। আর তাদেরই একজন এমন সেচ্ছামৃত্যু বেছে নেবে এটা কোনভাবেই মানতে পারছিলাম না। আমার সদা হাস্যোজ্জল ভাইটা এভাবে কেন হারিয়ে গেলো কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না।”
রাযীন দু’হাতে মুখ ঢাকলো। নিরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে বসে রইলো রুহি। অনেকটা সময় পার হওয়ার পর রুহি কোমল গলায় জানতে চাইলো-
“কারনটা কি পরে জেনেছিলেন?”
রাযীন ভেজা লাল চোখ জোড়া তুলে রুহিকে দেখে মাথা ঝাকালো, আর্দ্র কন্ঠে বললো-
“ভাইয়া আর নুরি আপু একে অপরকে ভালো বাসতো। দে আর ইন লাভ ইচ আদার।”
রুহি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রাযীনের দিকে। এমন এ্যাঙ্গেল আসতে পারে সেটা কখনোই ভাবেনি রুহি। রাযীন শুকনো ঠোঁট জোড়া টেনে হাসলো-
“আমারও এমন অবাক লেগেছিল ব্যাপারটা। বিশ্বাস করো কখনো ওদের দেখে বুঝিনি এমন কিছু চলছে। সেই সময় বাসায় আমার ফুফাতো খালাতো কত ভাইবোন আসতো। সারাদিন হইহট্টগোল চলতেই থাকতো। এখন যেমন বাড়িটা নির্জিব দেখছো এমন মোটেও ছিলোনা। এরমধ্যে এই মানুষদুটো কখন কাছাকাছি এলো সেটাই রহস্য। ভাইয়া বেশিরভাগ সময় হোস্টেলেই থাকতো আর নুরী আপুও মেডিক্যাল ও। প্রতিবছর ডিসেম্বরে আমি আর সৌরভভাই বাড়ি আসতাম। মাসখানেক থেকে আবার ফিরে যেতাম। ওদের মধ্যে কিছু চলছে সেটা ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। তাই শুরুতে ভাইয়া আর নুরী আপুর বিষয়টা অবিশ্বাস্য লেগেছিল। কিন্তু বিশ্বাস না করেই বা উপায় কি? ভাইয়া মারা যাওয়ার পরই নুরী আপুও নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সফল না হলেও অসফলও হয়নি। আপু আপাতত আশ্রয় হয়েছে পাগলাগারদে। কোন চিকিৎসায় আপুকে সুস্থ করা গেলোনা। অথচ ওদের ব্যাপারে আমরা যদি জানতাম তাহলে সত্যি বলতে খুশিই হতাম। এতো চমৎকার দু’জন মানুষ একসাথে থাকবে এই ব্যাপারটাই ভীষন ভালো। কিন্তু ওরা কেন এতো গোপনীয়তা মেনেছিলো সেটা আমি আজো বুঝিনি।”
“কারো কাছে জানতে চাননি?”
রুহি আন্তরীক গলায় জানতে চাইলো-
“চেয়েছি। কিন্তু কে কি বলবে? সবাই আমার মতো অবাক।”
রুহি চেহারায় ফুটে ওঠা অসস্তি রাযীন টের পেলো। সে চুপ করে রইলো। এতোদিন পরে ব্যাপারগুলো কারো কাছে শেয়ার করে সত্যি ভীষণ হালকা লাগছে নিজেকে। কেন লাগছে সে জানে না। রুহি হালকা গলায় বললো-
“কিন্তু ভালোবাসা ব্যাপারটা এমন যে এটা গোপন রাখা যায় না। কেউ না কেউ জানবেই। ওদের বিষয়টা অবশ্যই কেউ না কেউ টের পেয়েছিলো। কিন্তু কথা হলো টের পেলেই বা কি? ভাইয়ার এমন করার পেছনে কারনটা কি নুরী আপু ছিলো নাকি অন্য কোন ব্যাপার? ওদের মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল কি?”
