নিঃশ্বাসে তুই পর্ব-১০+১১

0
290

#নিঃশ্বাসে_তুই (১০)
—————————-
বিশালাকৃতির অত্যাধিক সৌন্দর্যপূর্ণ ছাদটির মাঝ বরাবর ফুলে ফুলে সজ্জিত দোলনায় চুপটি করে বসে আছে অহমি। তার থেকে কিঞ্চিৎ দূরত্বে অবস্থিত টি টেবিলের সম্মুখে দাড়িয়ে ধ্রুব বেশ মনোযোগ সহকারে ক্যান্ডেল জ্বালাচ্ছে। সবকিছু পরিপূর্ণ ভাবে গোছানো হয়ে গেলে ধ্রুব এগিয়ে আসে অহমির দিকে। শীতল কন্ঠে বলে,

“চলো ওখানটায়।”

অহমি এক পল তাকায় ধ্রুবর দিকে। দোলনা থেকে উঠে দাড়ায়। অহমিকে উঠতে দেখে ধ্রুব মনে মনে স্বস্তি পায়। কারণ এ পর্যন্ত যতগুলো কথা সে অহমিকে বলেছে দেখা যায় প্রত্যেকটি কথায় অহমি শুরুতে বাঁধ সেধেছে। পরবর্তীতে ধমকে রাজি করাতে হয়েছে। এবারে বিনাবাক্যে উঠে পড়ায় বেশ খুশি হয় ধ্রুব। কিন্তু তার এই খুশি বেশিক্ষণ টিকে না। কারণ অহমি উঠে দাড়িয়েই বলে,

“আমি বাড়ি যাব। অলরেডি সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। বাড়িতে চিন্তা করছে সবাই।”

ধ্রুব দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। ভাবল কী আর হলো টা কী। সে ট্রাউজারের পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে একটা কল করল। নিন্ম কন্ঠে কিছু একটা বলে ফোনটা অহমির কানে ধরল। অহমি শুনতে পেল অর্পার কন্ঠ। অর্পা তাকে ভরসার ইঙ্গিত দিয়ে বলছে,

“চিন্তা করিস না। ধ্রুব তোকে সময় মতো পৌঁছে দিয়ে যাবে। আর মাকে আমি ম্যানেজ করে নিব।”

অহমি কিছু বলতে নেয় কিন্তু তার আগেই ধ্রুব ফোন সরিয়ে ফেলে। অর্পাকে ‘বায়’ বলে কল কেটে দেয়। ফোন পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে,

“এবার কী আসা যায়, ম্যাডাম?”

অহমি চমকে ওঠে। ‘ম্যাডাম’ কী অদ্ভুত সম্মোধন। বুকের মধ্যে শিহরণ বয়ে গেল যেন। লোকটির ঠান্ডা মাথায় বলা ছোট্ট ছোট্ট বুলি গুলো যে কতটা প্রলয়ঙ্কারী তা কেবল অহমিই ভালো জানে। অথচ দেখো এই ‘অদ্ভুত মানব’ দিব্যি স্বাভাবিক। অহমির ছোট্ট হৃদয়ে কা’ল বৈ’শা’খীর ঝড় তুলে দিয়ে সে থাকে দমকা হাওয়ার বেগের মতো মহা সুখে।

ধীর পায়ে এগিয়ে যায় অহমি ধ্রুব’র পেছন পেছন। টি টেবিলের দুই পার্শ্বে দুটো চেয়ার পাতানো। টেবিলের ওপর নানারকম খাবারের এ্যারেঞ্জমেন্ট। চতুর্দিক মোমবাতির আলোয় আচ্ছাদিত। ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে বসেছে তারা।

ধ্রুব একটি চেয়ার টেনে অহমিকে বসতে ইশারা করে। অহমি চুপটি করে বসে পড়ে। ধ্রুব মুচকি হেসে অপর চেয়ারটাতে গিয়ে নিজে বসে পড়ে। আলো আধারির এ রাতে তার শব্দহীন হাসি রয়ে যায় আড়ালে। ধ্রুব প্লেটে খাবার বেড়ে অহমির দিকে এগিয়ে দেয়। নিজের জন্যও বেড়ে নেয়। অহমিকে খেতে ইশারা করে। তীব্র অস্বস্তি জেঁকে ধরেছে অহমিকে। এভাবে কী খাওয়া যায়? সামনে সুস্বাদু খাবার। খাবারের ঘ্রাণে মুখরিত চতুর্দিক। পরিবেশ টাও অত্যন্ত চমৎকার। কিন্তু অহমির খাওয়ার ইচ্ছে নেই। কী করে খাবে সে। সামনে এমন ‘অদ্ভুত মানব’ বসে থাকলে গলা দিয়ে খাবার নামে নাকি? এমন মানব সামনে থাকলে তো পুরো শরীর অকেজো হয়ে যায় সেখানে খাবার কী করে খাওয়া যায়?

