নিভৃতে যতনে পর্ব-২৮+২৯

0
1059

#নিভৃতে_যতনে
#Part_28
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

ডায়েরির সাদা পাতার উপর গোটা অক্ষরে লিখা চরণগুলো চোখের দৃষ্টিতে পড়তেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। স্থির হয়ে আসে দৃষ্টি। সেই সাথে মনের মাঝে জাগে কৌতূহল। প্রবল ইচ্ছা জাগে জানার,” এই চরণগুলো আসলে কার জন্য লিখা? এতটা আবেগ আর বিষাদ মিশ্রিত শব্দ রোয়েন ব্যবহার করেছে কার জন্য?” নিজের মনের কৌতূহল আর ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে না পেরে ডায়েরিটা হাতে তুলে নেই। সামনের দিক থেকে কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টাতে কিছু চরণের উপর এসে দৃষ্টি স্থির হয়,

” জীবনের সারণী সাদা খাতায় ফুটিয়ে তোলা রেওমিলের ছকের মতো কিন্তু হিসেব অগোছালো। রেওয়ামিলের হিসাব তো মেলানো যায় সঠিক নির্দেশনায়! কিন্তু,জীবনের হিসেবের খাতায় সঠিক পরিচালক না হলে সব এলোমেলো ঝড়া পাতার মতো হয়”

কথাগুলো পরে আমি পরের পৃষ্ঠা উল্টালাম। পরের পৃষ্ঠায় লিখা,

” আসলেই হুমায়ুন আহমেদ ঠিক বলেছেন, এই পৃথিবীতে প্রায় সবাই, তার থেকে বিপরীত স্বভাবের মানুষের সঙ্গে প্রেমে পড়ে। উদাহরণস্বরুপ আমি।”

পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখে পরে,

” পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন সমীকরণ হচ্ছে অনুভূতির সমীকরণ। এর মারপ্যাঁচ কখনই ধরা যায় না। যেমন আমি ধরতে পারছি না।”

আমি এই তিন পৃষ্ঠা পড়ার পর পুরো ডায়েরি একবার নেড়ে চেড়ে দেখি। ডায়েরিটা নরমাল ডায়েরির মত লিখা না। যেমনটা সাধারণত সকলে লিখে তেমন লিখা না। তার চেয়ে এইটা একটু ভিন্ন। ছোট ছোট এমন অসংখ্য অনুভূতির প্রকাশ এতে লিখা আর সেইসবের মাধুর্যও খুব গভীর৷ মানুষটা যেমন স্বল্পভাষী ঠিক তেমনই তাঁর ডায়েরিটাও। আমি যেখানে পড়া থামিয়েছিলাম সেখানে ফিরে যেতেই ডোরবেল বেজে উঠে। শব্দটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র আমি ভড়কে যাই, চোরা চোখে তাকাই ঘড়ির দিকে। সাড়ে চারটার বেশি বাজে। নিজেই ভাবতে থাকি, এই সময় কে আসলো? তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো আজ তো বৃহস্পতিবার। উনার তো আজ হাফ ডে। নিশ্চয়ই এখন রোয়েন এসেছেন। আমি চট জলদি উঠে ডায়েরিটা আমার সাইডের কাবার্ডে লুকিয়ে রাখলাম। পলি আন্টিকে দরজা খুলতে বলে মুহূর্তেই আমি রোয়েনের কাপড়গুলো ভাঁজ করতে শুরু করি। সেই সাথে, নিজেকে শান্ত রাখারও চেষ্টা করতে থাকি। ভাব এমন যে, এই বুঝি চুরি করতে গিয়ে ধরা খাওয়ার আগ মুহূর্তে বেঁচে গিয়েছি। হৃদস্পন্দন চলছে তার সর্বোচ্চ গতিতে। কখন না জানি ফুলস্টপ মেরে বসে।

কিছু প্রহর অতিক্রম হতেই রোয়েন ক্লান্ত পায়ে রুমে প্রবেশ করে। আমি একবার তার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেই। উনি বিছানার পাশে হেলমেট আর ব্যাগটা রেখে ক্লান্ত কন্ঠে বলেন,

— আমার সব কাপড়চোপড় নামালে যে?

আমি নিজেকে শান্ত রেখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলি,

— ধোঁয়া জামাগুলো রাখতে গিয়ে দেখি সব এলোমেলো হয়ে আছে তাই ভাবলাম ভাঁজ করে দেই।

উনি নিজের গলার টাই ঢিলে করতে করতে বলেন,

— আমি পরে গুছিয়ে নিতাম নে।

তাঁর কথা শুনে আমার কি হলো জানি না, আমি অকপটে জিজ্ঞেস করে উঠি,

— আমি করলে দোষ কোথায়?

উনি আমার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

— তুমি করলে দোষ কেন হবে?

আমি মুখ ফিরিয়ে কাপড় ভাঁজ করতে করতে বলি,

— না এমনি! আমি কিছু করলে আপনার ভালো নাও লাগতে পারে।

কথাটা শুনে রোয়েন কিছুক্ষণ আমার পানে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর আমার বা বাহু টেনে ধরে তাঁর দিকে ঘুরিয়ে নেন আমায়। আমাকে তাঁর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

— তোমার কি হয়েছে? আজ এমন রাফ বিহেভ করছো কেন?

