নিভৃতে যতনে পর্ব-১৭

0
966

#নিভৃতে_যতনে
#Part_17
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— ব্যাগ পত্র গুছিয়ে রেখো। পরশু আমরা সাজেক যাচ্ছি।

কথাটা কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতেই আমি তাঁর দিকে চকিত দৃষ্টিতে চাই। মুখশ্রীর প্রত্যেকটি ভাজে ফুটে উঠে বিষ্ময়। আমি অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

— হঠাৎ?

সে রেলিং এর উপর দুই হাত রেখে নিজের ভর ছেড়ে দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,

— অফিস থেকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। প্রতিবছরই এই সময়টায় আমাদের পিকনিকে নেওয়া হয়। তুমি তো এখন ঘরেই তাই ভাবলাম একটা রিফ্রেশমেন্ট দরকার।

— ফ্যামিলি নিয়ে যাওয়া যায়?

— নিয়ে যাওয়া না গেলে কি আমি তোমায় বলতাম?

কোথাটা শুনে আমি ফুঁসে উঠি। এই ব্যাটা কথার মাঝেও ত্যাড়ামি ছাড়ে না। আস্ত ঘাড়ত্যাড়া একটা। হুহ! আমি নিজেকে একটু স্থির করে বলি,

— তা কখন যাচ্ছি আমরা?

— পরশু রাতে রওনা দিব আমরা আর সেখানে তিন দিনের মত থাকবো।

— আচ্ছা।

— আর হ্যাঁ! কালকে সন্ধ্যায় রেডি থেক। শপিংয়ে যাব।

আমি কিছু না বলে শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা দুলালাম। অতঃপর দুইজনের মাঝে বিরাজমান করলো পিনপতন নীরবতা। আমিও রেলিং এর উপর নিজের ভর ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালাম। চেয়ে রইলাম পূর্ণ চাঁদটির দিকে। স্নিগ্ধ হাওয়ার কমল স্পর্শ ছুঁয়ে যায় আমার মুখখানি। মুখের উপর আঁচড়ে পড়ে অবাদ্ধ চুলগুলো। আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে সেগুলো কানে পিঠে গুঁজে নিলাম। সম্পূর্ণ চুল পিছে নিয়ে যেই না হাত খোঁপা করতে যাব ঠিক এমন সময় রোয়েন বলে উঠে,

— কিছু জিনিস বাধ্যর চেয়ে অবাদ্ধই ভালো।

কথাটা কর্ণপাত হওয়ার সাথে সাথে আমি থমকে যাই। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসে৷ আমি তার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি সে অতি শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যা মুহূর্তেই আমার মাঝে শিহরণ তৈরি করছে। মিনিট আগে পুশে রাখা বিরক্তি নামক পাখিটি যেন উঁড়ে চলে যায়। মনের মাঝে ছেয়ে যায় একরাশ মুগ্ধতা। আমি হাতের মুঠোয় থাকা পেঁচানো চুলগুলো ছেঁড়ে দেই। সাথে সাথে মুক্ত পাখির মত এলোমেলো ভাবে গড়িয়ে পড়ে এক গুচ্ছ চুল। আমি এক হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করতে করতে বিরবির করে বলি,

— চুলগুলো যে আজ আবদ্ধ করা আমার জন্য অন্যায়। ঘোর অন্যায়!

_________________

আঁধারে ভেসে বেড়াচ্ছে কুঞ্জ কুঞ্জ কালো মেঘ। ঝোড়ো হাওয়া বইছে৷ হিম হিম ভাব ছড়িয়ে পড়েছে আনাচে কানাচে। ক্রমেই কমে এসেছে ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততা। ফাঁকা ফাঁকা রাস্তার মাঝে ফুটে উঠেছে সোডিয়াম লাইটের হলদেটে আলো। সেই আলোয় পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে ধূলিকণার দল। একটু আগেই আমি আর রোয়েন এসে পৌঁছেছি উনার অফিসের সামনে। ভিতরে ঢুকতেই নজরে পরে সুবিস্তীর্ণ তেরো তালার দালানটি। তারই প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে চার চারটি এসি বাস। গেটের কাছে এসে সকলেই একত্রিত হয়েছে। প্রায় আশি শতাংশ মানুষই বিবাহিত। সাথেই আছে তাদের বউ,বাচ্চা। আর বাদবাকি ব্যাচেলররা নিয়ে এসেছে কিছু বন্ধু-বান্ধব। রোয়েন আমাকে সবার সামনে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতেই সকলে ‘ম্যাম! ম্যাম!’ বলে মুখের ফেনা তুলে ফেলে। প্রথমে এইসবে আমি ভড়কে গেলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেই। হাসি মুখেই সকলের সাথে কথা বলি। কথা বলার এক ফাঁকে জানতে পারি রোয়েন একাউন্টটিং সেক্টরের “হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট”। তার উপর আজকে যাচ্ছে দুই গ্রুপ। এক একাউন্টটিং ডিপার্টমেন্টেত গ্রুপ আরেকটা অন্য ডিপার্টমেন্টের গ্রুপ। এক গ্রুপ মানে রোয়েনের গ্রুপের গাড়ি সামনের গেট দিয়ে বের হবে আর অন্য গ্রুপের গাড়ি পিছন দিক দিয়ে। তাই এইখানে সকলেই রোয়েনের আন্ডারে কাজ করার সুবাদে আমাকে ‘ম্যাম’ বলে সম্মোধন করছে। প্রথম প্রথম এইসবে অস্বস্তি লাগলে পরে সয়ে যায়৷