ধ্রুব অহমিকে বসে থাকতে দেখে বিরক্তবোধ করে কিন্তু মুখে প্রকাশ করে না। এই সুন্দর মুহুর্তটা কোনো রকম রিয়াকশন করে নষ্ট করার ইচ্ছে তার নেই। তার ভীষণ ইচ্ছে জাগে নিজ হাতে অহমির মুখে খাবার তুলে দিতে। কিন্তু এখনই তা সম্ভব নয়। একসঙ্গে এত ঝটকা এই সহজ সরল আদুরে বেড়াল ছানার মতো মেয়েটা সহ্য করতে পারবে না। এমনিতেই তার সামনে এলে সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে। লোকে বলে, ‘সবুরে মেওয়া ফলে।’ তাই যদি হয় তবে ধ্রুবও না হয় অপেক্ষা করবে আরও কিছু প্রহর। ধীরে ধীরে অর্জন করে নিবে তার ‘প্রিয় কিশোরীর’ মন। তাড়াহুড়ো করে তীরে এসে তরী ডুবুক এমনটা সে চায় না। যত্নে পাওয়া আদুরে বেড়াল ছানাটাকে অতী যত্নেই এই বুকের মাঝে বেঁধে রাখতে চায় সে অনন্তকাল।

নিজের খাবারে চামচ চালাতে চালাতে কিঞ্চিৎ গুমোট কন্ঠে সে অহমির উদ্দেশ্যে বলল,

“খাওয়া – দাওয়া শেষ করতে যত লেট হবে কারো বাড়ি পৌঁছনোর টাইম তত পিছিয়ে যাবে।”

দেখা যায় ধ্রুবর কথা শেষ করতে দেরি তো অহমির খাওয়া শুরু করতে দেরি হয় না। তড়িঘড়ি করে খেতে থাকে সে। মনে হচ্ছে খাবার পালিয়ে যাচ্ছে। আসলে তো তার মন পালাতে চাইছে ধ্রুবর চক্ষু সামনে থেকে। তা যেকোনো উপায়ে। ধ্রুব বক্রহাসিতে নিমজ্জিত হলো। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল কীভাবে বাকিয়ে কার্য হাসিল করতে হয় তা ধ্রুব চৌধুরীর নখদর্পনে।

অহমির খাওয়ার গতি দেখে বেশ হাসি পেল ধ্রুবর। মেয়েটা তার থেকে পালাতে কতই না ব্যস্ত। কিন্তু এই মেয়েটাই একদিন তার জন্য পাগল হবে। তাকে চোখে হারাবে সর্বক্ষণ। এক নজর দেখার জন্য ছটফট করবে। তার পাশে পাশে থাকতে চাইবে। তাকে ছাড়া যেন তার চলবেই না। যেমন টা এখন তার মনের মধ্যে চলছে। কবে সেই ক্ষণ আসবে সেই অপেক্ষায় আছে ধ্রুব।

ধ্রুব অহমিকে পলক পলক দেখছে আর খাচ্ছে। সহসা রসিকতার ছলে সে বলে বসে,

“ধীরে খাও। খাবার তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না।”

অহমির হুঁশ ফিরে। এতক্ষণ কী করছিল ভেবেই লজ্জা পায়। কিন্তু তা প্রকাশ করলে চলবে না। লোকটা তবে তাকে দ্বিগুণ লজ্জায় ফেলবে। অহমি চোখ গরম করে তাকায় ধ্রুবর দিকে। অতঃপর স্বাভাবিক ভাবে খেতে থাকে। ধ্রুব অহমির চোখ গরম করাটা বেশ উপভোগ করে। তার বক্ষপিঞ্জরে গিয়ে আঘাত হানে সেই দৃষ্টি। মনে মনে ভাবে,

“বাহ মেয়েটা রাগতেও জানে। ইন্টারেস্টিং!”

.