“জানি না আমি কিছুই জানি না। শুভ বেনু আপা, রেনু ওরা কেউ কিছু বলতে পারে না। কারো কাছেই কোন সদুত্তর পাইনি। আর নুরী আপুতো নির্বাক।”
“এমন কি হতে পারে মা বাবা চাচা চাচী জানে কিন্তু তারা আপনাদের বলছে না?”
রাযীন রুহির দিকে চিন্তিত মুখে তাকালো-
“হতে পারে। মায়ের কাছে কয়েকবার জানতে চেয়েছি কিছু বলেনি। আর বাবারও কঠিন নিষেধ ওদের নিয়ে যেন না কথা বলি। এমনিতেই সমাজে তার যথেষ্ট ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে আর যেন কিছু না করি। আমরা কেউ আর সাহস করিনি এসব নিয়ে কিছু বলবার।”
রুহি অন্ধকারে তাকিয়ে কিছু ভাবলো। হতে পারে পরিবারের কেউ এই দু’জনার ব্যাপারে কিছু একটা করেছে। সেটা ধামাচাপা দিতেই হয়তো ব্যাপারটা বেশিদূর এগোতে দেয়নি আশরাফ চাচা। কিন্তু কি এমন ব্যাপার ঘটেছিলো যে একটা মানুষ নিজেকে শেষ করে দেবে? রুহি ভাবলো এবার ফিরে গিয়ে ব্যাপারটা জানার চেষ্টা করবে। ওকে জানতে হবে এর পেছনে কি রহস্য লুকিয়ে আছে।
চলবে—
©Farhana_Yesmin
#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-২৮
কাল চিটাগং ফিরবে সে হিসেবে আজ ঢাকায় শেষ রাত। গতকাল রাযীন কোন কাজে বাইরে গেছিলো তখন রুহিকে মায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলো। সারাদিন মায়ের কাছে থেকে রাতে আবার রাযীনের সাথে ফিরে এসেছিলো। সকালে ঘুম ভাঙতেই রুহি আজ বারান্দায় চলে এলো। এ বাড়ির বারান্দা বেশ সুন্দর। কর্নারের বাড়ি বলে রাস্তার অনেকটা দেখা যায়। সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গাও আছে যেখানে ফুলের গাছ লাগানো। ঘুম ঘুম চোখে নিচে তাকিয়ে দেখলো দারোয়ান লোকটা সামনের লনের আগাছা পরিস্কার করছে। পাশেই তার ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ান কিছু বলতেই ছোট মেয়েটা খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ছে। রুহি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে ওদের। এতো সকালে ওঠা হয়না ওদের। মুভি দেখতে দেখতে বেশির ভাগ রাতেই ঘুমাতে দেরি হয় রুহিদের। কাজ না থাকলে রাযীন বারোটা একটা পর্যন্ত ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ একসাথে করে যেটাকে আজকাল মানুষ ব্রান্চ বলে। রুহি আলস্য ভরা চোখ সরিয়ে সামনের রাস্তায় তাকালো। মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ি হুশ করে বেড়িয়ে যাচ্ছে। একদম সুনসান নীরব হয়ে আছে চারপাশ। রুহি গ্রিলে হাতের উপর থুতনি ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পরই পেছনে রাযীনের উপস্থিতি টের পেলো। ওকে জড়িয়ে ধরে চুলের গন্ধ নিয়ে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল-
“এতো সকালে উঠেছ কেন?”
“ঘুম ভেঙে গেলো।”
রাযীন হাম তুলে রুহির পাশে দাঁড়াতেই হালকা ঠান্ডা হাওয়া ওর শরীর ছুয়ে গেলো। আবেশে চোখ বুঁজে ফেললো রাযীন। রুহি মুচকি হাসলো-
“বাতাসটা খুব আরামদায়ক তাই না?”