কথাটা শুনে আমি কিছুক্ষণ নীরব থাকি। আনমনে ভাবতে থাকি, “আসলেই আমি এমন কেন করছি? কেন মন আমার আজ এত বিষাদময়? কষ্ট কেন হচ্ছে আমার? কেন রোয়েনকে দেখা মাত্র বার বার আমার ওই ডায়েরির লিখাগুলো চোখের সামনে ভাসছে? ক্ষণেই বুকের মাঝে রক্তক্ষরণ কেন হচ্ছে? রুষ্টু কেন হচ্ছি আমি? কেন? কেন?”
শত প্রশ্নগুলোর ভিড়ে একটারও সঠিক উত্তর খুঁজতে না পেরে আমি মিইয়ে যাই। বাহানা দিয়ে দেই,

— মুড সুইং হচ্ছে। কখন কিরকম বিহেভ করছি বুঝতে পারছি না।

রোয়েন চিন্তিত কন্ঠে বলেন,

— বেশি খারাপ লাগছে?

আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলি,

— না।

রোয়েন আমার বাহু ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলেন,

— ইউ নিড এ রিফ্রেশমেন্ট। সন্ধ্যায় রেডি থেক।

কথাটা বলেই তিনি বারান্দা থেকে টাওয়ালটা নিয়ে চলে যান ফ্রেশ হতে আর তাকিয়ে থাকি তাঁর পানে। মানুষটা প্রকাশ্যে নাহলেও নিভৃতে ঠিকই বুঝিয়ে দেয় আমার প্রতি তাঁর যত্নগুলো। চিন্তাগুলো৷ এরপরও কি তাঁর উপর রুষ্টু থাকা যায়? কেন জানি না, এই মানুষটার উপর এক আলাদা অধিকারবোধ কাজ করে। আমি সবকিছুর ভাগ দিতে রাজি কিন্তু এই মানুষটার ভাগ আমি কাউকে দিতে রাজি না। তাই বলে কি, ডায়েরির পাতায় অন্য এক নারীকে নিয়ে লিখা কাব্যিক কথাগুলো পড়ে আমার ঈর্ষা হচ্ছে? তাঁকে হারানোর ভীতি কাজ করছে আমার মাঝে? কিন্তু তাঁর প্রতি আমার মনোভাব কি? ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা?

______________________

সেদিনের পর ডায়েরিটা পড়ার সুযোগ আমার আর হলো না। বিভিন্ন ব্যস্ততা আর সময়ের স্বল্পতার ফলে ডায়েরিটা ধরাই হয়নি। সারাদিন আমার পার হয় ভার্সিটির প্রাঙ্গণে আর সন্ধ্যায় বাসায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতে রোয়েনও এসে হাজির হয়। ভার্সিটি নিয়ে যে ডায়েরিটা পড়বো তারও উপায় নেই৷ সবসময় বন্ধুমহলের মাঝেই থাকতে হয় আমায়। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ডায়েরিটা পড়া অসম্ভব৷

চৈত্রের শেষ ভাগ। শৈত্য প্রবাহ এখনো বিরাজমান। উত্তরা বাতাসের রাজত্ব এখনো চলছে। সেই সাথে আগমন হতে চলেছে বৈশাখের। ঢাকা ভার্সিটির প্রাঙ্গণ সজ্জিত হতে চলেছে ফুলে ফুলে। সেই নিয়ে সকলের কতই না উচ্ছাস। বৈশাখকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ভার্সিটিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। তা নিয়েই আলোচনায় মত্ত সবাই। টিচারও কাজ ভাগ করে দিচ্ছে সকলের মাঝে। এইসব আয়োজনের মাঝে আজ আমাদের সকালের ক্লাসটা বাদে বাকি ক্লাসগুলো স্থগিত হয়ে যায়। যেহেতু ভার্সিটিতে আমার আর কোন কাজ নেই সেহেতু আমি আর ভার্সিটিতে না থেকে চলে আসি বাসায়। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বসি ডায়েরিটা। যেখান থেকে পড়া ছেড়েছিলাম শুরুও করলাম সেখান থেকেই।

“ভালোলাগা আর ভালোবাসা হচ্ছে পৃথক সত্তা। এদের ব্যখ্যা আর সমীকরণও আলাদা। কিন্তু তাও আমি দুইটার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করতে পারছি না। দুইটাকেই গুলিয়ে ফেলছি। আদৌ সে আমার ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা?”