শুনশান নীরবতা বিরাজমান পুরো রাজপথে। রাত এগারোটার কাছাকাছি। এমন নিরবতা থাকাটা স্বাভাবিক।
পথঘাট ল্যাম্পপোস্টের লাল-নীল-হলুদ বাতির আলোয় আলোকিত। সেই পথ ধরে গাড়ি করে এগিয়ে চলেছে দুজন মানব-মানবী। রাত যত বাড়ছে শীতের প্রকোপ তত বাড়ছে। অহমির গায়ে কেবল একটা পাতলা চাদর। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে বলে হয়তো শীতের কোনো পোশাক পড়ে আসেনি। ধ্রুব খেয়াল করল গাড়ির জানালা দিয়ে আসা হিমশীতল প্রবাহে অহমি মৃদু কাঁপছে। দেরি না করে ধ্রুব এক হাতে স্টিয়ার ধরে অন্য হাতে তার গায়ের জ্যাকেট খুলে অহমির সামনে ধরল। আদেশের সুরে বলল,

“এটা পড়ে নাও। ঠান্ডা কম লাগবে।”

অহমি ইতস্তত কন্ঠে বলল, “আমি ঠিক আছি। প্রয়োজন নেই এটা।”

ধ্রুব সামনে তাকিয়েই বলল,

“এমন নির্জন রাস্তায় কোনো মেয়েকে ফেলে রেখে গেলে নিশ্চিত আগামীকাল সকালে ব্রেকিং নিউজ হবে,বখাটে ছেলেপেলে দ্বারা ধ’র্ষি’ত হয়ে সুন্দরী কিশোরীর মৃ’ত্যু।”

অহমি চট করে ধ্রুব’র হাত থেকে জ্যাকেটটা টেনে নেয়। গায়ে জড়াতে জড়াতে মনে মনে বলে, ‘অসভ্য।’

ধ্রুব ঠোঁট কামড়ে হাসে।

.

বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই অহমি তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়তে চায়। কিন্তু থেমে যায় ধ্রুবর কন্ঠ শুনে। ধ্রুব অহমির অনেকটা কাছে ঝুঁকে আসে। দুজনের মধ্যে দূরত্ব কিঞ্চিৎ। অহমি পেছনে ঠেকে বসে। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে। ধ্রুব মৃদু কন্ঠে ধীরে ধীরে বলে,

“তোমার সকল আবদার, শখ, ইচ্ছে আমার হোক। তা পূরণ একার একমাত্র দায় আমার হোক। অন্য কোনো ভাগিদার সেখানে না থাকুক।”

ধ্রুব চট করে সরে যায়। নিজের জায়গায় সোজা হয়ে বসে। অহমি একটা ডোক গিলে। ধীর গতিতে নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। এক পা, দু পা করে এগোতে থাকে। পায়ের চলন যেন অসাড় হয়ে আসছে তার। ধ্রুব’র জ্যাকেট যে তার গায়ে জড়ানো সে কথা একেবারে ভুলেই যায়। ধ্রুবকে কিছু না বলেই বাড়ির ভেতরে চলে যেতে নেয়। তখনই পেছন থেকে ভেসে আসে ধ্রুবর প্রগাঢ় কন্ঠ,

“জ্যাকেট টা কী এতটাই পছন্দ হয়েছে?”

অহমি থমকে দাড়ায়। নিজের শরীরের দিকে তাকায়। লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে তার। উত্তেজনায় কী সব কান্ড যে ঘটিয়ে বসছে আজ। আর এই লোকটাও হয়েছে তেমন তাকে লজ্জায় ফেলার একটা উপায়ও মিস দিচ্ছে না। পেছন থেকে ধ্রুব পুনরায় বলে ওঠে,

“খুব বেশি পছন্দ হলে রেখে দাও। থাকল না হয় আমার দু-একটা স্মৃতি তোমার কাছে।”

অহমি ফুঁসে উঠল। পেছন ঘুরে এগিয়ে আসে। গাড়ির জানালা থেকে হাত বাড়িয়ে জ্যাকেটটা ছুঁড়ে মা’রে ধ্রুব’র গায়ে। তেঁতে উঠে বলে,

“আমার অন্যের জিনিস নিজের কাছে রাখাটা প্রচন্ড অপছন্দনীয়।”

কথা শেষ করেই অহমি দৌড়ে চলে যায় ভেতরে। একটি বারের জন্যও পেছন ফিরে তাকায় না। অহমি চলে যাওয়া অব্দি ধ্রুব তাকিয়ে থাকে। অহমি চলে যেতেই সে জ্যাকেটটা হাতে নেয়। গায়ে জড়াতে গিয়েও থেমে যায়। বুকের মধ্যে চেপে ধরে। জ্যাকেট থেকে অহমির গায়ের পারফিউমের স্মেল আসছে। মুখের মধ্যে চেপে ধরে দীর্ঘক্ষণ সেই স্মেল নেয়। অতঃপর কোলের ওপর রেখে গাড়ি স্টার্ট দেয়। তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। ইদানীং তার বড্ড বেশি হাসি পায়। যখন তখন হাসি পায়। কারণে অকারণে হাসি পায়।

.

