#নিভৃতে_যতনে
#Part_15
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
রুমে পিন পিন নীরবতা। খাটের উপর পা তুলে বসে আছেন সালমা বেগম। তারই পায়ের সামনে বসে আছে রোয়েন। দৃষ্টি তার নত। সালমা বেগম বেশ কিছুক্ষণ ধরে রোয়েনকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। রোয়েনকে পর্যবেক্ষণ করা শেষে তিনি গলা পরিষ্কার করে বলে উঠে,
— বিয়েটা কি তুই আসলেই মেনে নিয়েছিস?
রোয়েন দৃষ্টি নত রেখে ভাবলেশহীন ভাবেই বলে,
— তা নয়তো কি?
— বিয়েটা যেহেতু মেনেই নিয়েছিস সেহেতু দায়িত্ব কর্তব্যগুলো ভালো মত পূরণ কর।
রোয়েন এইবার মাথা তুলে বলে,
— তুমি কি বুঝাতে চাইছো? আমি আমার কর্তব্য ঠিক মত পূরণ করছি না?
সালমা বেগম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
— না।
রোয়েন এইবার গম্ভীর কন্ঠে বলে,
— খাওয়াচ্ছি,পড়াচ্ছি, ওর যাবতীয় খরচ বহন করছি, ওকে দেখে রাখছি। আর কি?
— ওকে স্ত্রী হিসাবে মানতে পেরেছিস? স্ত্রীর অধিকার দিতে পেরেছিস ওকে? তুই যা করছিস তা প্রাত্যহিক জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা। এইগুলা তুই করতে বাধ্য। কিন্তু একটা মেয়ে সবকিছুর উর্ধ্বে তার স্বামীর সঙ্গ চায়, তার ভালবাসা চায়,তার সময় চায়। দিতে পেরেছিস তুই এইগুলো ওকে?
রোয়েন কিছু না বলে মাথা নত করে রাখে। সালমা বেগম তা দেখে শীতল কন্ঠে বলে,
— বিয়েটা তো তোর অমতে হয়নি তাই না? তাও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিস না? এতটা জড়তা কেন? এখনো তোদের সম্পর্কে অনেক ফাঁক রয়েছে। তোদের দেখলে যে কেউ বিষয়টা ধরে ফেলবে। বিয়ের ৩ মাস হতে চললো আর কত?
— একসময় ঠিক হয়ে যাবে।
সালমা বেগম এইবার সন্দিহান স্বরে বলে উঠে,
— আচ্ছা তুই কি এখনো অতীতটাকেই আঁকড়ে ধরে আছিস? ভুলতে পারিসনি সেটা?
কথাটা শুনার সাথে সাথে রোয়েনের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। সে সালমা বেগমের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— মনে রাখার মত কিছু ছিল নাকি যে ভুলতে পারবো না? আমার লাইফে অতীত বলতে কিছু নেই। যা আছে তা বর্তমান আর ভবিষ্যৎ।
— তাহলে সেই বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এই সিয়াশাকে বানা। ওকে নিজের জীবনের অংশ বানিয়ে নে। সম্পর্কটা নিয়ে সিরিয়াস হো।
রোয়েন কিছু না বলে সালমা বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। শীতল কন্ঠে বলে,
— তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি সম্পর্কটা নিয়ে সিরিয়াস না?
সালমা বেগম কথাটা শুনে মুচকি হেসে রোয়েনের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলে,
— সিরিয়াস যেহেতু আগে থেকেই আছিস সেহেতু একটু সময় দে। দুইজন দুইজনকে বুঝার চেষ্টা কর।
রোয়েন মায়ের কোলে মুখ গুঁজে বলে,
— হুম।
সালমা বেগম রোয়েনের বাহুতে চাপড় মেরে বলে,
— এত গম্ভীর আর চাপা স্বভাবের কেন তুই?একটু ভালো হাসলে, কথা বললে কি হয়? স্বাভাবিক হতে পারিস না?
