না_চাইলেও_তুমি_আমার পর্ব-১০

0
2930

#না_চাইলেও_তুমি_আমার
পর্বঃ ১০
জাহান আরা

রাত্রি বসে আছে নিচে এক রুমে,তাকে ঘিরে আছে মৌমাছির মতো একঝাঁক তরুণী।সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত,রাত্রির এসব কিছু ভালো লাগছে না।
রুমের সামনে দিয়ে অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন রাত্রির বাবা মাইনুল ইসলাম।

রাত্রি আড়চোখে দেখছে তাকে।

মাইনুল ইসলাম রিটায়ার্ড সরকারি চাকুরিজীবী,একটা কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন,৩ বছর আগে রিটায়ার করেছেন।
আজ তার বড় মেয়ের বিয়ে,তার নিজেকে কেমন অসহায় মনে হচ্ছে,সবসময়ই তিনি মেয়েদের খুব শাসনে রেখেছেন।নিজে কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন বলেই দেখেছেন কলেজে ছেলে-মেয়েদের কতো অপকর্ম হয় আড়ালে,প্রকাশ্যে।

মা হয় মেয়েদের সবচেয়ে বড় বান্ধবী,তার মেয়েদের ভাগ্য প্রসন্ন ছিলো না,তাদের মা ছিলো না।
অনেকে বলতো ঘরে মা না থাকলে ছেলে-মেয়েরা বিগড়ে যায়।মাইনুল ইসলাম সেই বিষয় টি শক্ত হাতে সামাল দিয়েছেন।
শিক্ষকদের নাকি সামনে ২ চোখে,পিছনে ২ চোখ হয়,ছাত্রদের দেখে রাখার জন্য,কিন্তু তার ৪ চোখ না,১৮ চোখ ছিলো নিজের সন্তানদের জন্য।
ছেলে-মেয়েদের কে তিনি এতোটাই শাসনে রেখেছেন যে তাদের সাথে সহজ সম্পর্ক ও নেই।
মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছে করতো ২ মেয়েকে ২ পাশে নিয়ে খাবার খেতে,শপিং এ নিতে,ঘুরতে যেতে,কিন্তু তবু করেন নি,চেয়েছিলেন মেয়েরা যাতে তাকে ভয় করে,ভুল পথে পা বাড়ানোর আগে ২বার না,যেনো ১০ বার ভাবে।

মুখে গাম্ভীর্যের মিথ্যে মুখোশ পরে মেয়েদের সাথে ব্যবহার করেছেন।আজ কেনো যেনো তার মনে হচ্ছে এতোটা শাসন না করলেও পারতেন।
রাত্রির দিকে তাকিয়ে ভাবছেন,”ওই তো সোফায় বসে আছে আমার বড় মেয়ে,রাত্রি।তার জন্ম হয়েছে মাঝরাতে,কি ভীষণ শীত ছিলো সে সময়।রাত্রির জন্মের পর প্রথম তিনি কোলে তুলে নিয়েছেন,কান্না করতে থাকা মেয়েটি কেমন শান্ত হয়ে গেছে তার কোলে আসা মাত্রই।
মাঝরাতে জন্ম হয়েছিলো বলেই তিনি মেয়ের নাম রেখেছেন রাত্রি।
আর চন্দ্র!
সে-তো জন্মেছে এক ভরা পূর্ণিমায়,যে রাতে মানুষ গৃহত্যাগী হয়,তেমনই গৃহত্যাগী জোছনা ছিলো সেই রাতে।
তিনি তখন নাম দিয়েছেন চন্দ্র।”

এইতো দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেলো ২জনই।আজ বড় মেয়ের বিয়ে।তার বুকের বা পাশে কেমন চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে,এই ব্যথা কিসের?
কন্যা বিদায়ের সময় যতো এগিয়ে আসছে তার অস্থিরতা ততই বাড়ছে।
হঠাৎ করেই তার মনে হলো,”আমি কি রাত্রি-চন্দ্রর বাবার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি?
সারাজীবন এতো শাসন করেছি আজ হয়তো রাত্রি মুক্তির আনন্দে হেসে হেসে এই বাড়ি ছেড়ে যাবে।রাত্রি কি আজ আমার জন্য ২ ফোঁটা চোখের জল ফেলবে?
আজ ওদের মা থাকলে কেমন হতো?”

