নিভৃতে যতনে পর্ব-১১

0
1012

#নিভৃতে_যতনে
#Part_11
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— হোয়াট ইজ অল দিস সিয়াশা?

কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি ভড়কে যাই। অস্ফুট দৃষ্টিতে রোয়েনের দিকে তাকাই। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ দেখে আমি আমতা আমতা সুরে বলি,

— মানে কি?

রোয়েন আমার কোলে একটা কাগজ ছুঁড়ে মেরে বলে,

— এইটা কি?

আমি রোয়েনের দিকে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কাগজটা হাতে নেই। ভাঁজ খুলেই বুঝতে পারি যে এইটা আসলে আমার একাউন্টিং এক্সামের খাতা। খাতার বা দিকটায় মোটা লাল কালি দিয়ে ২০/৬০ লিখাটা যেন জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠেছে। প্রেপারেশন ভালো ছিল না বিধায় এই রেজাল্ট। আমি খাতাটা দেখার পর কিঞ্চিৎ রোয়েনের দিকে তাকাই। ঠোঁটের কোনে সুরু এক হাসির রেখা ফুটানোর বৃথা চেষ্টা করে অস্ফুট স্বরে বলি,

— একাউন্টিং এর খাতা।

রোয়েন এইবার রুদ্ধদ্বার কন্ঠে বলে উঠে,

— কত পেয়েছ একবার দেখেছ? ষাটের মধ্যে মাত্র বিশ। এইটা কোন নাম্বার হলো? এই নাম্বার নিয়ে তুমি পাবলিক ভার্সিটিতে এক্সাম দিবে? লাইক সিরিয়াসলি?

আমি থমথম গলায় বলি,

— ইয়ে মানে..

উনি তার অগ্নি দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে বলেন,

— ডু ইউ ইভেন নো? পাবলিক ভার্সিটির এভারেজ নাম্বারও কত? জাস্ট এক নাম্বারের জন্য মানুষ শত জনের পিছে পড়ে যায়, চান্স পায় না। আর তুমি তো এখনো কোটি মাইল দূরে।

আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— তো কি করবো?

আমার এই কথায় যেন রোয়েন আরও রেগে যায়। সে রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠে,

— কি করবে মানে কি? ইউ হ্যাভ টু ওয়ার্ক মোর হার্ড। কোচিং এর সব এক্সামে এভারেজে হলেও ষাটের মধ্যে পঞ্চান্ন উঠাতে হবে।

কথাটা শুনার সাথে সাথে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি গোলগোল চোখে তাকিয়ে রই। এই ব্যাটা কি পাগল? ষাটের মধ্যে পঞ্চান্ন? কেমনে কি ভাই? ওভার ডেট কিছু খেয়ে কথা বলছে নাকি? আমি অস্ফুটে সুরে বলে উঠি,

— ষাটের মধ্যে মানুষ পঞ্চান্ন কিভাবে পায়? হাও? আমি জীবনেও পারবো না।

— তুমি পারবে মানে সাথে তোমার ঘাড়ও পারবে। আর যদি তা না পেরেছ তোমার খাওয়া-দাওয়া সব অফ।

রোয়েনের কথা শুনার সাথে সাথে আমার ঠোঁট যুগলের মাঝে কিঞ্চিৎ দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। আমি অস্ফুটে স্বরে বলে উঠি,

— এইটা তো শিশু নির্যাতন।

কথাটা শুনে রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— এইখানে শিশু কে?

আমি কিঞ্চিৎ বলে উঠি,

— কেন আমি!

কথা বলে আমি নিজেই ব্যাক্কল বনে গেলাম। বোকা চোখে তাকিয়ে রইলাম রোয়েনের দিকে। আমি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে উঠে। এই প্রথম আমি রোয়েনকে হাসতে দেখছি। এর আগে কখনো তাকে হাসতে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না আমার। হাসার ফলে তার দুই ধারে থাকা গেজ দাঁত ফুটে উঠেছে। গেজ দাঁত দুইটি একদম ভ্যাম্পায়ারের দাঁতের মত। উঁচু, ধারালো আর সুক্ষ্ম। হাসিরটার প্রাণ হিসাবে যেন সেই গেজ দাঁত গুলো পালন করছে। কথাটা না বললেই নয়, তাকে হাসলে কিন্তু মারাত্মক লাগে।
আমি স্নিগ্ধ চোখে তার হাসির দিকে তাকিয়ে আছি। সে হেসেই আমাকে বলে,

— তুমি শিশু? লাইক সিরিয়াসলি? তা শিশুদের বুঝি বিয়ে হয়?