“উমমম। অনেক দিন পরে এই শীতল হাওয়ায় স্পর্শ পেলাম। সকালে এতো তাড়ায় থাকি যে এসব মনেই থাকে না। আর নয়তো ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই।”
রাযীন এখনো চোখ বুজে আছে। ঘুমঘোর চোখে রুহির দিকে চাইলো-
“তোমার কি মনখারাপ লাগছে আজ চলে যাবো তাই?”
রুহি নিজেকে আড়াল করতে চাইলো-
“না সেরকম কিছু নয়।”
একহাতে রুহিকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো, ওর নাকের ডগায় আলতো চুমো দিয়ে হাসলো-
“সত্যি বললে তোমাকে কেউ বকবে না বোকা মেয়ে। আমার নিজেরও কিন্তু যেতে মন চাইছে না। কিন্তু কি জানো এখানে অল্প দিন থাকি বলেই এতো ভালো লাগে। আবার যখন এখানে পার্মানেন্ট থাকবো তখন দেখবে চিটাগং যাওয়ার জন্য মন কেমন করছে।”
“জানি। আমি আসলে আপনাকেই বেশি মিস করবো। আপনার বানানো খাবারগুলো।”
রুহি গাল ফোলাতেই রাযীন হো হো হাসলো-
“কি কপাল আমার। বউ আমাকে না আমার রান্না মিস করবে। আচ্ছা যখন তোমার খেতে ইচ্ছে করবে তখন বলবে আমি রেঁধে খাওয়াবো। ঠিক আছে?”
“না ঠিক নেই। সবার মাঝে ওভাবে রান্না করলে সবাই আপনাকে খেপাবে। বউপাগল বলবে সবাই।”
রুহি মন খারাপ করে বলে। রাযীন গভীর চোখে রুহিকে দেখলো-
“বলুক। বললে আমি থোড়াই কেয়ার করি।”
রুহি মনখুন্ন গলায় জবাব দিলো-
“আমি চাই না কেউ আমার কারণে আপনাকে কিছু বকুল।”
রাযীন চোখ বড় বড় রুহিকে দেখলো-
“ও বাবা, এটা কি বললে? এই ডায়লগ এর মানে কি?”
রুহি টোস্টার থেকে টোস্ট বের করতে করতে ঘুরে তাকালো, চোখ পাকিয়ে বলে-
“ফাজলামো হচ্ছে?”
রাযীন আঁতকে উঠে রুহিকে জড়িয়ে ধরলো-
“আমার এতো সাহস আছে?”
একটু নিরব থেকে রাযীন মুখ খুললো-
“তোমার কাছে কিছু চেয়েছিলাম। মনে আছে?”
“উহু।”
“দেবে না?”
রা্যীনের কন্ঠ গাঢ় হলো। ওর কন্ঠে এমন কিছু ছিলো যে রুহি শিউরে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে জানতে চাইলো-
“না বললে দেবো কি করে? নিজেকেই তো দিয়ে বসে আছি আর কি দেবো বলুন?”
রাযীন রুহির কাঁধে নাক ঘষে-
“আমাকে এতোদিনেও তুমি বোঝোনি তবে?”
রুহি ফট করে ঘুরে রাযীনের চোখে চাইলো। কি বলতে চাইছে রাযীন? রাযীনের চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রুহির গাল আরক্ত হলো। রুহি যেন বুঝতে পারছে রাযীন কি চায়। আশ্চর্য লোক একটা। রুহির পক্ষে কখনো সম্ভব না এমন কিছু করা। রুহি কেবল সমার্পন করতে পারে। নিজ মুখে রাযীনকে কাছে চাওয়ার কথা ভাবতেও তার লজ্জা। সে নিজেকে লুকাতে ডিমের ওমলেট বানাতে মন দিলো। রাযীন আহত স্বরে বললো-
“ঠিক আছে আমি গেলাম তুমি কাজ করো।”
রুহি দৌড়ে এসে রাযীনের হাত ধরলো-
“এই না যাবেন না প্লিজ।”
রাযীনের মুচকি হাসি নজরে এলো। রুহি মনে মনে বকলো-
“বদলোক একটা।”
★★★
“মা, আলিফ ভাই আর নুরী আপুর কথা জানতে চাই।”
রোজী বিহ্বল দৃষ্টি মেলে রুহির পানে তাকিয়ে রইলো। রুহি নরম গলায় ডাকলো-
“মা, প্লিজ বলুন না আমাকে। আর কতোদিন নিজের মধ্যে কথা চেপে রাখবেন?”