উপর পৃষ্ঠা উল্টাতে দেখি,

“পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। কিন্তু এর মধ্যে প্রেমের অত্যাচার হচ্ছে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলা যায় না আবার সহ্যও করা যায় না।”

আমি একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখতে থাকি সবগুলো। হঠাৎ এক জায়গায় এসে দৃষ্টি স্থির হয় আমার।

“প্রেম-ভালোবাসা হচ্ছে মরীচিকার মত। যখনই সেটা আগলে ধরে মানুষ বাঁচতে চায় তখনই তা নিমিষেই মিইয়ে গিয়ে চরম বাস্তবতা দেখিয়ে যায়।”

এরপরের পৃষ্ঠায় লিখা,

” পৃথিবীতে বোঝাপড়া, রুজি- রোজগার, জীবনযাত্রার মান আর শরীরের চাহিদার সামনে প্রেম-ভালোবাসা অতি ঠুনকো।”

এরপরই আসে সেই কাঙ্ক্ষিত চরণটি,

” হয়তো তুমি আমার ভাগ্যে নেই। হয়তো বা তুমি আমার ধরা-ছোয়ার বাহিরে। হয়তো তুমি সেই অমূল্য রত্ন যাকে নিয়ে ভাবাও আমার জন্য বিলাসিতা। কিন্তু আসলেই কি তাই? হয়তো তাই।

— আমি ভেবে নিলাম
তুমি সেই লাল গোলাপ
যাকে নিরন্তর পাহাড়া দেয় এক কাটার বাগান।”

আমি এই কথাগুলো দ্বিতীয়বার পড়ার পর কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকি। ভিতরে ভিতরে বেশ কষ্ট পাচ্ছি আমি। শ্বাস আটকে আসছে। কান্নাগুলো দোলা পাকিয়ে আসছে কণ্ঠনালীর মাঝে। আমার আগে রোয়েনের জীবনে একজন ছিল তা আমার অজানা নয়। রোয়েন তো আমায় নিজ থেকেই বলেছিল তাঁর জীবনে একজন ছিল। যে তাঁকে ছ্যাঁকা দিয়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু তখন সেটা শুনে এতটা কষ্ট হয়নি যতটা না আজ সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে নিয়ে লিখা রোয়েনের মনোভাবগুলো পড়ে হচ্ছে। বার বার বিষিয়ে যাচ্ছি আমি। আমি সাহস করে পরের পাতা উল্টালাম। তাতে লিখা,

” জীবনে দুই-একটা ভুল সম্পর্কে জড়ানো উচিৎ, পৃথিবীর কঠোর বাস্তবতা বুঝার জন্য।”

পরের পাতায় লিখা,

“আজ বছর খানিক পর বুঝতে পারলাম তোমার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো। বুঝতে পারলাম আমাদের সম্পর্কটা। তোমার আমার মধ্যে যা ছিল তা নিছক প্রেমের সম্পর্ক। ভালোবাসার না৷ ভালোবাসার সম্পর্ক হলে হয়তো আমি দিব্যি চলতে পারতাম না।”

সর্বশেষ পাতায় লিখা,

” ভালোবাসা,ভালোলাগা আর আবেগের মধ্যে পার্থক্য বুঝানোর জন্য ধন্যবাদ তাকে।”

এরপর আর কিছু লিখা নেই। পুরো ডায়েরিটা পড়ে আমি নীরব। কেন জানি মানতে পারছি না বিষয়টা। ডায়েরির প্রত্যেকটা কথা যে তিনি তাঁর প্রাক্তনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু মনের মাঝে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল, “সেই মানুষটি রোয়েনের ভালোবাসা ছিল নাকি আবেগ ছিল?” ডায়েরির কোথাও স্পষ্ট লিখা নেই তাঁর প্রতি রোয়েনের ঠিক অনুভূতিটা কি ছিল। লিখা পড়ে তো মনে হচ্ছে সেটা উনার আবেগ ছিল। কিন্তু আদৌ কি তাই? হঠাৎ টনক নাড়ে, “উনার জীবনের প্রথম নারী আমি নই। তাঁর কোন কিছুতেই আমি প্রথম না।” কথাটা ভাবা মাত্র আমি দুমড়ে মুচড়ে যায়। বিষিয়ে যাওয়া মন নিয়ে রোয়েনের কাবার্ডে কাপড়ের ভাঁজে সপ্তপর্ণে রেখে দেই ডায়েরিটা। অতঃপর পলি আন্টিকে বলে হাটা দেই ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

________________________

চৈত্র মাসে সাধারণত বৃষ্টি হয় না। কিন্তু কেন যেন আজ প্রকৃতি তার বিধানের উল্টো নিয়মে চলছে। আকাশটা আজ বিষন্নতায় ঘেরা। কালো ঘন মেঘের হাতছানি। ঝোড়ো হাওয়া বইছে। দূর আকাশে মেঘরা মৃদুস্বরে ডেকে উঠছে। হয়তো ক্ষণের মাঝেই ঝুম বৃষ্টি নামবে। সেই বিকেল থেকেই আমি ছাদে। বিষন্ন চোখে দেখছি পরিবেশটা। বৃষ্টি নামবে যেনেও আমি নামছি না ছাদটি থেকে, স্থির দাঁড়িয়ে আছি। কিছুই যে ভালো লাগছে না আমার। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই থাকার পর আমার বাহুতে টান অনুভব করি। আমি পিছে ঘুরে তাকাতেই দেখি রোয়েন। উনি আমার দিকে রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি পিছনে ঘুরে দাঁড়ানো মাত্র তিনি গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

— এই সময় ছাদে কি করছো তুমি? দেখছো না আকাশ খারাপ করছে? তাও নিচে নামছো না কেন?

আমি বেশ কিছুক্ষণ রোয়েনের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— আজ আমায় একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন? উত্তরটা না জানা পর্যন্ত আমি শান্ত হতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।

রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলেন,

— কি জানতো চাও তুমি?

