#নিভৃতে_যতনে
#Part_32
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
সকালে উঠে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করে রুমে এসে বসে আছি। দরজা ভিতর থেকে লাগানো। ভালো লাগছে না কিছুই। রোয়েন আর বাবা গিয়েছেন মসজিদে ইদের নামাজ পড়তে। মা হয়তো রান্নাঘরে কাজ করছে। আপাতত আমার খোঁজ করার মত কেউ নেই। তাই একাকিত্ব এই সময়ে নিজেকে নিয়ে ভাবার মোক্ষম সময়। বিছানার এক কোনে চোখের পাতা দু’টি বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে বসে আছি৷ মস্তিষ্ক জুড়ে পদচারণ করছে ছোট বেলার তিক্ত স্মৃতি। মনে পড়ছে আমার প্রতি করা সকলের ব্যবহার। সেই সাথে ভারি হচ্ছে হিসাবের পাল্লা। হিসাববিজ্ঞানে তো অনেক হিসাব মিলালাম এইবার না হয় জীবনের হিসাব মিলাবো। যখন আমি জীবনের ছক কষছি তখনই দরজায় কড়া আঘাত পড়ে। মা ডাকছে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি তিনি যা বলছেন। প্রথমকে তার কথাগুলো শুনে কিছুটা ভড়কে গেলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেই। না শোনার ভাণ ধরে বসে থাকি। কেন না তার কথা রাখার সাধ্য যে আমার নেই। খানিকটা সময় অতিক্রম হওয়ার পরও যখন মা গেলেন না তখন আমি গলার স্বর উঁচিয়ে কোমল কন্ঠে বলি,
— মা আপনি চলে যান। আমি পরে তাদের ফোন দিয়ে কথা বলে নিব নে।
কথাটা মা শুনলো কি-না জানি না কিন্তু দরজার ওপাশ থেকে আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আমিও এইসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকি। ভাবতে থাকি, আমার পরিবারটা আসলে কতটা স্বার্থপর। যেখানে তারা মাসে একবারও ফোন দিয়ে আমার খবর নেয় কি-না সন্দেহ সেখানে আজ তাদের দরকারের জন্য ফোনের উপর ফোন করেই চলেছে। হৃদিপুকে দিয়ে আমাকে রাজি করাতে পারেনি বলে এখন নিজেরাই মায়ের ফোনে ফোন দিচ্ছে। বাহ,চমৎকার!
ঘন্টাখানিক বাদে রোয়েনের গম্ভীর কণ্ঠ কর্ণধারে বারি খেতেই চকিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকাই।
— সিয়াশা! দরজা খোলো।
রোয়েন কন্ঠ শ্রবণ হতেই আমি বিনাবাক্যে উঠে দাঁড়াই। ধীর পায়ে এগিয়ে যাই দরজার দিকে। দরজা খুলতেই নজরে পরে রোয়েনের গম্ভীর চেহেরা। আমি একপলক তাঁর দিকে তাকিয়ে চলে যাই বারান্দায়। বারান্দার এককোনে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি দূর আকাশের পানে। রোয়েন তৎক্ষনাৎ আমার কাছে এসে বলেন,
— এইসব কি হচ্ছে সিয়াশা?
আমি ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেই,
— কোনসব?
— তোমার বাসা থেকে বার বার ফোন আসছে, সবাই তোমাকে খোঁজ করছে আর তুমি কি-না হাত গুটিয়ে বসে আছো?
আমি রোয়েনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,
— কেন ফোন দিচ্ছে জানেন?
— হ্যাঁ! তুমি না বললে কি হবে? তারা নিজেরাই ঘন্টাখানিক আগে ফোন করে সব জানিয়েছে।
আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে উত্তর দেই,
— অহ আচ্ছা।
রোয়েন কাঠ কাঠ গলায় বলেন,
— একজন শয্যাশায়ী মানুষ অনবরত তোমাকে খোঁজ করছেন, কাছে চাইছেন তোমায় আর তুমি কি-না তার সাথে দেখা করতেও ইচ্ছুক না?
— ব্যক্তিটা যদি নাসরিন বেগম না হতো তাহলে বিষয়টা ভিন্ন হতো।
— সবকিছুর উর্ধ্বে মানুষকে মানুষ বলে সম্মানের স্থানে বসাতে হয়। বিবেকহীন হলেও তাকে সর্বপ্রথম মানুষ হিসেবে গণ্য করতে হবে কারণ সে মানুষ।
আমি রোয়েনের দিকে কোমল চাহনি নিক্ষেপ করে বলি,
— আমি যে পারছি না। তার কথা যতবার মনে পড়ছে ততবার আমার প্রতি করা তার অন্যায়গুলোই মনে পড়ছে।
— অতীত থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমানকে নিয়ে চিন্তা করো। তাহলে দেখবে সব সহজ লাগছে।
— আমার অতীত থেকে বেরিয়ে আসা এত সহজ না। আমার অতীতই যে আমার পরিচয়।
রোয়েন আমার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,
— অতীত কখনো পরিচয় হতে পারে না। অতীত শুধুমাত্র আমাদের কষ্টের এক বৃহত্তর অংশ, যা শুধু পীড়া দিতে জানে। তুমি যত তোমার অতীত চাপা রাখবে তত তুমি কষ্ট পাবে।
আমি রোয়েনের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,
— হতো তাই৷ তা একটা গল্প শুনবেন?