রোয়েন অকপটে বলে উঠে,
— না।
সালমা বেগম দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নিয়ে চুপ হয়ে যান। এই ছেলেকে স্বাভাবিক হওয়া বলাটাই বেকার।
_____________________
আমি বারান্দায় বার বার পায়চারী করছি। মাথায় চলছে যত ধরনের অপ্রীতিকর চিন্তা-ভাবনা। ধীরে ধীরে অস্থিরতা বাড়ছে। ফাঁস-হাঁস করছি বার বার। কালকে এডমিশন টেস্টের রেজাল্ট। কি আসবে রেজাল্ট আল্লাহ মালুম। আদৌ চান্স পাবো কি-না কে জানে? চিন্তায় মাথাটা ধরে এলো। এক কফি হলে ভালো হতো। কিন্তু কফি বানানোর ইচ্ছাটাও এখন হচ্ছে না যার জন্য এই ইচ্ছাটা পরক্ষণেই বাদ দিয়ে দিলাম। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। হঠাৎ হৃদিপুর কথা মনে পড়তেই আমি আর কিছু না ভেবে মুঠোফোন হাতে নিয়ে কল লাগালাম হৃদিপুর নাম্বারে৷ দুইবার রিং বাজতেই হৃদিপু কল রিসিভ করে। কল রিসিভ হতেই আমি ধৈর্য্যহারা কন্ঠে বলি,
— আপু আমি টেনশনে মারা যাচ্ছি। মনে হচ্ছে এখনই টুপ করে মারা যাবো।
হৃদিপু আমার কথা শুনে এক ধমক দিয়ে বলে,
— চুপ! এইসব বললে দিবো ধরে এক মাইর। আর এত কিসের টেনশন হ্যাঁ?
আমি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলি,
— কালকে রেজাল্ট!
— তো কি হয়েছে? রেজাল্ট কি একা তোর বের হচ্ছে নাকি? এত ভয় টেনশনের কি আছে? পরীক্ষা যেহেতু ভালো দিয়েছিস রেজাল্টও ভালোই হবে।
আমি মিনমিনে গলায় বলি,
— তাও ভয় করে তো।
— আন্ডা করে। প্রতিবার রেজাল্টের আগে এমন ভাব করছিস যেন পরীক্ষা অনেক খারাপ দিয়েছিস আর এইবার সিউর তুই ডাব্বা মারবি। কিন্তু শেষে কি হয়? এর উল্টোটা।
— কিন্তু এইবার আমি সিরিয়াস। চান্স হবে না দেইখো তুমি। আমার মন বলছে হবে না চান্স।
— কেন হবে না শুনি?
— এসএসসিতে যে এ প্লাস নেই আমার। ভয়টা তো এইখানেই।
হৃদিপু এইবার নরম গলায় বলে,
— এইচএসসিতে তো গোল্ডেন পেয়েছিস নাকি? সেই সাথে এডমিশন এক্সামও ভালো দিয়েছিস। সেহেতু ভয়ের কারণ নেই। চান্স হয়ে যাবে তোর।
আমি আবার মিনমিনে স্বরে বলি,
— তাও!
হৃদিপু এইবার শাসনের সুরে বলে,
— আরেকবার বাজে বকলে একটা মাইর ও নিচে পড়বে না বলে দিচ্ছি। এত টেনশন কেন করচ্ছিস? নিজেকে শান্ত কর। অন্য কোন কিছুতে মন লাগা। মুভি দেখ না হয়।
— ভালো লাগছে না।
— তাহলে অন্য কিছুতে মন লাগা।
আমি দুঃখী দুঃখী কন্ঠে বলি,
— আজ বইন সত্যি আফসোস হচ্ছে, কেন যে একটা বয়ফ্রেন্ড বানালাম না। রেজাল্টের আগের দিন টেনশন দূর করার জন্য হলেও একটা বয়ফ্রেন্ড প্রয়োজন।
হৃদিপু হেসে বলে,
— বয়ফ্রেন্ডের আপডেট ভার্সনই আছে তোর কাছে। সে থাকতে বয়ফ্রেন্ড লাগেনি?