উনার কথা শুনে আমি ভড়কে যাই। আমতা আমতা করে বলি,

— ইয়ে মানে.. শিশুর জায়গায় নারী হবে। আর এইভাবেও শিশু হোক আর নারী হোক নির্যাতন তো নির্যাতন এই৷ হুহ!

রোয়েন হালকা হেসে বলে,

— তা নির্যাতনটা তকমাটা যখন লেগেই গিয়েছে তাহলে সেটার সৎ ব্যবহার করা যাক কি বলো?

আমি পুনরায় ভড়কে গিয়ে বলি,

— মানে?

উনি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পকেটে নিজের দুই হাত গুঁজে বলে,

— এখন থেকে আমি তোমায় পড়াবো প্লাস তুমি পড়া না পারলে শাস্তিও দিব।

কথাটা শুনে আমার ঠোঁট যুগল আপন শক্তিতে নিজের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে নেয়। অস্ফুট স্বরে বলে উঠি,

— অ্যাহ!

রোয়েন কিছু না বলে চুপচাপ নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়। আমি চটজলদি বলে উঠি,

— আপনি না সায়েন্সের স্টুডেন্ট? আমাকে কিভাবে পড়াবেন? আপনি তো কমার্সের পড়া জানেন এই না।

সে ভ্রু কুঁচকে বলে,

— কে বলেছে আমি সায়েন্সের স্টুডেন্ট?

আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— তো কমার্স নিয়ে পড়তে বলেছিল কে? সায়েন্স বা আর্টস নিয়ে পড়লে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?

— হ্যাঁ যেত।

আমি তীক্ষ্ণ গলায় বলি,

— আমি পড়বো না আপনার কাছে।

— লেটস সি৷

কথাটা বলেই তিনি রুম থেকে বেরিয়ে যান। আর নিজের কাপালে চাঁপড় মেরে বলি,

— এই ছিল তোর কপালে বুঝলি সিয়াশা। খাটাশ জামাই তো জামাই, এখন খাটাশ টিউটারও সে। হায় কপাল!

____________________________

রাত প্রায় আটটা ছুঁইছুঁই। আমি রুমের মধ্য ভাগে এক পায়ে কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আপ্রাণ চেষ্টা করছি নিজেকে ব্যালেন্স করার। কিন্তু তেমন ব্যালেন্স রাখতে পারছি না। রাখতে পারবো কিভাবে? জীবনে এইভাবে কানে ধরেছি নাকি? আজ জীবনে প্রথম এই খাটাশ ব্যাটাটার জন্য ধরতে হচ্ছে। তাও সাধারণ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি বলে। তাও প্রশ্ন কি ছিল? “স্বতন্ত্র অংশীদারী আইন পাশ হয় কত সালে?” আরেহ ভাই এর থেকে কত ইমপোর্টেন্ট ইমপোর্টেন্ট সাল আছে তাই মনে রাখা যায় না। সেখানে এইটা মনে রাখি কিভাবে? কিন্তু এই খাটাশকে তা কে বুঝায়? আমি রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে আর আমার বইয়ে কি যেন আঁকিবুঁকি করছে। তা দেখে আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠি,

— আর কতক্ষণ? পা ভেঙ্গে যাচ্ছে আমার৷

সে ভাবলেশহীন গলায় বলে উঠে,

— যতক্ষণ না তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ।

আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলি,

— জানি না তো। আর তার উপর এইটা এত ইমপোর্টেন্ট ও না যে মনে রাখতেই হবে।

আমার কথা শুনে সে কিঞ্চিৎ আমার দিকে চায়। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলে,

— ছোট ছোট ধূলিকণা থেকেই কিন্তু এক স্তুপ সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে টিলা এরপর ধীরে ধীরে পাহাড়। তাই কখনো ছোট খাটো জিনিস কে অবহেলা করতে নেই। তাদের কে কম ইমপোর্টেন্ট বুঝতে নেই। বুঝেছ?