রাশেদার কথা মনে পড়তেই তার মন আরো বেশি খারাপ হয়ে গেলো।এতো তাড়াতাড়ি ছেড়ে চলে গেলো কেনো রাশেদা?
সে থাকলে তো তিনি এরকম কঠোর হতেন না।যা চলে যায় তা আর ফিরে আসে না,তবুও বোকা মন তাকে ভুলতে পারে না।

রুমে গিয়ে বসে থাকে চন্দ্র,তারপর আবার হঠাৎ করে মনে হয় চন্দ্রর,আশ্চর্য তো,আমি নিষাদের কথা শুনে নিচে নেমে এসেছি কেনো?
নিষাদ কে আমার?
সে-তো মারিয়ার সাথে সব ঠিক করেই নিলো গতকাল,তবে কেনো আমার উপর এরকম অধিকার দেখাচ্ছে?
নিষাদ আমার কেউ না,তবে কেনো আমি ওকে ভয় পাচ্ছি?
আমি মোটেও ওর কথা শুনবো না।
কেমন জেদি হয়ে উঠে চন্দ্র,আবার ছাদে উঠে,সে অবশ্যই তুরাগের সাথে কথা বলবে।
এই মিছে অভিমানের কারন কি চন্দ্র জানে না,তবুও উঠে যায় চন্দ্র ছাদে।

ছাদে উঠার সিঁড়ির মুখেই তুরাগের সাথে দেখা হয় চন্দ্রর।হাতে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে তুরাগ নিচে নামছে।
চন্দ্র সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে,পিছুপিছু তুরাগ আসে।
ঠিক নিষাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় চন্দ্র,তারপর তুরাগের দিকে তাকিয়ে হেসে কথা বলে। তুরাগ চন্দ্রকে হেসে কথা বলতে দেখে মনে করে এটা চন্দ্রর গ্রীন সিগনাল।

হাতে থাকা গোলাপ ফুল চন্দ্রকে দেখিয়ে বলে,”খোপায় শিউলি মালা না বিয়াইন,গোলাপ গুঁজলে আপনাকে বেশ লাগবে”

“গোলাপ তো আপনার হাতে,আমি গুঁজবো কিভাবে?”
রহস্যময় হাসি দিয়ে চন্দ্র উত্তর দেয়।

“আপনি কষ্ট করবেন কেনো,আমি না হয় পরিয়ে দিচ্ছি আপনার খোপায় ফুল।”

তুরাগ চন্দ্রর চুল থেকে শিউলি মালা খুলে টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে খোপায় গোলাপ ফুল লাগিয়ে দেয়।
নিষাদের রাগ সপ্তমে উঠে যায়,টেবিলের উপর থেকে পানির জগ নিয়ে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে।

চন্দ্র চমকে তাকায় নিষাদের দিকে,নিষাদের কান লাল হয়ে উঠেছে,দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিষাদ নিজেকে সংযত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে।
নিশান নিষাদের কাঁধে হাত রেখে শান্ত হতে ইশারা দেয়।তারপর চন্দ্রকে ডাক দেয়।

চন্দ্রর ভীষণ মজা লাগছে,নিষাদ কষ্ট পাচ্ছে এতেই চন্দ্র খুশি।কিসের এতো আড়াআড়ি তাদের চন্দ্র জানে না।

চন্দ্র কাছে যেতেই নিশান বলে,”নিষাদ কে একটু তোমার রুমে নিয়ে যাও তো চন্দ্র,ওর ভীষণ মাথা ধরেছে,ওর একটু রেস্টের দরকার,সারারাত ঘুমায় নি।”

এতোক্ষণের আনন্দ কর্পূরের মতো উবে যায় চন্দ্রর।নিষাদ কেমন রেগে আছে চন্দ্র বুঝতে পারছে,একা পেলে চন্দ্রকে ধরে থাপ্পড় দিতে পারে।
কি করবে বুঝতে পারছে না,নিষাদ ততক্ষণে স্টেজ থেকে নেমে এসেছে।