কলিং বেল বাজাতেই অর্পা এসে দরজা খুলে দেয়। বাকি সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। অহমি কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে যায়। অর্পাও কিছু জিজ্ঞেস করে না।

অহমি ঘরে গিয়ে ফোন চেক করে দেখে পুষ্পর অনেক গুলো ফোন এসেছে। ফোন সাইলেন্ট থাকায় কল ধরতে পারে নি সে। মেয়ে টা নিশ্চয়ই অনেক চিন্তা করেছে তার জন্য। নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার এখন। কী করে পারল পুষ্পকে ভুলে যেতে। সে তো জানত পুষ্প ফোন করবেই। অযথা মেয়েটাকে কতটা চিন্তায় রাখল। তড়িঘড়ি করে পুষ্পর ফোনে কল দিতে যায় অহমি। কল দিতে গিয়েও পুনরায় থেমে যায়। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, ‘কী এক্সকিউজ দেবে সে পুষ্পকে? পুষ্প তো অনেক কিছু জানতে চাইবে? কী বলবে তখন সে? পুষ্পর কাছে মিথ্যে বলতে সে পারবে না বললেও পুষ্প ঠিক বুঝে ফেলবে। আর সত্যি টাও বলতে পারবে না। তাহলে উপায়?’

অনেক ভেবে পুষ্পর নম্বরে ছোট্ট করে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিল। তাতে লেখা, ‘মাথা ব্যথা করছিল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুই ঘুমিয়ে পড় সকালে কথা হবে।’

পরিস্থিতি মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। যে প্রাণপ্রিয় বান্ধবী ছাড়া তার জীবনের একটি মুহূর্ত চলে না আজ জীবনের বিশেষ কিছু মুহূর্ত তার কাছে উপস্থাপন করতেই কুন্ঠাবোধ করতে হচ্ছে। ইতস্তততা ঘিরে ধরছে। মাথা চেপে ধরে ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় অহমি। চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয়। বড্ড ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে আসছে।

.

ম্যাসেজের টুংটাং শব্দে কেঁপে ওঠে পুষ্প। সেই সন্ধ্যা থেকে চিন্তায় – চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে সে। অর্পার কাছে ফোন করে কিছু জিজ্ঞেস করবে সেই সুযোগও পায়নি। ভেবেছে ধ্রুবর কথা অর্পাকে জানালে সমস্যা হতে পারে। দৌড়ে ফোনের কাছে ছুটে যায় সে। ম্যাসেজ সিন করে বড়সড় ধাক্কা খায়। এতক্ষণের চিন্তা আরও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। অহমি তাকে ইগনোর করছে কিন্তু কেন? নিশ্চয়ই এর পেছনে বড় কোনো রহস্য আছে। কাল সকালেই ও বাড়িতে যাবে সে। আসল রহস্য উদঘাটন করতে।

.
চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ

#নিঃশ্বাসে_তুই (১১)
—————————-
“সকাল হতে না হতেই কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

সাবিনা বেগমের কড়া গলার শক্ত বাণীতে পা থেমে গেল পুষ্প’র। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সাবিনা বেগম তাকে নিজ মুখে বাহিরে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করছে। বিষয়টা সত্যিই পুষ্প’র কাছে অবিশ্বাস্য। যে মা তার ভালো মন্দ দেখা শোনা তো দূর ঠিকমতো কথা পর্যন্ত বলে না। বাড়িতে যেটুকু সময় থাকে খাটিয়ে মা’রে যাতে করে পুষ্প বাড়িতে বেশি সময় না থাকে। আজ তার মুখ থেকে এমন কথা ঠিক মেনে নিতে পারছে না সে। পুষ্প অবাক দৃষ্টিতে সাবিনা বেগমের দৃষ্টিতে দৃষ্টি ফেলে বলল,

“অহমিদের বাড়িতে যাচ্ছি। একটু দরকার আছে।”

সাবিনা বেগম সেভাবেই শক্ত কন্ঠে বললেন,

“এখন থেকে তোমার বাহিরে চলাচল সীমিত করতে হবে। প্রয়োজন ব্যতিত বাড়ির বাহিরে পা রাখবে না।”

পুষ্প ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কেন?”

