নিভৃতে যতনে পর্ব-২৬+২৭

0
1234

#নিভৃতে_যতনে
#Part_26
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

আমি দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। সামনেই হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে রোয়েন। ডান হাতে তার প্লাস্টার ঝুলছে, ডান পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সাদা মোটা ব্যান্ডেজ। অভ্যন্তরীণ আরও চোট পেয়েছে কিন্তু তা এতটা গভীর না। মাথার উপর স্যালাইন ঝুলছে। ঘন্টা খানিকের মধ্যে হয়তো স্যালাইন দেওয়া শেষ হয়ে যাবে এরপর বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে তাঁকে। পাশেই মা বসে অঝোরে কেঁদে চলেছেন। বাবা গিয়েছেন ঔষধগুলো আনতে। রোয়েন ঘুমে হওয়ায় মায়ের পরিস্থিতিটা তাঁর দেখা হলো না। আমি এগিয়ে গিয়ে মায়ের কাঁধ হাত রাখলাম কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার মত কিছু খুঁজে পেলাম না। দৃষ্টি গেল রোয়েনের পানে। আমি যতবারই তাঁর মলিন মুখ পানে তাকাচ্ছি ততবারই ভিতরটা হাহাকার করে উঠছে। মন অস্থিরতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। গুমোট এক চাপা অনুভূতি কামড়ে ধরছে আমায়। কেন জানি না, সামনে শুয়ে থাকা মানুষটির এই অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছি না। তার ক্ষতবিক্ষত হওয়া হাত পা দেখে আমি বার বার দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছি। কষ্টরা দলা পাকিয়ে আসছে। আমি জানি না, এই কষ্ট কিসের? তাঁর প্রতি আমার এত প্রগাঢ় অনুভূতি কেন? শুধু জানি, মানুষকে এই অবস্থায় আমি মানতে পারছি না। কিছুতেই পারচ্ছি না।

হসপিটালে আসা মাত্র জানা গেল, রোয়েনকে রাস্তার কিছু পথিকরাই এই হসপিটালে নিয়ে এসেছেন।কিন্তু রোয়েনের মোবাইল লক থাকায় তারা কাউকে ইনফর্ম করতে পারেনি৷ এক্সিডেন্টের সময় রোয়েন রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল যার জন্য তাঁকেও জিজ্ঞেস করা যায়নি। এরপর যখন হসপিটালে তার জ্ঞান ফিরে তখন সে বাবার নাম্বারটা হসপিটাল কর্তৃপক্ষকে দেন যোগাযোগ করার জন্য৷ রোয়েন গুরুতর এক্সিডেন্ট করেন নি কিন্তু চোট পেয়েছেন বেশ। একটু আগেই ডাক্তার এসে জানিয়ে গেলেন, তার ডান হাতটা না ভাঙলেও বেশখানিক কেটে দিয়েছে। সেই সাথে রগে টান পড়েছে বিধায় হাতে প্লাস্টার পড়েছে। সপ্তাহখানেক তা রাখতে হবে। ডান পা-টা মচকে গিয়েছে এবং ছিলে গিয়েছে। কিছুদিনের জন্য তার চলাফেরা সম্পূর্ণ নিষেধ। বাকি আরও অনেক জায়গায় ছিলে ও কেটে গিয়েছে সেখানে ডেসিং করে মেডিসিন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোটামুটি তাকে পনেরো-বিশ দিনের মত বেডরেস্টে থাকতে বলেছেন ডাক্তার। যত্ন নিতে বলেছেন আমাদের।

বেশ কিছুক্ষণ পর রোয়েনের ঘুম ভাঙ্গতেই মা তাঁর এক হাত চেপে ধরে দ্বিগুণ কান্না কর শুরু করে দেন। বকতে থাকেন তাকে। বাবা কিছুক্ষণ ধমকালেন বেপরোয়াভাবে বাইক চালানোর জন্য। চুপ শুধু আমি থাকলাম। কোন কথাই বললাম না। নীরব দৃষ্টিতে দেখতে থাকলাম মানুষটিকে। উনি বাবা-মার সবকিছুই নীরবে হজম করে বাবা-মাকে বুঝ দিলেন। চলতি রাস্তায় সামনে থাকা গাড়িটি হঠাৎ ব্রেক করায় তাঁর ব্যালেন্স হারিয়ে যায় এবং সে এক্সিডেন্ট করে বসে। ঘটনাক্রমে শোনামাত্র বাবা-মা চুপ হয়ে যান। তাঁর মাথায় আদরমাখা হাত বুলিয়ে দেন মা। ক্ষণিকের মাঝে উনি চারদিকে চোখ বুলাতেই আমার নয়ন দুইটির দৃষ্টির সাথে তার দুইটি নয়নের দৃষ্টির সাক্ষাৎ হয়। চারটি নয়ন একত্রিত একই সুতোর মালায় এসে স্থির হয়। এরপর নিভৃতে চলতে থাকে দৃষ্টির আদান-প্রদান।