চন্দ্র ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে যাচ্ছে,পিছন থেকে পলাশ মৃদু সুরে বলে,”দোস্ত বেস্ট অফ লাক”

চন্দ্রর শরীর কেঁপে উঠে,মনে মনে দোয়া করে যেনো রুমে গিয়ে দেখে কেউ না কেউ রুমে আছে।

ভাগ্য চন্দ্রর সহায় থাকে না,চন্দ্রর রুম খালি।নিজের গালে নিজের চড় মারতে ইচ্ছে করে চন্দ্রর,কেনো ছাদে গেলো সে জেদ দেখিয়ে!

রাগে নিষাদের কপালের রগ দপদপ করছে,ইচ্ছে করছে তুরাগ ‘কে সেখানেই পুঁতে দিতে,কিন্তু সিনক্রিয়েট করতে চায় না এই বাড়িতে সবার সামনে সে।

রুমে ঢুকতেই নিষাদ নিজেকে আর সামলাতে পারে না,চন্দ্রকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করে,”তোমার এতো সাহস কিভাবে হলো আমি নিষেধ করার পরেও তুরাগের সাথে এরকম মাখামাখি করার?”

আকস্মিক এই আক্রমণ চন্দ্রর সম্পুর্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো,নিষাদের এরকম স্পর্শ ও চন্দ্রর অনাকাঙ্ক্ষিত।ভয়ে কেঁপে উঠে চন্দ্র।

ভিতরে জমে থাকা অভিমান মাথাচাড়া দিয়ে উঠে চন্দ্রর,বলে ফেলে”কেনো মারিয়ার সাথে যখন কাল কথা বলছেন তখন কি আমি কিছু বলেছি?
মারিয়ার সাথে তো সবই ঠিক করে নিয়েছেন,আপনার মতলব কি?
গাছের ও খাবেন,তলার ও কুড়োবেন?
আমি আপনার স্ত্রী না,আপনি আমাকে যেমন স্ত্রী মানেন না আমিও আপনাকে স্বামী মানি না।”

চন্দ্রর কথাতে নিষাদ অবাক হয়ে যায়,কি বলছে এসব চন্দ্র?
মারিয়ার সাথে তার কাল কখন কথা হলো?
“বাজে কথা বলো না চন্দ্র,তুমি আমার স্ত্রী,কান খুলে শুনে রাখো চন্দ্র,তুমি শুধু আমার,মারিয়ার সাথে আমার কোনো কথাই হয় নি।এখন মারিয়া কি বলুক,না বলুক,আই ডোন্ট কেয়ার।”

“আমাকে মিথ্যা বুঝ দিতে আসবেন না প্লিজ।”

“চন্দ্র,তুমি এখনো অনেক ছোট,অনেক ঘোরপ্যাঁচ বুঝো না,তোমার হিটলার বান্ধবীকে তুমি এখনো চিনলে না,তোমার বান্ধবী এখনো জানে না আমি কাকে বিয়ে করেছি,তারজন্যই সে আন্দাজে ঢিল ছুড়ছে,যাতে জানতে পারে আমি কাকে বিয়ে করেছি,মিলিয়ে নিও আমার কথা।
এবার বলো,কোন সাহসে তুমি গতরাতে এতোগুলা ছেলের সামনে নেচেছো?”

চন্দ্র বিশ্বাস করতে চায় না নিষাদের কথা,ভিতরের অভিমান কিছুতেই কমছে না।নিষাদের এই প্রশ্ন যেনো আগুনে ঘি ঢেলে দিলো,তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে চন্দ্র,চোখ-মুখ শক্ত করে বলে,”আপনার সমস্যা কি তাতে,আমি কার সাথে কথা বলবো,না বলবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার,তার কৈফিয়ত কি আমি আপনাকে দিবো?
আমার বোনের হলুদে আমি নাচবো,গাইবো,কার কি তাতে?আপনার তাতে গা জ্বলে কেনো?
অধিকার দেখাতে আসছেন না-কি?
স্বামীর অধিকার? এভাবে আমাকে শাসন করে অধিকার ফলাতে চান আমার উপর,না-কি গায়ে হাত তুলে??”