সাবিনা বেগমের কাটছাট জবাব, “আমি বলেছি তাই। যাও এখনই নিজের ঘরে যাও। আর হ্যাঁ, এখন থেকে নিজেকে একটু পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখবে। মনে থাকে যেন।”

সাবিনা বেগম গটগট পায়ে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। পুষ্প কিছু জিজ্ঞেস করবে সে সুযোগ টুকু দিলেন না। পুষ্প দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে গেল। সাবিনা বেগম যখন একবার নিষেধ করেছে তারমানে এখন তার কথার অবাধ্য হলে ভ’য়ং’ক’র কান্ড হবে।

.

ব্রেকফাস্ট টেবিলে বিভোরকে দেখা গেল ভীষণ ব্যস্ত। বেশ তাড়াহুড়োয় খাচ্ছে। অহমি কৌতুহল দমাতে না পেরে বলে বসল,

“ভাইয়া তুমি কী খুব বিজি?”

বিভোর খাবার মুখেই জবাব দিল, “হুম একটু।”

“কেন?”

“একটু কাজ আছে।”

বিভোর যখন কথাটার উত্তর ঘুরিয়ে দিল অহমি তখন বুঝে নিল বিভোর হয়তো বলতে চাইছে না। তাই সেও আর কোনো প্রশ্ন করল না। চুপচাপ খেতে লাগল। খাওয়া শেষে বিভোর তাহমিনা বেগমকে ডেকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে দোয়া চাইল। তাহমিনা বেগম ছেলের কপালে চুমু খেয়ে দোয়া করে দিলেন। বিভোর অর্পা – অহমিকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। অহমি তখন বিভোরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাহমিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“কী হলো এটা! কিছু স্পেশাল আছে নাকি?”

তাহমিনা বেগম হেসে জবাব দিলেন, “সময় হলে জানতে পারবে। এখন আপাততঃ ভাইয়ের জন্য দোয়া চাও আল্লাহর কাছে।”

অহমি বোকার মতো চেয়ে রইল কিছুই বোধগম্য হলো না। অর্পা বরাবরের মতো খাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেল। তার দ্বারা বেশি প্যাচাল সম্ভব নয়।

.

ফোন হাতে ঘরের সর্বত্র পায়চারি করছে অহমি। বারকয়েক চেষ্টা চালিয়েও পুষ্পকে ফোন করতে ব্যর্থ হচ্ছে সে। কীভাবে কী শুরু করবে বুঝতে পারছে না। অকস্মাৎ ফোনের রিংটোনে কেঁপে উঠল সে। স্ক্রিনে দৃষ্টি ফেলতেই ভেসে উঠল এক আননোন নম্বর। অহমি ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এই নম্বরটা আবার কার? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেল। অহমি বোকার মতো চেয়েই রইল। কয়েক সেকেন্ড পর পুনরায় ফোন বেজে উঠল। এবার অহমি তাড়াতাড়ি করে কল রিসিভ করল। শুরুতে সে মৌন থেকে বোঝার চেষ্টা করল কে ফোন করেছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না। কারণ অপর পার্শের ব্যক্তিটিও নিশ্চুপ। অবশেষে গলা ঝেড়ে নিয়ে প্রশ্ন করল অহমি,

“হ্যালো! কে বলছেন?”

পর মুহুর্তেই ওপাশ থেকে দাবানলের ন্যায় জ্বলে উঠল সেই অপরিচিত মানব। ভেসে এলো চেনা- পরিচিত, রাশভারি, পুরুষালী কন্ঠস্বর,

“এতক্ষণ কী মুখে কুলুপ এঁটে ছিলে?”

অহমির হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। কান থেকে ফোন নামিয়ে একবার চোখের সামনে এনে দেখে নিয়ে পুনরায় কানে ধরল। বারকয়েক শুকনো ঢোক গিলল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে এটা ধ্রুব। কিন্তু ধ্রুব কী করে ওর নম্বর পেল? লোকটার কথার ধরণ আর গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠ শুনলে যে কেউ তাকে চিনে ফেলতে সক্ষম হবে। হোক তা সরাসরি বা ফোনে। অহমিও চিনে ফেলল। তাই তো এখন তার উত্তর দিতে কষ্ট হচ্ছে। কথা গুলো কণ্ঠনালীতে গিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে ফের পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। ওদিকে ধ্রুব ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে ভীষণ বিরক্ত হয়। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত কন্ঠে ধমকে ওঠে,

“হেই ইডিয়ট গার্ল, কথা কানে যায় না তোমার? নাকি বোবা হয়ে গেছ? ঝটপট মুখ খোলো।”

অহমি আরেকটি ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে,

“অ্যাহহ হ্যাঁ হ্যাঁ। জ্বি আসসালামু আলাইকুম।”

“এতক্ষণ পরে হুঁশ ফিরল। ওয়ালাইকুম আসসালাম। আচ্ছা শোনো বিকেলে কোচিং আছে তো?”