_____________________

রাত বারোটায় স্যালাইন শেষ হতেই হসপিটালের সকল টাকা পরিশোধ করে আমরা রোয়েনকে নিয়ে আসি। মা রোয়েনকে ফ্রেশ করিয়ে দিতে বাবা আর আমি ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে দেই। এরপর আমরা সকলেই ফ্রেশ হয়ে আসি। ফ্রেশ হয়ে এসে আমি জোর করে বাবা-মাকে খাওয়ার জন্য বসিয়ে দেই আর নিজে প্ল্যাটে খাবার তুলে নিয়ে যাই রোয়েনের জন্য। সেই সাথে তাদের কড়া নির্দেশ দিয়ে দিলাম, তারা যাতে রাত না জাগে৷ রোয়েনের পাশে আমি আছি তাই তারা যাতে নিশ্চিন্তে থাকে আর খেয়ে ঘুমাতে চলে যান।তারাও আর দ্বিমত প্রকাশ করলেন না। বাবা-মায়ের চেহেরা দেখেই বুঝ যাচ্ছে তারা বেশ ক্লান্ত। হবেই বা না কেন? যে দখল গিয়েছে আজ তাদের উপর দিয়ে৷ তাই তাদের এখন বিশ্রাম করাটা জরুরি বৈকি। খাবারের প্ল্যাট নিয়ে রুমে এসে বিছানায় বসতেই রোয়েন ভ্রু কুঁচকে তাকালেন কিন্তু কিছু বললেন না৷ আমি ভাত মেখে তাঁর মুখের সামনে ধরতেই সে চুপচাপ তা খেয়ে নিলেন। শুধু চেয়ে থাকলেন নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে। খাওয়া শেষে আমি হাত ধুয়ে এসে তাকে পানি আর মেডিসিন খাইয়ে দিলাম। এরপর যখন উঠে যেতে নেই উনি বা হাত দিয়ে আমার ডান হাত চেপে ধরে বলেন,

— কি হয়েছে? কথা বলছো না কেন?

আমি এতটা সময় নতজানু হয়ে ছিলাম। রোয়েনের নয়নের সাথে নয়ন না মিলে যায় সেই ভয়ে৷ কিন্তু এইবার আমি মুখ তুলে তাকাই। দৃশ্যমান হয় আমার রক্তিম লাল নয়ন দুইটি। আমি কিছু প্রহর রোয়েনের মুখ পানে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেই। মুখে নেই কোন শব্দ৷ রোয়েন এইবার নরম সুরে বলে,

— কথা বলবে না?

আমি সাথে সাথে না সূচক মাথা দুলাই। রোয়েন তা দেখে স্মিত হেসে বলেন,

— কিন্তু কেন?

আমি তাও নির্বিকার বসে থাকি। কোন কথা বলি না। কেন জানি তাঁকে এই অবস্থায় দেখে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। ভিতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। গলা ধরে আসছে বার বার। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে আমার। রোয়েন যাতে আমার ভিতরের অবস্থা বুঝতে না পারে তাই চুপ হয়ে আছি। রোয়েন আবার বলে উঠেন,

— চুপ থাকার স্বভাব কিন্তু আমার তোমার না।

আমি তাও কিছু না বলে চুপচাপ উঠে যাই, ঔষধের ঝুলি থেকে একটা ক্রিম নিয়ে পুনরায় ফিরে আসি আর রোয়েনকে সোজা করে বসিয়ে দেই। উনি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

— কি হয়েছে?