আমি অকপটে জিজ্ঞেস করি,

— আপনার প্রাক্তন কি আপনার আবেগ ছিল নাকি ভালোবাসা?

— হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?

— জানতে চাই আমি এই প্রশ্নের উত্তর।

রোয়েন কিছুক্ষণ চুপ থেকে শীতল কন্ঠে বলেন,

— আবেগ ছিল।

— আর আমি?

রোয়েন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে বলে,

— মানে?

আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— আমি আপনার কি? আমার জন্য আপনার অনুভূতি কি?

— তোমার আজ কি হয়েছে? এইসব প্রশ্ন কেন করছো?

আমি আমার বাহু থেকে রোয়েন হাত সরিয়ে বলি,

— কারণ আজ আমি এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই। জানতে চাই আমি আপনার কি হই? আপনার জীবনে আমার জায়গায়টা আসলে কি?

রোয়েন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

— নিচে চলো।

— কেন? উত্তর নেই আপনার কাছে? সে তো আপনার জীবনে প্রথম নারী ছিল। কিন্তু আমি?

রোয়েন আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— আমার প্রাক্তন আমার অতীত যার বর্তমানে কোনে অস্তিত্ব নেই আর না কখনো থাকবে। কিন্তু হঠাৎ তুমি অতীত কেন টানছো? আর এইসব প্রশ্নই বা কেন করছো?

আমি মুখ ঘুরিয়ে বলি,

— জানি না কেন করছি। কিন্তু আজ আমার সকল প্রশ্নের উত্তর চাই এই চাই।

রোয়েন আমার সামনে এগিয়ে এসে বলেন,

— আমার প্রাক্তন আমার অতীত আর তুমি আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সে আমার জীবনে প্রথম নারী হলেও আমার জীবনের শেষ নারী কিন্তু তুমিই। অর্ধাঙ্গিনী তুমি আমার। তোমার সাথে তো ওর কোন তুলনা হয় না আর কখনো হবেও না।

— কিন্তু তাও যে আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে এইসব। কেন কষ্ট হচ্ছে জানি না শুধু জানি প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।

হঠাৎ আকাশে বাজ পড়ে শুরু হয় মুষলধারের বৃষ্টি। বৃষ্টির বড় বড় কণা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে যেতেই ভড়কে যাই দুইজনেই। দুইজনের মধ্যে বেশ দূরত্ব না থাকায় বৃষ্টির এই ধারার মাঝেও দুইজনেই চেয়ে থাকি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে একে উপরের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিক্রম হতেই রোয়েন আরেকটু এগিয়ে এসে আমার চর্বিযুক্ত গালের হাত গলিয়ে দিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলেন,

— ভালোবাসো আমায়?

কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র ভড়কে যাই আমি। শরীরের মধ্যে বয়ে শীতল এক শিহরণ। আমি নিজের দৃষ্টি নামিয়ে বলি,

— জানি না।

উনি নির্লিপ্ত কন্ঠে উত্তর দেন,

— যে প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই জানো না সেই প্রশ্নের উত্তর তুমি আমার কাছে আশা করছো? স্ট্রেঞ্জ!

রোয়েন আমার এত কাছে থাকায় আমার এখন প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। ভিতরটা ক্ষণেই এলোমেলো হয়ে আসলো। যে প্রশ্নের উত্তর গুলো জানার জন্য এতক্ষণ অস্থির হয়ে ছিলাম তা নিমিষেই চলে গিয়েছে। আমি কোনমতে বলে উঠে,

— আমি নিচে যাব।

উনি নরম সুরে বলে,

— উত্তর না নিয়েই চলে যেতে চাচ্ছো?

আমি দৃষ্টি তুলে জিজ্ঞেস করি,

— তাহলে দেন উত্তর। আমি আপনার কি?

উনি নমনীয় গলায় বলেন,

— আবেগ আর ভালোলাগার উর্ধ্বে তুমি। আমার সকল অনুভূতির শিরোনাম তুমি। আমার জীবনের শেষ পরিনতি তুমি।

আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বলি,

— উত্তরটা কিন্তু এখনো ঘোলাটে।

রোয়েন কিছু না বলে আমার দৃষ্টিতে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নেয়। পানির বিন্দু বিন্দু কণা তাঁর মুখশ্রী ছুঁয়ে দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আমার মুখমন্ডলের উপর। ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার চর্বিযুক্ত গাল,ঠোঁটযুগল। বেশ কিছু সময় পেরুতেই আমি দৃষ্টি নত করে নেই। হঠাৎ রোয়েন আমার মুখ উঁচু করে সপ্তপর্ণে নিজের ভেজা অধরযুগলের মাঝে আমার অধরযুগল নিবদ্ধ করে ফেলেন। ঘটনাক্রমেই বুঝতেই সারা শরীরে আমার শিহরণ বয়ে যায়। অবাকে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। নড়তে পর্যন্ত ভুলে যাই আমি। ঘোরের ভিতর চলে যাই আমি।

বেশ কিছুক্ষণ পর রোয়েন একটু সরে আসতে আমি ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসি। ছিটকে সরে দাঁড়াই তাঁর কাছ থেকে। লজ্জায় নতজানু হয়ে আছি আমি। গাল দুইটির মাঝে ফুটে উঠেছে রক্তিম লালাভ আভা। আমি কিছু না বলে তাঁর পাশ কাটিয়ে আসতে নিলে উনি আমার হাত চেপে ধরে বলে,

— কি পেয়েছ তোমার স্পষ্ট উত্তর?