“জ্বী আছে।”

“আজকে যেতে হবে না। বিকেলে তৈরি হয়ে থেকো ড্রাইভার যাবে। চুপচাপ ড্রাইভারের সঙ্গে চলে আসবে। পুষ্পকেও বলে দিও।”

“কো..কোথায় যাব?”

“সেটা তোমার না জানলেও চলবে। এখন যা বলছি মাথায় রেখ। ঠিক বিকেল চারটায় নিচে নেমে আসবে। মাইন্ড ইট।”

অহমি আরও কিছু বলতে চাইল কিন্তু তার আগেই কল কেটে গেল। অহমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পুষ্পকে কল করল। সঙ্গে সঙ্গেই কল রিসিভ হলো। অহমি আমতা আমতা করে বলল,

“পুসি আজকে বিকেলে কোচিং যেতে হবে না। বিকেলে তৈরি হয়ে থাকিস অন্য কোথাও যেতে হবে।”

“অন্য কোথাও মানে?”

“জানি না রে! ধ্রুব চৌধুরীর অর্ডার। লোকটা যে কী চাইছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আর না পারছি কিছু বলতে। কিছু বললেই মেঝ আপি আমাকে বকে। কী অদ্ভুত বল?”

“ধ্রুব ভাই বলেছে। আচ্ছা আমি চলে আসব। কিন্তু আসলেই এই ধ্রুব ভাই মানুষটা বড্ড অদ্ভুত। কেমন যেন রহস্যময়। তার সব কিছুতেই আমি একটা চাপা রহস্যের গন্ধ পাই। যাই হোক, এখন তুই বল কাল থেকে তোর হয়েছে টা কী? উহুম, আমি কিন্তু কোনো বাহানা শুনব না অমু। সত্যি সত্যি বলবি।”

অহমি জিহ্বায় কামড়ে ধরে বলল,

“আসলে দোস্ত হয়েছে কী। এভাবে বলতে পারছি না। সামনাসামনি বলি?”

“ওকে তবে তাই বলিস। আর জানিস আমাদের বাড়িতেও না অদ্ভুত সব কান্ড ঘটছে।”

“তাই বুঝি। তা কী ঘটছে শুনি?”

“এভাবে নয় আমিও দেখা হলে বলব।”

“ওকে। বায়।”

“বায়।”

.

কোচিং এ সকলে অধির আগ্রহ নিয়ে বসে ছিল পুষ্প, অহমির জন্য। কিন্তু সকলের আসায় জল ঢেলে দিয়ে ওরা আজ কোচিং এলোই না। অলরেডি ক্লাসে স্যার আসার সময় হয়ে গেছে। তখনই লামিয়া বলল,

“ওরা বোধহয় আজ আসবে না।”

লামিয়ার কথার প্রতিত্তোরে ফাহিম বলল,

“হুম আমারও তাই মনে হয়।”

রাফি বলল,”তাহলে উপায়? আরও একদিন অপেক্ষা করে থাকতে হবে?ওরা তো ফোনও তুলছে না।”

প্রিয়া ভাবুক দৃষ্টিতে বলল,”আমার কী মনে হয় জানিস ওই লোকটার সঙ্গে নিশ্চয়ই কোনো চক্কর আছে ওদের।”

ফাহিম বাঁধ সেধে বলল,”আরে কী বলিস। জানিস উনি কে? শুধু শুধু এসব বলছিস। আমার মনে হয় অন্য কোনো ব্যাপার আছে।”

লামিয়া বলে উঠল,”আচ্ছা ওই লোকটাকে তোরা কী করে চিনিস?”

“আরেহ ধ্রুব চৌধুরীকে কে না চেনে। উনি তো…… ”

ফাহিম কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই ক্লাসে স্যার চলে এলো। ছেলেরা মেয়েরা দ্রুত ক্লাসে মনোযোগী হলো।

.
চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