আমি কিছু না বলে তাঁর পিছনে গিয়ে টি-শার্টটা উপরের দিকে গুটিয়ে নেই। সেই সাথে দৃশ্যমান হয় ক্ষত-বিক্ষত পিঠ। জায়গায় জায়গায় ছিলে ও কেটে যাওয়ার লালাভ দাগ। এই দৃশ্য দেখা মাত্র আমার বুক মুচড়ে উঠে। নরম হয়ে আসে নয়ন জোড়া। আমি হাতের তর্জনীর গোড়ায় কিছুটা মলম নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে তাঁর সপ্তপর্ণে ক্ষতস্থানে ছুঁয়ে দেই। সাথে সাথে রোয়েন একটু কুঁকড়ে উঠে। জ্বালায় উহু শব্দ করে উঠে। কেন জানি না আমি এইবার নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। নাক টানতে শুরু করলাম। আমার কান্নার আওয়াজ রোয়েনের কর্ণধার পর্যন্ত পৌছাতেই সে ভড়কে যায়। দ্রুত পিছে ঘুরতে নিলেই সারা শরীরে ক্ষত গুলো কামড়ে ধরে তাঁকে। সে ধীরে সুস্থে পিছে ঘুরে আমায় জিজ্ঞেস করে,

— আরেহ কাঁদছো কেন? এতক্ষণ তো ঠিকই ছিলে।

আমি কিছু না বলে তাঁর বুকে মাথা রেখে সশব্দে কেঁদে দেই। এতে রোয়েন যেন দ্বিতীয় বারের মত ভড়কে যায়। অতঃপর নিজেকে সামলে আমায় তাঁর বা হাত দিয়ে আগলে নিয়ে বলেন,

— কি হলো? কাঁদছো কেন?

আমি ফুঁপিয়ে উঠে বলি,

— জানি না।

— খারাপ লাগছে?

আমি নাক টানতে টানতে বলি,

— জানি না।

— কি হয়েছে বলো তো?

— জানি না।

রোয়েন এইবার কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

— তাহলে জানোটা কি?

আমি অকপটে উত্তর দেই,

— জানি না। কিছু জানি না আমি।

রোয়েন উত্তর শুনে কিছু না বলে স্মিত হাসে। কিন্তু কিছু বলে না। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আমি বলি,

— বাইক ঠিক মত চালাতে পারেন না? দেখেছেন সারা শরীরে কত ক্ষত?

রোয়েন অকপটে জিজ্ঞেস করে বসে,

— আমাকে এইভাবে দেখে তোমার কষ্ট হচ্ছে?

কথা শ্রবণ হওয়া মাত্র আমি কিছুটা মিইয়ে যাই। মিনমিনে গলায় বলি,

— জানি না।

আমি উত্তর শুনে রোয়েন তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে। উদাসীন গলায় বলে,

— আমি তোমার কে হই যে তুমি আমায় এইভাবে দেখে কষ্ট পাচ্ছো?

কথাটা কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতেই আমি স্থির হয়ে যাই। গুটিকয়েক বার একটানা চোখের পাপড়ি ফেলে নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দেই,

— জানি না।

রোয়েন কিঞ্চিৎ হেসে স্বাভাবিক কন্ঠে বলেন,

— বাইক চালাতে গেলে এমন টুকিটাকি এক্সিডেন্ট হয়ই। এর আগেও দুই-একবার এমন এক্সিডেন্ট করেছি। ব্যাপার না।

আমি কিছু না বলে কাঁদতে থাকি। উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,

— সে কি জানে? তার চোখের জল যে আমার কাম্য নয়। তার চোখের জল ব্যথিত করে আমায়। মুহূর্তেই ছন্দছাড়া করে ফেলে?

কথাটা শুনে আমি নিরব হয়ে যাই। আমি নিরবতা দেখে উনি পুনরায় বলেন,

— সকলের জন্য কিন্তু চোখের পানি ঝরে না আর যার জন্য ঝরে সে হয় অতি ভাগ্যবান। তাহলে কি আমি ধরে নিব আমি ভাগ্যবান?

