নিভৃতে যতনে পর্ব-১৩

0
937

#নিভৃতে_যতনে
#Part_13
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

আকাশটা আজ ধূসর রাঙা। কালো ও ধূসর মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে উন্মুক্ত আকাশের বুকে। দক্ষিণ দিকে বইছে ঢেউ খেলানো বাতাস। বাতাসের মাঝেই ফুটে উঠেছে ধুলোবালির ঘূর্ণন রেখা। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাখিদের আতঙ্কিত কন্ঠ। সময়টা দুপুর হলেও বাইরে দেখে মনে হচ্ছে যেন গোধূলির লগ্ন ঘনিয়ে এসেছে। আমি দ্রুত বারান্দা থেকে কাপড় নিয়ে আসি অতঃপর বারান্দার থ্যাই গ্লাসটা লাগিয়ে দেই। বিছানা কাপড় রাখতে রাখতে দেখি ইতিমধ্যে হৃদিপু সকল জানালা বন্ধ করে ফেলেছে। আমি কাপড়গুলো বিছানার উপর রাখতে রাখতে হৃদিপুকে জিজ্ঞেস করি,

— পলি আন্টি কি চলে গিয়েছে?

হৃদিপু বিছানায় পা তুলে বসে বলে,

— হ্যাঁ মাত্র গেলো।

— সাথে ছাতা নিয়ে যেতে বলেছিলাম তাকে। নিয়েছিল কি?

— দেখলাম তো নিয়েছে।

আমি এক গাদা কাপড় হৃদিপুর কোলে ছুঁড়ে মেরে বলি,

— বসে আছো কেন? কাজ করো। কাজ ছাড়া কিন্তু এই ঘরে ভাত নাই।

হৃদিপু আমার মুখের উপর একটা জামা গোল করে ছুঁড়ে মেরে তীক্ষ্ণ গলায় বলে,

— ছোট বেলায় তোকে হাতে খায়িয়ে দিয়েছি এইদিন দেখার জন্য? আমার কষ্টের এই প্রতিদান দিলি তুই?

আমি ভ্রু কুঁচকে বলি,

— তো এর চেয়ে বেশি তুমি কি এক্সপেক্ট করো?

হৃদিপু আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উঠে আসে। তা দেখে আমি দ্রুত সরে যাই। হৃদিপু এইবার রুদ্ধ গলায় বলে,

— ইউ বেয়াদব মেয়ে! দাঁড়া বলছি। আজ তোর একদিন কি আমার চল্লিশ দিন৷

কথাটা বলেই হৃদিপু আমার দিকে তেড়ে আসতে নিলে আমি হৃদিপুকে জড়িয়ে ধরে বলি,

— ওলে ওলে আমার বইনাটা। কত রাগ করে।

হৃদিপু ফোঁসফোঁস করতে করতে বলে,

— ছাড় আমায়। ছাড়। হুহ! হুহ!

আমি হেসে বলি,

— ইশশ! ইশশ! কি রাগ। জ্বলে পুড়ে আইস্ক্রিম হয়ে গেলাম।

কথাটা বলেই ফিক করে হেসে দেই। আমার হাসি দেখে হৃদিপুও হেসে দেয়৷ অতঃপর সেও আমায় জড়িয়ে ধরে।

____________________

বাহিরে আজ ঝড় হচ্ছে। আষাঢ় মাসের ঝড়। চাপা এক হুংকার দিয়ে বাতাস বইছে। চারদিকে হিম শীতল এক ভাব। পরিবেশটা শীতল দেখে আমি আর হৃদিপু ঢুকে পড়লাম রান্নাঘরে। মূল উদ্দেশ্য ভুনা খিচুড়ি আর গরু মাংসের রেজালা রান্না করা। বৃষ্টি-বাদলের দিন আর বাঙ্গালীরা খিচুড়ি খাবে না?তা কি হয়! দুইজনে মিলে রান্না শেষ করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। রাতের খাবার খেতে এখনো দেরি তাই আমি মোবাইল নিয়ে খাটে বসলাম। এফবিতে লগইন করে নিউজফিড স্ক্রোল করতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর হৃদিপু আমার পাশে এসে জিজ্ঞেস করে,

— ভাইয়া কবে আসবে রে?