রোজী অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেয় যেন। খর কন্ঠে বললো-
“কেন তোমার জেনে কি হবে? ওদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে করি না।”
রুহি আহত কন্ঠে বলে-
“এভাবে বলছেন কেন মা? আমিও তো এ বাড়ির সদস্য, তাহলে আমার কি জানার অধিকার নেই? তাছাড়া আমি জানি এসব নিয়ে এ বাড়ির প্রতিটি কোনো এক ধরনের চাপা অসন্তোষ আছে। হতে পারে সবার মনে এ নিয়ে ভুল কিছু ধারণা বাসা বেঁধেছে।”
রোজী ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-
“থাকলেই বা এখন কি করা যাবে? যা হওয়ার তা হয়েছে, অতীত খুঁড়ে দুঃখ ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। তুমি বরং নিজের দিকে নজর দাও। এ সময় এতো স্ট্রেস নিতে হয় না। বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর হবে। যাও রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।”
রুহি আরো কিছু বলতে চাইলেও রোজীর কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে বলার সাহস হয় না। রুহি ব্যর্থ মনে ধীর পায়ে রোজীর রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। ঢাকা থেকে ফেরার পর থেকে রুহি চেষ্টা করছে রোজীর কাছ থেকে কথা বের করতে। কিন্তু রোজী কিছুতেই মুখ খুলে না। নিজের রুমে ফিরে এসে রুহি বিছানায় শুয়ে পড়লো চুপচাপ। এখন অল্পতেই শরীর ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যায়। মাঝে একদমই খেতে পারতোনা এখন অল্প অল্প করে খায়। প্রেগনেন্সির চারমাস পার হয়ে পাঁচে পড়লো। রুহির দিন কাটতে চায় না। ঢাকা থেকে ফিরে রাযীনও ভীষণ ব্যস্ত থাকে। ক’দিন ধরে ভীষণ চিন্তিতও দেখছে। কি হয়েছে জানতে চাইলে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। রুহি ভাবে রাযীন আসলে অদ্ভুত একটা ছেলে। ঢাকায় কয়েকদিন থাকার কথা থাকলেও প্রায় একমাস থাকলো ওরা। সারাদিন একসাথে থাকতে থাকতে রুহির মনে হয়েছিলো সে রাযীন নামের মানুষটাকে চিনে ফেলেছে পুরোপুরি। একটু রগচটা আর নিজের মতো থাকতে পচ্ছন্দ করলেও মনটা পরিস্কার বেশ। পুতুপুতু প্রেম করতে না পারলেও নিজের দায়িত্বে অবহেলা করেনা কখনো। তবে একটা ব্যাপার মনে পড়লে রুহির এখনো ভীষণ অবাক লাগে। এখানে ফিরে এসে যখন জানলো ও প্রেগনেন্ট তখন এ কথা জানার পরেও রাযীন ভীষণ শান্ত আর ঠান্ডা হয়ে ছিলো। যতটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে ভেবেছিলো রুহি ততটা করেনি। শান্ত চোখে রুহির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দিয়ে রুহির হাত ধরে বলেছিলো-
“কন্গ্রাচুলেশনস রুহি। শেষ মেষ মা হয়ে যাচ্ছ তাও আবার আমার সন্তান যাকে একসময় মেনেই নিতে চাওনি। তুমি খুশি তো?”