চন্দ্রর এরকম রেগে যাওয়া দেখে নিষাদ ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায় চন্দ্রর দিকে,একদমে এতো কথা বলে চন্দ্র হাঁফাতে লাগলো।
চন্দ্রর শেষের কথাগুলো নিষাদের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়,দুজনের মধ্যকার যে সামান্য দূরত্ব ছিলো,নিষাদ এগিয়ে গিয়ে সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়,আচমকা হামলে পড়ে চন্দ্রর ঠোঁটের উপর।
মুহূর্তের আক্রমণে চন্দ্র হতভম্ব হয়ে যায়,তারপর নিষাদকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে,চিৎকার করতে চায়,নিষাদ তার ঠোঁট দিয়ে এমনভাবে ধরেছে চন্দ্রর চিৎকারের শব্দ বাহিরে আসে না।
মাথায় ধরে উঠা আগুন না নেভা পর্যন্ত নিষাদ চন্দ্রর ঠোঁট ছাড়ে না।

তারপর ছেড়ে দিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,”আদরেই যদি বউ’কে পোষ মানানো যায় তবে কেনো বৃথা গায়ে হাত তুলতে যাবো বলো?আমি আদরে বিশ্বাসী,মারামারি তে না।
আমার অপছন্দের কাজ আবার করতে দেখেছি,এই শাস্তি আবার পাবে,কে বলতে পারে শাস্তির ধরনও হয়তো আরো পালটে যাবে।আর যেনো নিষেধ করতে না হয় তুরাগের কথা।চোখ মুছে ভাবীর কাছে যাও”

কথা শেষ করে নিষাদ আর এক মুহূর্ত ও দাঁড়ায় না সেখানে।চন্দ্র বজ্রাহত ব্যক্তির মতো থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।কিছুক্ষণ আগে কি হলো এখনো চন্দ্রর মাথায় ধরছে না।চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

মাইনুল ইসলাম চন্দ্রর রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন,ভেজানো দরজা খুলে প্রবেশ করতে গিয়ে তার মনে পড়লো,মেয়েরা বড় হয়েছে।
বুকের ভিতরের কষ্ট টা যেনো বহুগুণ বেড়ে গেলো।

চন্দ্রর দরজায় নক করলেন।সম্বিৎ ফিরে পেতেই চন্দ্র চোখ মুছে দরজা খুলে দিলো।বাবা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেমন হকচকিয়ে গেলো চন্দ্র।
বুকের ভিতর ১০ নাম্বার বিপদ সংকেত বেজে উঠে। বাবা কি দেখে ফেলেছে?

চন্দ্র কে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন,”একটু রাত্রি কে ডেকে আনবি এখানে?”

বাবার এরকম নরম গলা চন্দ্র কোনোদিন শুনে নি,বাবা কে এতো ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেনো?
কেমন টেনে টেনে কথা বলছে যেনো অনেক কষ্ট হচ্ছে।চন্দ্র আর দেরি করে না,দৌড়ে যায় রাত্রির কাছে।

রাত্রিকে বাবার কথা বলতেই রাত্রি ছুটে আসে,আমির ছাদের দিকে যাচ্ছিলো,২ বোনকে এভাবে ছুটতে দেখে আমির ভয় পেয়ে যায়।পিছন পিছন সেও যায় দেখতে কি হয়েছে।

চন্দ্রর রুমের সামনে গিয়ে ভিতরে উঁকি দিতেই দেখতে পায় হৃদয়বিদারক দৃশ্য।
মাইনুল ইসলাম ২ মেয়েকে বুকের দুইপাশে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে,বহু দিনের জমে থাকা কষ্ট যেনো কান্না হয়ে ঝরে যাচ্ছে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমির চোখ মুছে,মাইনুল ইসলাম দেখতে পেয়ে ছেলেকে ইশারায় ডাকেন।
আমির ও ছুটে যায়,কাঁদতে থাকে বোনদের জড়িয়ে ধরে।

আমির নিজেও বুঝতে পারে না কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে আজ তার।

চলবে…???