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই পিছন থেকে এক পুরুষালী কন্ঠ কানে ভেসে আসে,
— সিয়াশা!
কন্ঠটা শুনে আমি ভড়কে যাই। তাই চট জলদি পিছনে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে রোয়েনের মুখশ্রী। উনার মুখপানে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করি উনি কি আদৌ আমার কথাগুলো শুনেছে কি-না। কিন্তু মুখভঙ্গি স্বাভাবিক হওয়ায় তা বুঝা গেল না। তাই ধরেই নিলাম সে হয়তো কিছু শুনে নি। আমি হৃদিপুকে চাপা গলায় বলে উঠি,
— পরে কথা বলি।
কথাটা বলেই ফট করে কলটা কেটে দিলাম। নিজেকে সামলে স্মিথ হাসার চেষ্টা করে বলি,
— কিছু বলবেন?
রোয়েন কিছু না বলে আমার দিকে এক কাপ কফি এগিয়ে দেন। কফির কাপটা দেখে আমি সেদিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রই। বুঝার চেষ্টা করি, “উনি বার বার আমার চাওয়াটা কিভাবে বুঝে যায়? যেটা আমি প্রকাশই করি না সেটা উনি বুঝে কিভাবে? হাও?” কথাটা যখন আমি ভাবছি উনি স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে উঠেন,
— রেজাল্ট যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে এখন তুমি টেনশন করলেই তা বদলে যাবে না। যা হওয়ার তাই হবে। সো রিলেক্স।
উনার কথায় আমি একটু নড়েচড়ে দাঁড়াই। অতঃপর কফির কাপটা হাতে নিতে মাথা নত করে বলি,
— হুম।
উনি স্বগতোক্তি স্বরে বলে উঠেন,
— মুভি দেখবে?
কথাটা শুনে আমি তার দিকে চকিতে চাই। অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে রই। হঠাৎই মুভি না দেখার ইচ্ছেটা বদলে গেল আমার। মুভি দেখার প্রতি আগ্রহ মনে হয় একশো গুন বেরে গেলো। কেন এমন হলো জানি না। কিন্তু হলো। আমি দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নিয়ে যত্নসহকারে নিজের কপালে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো কানে পিঠের গুঁজে দিয়ে বলি,
— হ্যাঁ।
রোয়েন আর কিছু না বলে চলে যায় রুমে। আমিও চুপচাপ কফি হাতে নিয়ে উনার পিছু পিছু চলে যাই রুমে। তিনি কাবার্ড থেকে ল্যাপটপ বের করতে করতে হঠাৎই বলে উঠেন,
— টেনশন দূর করার জন্য কিন্তু বর ও মন্দ নয়।
কথাটা শুনার সাথে সাথে আমার কান গরম হয়ে আসে। গালে ভেসে উঠে রক্তিম এক আভা। তীব্র এক অস্বস্তিতে পরে যাই আমি। আমি আড়চোখে রোয়েনের দিকে তাকাতেই দেখি তার ঠোঁটের কোনে ঝুলছে সুরু এক হাসির রেখা। যেটা চোখে পড়ার সাথে সাথে আমার অস্বস্তি গাঢ় হয়ে আসে। আমি নিজেই নিজেকে মনে মনে বলে উঠি,
— দেখে শুনে কথা বলতে পারিস না? এখন দিলো তো খাটাশ ব্যাটা খোঁচা মেরে। ইশশ! কি লজ্জা! কি লজ্জা! লজ্জায় তোর বুড়িগঙ্গায় গিয়ে ডুবে মরা উচিৎ।
#চলবে