রুহির অদ্ভুত লেগেছিল কথাগুলো। সে বিস্মিত কন্ঠে বলে-
“মা হতে পেরে খুশি কিনা বুঝতে পারছি না। বাচ্চা হওয়ার পর বুঝতে পারবো হয়তো। কিন্তু আপনি এভাবে বলছেন কেন? আপনি কি খুশি হননি?”
রাযীন মুচকি হাসে-
“খুশি! কি জানি? আমিও আসলে বুঝতে পারছি না। কখনো ভাবিনি তো এসব নিয়ে। বিয়ে বউ বাচ্চা সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। মনেহচ্ছে আমি আমি না অন্য কেউ।”
শুন্য দৃষ্টিতে রাযীন তাকিয়ে ছিলো অনেকটা সময়। রুহির হাত ছেড়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেছিলো। রুহি অবশ্য ভাববার সময় পায়নি। হুড়মুড় করে সবাই ঘরে ঢুকে গেছিলো। এ বাড়ির ছেলের প্রথম সন্তান আসবে বলে সবাই বেশ খুশি। বেনু আপা রেনু সবাই এসেছিলো ওকে শুভকামনা জানাতে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসে এখনো। কখনো ফুফু শাশুড়ীরা, কখনো ফুপাতো দেবর ননদেরা। এ সংবাদ শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলো আশরাফ আঙ্কেল। অসুস্থ মানুষটা এক লহমায় যেন সুস্থ হয়ে গেছিলেন। উঠে বসবার প্রানন্তকর চেষ্টা করে অবশেষে সফল হলো। রুহিকে ধরে কেঁদে দিলো। গুঙিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলো। পরিস্কার না বুঝলেও রুহির জন্য তিনি অনেক দোয়া করেছেন এটা বুঝতে পেরেছিলো।
রুহির মা হওয়ার খবরে সবচেয়ে বেশি পাল্টে গেছে শুভ। ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর রুহির সাথে কয়েকবার কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু রুহি সুযোগ দেয়নি। ভীষণ কঠিন ভাষায় শুভকে তিরস্কার করেছে। শুভ আহত বাঘের মতো ছটফট করেছে যেন পারলে এখনই রুহির জান কবচ করে। রুহি পাত্তা দেয়নি। শুভ যদি ওদের সম্পর্কের কথা বলে দেয় তো দেবে এ নিয়ে ভয় পেয়ে কি হবে? রাযীন তো জানতো ওর রিলেশন আছে কারো সাথে। সেই মানুষটা শুভ হলেই বা কি? রুহি তো আর ইচ্ছে করে শুভর সাথে রিলেশন করেনি। কাজেই ওর দোষ দিয়ে কেউ পার পাবে না। রুহির মনের জোর দেখেই হয়তো শুভ চুপসে গেছে। আজকাল শুভ বাসায় থাকে কিনা বোঝা যায় না। রুহির চোখে পড়ে না শুভকে। এর মাঝে খবর পেয়ে বাবা মা রুনি রুমি দেখতে এসেছিলো ওকে। দু’দিন থেকে গেছিলো এ বাড়িতে। রুহির তখন খুব ভয় লেগেছিল। শুভকে দেখলে বাবা কি করবেন? সবাই জেনে গেলে ভীষণ অসস্তিদায়ক ব্যাপার হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো সেই দু’দিন শুভকে দেখাই গেলোনা। ও কি নিজ থেকে পালিয়ে ছিলো? কিন্তু কেন? রুহি রাযীনকে অনেক বার বলবে বলবে করেও বলতে পারেনি শুভর কথা। কেমন একটা বাঁধা টের পায়। ধ্যাৎ, যেমন চলছে চলুক। যা হওয়ার হবে এতো ভেবে কাজ নেই।
চলবে—
©Farhana_Yesmin