আমি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলি,

— পরশু আসবে মনে হয়৷ কেন?

— না এইভাবেই।

আমি আর কিছু না বলে চুপ করে রই। আজ দুইদিন হতে চললো রোয়েন বাসায় নেই৷ অফিসিয়াল কিছু কাজ পড়ায় তাকে ঢাকার বাহিরে যেতে হয়েছে। আমার যেহেতু এক্সাম সেহেতু আমাকে নেওয়া সম্ভব ছিল না। আবার আমাকে একবারে একা রেখেও সে যেতে পারছিল না। তাই তিনি সব দিক বিবেচনা করে হৃদিপুকে এইখানে থাকার জন্য বলেন। হৃদিপুও আমার সাথে থাকতে আপত্তি করে নি।
হঠাৎ হৃদিপু বলে উঠে,

— সিয়া তুই কিন্তু ঠিক মত পড়ছিস না। এডমিশন টেস্টের জন্য কিন্তু হাতে বেশি টাইম নেই। পরের সপ্তাহেই হয়তো ডেট পড়বে। এখন সিরিয়াস না হলে কিন্তু ঢাবিতে চান্স পাবি না।

আমি ভাবলেশহীন গলায় বলি,

— নাই বা পেলাম। সমস্যা কি?,

হৃদিপু বিষ্ময়কর ভরা কন্ঠে বলে উঠে,

— লাইক সিরিয়াসলি? তুই বলছিস এই কথা? তোর না স্বপ্ন ছিল ঢাবিতে পড়ার? ইচ্ছে না ছিল আমার ক্যাম্পাসকে নিজের বলার? আমার সাথে ঢাবির প্রাঙ্গনে উন্মুক্ত পাখির মত ঘুরে বেড়ানোর?

আমি হৃদিপুর দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,

— সেসব ইচ্ছে যে অনেক আগেই মৃত ঘষিত হয়েছে। আর মৃত জিনিস কখনো জীবন্ত হয় না। হোক সেটা মানুষ বা ইচ্ছে। ভুলে গেছি আমি আমার সকল ইচ্ছে। এখন আর কোন ইচ্ছে কাজ করে না আমার ভিতর। পড়ালেখাও এখন বিরক্ত লাগে৷

হৃদিপু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

— যা তো একটা কলম আর সাদা কাগজ নিয়ে আয়।

আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,

— কেন?

হৃদিপু একটু কঠোর সুরেই বলে,

— আনতে বলেছি আন। বেশি কথা কেন বলিস?

আমি আর কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে স্টাডি টেবিলের উপর থেকে একটা কলম আর কাগজ নিয়ে আসি। দুইটা তার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলি,

— নাও।

হৃদিপু আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তোর কাছে রাখ আর আমার সামনে বোস।

আমি হৃদিপুর কথা মতই তার সামনে বসি। হৃদিপু আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— এইবার এই সাদা কাগজে একটা সোজা একটা দাগ টানতো।

কথাটা শুনার সাথে সাথে আমার ভ্রু যুগল একত্রিত হয়ে আসে। আমি কৌতূহলপূর্ণ চোখে তার দিকে তাকাই। হৃদিপু আমার দৃষ্টির মর্ম বুঝতে পেরে বলে,

— আহা কর না।

আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে কাগজের মাঝে একটা দাগ টানি। এরপর হৃদিপুর দিকে তাকাতেই হৃদিপু আমায় বলে,

— এইবার এইটা মুছে ফেল।

কথাটা শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। বিষ্ময়কর চোখে তাকিয়ে রইলাম হৃদিপুর দিকে। অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

— পাগল হয়েছ? কলমের কালি আবার মুছে কিভাবে?