আমি বুঝতে পেরেছি তাঁর উত্তর কিন্তু লজ্জায় আর সংশয়ের ফলে গলায় দিয়ে আমার একটা শব্দও বের হচ্ছে না। আমি কোন মতে তাঁর থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে আসি নিচে। আমার হৃদস্পন্দন যেন তার সর্বোচ্চ গতিতে চলছে। চারদিকে যে সেই ধ্বনি কম্পিত হচ্ছে.. ধুকধুক..ধুকধুক। সকলেই হতো শুনতে পাচ্ছে সে ধ্বনি। কি লজ্জা! কি লজ্জা! এইদিকে শীতের মৌসুমে বৃষ্টি ভিজে এখন শীতে আমি কাত। থরথর করে কাঁপছি আমি। টলমল পায়ে এসে পৌঁছাই দরজার সামনে। দরজার হ্যান্ডেল ঘুরাতেই বুঝতে পারি দরজা ভিতর দিয়ে বন্ধ। আমি চঞ্চল ভঙ্গিতে চাপতে থাকি ডোরবেলের সুইচ। কিন্তু কেউ এসে দরজা খুলে না। হঠাৎ পিছন থেকে রোয়েন বলে উঠেন,

— বাসায় কেউ নেই। দরজার চাবি আমার কাছে।

রোয়েনের কন্ঠ কর্ণপাত হতেই আমি স্থির হয়ে যাই। তৎক্ষনাৎ দূরে সরে দাঁড়াই। গুটিয়ে নেই নিজেকে। বুঝতে দেরি নেই রোয়েন আসা মাত্র পলি আন্টি বেরিয়ে গিয়েছেন। রোয়েন আর কিছু না বলে দরজা খুলে দেন। উনি ভিতরে যেতেই আমিও চলে ভিতরে। মাথা নত করে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে নেই রুমের দিকে। হঠাৎ নিজের ডান বাহুতে দ্বিতীয় বারের মত টান অনুভব করি। আমি পিছনে না ঘুরে কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে বলি,

— কিছু কি বলবেন?

উনি আমার একটু কাছে এসে বলেন,

— তুমি নামক অসুখে আজ আমি আক্রান্ত। গুরুতরভাবে আক্রান্ত। এই অসুখ ছাড়াতে যে এখন আমার তোমাকে প্রয়োজন। তুমি কি দায়িত্ব নিবে আমার অসুখ নিরাময় করার? নিবারিত কি হবে আমার মাঝে?

অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বলেন,

— আজ নিজের সীমা লঙ্ঘন করতে চাই আমি। তোমাতে রাঙ্গাতে চাই এই আমিটাতে। তুমি কি অনুমতি দিবে আমায় সকল সীমা লঙ্ঘন করার?

#চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_29
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

গোধূলির লগ্ন। পশ্চিমাকাশে ছেঁয়ে আছে হলদেটে ভাব। পাখিরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটে চলেছে আপন নীড়ে। আমি বারান্দায় রাখা বেতের মোড়ার উপর বসে আছি। হাতেই ধোঁয়া উঠানো এক কাপ কফি। দৃষ্টি নিবদ্ধ কমলা রাঙ্গা ডুবন্ত সূর্যটির দিকে। কফির কাপে একটু চুমুক দিতেই কোথ থেকে এক জোড়া চড়ুই পাখি এসে বসে বারান্দার কার্নিশে। ক্ষণেই বাতাসে কিচিরমিচির শব্দ তুলে মেতে উঠে খুনসুটিতে। তাদের দেখা মাত্র আমি নিরব হয়ে যাই। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকি তাদের। অতঃপর আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই চোখ আটকে যায় বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা রোয়েনের একটি টি-শার্টের দিকে। টি-শার্টটি দেখা মাত্র চোখে ভেসে উঠে রোয়েনের চেহেরা। সেইসাথে মনে পড়ে যায় চৈত্র মাসের অনাকাঙ্ক্ষিত সেই বর্ষণের রাতের কথা। মুহূর্তেই আমার চর্বিযুক্ত গাল দুইটি হয়ে উঠে রক্তিম লাল। লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলি আমি। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস নেই।