আমি এইবার রোয়েন কাছ থেকে সরে এসে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলি,

— পিছে ঘুরুন, মলম লাগানো বাকি আছে আমার।

রোয়েন তাঁর বা হাতের তর্জনী উঁচু করে সপ্তপর্ণে আমার ফোলা চর্বিযুক্ত গালের উপর গড়িয়ে পড়া তপ্ত পানির কণাগুলো মুছে দিয়ে বলেন,

— কান্নায় নয়,হাসিতে মানায় তাকে।

মুহূর্তেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে কিঞ্চিৎ হাসি।

__________________

রাত তখন কয়টা বাজে জানি না। আমি বিছানায় বসে দেয়ালে মাথা রেখে ঝিমুচ্ছি। রোয়েনের কিছু লাগতে পারে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জেগেই থাকবো আজ। কিন্তু কখন যে চোখ লেগে আসে বুঝতেই পারিনি। ঘুম যখন একটু গাঢ় হয়ে আসতে নিলো তখনই কেউ আমায় টানছে। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও ক্ষণেই রোয়েনের কথা টনক নাড়তে ঘুম ছুটে যায় আমার। আমি তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকাই। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় বুঝতে পারি রোয়েন আমার একবাহু ধরে রেখেছে। আমি চট জলদি জিজ্ঞেস করি,

— কিছু লাগবে আপনার? ওয়াশরুমে যাবেন? ব্যথা করছে কোথাও? ঘুমাতে অসুবিধা হচ্ছে?

রোয়েন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,

— না।

— তাহলে?

— তুমি এভাবে বসে ঝিমাচ্ছো কেন? শুয়ে পড়ো।

কথাটা শ্রবণ হওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ তাঁর পানে চেয়ে থাকলাম। অতঃপর ঘটনাক্রমে বুঝতে পারলাম উনি তাঁর এক হাত দিয়ে ঘুমন্ত আমিটাকে শুয়ে দেওয়ার বৃথা করছিলেন। কথা বুঝার পর ঠোঁটের কোনে সরু হাসির রেখা ফুটে উঠে৷ আমি নরম সুরে বলি,

— নিজেই আমাকে শুয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তাই তো?

কথাটা বলা মাত্র রোয়েন থমথম খেয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলে,

— এইভাবে থাকলে সকালে পিঠ ব্যথা তো আমার না তোমার করবে। তখন সেবা কিভাবে করবে আমার?।

আমি কিঞ্চিৎ হেসে বলি,

— নিজে অসুস্থ হয়েও আমায় আগলে রাখার চেষ্টা করছেন? কিন্তু কেন?

রোয়েন আমার দিকে সরল চাহনিতে চেয়ে বলে,

— কে বলেছে আমি তোমায় আগলে রাখছি?

— তো কাকে রাখছেন?

— শুনেছি, স্বামীর বা পাজারের হাড় দিয়ে নাকি স্ত্রী তৈরি। তো সেই হিসাবে, আমি তো আমার আমিটাকেই আগলে রাখছি। তোমাকে না।

কথাটা শোনামাত্র ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি। মনে এসে ভীড় করে এক রাশ মুগ্ধতা।

#চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_27
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

রান্নাঘরে আমি আর পলি আন্টি কাজ করছি। রুমেই মা রোয়েনের সারা শরীরে স্পঞ্জ করে দিচ্ছেন। বাবা যোহরের নামাজ পড়ে টিভিতে খবর দেখছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর মা রোয়েনকে ফ্রেশ করিয়ে রান্নাঘরে আসেন। আমাকে টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিতে বলে তিনি হাতমুখ ধুতে চলে যান। আমিও তার কথামত চটজলদি টেবিলে খাবার সাজিয়ে নিলাম। অতঃপর মা-বাবাকে ডেকে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। নিজে তাদের প্ল্যাটে খাবার তুলে দিয়ে, আরেকটা প্ল্যাটে রোয়েনের জন্য খাবার তুলে নিলাম। খাবারের প্ল্যাটটা নিয়ে রওনা হলাম রুমের উদ্দেশ্যে। রুমে এসে দেখি রোয়েন শুয়ে শুয়ে মোবাইল দেখছে। দৃশ্যটা দেখামাত্র মেজাজ চটে গেল আমার। কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠলাম,

— অসুস্থ অবস্থায়ও মোবাইল ছাড়া চলে না আপনার?

আমার কথা শুনে রোয়েন চকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। অতঃপর ভ্রু কুঁচকে বলেন,

— তো সারাদিন রুমে শুয়ে বসে থেকে করবোটা কি? বউয়ের সাথে হা-ডু-ডু খেলবো?