হৃদিপু ভাবলেশহীন গলায় বলে,

— তাহলে বলছিস এই দাগটা মুছা যাবে না?

আমি অকপটে স্বীকার করি,

— না! এইটা ইম্পসিবল।

হৃদিপু আমার কথা শুনে মুচকি হেসে বলে,

— আমাদের ইচ্ছেগুলো ঠিক এই কলমের কালির মতই হয়। কালো,ঘন ও গভীর এক টান। যা একবার মনের ক্যানভাসে আঁচড়ে পড়লে মুছা বড় দায়। তুই যতই চেষ্টা কর সেই দাগটাকে তুলতে কিন্তু তুই পারবি না৷ সর্বদা এর ছাপ রয়েই যাবে। এর অস্তিত্বও রয়েই যাবে। ঠিক যেমন তুই এই কাগজের পাতা থেকে কলমের দাগ মুছতে পারবি না তেমনই নিজের ইচ্ছেগুলো ভুলতে পারবি না। সেগুলো সর্বদা তোর মনের মাঝেই থাকবে। হোক জীবন্ত অথবা মৃত। অস্তিত্ব কিন্তু রয়েই যাবে আর সেটা তুইও পদে পদে অনুভব করতে পারবি৷

আমি চাপা কন্ঠে বলি,

— কি বুঝাতে চাইছো?

— এইটা যে ইচ্ছাগুলো কখনো ভুলা যায় না। সেগুলো সর্বদাই আমার মনের মাঝে থাকে। শুধু একটা সুযোগ খুঁজে বেরিয়ে আসার। নিজেকে তুলে ধরার। আর তুই এখন সে সুযোগটা পাচ্ছিস। কিন্তু তা কাজে লাগাচ্ছিস না। লাইফ তোকে একটা সুযোগ দিচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানোর। সুযোগটা কাজে লাগা। নিজেই একবার ভাব, আমাদের দেশে কতজন নারী পারে বিয়ের পর নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে? কয়টা শ্বশুরবাড়ি বা জামাই হয় এমন যারা কিনা তাদের বউদের পড়ালেখা করায়? ভাব!

আমি কিছু না বলে চুপ করে রই। মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করতে থাকে হৃদিপুর কথাগুলো। কথাগুলো বার বার আমাকে নতুন এক ভাবনা ভাবতে বাধ্য করছে। এইদিকে আমায় চুপ থাকতে দেখে হৃদিপু আবার বলে,

— ভাইয়া তোকে নিজ থেকে পড়াচ্ছে, তোকে সাপোর্ট করছে, তোকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে কিন্তু তাও তুই সেটা হেলায় নিচ্ছিস? নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস কর। যেমন আগে করতি। নতুন দমে, নতুন রুপে, নতুন উদ্যোগে নিজের ইচ্ছাগুলো জীবিত কর। তোর মনোবল কিন্তু অনেক স্ট্রোং। সেটা আপাতত এখন ঢাবির দিকে স্থির কর। আই নো ইউ ক্যান ডু ইট। গিভ এ চান্স টু ইউর সেল্ফ৷ প্লিজ! ভুলে যাস না তোকে নিজেকে প্রুভ করতে হবে আর এর শুরু কিন্তু এখন থেকেই।

হৃদিপুর কথাগুলো শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। নির্মল চোখে তাকিয়ে রই হৃদিপুর দিকে। মস্তিষ্কে চলতে থাকে হাজারো ভাবনা, হাজারো চিন্তা। মনে পড়ে অতীতগুলো। সেই ইচ্ছে, সেই মনোভাব গুলো। সকলের ব্যবহার গুলো। হঠাৎই আমার বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। আমি কিছু না বলে শুধু আপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। ঠিক তখনই তপ্ত এক নোনাজলের ফোটা গড়িয়ে পড়ে চোখের কার্নিশ বেয়ে।

#চলবে