সেদিন রোয়েনের এহেন প্রস্তাবে আমি ক্ষনিকের জন্য ভড়কে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরমুহূর্তেই লজ্জায় মিইয়ে গিয়েছিলাম। গা মৃদু পরিমাণে কাঁপছিল আমার। যেখানে আমার বিভ্রান্তিতে পড়ার কথা সেখানে সপ্তপর্ণে মুখ লুকিয়ে ছিলাম তাঁর বুকে। তাঁর বুকে মাথা রাখতেই যেন এক আলাদা প্রশান্তি অনুভব করি। সেই সময় আমার মধ্যে না ছিল কোন সংশয়, না ছিল কোন আড়ষ্টতা। ছিল এক অদ্ভুত ভালোলাগা। কোন এক অদৃশ্য কারণে তাঁকে আমি কখনো ‘না’ করতে পারি না, সেইদিনও পারিনি৷ নীরবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলাম তাঁর মাঝে। সাঁই জানিয়েছিলাম তাঁর প্রস্তাবে। অতঃপর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বর্ষণের অনাকাঙ্ক্ষিত সেই প্রহরে পূর্ণতা পেয়েছিল আমাদের সম্পর্ক। রচিত হয়েছিল নতুন এক জীবনের সূচনা।

হঠাৎ চারদিকে মাগরিবের আযান প্রতিধ্বনিত হতেই আমি উঠে রুমে চলে আসি। ওযু করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে রোয়েনের জন্য এক সেট কাপড় বিছানায় রেখে চলে যাই রান্নাঘরে। এক কাপ কফি চুলোয় চড়িয়ে দেই রোয়েনের জন্য। কফি যখন প্রায় হয়ে এসেছে ঠিক তখনই ডোরবেল বেজে উঠে। পলি আন্টি গিয়ে দরজা খুলে দেয়। অতঃপর রোয়েন রুমে চলে যেতেই পলি আন্টি নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আমায় বলে চলে যায়। আমি দরজাটা আটকে এসে কফিটা কাপে ঢেলে নেই। অতঃপর অগ্রসর হই রুমের দিকে। রুমে আসতেই দেখি রোয়েন মাত্র ফ্রেশ হয়ে বের হচ্ছেন। আমি তাঁর দিকে এক পলক তাকাতেই দৃষ্টি নত করে ফেলি। সেদিনের পর থেকে তাঁর দৃষ্টির সামনে আসতেই লজ্জা আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। তাঁর দিকে দৃষ্টি স্থির রাখাটাই দুষ্কর হয়ে পড়ে আমার জন্য। এই যে যেমন এখন হচ্ছে। আমি কফির কাপটা সাইড টেবিলের উপর রেখে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পা চালাতে শুরু করি। এর মাঝেই ডান বাহুতের গভীর টান অনুভব করতে সামনে দিকে এগোনোর বদলে কয়েক কদম পিছিয়ে আসি। আমি কিছু বলতে যাবো তাঁর আগে রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠেন,

— দুইদিন ধরে খেয়াল করছি তুমি আমায় এড়িয়ে চলছো, সমস্যা কি?

আমি কম্পিত কন্ঠে বলি,

— কোথায় এড়িয়ে চলছি?

— তা না হলে এখন কি করছো?

আমি তাঁর দিকে কিছুটা ঘুরে হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বলি,

— আরেহ ধুর! ছাড়েন তো, পড়া আছে আমার।

রোয়েন ভ্রু কুঁচকে বলেন,

— এই কয়েকমাসে একবারও তো ঠিক মত বই ধরতে দেখলাম না আর আজ বলছো পড়া আছে?

আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলি,

— আজ আছেই বলেই বলছি।

— অজুহাত দিয়ে কাটিয়ে দিতে চাইছো বিষয়টা?

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি,

— তেমন না বিষয়টা?

রোয়েন আমার হাতের কব্জি ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে দাঁড় করালেন। মুখোমুখি হয়ে বললেন,

— তাহলে কেমন? এড়িয়ে কেন চলছো আমায়?

আমি কিছু না চুপচাপ দৃষ্টি নত করে দাঁড়িয়ে থাকি। আনমনে তাঁর ছুটে পালানোর রাস্তা খুঁজতে থাকি। রোয়েন কিছুক্ষণ উত্তরের আশায় আমার মুখ পানে তাকিয়ে থাকেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন আমার আকার-ভঙ্গি। অতঃপর স্বাভাবিক সুরেই বলেন,

— তুমি আমার সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছো?

আমি মাথা নুইয়ে বলি,

— হুম।

রোয়েন এইবার নিঃশব্দে হেসে উঠে। হাসির দুই ধারে বেরিয়ে আসে গজদাঁত দুইটি। বরাবরের মতই অমায়িক সেই হাসিটি৷ আমি একপলক সেই হাসির দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলি। সে কি জানে? তাঁর এই হাসিতে আমি বারংবার খুন হই? হঠাৎ রোয়েন নিজের হাতের তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকের মাঝ দিয়ে আমার থুতনি চেপে ধরে মুখটা উঁচিয়ে রসিকতা সুরে বলেন,

— আমি তো তাঁর লজ্জা ভেঙ্গেই দিয়েছি তাহলে সে এত লজ্জায় পায় কিভাবে?