কথাটা শোনামাত্র কান গরম হয়ে যায় আমার। তাঁর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলি,

— ছিহ! কথার কি শ্রী। রুমে থেকে থেকে মাথা গিয়েছে নাকি আপনার?

সে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,

— হ্যাঁ গিয়েছে। কত ভালো লাগে এই রুমে বন্দী হয়ে থাকতে?

কথাটার মর্ম বুঝে আমি হালকা হেসে বলি,

— তিনদিন হলো মাত্র আর তাতেই এই অবস্থা? বাকি পনেরো-বিশ দিন কিভাবে কাটাবেন?

— জানি না।

আমি আর কিছু না বলে এগিয়ে গেলাম তাঁর দিকে। বেডসাইড টেবিলে খাবারের প্ল্যাটটা রেখে রোয়েনকে ধরে উঠে বসালাম। পিঠে পিছনে বালিশ দিয়ে ভালো মত বসিয়ে দিলাম। খাবারের প্ল্যাটটা হাতে নিয়ে তাকে খায়িয়ে দিতে শুরু করলাম। কিছুটা সময় অতিক্রম হতেই রোয়েন শীতল কন্ঠে বলে উঠেন,

— এইসব করতে তোমার বিরক্তি লাগে না?

আমি উনার দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— বিরক্তি কেন লাগবে?

উনি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,

— আমার কিছু তো এখন তোমাকেই করতে হচ্ছে। মা মাঝে মধ্যে একটু সহযোগিতা করলেও বাকিসব তো তোমাকেই করতে হচ্ছে। রাতও জাগতে হচ্ছে। সেবা করতে হচ্ছে আমার। তাই বিরক্তি আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না।

আমি মৃদু হেসে বলি,

— আপনজনদের জন্য কিছু করতে কখনো বিরক্তি আসে না৷

রোয়েন কিছু না বলে শীতল দৃষ্টিতে আমার মুখ পানে তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ আমার ফোনের রিংটোন বেজে উঠতে তিনি চোখ সরিয়ে নেন। তাঁর বা পাশেই আমার ফোনটি থাকায় বলি,

— ফোনটা একটু দেন তো।

রোয়েন ফোনটা হাতে নিয়ে বলে,

— তোমার হৃদিপু ফোন দিয়েছে।

আমি ভাত মাখতে মাখতে বলি,

— তাহলে থাক। আমি পরে কল ব্যাক করে নিব নে।

রোয়েন কিছু বলতে যাবে তার আগেই কল কেটে যায়। তাই তিনি আর কিছু না বলে ফোনটা পাশে রাখতে নেয়, ঠিক এমন সময় পুনরায় রিংটোন বেজে উঠে। তা দেখে তিনি বলেন,

— পরে কথা বলতে হবে না, এখনই বলে নাও। আমি ধরে রাখছি তুমি কথা বলো।

আমি অহেতুক কথা না বাড়িয়ে বলি,

— তাহলে রিসিভ করে স্পিকারে দেন।

রোয়েন আমার কথা মতই কলটা স্পিকারে দিয়ে আমার সামনে ধরেন। আমি ‘হ্যালো’ বলার আগেই অপরপাশ থেকে হৃদিপু বলে উঠেন,

— ওই মাইয়া এতক্ষণ লাগে ফোন ধরতে?

আমি ভেংচি কেটে বলি,

— একবার ফোন দিয়েই এই হাল? আর নিজে যে হাজারবার ফোন দিলেও তুলো না তার বেলায় কি?

— আমার বেলায় সব মাফ।

— কচু! কি জন্য ফোন দিয়েছ তা বলো। হাতে কাজ আছে আমার।

হৃদিপু অভিমানী সুরে বলে,

— বিয়ে করে মেয়ে তুই আমায় ভুলে গেলি। আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলি তুই?নাইছ!

হৃদিপুর কথা শুনে রোয়েনের ভ্রু কুঁচকে আসে। তা দেখে আমি হালকা হেসে বলি,

— হ্যাঁ দিলাম এই প্রতিদান। হ্যাপি!

কথা বলে আমি রোয়েনের মুখে ভাত পুরে দিলাম। হৃদিপু দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— ভাইয়া কেমন আছে?