আমি গাল ফুলিয়ে মাথায় দুলাই। কিন্তু মনে মনে ঠিকই তার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলি৷ সে মিনিট দুয়েক পর আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বলেন এবং তার হাতের বইটা আমার হাতে দিয়ে বলে,

— নাও এখন এইটা পড়ো আর আমি যে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম সেটার উত্তর ও খুঁজে বের করো। না পারলে এরপরের বার পানিসমেন্ট ডাবল হবে।

আমি কিছু না বলে চুপচাপ বইটা নিয়ে মন দিয়ে পড়া শুরু করে দেই৷ কেন না এতক্ষণে আমি তাকে চিনে গিয়েছি। শাস্তি যেহেতু ডাবল দিবে বলেছে তার মানে দিবেই আর আমাকে নাস্তানাবুদ করেই ছাড়বে। স্বাদে কি খাটাশ বলি? হুহ!

___________________________

দেখতেই দেখতে এক সপ্তাহ চলে গেল। রোয়েনের ছুটিও ফুরিয়ে আসলো। তিন-চারদিন হতে চললো সে পুনরায় অফিসে নিয়োজিত হয়েছে। সকালে আমাকে কোচিং এ নামিয়ে দিয়ে সে অফিসে চলে যায়। বাকি আসার সময় আমায় একাই আসতে হয়। একা আসতে হয় বললে ভুল হবে, আসার সময় আমি এক সঙ্গী পেয়েছি৷ নাম তার সুরাইয়া। আমার সাথেই পড়ে এবং আমাদের এলাকাতেই থাকে। আমি থাকি ধানমন্ডি ‘নাইন এ’ নাম্বার রোডে আর ও থাকে পনেরো নাম্বার রোডে। তাই যাতায়াতে তেমন আর সমস্যা হয় না।
প্রথম দিকে ভেবেছিলাম খাটাশটা অফিসে গেলে হয়তো বা আমাকে আর পড়াতে পারবে না। তার হাত থেকে নিস্তার পাবো। কিন্তু সে যে গুড়ের বালি। তার অফিস টাইম শেষ হয় ছয়টা। সাতটা কি সাড়ে সাতটায় সে বাসায় এসে হাজির। এরপর ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে রাত নয়টা শুরু হয় আমার ক্লাস। যা চলে রাত এগারোটা অব্দি। এরপর পরেরদিনের জন্য এক গাদা পড়া ঝুলিয়ে দেয় গলায়৷ সেই সাথে পড়া না পড়লে শাস্তি তো আছেই। মানে সে না থাকলে আমায় পড়তেই হয়। পড়া থেকে আর নিস্তার নেই আমার।

কিছু দিন আগেই ম্যানেজমেন্টের উপর ষাট মার্কের পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তারই রেজাল্ট দিয়েছে আজ। ষাটের মধ্যে তিপ্পান্ন পেয়েছি। সেই সাথে এই পরীক্ষায় হায়েস্ট নাম্বারও আমি এনেছি। ভাবা যায়? সবই হচ্ছে মিস্টার খাটাশ ব্যাটার কামাল। যে হাড় খাটুনি আমাকে দিয়ে করাচ্ছে এমন নাম্বার পাবো না তো কি পাবো? ইতিমধ্যে ক্লাসে বেশির ভাগ সকলেই আমাকে নিয়ে টুকিটাকি কথা বলতে ব্যস্ত। বিষয়টা বেশ ভালোই লাগছিল। টপার টপার ফিলিং আসছিল৷ হিহিহি!
ক্লাস শেষে আমি নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে আসতে নেই তখন সুরাইয়া এসে বলে,

— ট্রিট দে।

আমি ভ্রু কুঁচকে বলি,।

— কোন খুশিতে?

সুরাইয়া দাঁত কেলিয়ে বলে,

— বাহ রে! এত ভালো রেজাল্ট করেছিস ট্রিট দিবি না? ট্রিট না দেওয়া পর্যন্ত আজ তোকে ছাড়ছি না। হুহ!

আমি এক গাল হেসে বলি,

— আচ্ছা যা এক প্লেট ফুচকা খাওয়াবো নে।

সুরাইয়া হালকা হেসে বলে,

— ওকে ডান! বাট আগে বসুন্ধরা যাব একটু। আমার কিছু কিনার আছে।

— আচ্ছা। চল এইবার।

কথা শেষ হতেই দুইজনে বেরিয়ে পড়লাম বসুন্ধরার উদ্দেশ্যে।

#চলবে