কথাটা শোনা মাত্র আমি রোয়েনের বুকে মুখ লুকিয়ে বলি,

— জানি না।

রোয়েন হেসে ফিসফিসিয়ে বলেন,

— লজ্জা পেলে কিন্তু তাকে চ্যারির মত লাগে। ইচ্ছে করে…

আমি তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই ছিটকে সরে দাঁড়াই। স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠি,

— দিন দিন নির্লজ্জ হচ্ছেন আপনি।

রোয়েন পুনঃরায় নিঃশব্দে হেসে উঠেন। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসতে বসতে বলেন,

— যার বউ এত লজ্জা পায় তার বরকে তো না চাইতেও নির্লজ্জ হতেই হয়।

__________________

কালকে পহেলা বৈশাখ। সেই উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম খুব সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে। সকলের মধ্যে কাজ ভাগ করে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন টিচাররা। কমনরুমে চলছে গান ও নাচের রিহার্সাল। চেয়ার সাজানোর দায়িত্ব পড়েছে ইফতি,নূরের উপর আর আলপনা করার দায়িত্ব পড়েছে আমার উপর। স্নেহা আর আদিবকে ম্যাম বাহিরে পাঠিয়েছে কি যেন এক কাজে। এইদিকে কাজ করতে হবে বলে সুরাইয়া আগে ভাগেই অসুস্থতার বাহানা দিয়ে ভেগেছে। আস্ত কামচর একটা। আমি আনমনে আলপনা করছি তখন দূর থেকে ইফতি চেঁচিয়ে বলে,

— ওই সিয়া! তোর ফোন বাজতাসে।

আমি চকিত দৃষ্টি ইফতির দিকে তাকিয়ে বলি,

— আমার ফোন কি তোর কাছে?

ইফতি আমার ব্যাগ উঁচিয়ে বলে,

— হো। আলপনা করার আগে না তুই আমাকে দিয়ে গেসিলি৷

আমি আলপনা ঠিক করতে করতে বলি,

— তাইলে মোবাইলটা এইদিকে নিয়ে আয়। এখন উঠতে পারবো না।

ইফতি ফোন বের আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,

— ওই মাইয়া! এই ‘খারুশ’ কেডা? দশবারের উপরে ফোন দিসে তোরে।

কথাটা কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতে দেরি কিন্তু আমার লাফ মারতে না। মূহুর্তেই আমি ভড়কে গিয়ে বলি,

— কয়বার ফোন দিসে?

ইফতি আমার দিকে ফোনটা এগিয়ে বলে,

— কানে কি কম শুনোস? বলসি না একবার?

আমি ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকি। অতঃপর উঠে রঙ লাগানো হাতেই ইফতির পিঠে ধুপধাপ দুইটা কিল মেরে বলি,

— এতবার ফোন আসার পর তুই এখন এসে বলছিস আমার ফোন এসেছে? তোকে রাখতে দিসিলাম কেন ফোন তাইলে আমি? কানে আমি কম শুনি না তুই?

ইফতি নিজের পিছনের শার্টের অংশটুকু টেনে সামনে এনে ধরে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,

— এইটা কি করলি তুই? দুইদিন আগেই শার্টটা নামাইসিলাম। ঘামের গন্ধও লাগে নাই ঠিক মত শার্টে তার আগেই তুই এইটা নষ্ট করে দিলি? আল্লাহ গজব ফালাইবো তোর উপরে দেখে নিস।

আমি বিরবির করে বলি,

— আমার উপরে যে এখন কোন গজব পড়বো আল্লাহই জানে।

এর মাঝে নূর এসে বলে,

— কি বিরবির করছিস?

আমি চোখ মুখ বিরক্তি ঘুচে বলি,

— আন্ডা বলছি। বলবি তুই আমার সাথে?

নূর এইবার স্মিত হেসে বলে,

— ওইদিকে শোরগোল বেশি ছিল তাই হয়তো শুনে নাই ওই। এত প্যারা কেন নিচ্ছিস?

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই আমার ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে ভেসে উঠে ‘খারুশ’ নামটি। আমি কিছু না বলে ওদের থেকে সরে এসে ফোনটা রিসিভ করতেই উনি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,

— ফোন কই থাকে তোমার? কয়বার কল দিয়েছি দেখেছো?

আমি আমতা আমতা করে বলি,

— খেয়াল করি নি।

— বাইরে এসো।

আমি অকপটে জিজ্ঞেস করে উঠি,

— কেন?

— আসতে বলেছি আসবে। কোন কথা না আর সন্ধ্যা কয়টা বাজে সেই খেয়াল আছে কি তোমার?

আমি একবার ফোনে সময় দেখে নিলাম। সাড়ে ছয়টার মত বাজে। তা দেখামাত্র আমি বিনয়ী সুরে বলি,

— কাজ করছিলাম তাই খেয়াল ছিল না। হাতের কাজটা সেরেই আমি দ্রুত আসছি৷

— হারি আপ!

কথাটা বলেই তিনি ফোন কেটে দেন আর আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি। ভেবেছিলাম মহাপ্রলয় শুরু হবে কিন্তু তা হয়নি। আমি দ্রুত নিজের কাজটা শেষ করে হাত না ধুয়েই ইফতি আর নূরকে বলে চলে আসি বাইরে। গেটের বাইরেই আসতে দেখি রোয়েন বাইকের সাথে হেলান দিয়ে পা দুইটি আড়া-আড়িভাবে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি তার নিবদ্ধ মুঠোফোনের উজ্জ্বল স্ক্রিনের দিকে। আমি নিঃশব্দে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে হালকা কেশে উঠতেই তিনি আমার দিকে চোখ তুলে তাকান। আমি স্মিত হেসে বলি,

— হঠাৎ এইদিকে আসলেন যে?