কথাটা শুনে আমি রোয়েনের দিকে তাকালাম। অতঃপর হালকা হেসে বলি,

— আপাতত ভালোই আছে। বেড রেস্টে আছে।

— আচ্ছা তাঁর খেয়াল রাখিস আর শুন চাচী কথা বলবে তোর সাথে। নে কথা বল।

আমি নির্বিকার গলায় বলি,

— দাও।

মা ফোনে আসতেই আমি সালাম দিলাম। মা সালামের উত্তর দিয়ে রোয়েনের কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। অতঃপর মা উদাসীন গলায় বলেন,

— তোর বাবাকে বলেছি একবার ওই বাসায় যাওয়ার কথা। দুই-একদিনের জামাইকে দেখে যাব নে আমরা৷

আমি শীতল কন্ঠেই বলি,

— সেটা তোমাদের ইচ্ছা। আসলে আসবে নাইলে না।

— এমন করিস কেন?

আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,

— কেমন করলাম?

মা কিছু বলতে যাবে তার আগেই নাসরিন বেগমের কন্ঠ শোনা গেল। তিনি গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছেন,

— ওই হৃদি তোর চাচী কার লগে কথা কয়?

হৃদিপু অকপটে উত্তর দেয়,

— সিয়ার সাথে দাদি।

— কেল্লা?

— ভাইয়া এক্সিডেন্ট করেছিল তো তাই তাঁর খোঁজ নিচ্ছিল চাচী।

নাসরিন বেগম খ্যাঁক করে বলে উঠেন,

— ওই অপয়ার লিজ্ঞাই তো পোলাডার আজ এই অবস্থা। অপয়া কোনহানকার। যার জীবনে যায় হের জীবনেই শনি ডাইক্কা লইয়া আহে। আমাগো রে তো ধ্বংস করসেই এখন ওই পোলাটার জীবনটাও ধ্বংস করতাসে। বিয়া কইরা বেচারা পোলাডার জীবনটাই নষ্ট।

আমি ফোনে আছি দেখে হৃদিপু দ্রুত তাকে বলে,

— আহা দাদি চুপ করো তো। কি বলছো এইসব?

— ঠিকই তো কইতাসি। ওই অপয়াডা যেমনে আমাগো জীবন খাইসে,তেমনই ওই পোলাডারও জীবন খাইবো দেখিস। মুখপোড়া মাইয়া কোনহানকার।

মা এইবার চাপা কন্ঠে বলে উঠেন,

— আহা মা চুপ করুন। ওই সব শুনছে।

— হুনলে হুনুকজ্ঞা।

এতক্ষণ ধরে মোবাইলের অপর পাশের সকল কথাই আমি শুনছিলাম। সেই সাথে শুনছিল রোয়েনও। হয়তো অন্য সময় হলে এইসব আমার মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি করতো না। গায়েই মাখতাম না কথাগুলো৷ কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। আজ রোয়েন আমার সামনে বসা এবং কথাগুলো উনিও শুনেছে। কথাগুলো উনি শুনেছেন বলেই আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। নয়ন দুইটি ক্ষণে ক্ষণে জ্বালা করে উঠছে। গলা ধরে আসছে। আমি নতজানু হয়ে আছি। সাহস হচ্ছে না মুখ তোলার। আমি কোন মতে বলে উঠি,

— মা পরে কথা বলি।

কথাটা বলেই আমি ভাত মাখা হাতে ফোনটা কেটে দেই। ফোনটা কেটে দিয়ে আমি চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে বাকি ভাতগুলো মাখিয়ে নিতে থাকি। কানে বাজছে নাসরিন বেগমের একটি কথা, ‘রোয়েনের এই অবস্থা নাকি আমার জন্য।’ হঠাৎ আমার কি হলো জানি না আমি নতজানু হয়ে রোয়েনকে জিজ্ঞেস করে বসলাম,

— আপনারও কি তাই মনে হয় আমি অপয়া? আমার জন্যই আপনার এই অবস্থা?

বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই নতজানু হয়ে থাকলাম উত্তরের আশায়। কিন্তু তাও কোন উত্তর না পাওয়ায় আমি মুখ তুলে তাকালাম। তাঁর নয়ন দুইটির দিকে নজর যেতেই দেখলাম তা প্রগাঢ় রক্তিম লাল। চোখে-মুখে কাঠিন্য ভাব বিদ্যমান। আমাকে তাঁর দিকে তাকাতেই উনি কাঠ কাঠ গলায় বলে,

— তোমার ভাগ্য ভালো যে আমার হাতে প্লাস্টার ঝুলছে। নাহলে আজ একটা থাপ্পড়ও মাটিতে পড়তো না।

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,

— মানে?

রোয়েন বাজ গলায় বলেন,

— নিজেকে অপয়া বলো কোন লজিকে তুমি? মুর্খ তুমি? কেউ তোমায় অপয়া বললো আর তুমি তা মেনে নিলে? আর আমার এই অবস্থার দায়ী তুমি নিজেকে কিভাবে বলে দাবী করো? তখন ছিলে তুমি আমার সাথে?

আমি কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকি। তা দেখে রোয়েন বলে উঠেন,

— স্পিক আপ ডেমিট।

আমি তাও কিছু না বলে নতজানু হয়ে যাই। দুই দিকে না সূচক মাথা নাড়াই। তা দেখে উনি কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বলেন,

— আমাদের সাথে কখন কি হবে না হবে তার নির্ধারণ কারী আল্লাহ। মানুষ না। আমাদের ভাগ্যও আল্লাহই লিখেন। যা হয় সব আল্লাহর মর্জিতে। তো সেই হিসাবে আমার সাথে যা হয়েছে তা আল্লাহর ইচ্ছায়৷ এই এক্সিডেন্ট আমার ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে৷ এতে তোমার অবদান কোথায়? বুদ্ধি খাটাও।

— হুম।

— অন্যের কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার চেয়ে নির্বোধ থাকাও শ্রেয়। ইচ্ছে তো করছে ঠাডিয়ে দেই কয়েক। তোমাকে তিনি এমন কথা কেন বলেছে তা জানার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই কিন্তু এমন ফালতু কথা কানে নিতে কে বলেছে তোমায়?

আমি মাথা উঁচু করে বলি,

— কথাগুলো কখনোই আমলে নেই না। আজও তাই। শুনতে শুনতে সয়ে গিয়েছে এইসব। কিন্তু কেন জানি না আজ আপনাকে কথাটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো তাই করলাম।

রোয়েন কিছুক্ষণ আমার দিকে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে অতি শীতল কন্ঠে বলেন,

— তাঁর কাঁটাযুক্ত বাগানে নিভৃতে ফোটে উঠা পবিত্র ফুল তুমি। যার গায়ে না আছে কোন দাগ, না আছে কোন কলঙ্ক। আছে শুধু প্রগাঢ় স্নিগ্ধতা আর পবিত্রতা।

এইটুকু বলে রোয়েন চুপ থাকে। অতঃপর বলে,

— তাঁর জীবনে আর্শীবাদ তুমি, অভিশাপ নও।

কথাটা বলেই রোয়েন দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। আর আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। মনের মাঝে থাকা কালো মেঘের কুন্ডলীকে চিরে খিলে উঠে এক চিলতে রোদ। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি। আনমনে বলে উঠি, “এই মানুষটার তীরেই আমার আসল নীড়।”