দেখতেই দেখতে রাত এগারোটার মধ্যে আমরা সকলে বাসে উঠে পড়ি। সকলে সকলের সিট দখল করে নিতেই একজন এসে দেখে নেয় সকলে এসেছে কি-না। অতঃপর সব ঠিক হতেই গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। মিনিট দুয়েকের মাঝেই গাড়ি ছেড়ে দেয়। ছুটে চলে নিজের গন্তব্যের দিকে।

____________________

চারদিকে পিনপতন নীরবতা। কোথায় কোন শব্দ নেই। একটু আগেও সোরগোল ছিল প্রচুর। আমাদের বাসে বেশির ভাগ যুবক-যুবতী আর নবদম্পতি হওয়ায় সকলের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কোন কমতি নেই। গান-বাজনা, আড্ডায় মত্ত ছিল সবাই। কিন্তু ধীরে ধীরে আঁধারের মায়া গাঢ় হয়ে আসতেই সকলে নেতিয়ে পড়ে। নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে বাসের ভিতরেও নেমে এসে ঘন অন্ধকার। মাঝে মধ্যে সরু কাঁচ ভেদ করে কোলের উপর এসে পড়ছে এক ঝাঁক সোডিয়াম লাইটের আলো। এসির পাওয়ার অন হওয়ায় চারপাশে হিম হিম ভাব। কম বেশি সকলের গায়েই জড়ানো মোলায়েম পাতলা কম্বল।

আমার দৃষ্টি কাঁচ ভেদ করে বাহিরে রাস্তার ধারে নিবদ্ধ হয়ে আছে। এই প্রথম ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়া আমার। আগে কখনো সুযোগ হয়নি আমার ঢাকার বাইরে যাওয়ার। বলতে গেলে কেউ নিয়েই যায় নি। সবসময় স্বপ্ন ছিল ঢাকার বাইরে ঘুরে বেড়ানোর। বিশেষ করে সাজেক যাওয়ার। আর আজ আমি সত্যি সত্যি সাজেক যাচ্ছি তা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। মনের মাঝে আজ উড়ে বেড়াচ্ছে শত রঙ্গের প্রজাপতি। এক রাশ ভালো লাগা ঝেঁকে ধরেছে আমায়। বেশ কিছুক্ষ্ণ বাইরে তাকিয়ে থাকার পর আমি ঘুরে রোয়েনের দিকে তাকাই। অন্ধকারের আবছা আলোয় বুঝতে পারলাম উনি কানে ইয়ারফোন গুঁজে শুয়ে আছে। নয়ন যুগলটি তাঁর বন্ধ। আমি কিছু না বলে হুট করে তাঁর একটা ইয়ারফোন নিয়ে নিজের কানে গুঁজে নেই। আমার এমন এহেন কান্ডে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। চোখ খুলে তাকায় আমার দিকে। অতঃপর ঘটনা ক্রমে বুঝতে পেরে লম্বা এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— বললেই হয়তো ইয়ারফোন লাগবে। মানা করতাম নাকি?

আমি অকপটে বলে উঠি,

— আমার যেভাবে ইচ্ছা আমি সেভাবে নিবো। আপনার কি?

সে পুনরায় চোখ বন্ধ করে বলে,

— আমার কিছু না কিন্তু আমার বউয়ের অনেক কিছু।

কথাটা শুনে আমি ফুঁসে উঠি। অন্ধকারের মাঝেই তার দিকে কিছুক্ষণ কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রই। কিন্তু তার মধ্যে কোন হেলদোল না থেকে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেই। অতঃপর সিটে গা এলিয়ে দিয়ে নিদ্রার দেশে পারি দেওয়ার চেষ্টা করি।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি ঠিক খেয়াল নেই। ঘুমের ঘোরেই হেলে পড়ি রোয়েনের কাঁধের উপর। ঘুমানোর আগে গায়ে ভালো মত কম্বল জড়িয়ে না নেওয়ার ফলে তা এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এইদিকে শীতে আমার প্রায় জুবুথুবু অবস্থা। ধীরে ধীরে শরীর কাঁপন দিতেও শুরু করে। কিছুক্ষণ বাদেই আমি রোয়েনের কাঁধের উপর পড়তেই রোয়েনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে আমার দিকে চাইতেই দেখে আমি বিড়ালের ছানা ন্যায় কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে আছি আর মৃদু পরিমাণ কাঁপছি। তা দেখা মাত্র রোয়েনের ভ্রু কুঁচকে আসে। সে কিছুক্ষণ আমার পানে তাকিয়ে থেকে আমাকে সোজা করে বসিয়ে দেয়। অতঃপর মাঝে সিটের হ্যান্ডেলটা সরিয়ে নিয়ে আমাকে তার বাহুদ্বয়ে আবদ্ধ করে নেন। আলতো হাতে আমার মাথাটা তাঁর বুকের উপর রেখে আমার গায়ে নিজের কম্বলটা জড়িয়ে দেন। আমি রোয়েনের গায়ের উষ্ণতা পেয়ে ঘুমের ঘোরেই তার সাথে আরও লেপ্টে যাই। দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরি তার কোমড়। ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকি তার বুকে মাঝে। সে আমার মুখে উপর পড়া অবাদ্ধ চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে নিজেও চোখ বুজে শুয়ে পড়ে।

#চলব