রোয়েন নিজের মুঠোফোন বন্ধ করে পকেটে ভরতে ভরতে বলেন,

— একটা মেয়েকে লিফট দিয়েছিলাম এইদিকটায়। তো তাকে নামিয়ে যাওয়ার পথে ভাবলাম তোমায়ও লিফট দেই।

কথাটা শোনামাত্র আমার ঠোঁটের কোনে ঝুলে থাকা হাসিটি উধাও হয়ে গেল। চোখে-মুখে নেমে এলো অন্ধকার। আমি চোখ মুখ শক্ত করে বলি,

— বাজে বকা বন্ধ করুন।

রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলেন,

— কি বাজে বকলাম?

আমি মুখ ঘুরিয়ে অভিমানী সুরে বলি,

— কিছু না। আর আপনি চলে যান চাই না আপনার লিফট আমি। একাই চলে যেতে পারবো আমি।

— তা তো হচ্ছে না। আমি যেহেতু এসেছি সেহেতু যেতে তো তোমায় আমার সাথেই হবে।

আমি নাকছ করে বলি,

— যাব না আমি।

— তোমার থেকে কেউ তোমার মতামত চায়নি।

কথাটা বলে তিনি আমার হাতের কব্জি ধরে টান দিতেই তাঁর নজরে পড়ে বিভিন্ন রঙে মাখা আমার হাতটি। তা দেখে তিনি বলেন,

— হাত ধুয়ো নি কেন?

আমি স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠি,

— ইচ্ছা।

রোয়েন কিছু না বলে বাইকের সিট উঠিয়ে ভিতর থেকে পানির বোতল বের করে আমায় টেনে নিয়ে যায় রাস্তার ধারে। নিজেই খুব সপ্তপর্ণে ধুয়ে দেন আমার হাত। আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। কেন যেন সবকিছুই আমার অসহ্য লাগছে। আমার হাত ধুয়ে দিয়ে তিনি আমায় টেনে নিয়ে নিজের বাইকের কাছে নিয়ে যান। আগে নিজে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিয়ে আমায় উঠে বসতে বলেন। আমি বিনাবাক্যে উঠে পড়ি তার বাইকে। টু শব্দ পর্যন্ত করিনা। কারণ জানি সে যে পরিমাণে ঘাড়ত্যাড়া আমাকে না নিয়ে সে যাবেই না। কিন্তু তাই বলে নিজের অভিমান ফেলে দেইনি আমি। তাঁর থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে চুপটি মেরে বসি যাতে তাঁর শরীরের সাথে আমার স্পর্শ না লাগে। রোয়েন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যখন দেখলেন আমি তাঁকে ধরছি না তখন তিনি নিজেই তাঁর হাত পিছিয়ে নিয়ে আমার হাত দুইটি টেনে নিজের পেটের দুই পাশে রাখলেন। আমি হাত সরিয়ে নিতে গেলে তিনি আমার হাত দুটি চেপে ধরে বলেন,

— আমার ব্যক্তিগত বাইক ছোঁয়ার উঠার অধিকার শুধুমাত্র আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটার আছে। এর বাইরে কল্পনাতেও আমার বাইকে উঠার সাধ্য কারো নেই।

কথা বলেই তিনি একটানে বাইক চালাতে শুরু করেন। রোয়েনের কথা শুনা মাত্র আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি। আমি জানি মানুষটা কেমন। যে নাকি কখনোই কোন মেয়েকে নিজের কাছেও ঘেষতে দেয় না সে আবার লিফট দিবে অন্য কোন মেয়েকে? প্রশ্নই আসে না। কিন্তু ওই যে বাঙালি নারীর মন। আপন মানুষটার মুখে অন্য কোন মেয়ের কথা উচ্চারিত হতে না হতেই নিখিল জাহানের সকল ঈর্ষা এসে ভর করে তখন। বড্ড অভিমান জাগ্রত হয় তখন মনের মাঝে৷ অতঃপর যতক্ষণ না আপন মানুষটি অভিমানটি ভাঙ্গাচ্ছে ততোক্ষণ পর্যন্ত অভিমান প্রগাঢ় হতেই থাকে। রোয়েন জানতো আজ আমার বাসায় যেতে রাত হবে তাই তো সে নিজে এসেছেন আমায় নিতে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে মানুষটা প্রচন্ড ক্লান্ত। অথচ তিনি বিনা বিরক্তি প্রকাশ করে ক্লান্ত শরীরটাই টেনে নিয়েই এসে হাজির হয়েছেন আমার সামনে। আসলেই মানুষটা আমার নির্মল প্রেমিক। আমি নিঃশব্দে খানিক্ষন হেসে তাঁর পেট জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা এলিয়ে দেই৷ এইটাই আমার নির্ভরতার সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। আমি নয়ন দুইটি বন্ধ করে নিতেই রোয়েন বলে উঠেন,

— অভিমানিনী কে অভিমানেই ভালো মানায়।

#চলবে
অধর অর্থ ঠোঁট। অনেকেই শব্দটার মানে জানতেন না তাই বলে দিলাম।

রি-চেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।