______________________

দেখতেই দেখতে মাস খানিক চলে গেল। সেই সাথে বদলে গেল জীবনের ধারাও। রোয়েন সম্পূর্ণভাবে ঠিক হয়ে গিয়েছেন আরও বিশ-পঁচিশ দিন আগেই। আর অফিসে জয়েন দিয়েছিল পা ঠিক হতেই। বাবা-মাও চলে গিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। এইদিকে আমারও ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। নতুন কিছু বন্ধুও জুটেছে৷ এর মধ্যে পুরোনো বন্ধু হলো সুরাইয়া। কচিং-এ তো একসাথে ছিলামই এখন ভার্সিটিতেও একসাথে। আমার জন্য ভালোই হয়েছে যাতায়াতের সঙ্গী আর ভালো বন্ধু হিসাবেও পেয়েছি তাকে। সেই সাথে আদিব, ইফতি, স্নেহা, নূর এদের সাথেও বেশ ভালো বন্ধুত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমার। যেমন সবকিছুতেই কিছুটা পরিবর্তন এসেছে তেমনই রোয়েনের প্রতি আমার অনুভূতিগুলোর মধ্যেও পরিবর্তন হয়েছে। আগে তাঁর জন্য আমার অনুভূতি ছিল আবছা কিন্তু এখন তা প্রগাঢ় হয়ে এসেছে। তাঁর জন্য আমার এই প্রগাঢ় অনুভূতির নাম জানা নেই আমার। এইটা তাঁর প্রতি আমার মোহ নাকি ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা আমার জানা নেই। শুধু জানি, উনি আমার পাশে থাকলে আমার আর কিছুই চাই না। আমার জন্য তাঁর মনোভাব কি তা এখনো অস্পষ্ট আমার কাছে। অবশ্য যেখানে আমার অনুভূতিগুলাই আমার কাছে অস্পষ্ট সেখানে রোয়েনের অনুভূতি কি করে বুঝি আমি? দুইজনের সম্পর্ক এখন কেমন ভাসমান৷ না আছে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের মাঝে আর না আছে সেটা বিবাহ দাম্পত্যের মাঝে। কোন এক জায়গায় সেটা আটকে আছে কিন্তু সেটা কোথায় তা হয়তো দুইজনের কারোই জানা নেই। কিন্তু মজার বিষয় হলো দিন যাচ্ছে ঠিকই আপন নিয়মে।

বৃহস্পতিবার হওয়ায় আজ আমার হাফ ডে ছিল। যার ফলে আজ আমার দুপুরের মধ্যেই বাসায় অবস্থান করার সৌভাগ্য হলো। নাহলে তো সন্ধ্যার আগে বাসায় আসাটাই দুষ্কর। দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে আসতেই দেখি বিছানার এক কোনে রোয়েন কাপড় পড়ে আছে। সেগুলো দেখে আমি কাপড়গুলো ভাঁজ করে নিলাম। অতঃপর রোয়েনের কাবার্ড খুলে কাপড়গুলো রাখতেই দেখি কাবার্ডের কাপড়গুলো আজ এলোমেলো। সচরাচর রোয়েনের কাবার্ড এলোমেলো থাকে না৷ সবসময় পরিপাটি থাকে৷ তাই আজ এমন অবস্থা দেখে বেশ ভড়কেই গেলাম আমি। কিন্তু ক্ষণেই নিজেকে সামলে গুছিয়ে দিতে থাকলাম কাবার্ডটা। গুছানোর এক পর্যায়ে হাতে ডায়েরি মত কিছু একটা পড়ে। আমি সেটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম অতি যতনে কালো মলাটে পুরানো থাকা জিনিসটি আসলেই একটি ডায়েরি। যেহেতু রোয়েনের সাইড থেকে ডাইরিটা পাওয়া সেহেতু নিসন্দেহে এইটা তাঁরই। কিন্তু রোয়েন ডায়েরি লিখে জেনে বেশ কৌতূহল হলো আমার। ইচ্ছে হলো খুলে ডায়েরিটা পড়ার। কিন্তু ভদ্রতার জন্য সেই ইচ্ছাটাকে সাই দিলাম না। কারো পারসোনাল জিনিস নিয়ে এত আগ্রহ দেখানো ঠিক না। তাই ডায়েরিটা নিজ জায়গায় রেখে দিতে নিলাম কিন্তু তার আগেই সেটা হাত থেকে ফঁসকে নিচে পড়ে যায়। মেঝেতে পড়ে মাঝের কিছু বদ্ধ পৃষ্ঠা উন্মুক্ত হয়ে আসে আমার সামনে। আমি সেটা উঠাতে গিয়ে না চাইতেও চোখ পড়ে যায় কিছু লাইনের উপর। যা দেখা মাত্র আমি স্তব্ধ হয়ে যাই।

“হয়তো তুমি আমার ভাগ্যে নেই। হয়তো বা তুমি আমার ধরা-ছোয়ার বাহিরে। হয়তো তুমি সেই অমূল্য রত্ন যাকে নিয়ে ভাবাও আমার জন্য বিলাসিতা। কিন্তু আসলেই কি তাই? হয়তো তাই।

— আমি ভেবে নিলাম
তুমি সেই লাল গোলাপ
যাকে নিরন্তর পাহাড়া দেয় এক কাটার বাগান।”

#চলবে