রোয়েন ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে বলেন,
— কিসের গল্প?
— শোনার পর না-হয় বুঝতে পারবেন। শুনবেন কি? বেশি সময় অপচয় হবে না আপনার।
রোয়েন কাঠ কাঠ গলায় বলেন,
— বড্ড বেশি কথা বলো তুমি।
আমি শ্লেষের হাসি হেসে বলি,
— সে আর নতুন কি?
রোয়েন কিছুক্ষণ আমার মুখপানে তাকিয়ে থেকে বলেন,
— শুরু করো।
আমি একপলক রোয়েনের দিকে তাকিয়ে নীলাভ আকাশের পানে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করি,
— আজ থেকে কয়েকবছর আগে সম্মানিত এক পরিবারে জন্ম নেয় একটি মেয়ে। মেয়েটির জন্ম যে সকলের মাঝে খুশি বয়ে আনে তা কিন্তু না। তখন সকলের মুখে বিষাদের ছায়া। দেয়াল জুড়ে ছিল মরাকান্নার প্রতিধ্বনি। শোকের আমেজ ছিল চারদিকে। কেন না মেয়েটি জন্ম হওয়ার কিছু প্রহর পূর্বেই তার শ্রদ্ধেয় দাদাজান মারা গিয়েছিল। মেয়েটির দাদাজানের মৃত্যু আকস্মিক হওয়ায় কেউ সেটা সহজভাবে মেনে নিতে পারে নি। বিশেষ করে মেয়েটির দাদিমা। নিজের স্বামীর মৃত্যু তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। পাগলের মত বিলাপ শুরু করে দিয়েছিলেন। ক্ষণে ক্ষণেই দোষ দিয়ে যাচ্ছিলেন নবজাতক সেই মেয়েটিকে। যে কি-না মাত্র ভূ-পৃষ্ঠে জন্ম নিয়েছিল। বার বার বলেই চলেছিলেন, ‘ওই মেয়েটাই নাকি তার স্বামীকে খেয়েছে। তার সংসারে নাকি সে নজর দিয়েছে। ধ্বংস বয়ে এনেছে সেই মেয়েটা। অলক্ষুণে, অপয়া সে।’ এমন আজেবাজে আরও অনেক কিছু বলতে থাকেন আর দাদাজানের মৃত্যুর পুরো দোষ সেই নবজাতক মেয়েটিকেই দিচ্ছিলেন। মেয়েটির পরিবারের সকলেই তখন তার দাদিমাকে শান্ত করতে ব্যস্ত ছিল। ধীরে ধীরে পরিবেশ শান্ত হয়৷ কিছু দিন যায়, বাসায় তখনো শোকের আমেজ যখন মেয়েটিকে হসপিটাল থেকে বাসায় আনা হয়। বাসায় আনার পর দাদিমা যখন মেয়েটি দেখে তখন তার দিকে অহেতুক কিছু কটুকথা ছুড়ে মারেন। নিজের নাতনিকে আগলে নেওয়ার বদলে ‘অপয়া’ বলে দূর দূর করে সরিয়ে দেন। পারলে তিনি মেয়েটা এবং তার মাকে সহ বাসা থেকে বের করে দেন কিন্তু তার ছেলের জন্য পারেন না। কেন না তাদের দুইজনকে বের করলে যে তার ছেলেও ঘর ছেড়ে চলে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে তিনি জায়গা দেন মেয়েটিকে।
মেয়েটির যখন এক মাস পূর্ণ হবে তখন তার বাবা ও বড়বাবা ব্যবসায় অনেক বড় লস খায়। মুহূর্তেই সংসারে নেমে আসে বিপর্যয়। সংসারটা অভাবে পরিনত হয়। এইসব দেখে মেয়েটির দাদী দ্বিতীয়বারের মত মেয়েটিকেই দোষারোপ করেন। মেয়েটির জন্যই নাকি তাদের এমন দুর্দশা। মেয়েটি অপয়া। দাদিমার সেই বিলাপ তখনও কেউ মেনে নেই। ভাগ্যের লিখন বলে সকলে তার কথা অগ্রাহ্য করে।
ধীরে ধীরে তাদের আগের অবস্থান ফিরে আসে। মেয়েটিও তার দাদিমার অনাদরে বড় হতে থাকে। দাদিমার সামনে গেলেই মেয়েটিকে গাল-মন্দ শুনতে হতো। দূর দূর করে সরিয়ে দেওয়া হতো তাকে। মেয়েটি যেন ছিল তার দুই চোখের বিষ। মেয়েটি যখন দেখতো তার সকল ফুপাতো,চাচাতো ভাই-বোনদের দাদি আদর করছে কিন্তু ওকে না তখন মেয়েটা খুব কাঁদতো। তখন তার মা-বাবাই তাকে সান্ত্বনা দিত।
মেয়েটার বয়স যখন চার কি পাঁচ তখন ওর বড় ফুপু বিদেশ থেকে দেশে ঘুরতে আসেন। মেয়েটির ফুপু যখন বাসায় আসে তখন মেয়েটি জানতে পারে তার একটি বড় ফুপাতো বোনও আছে। নাম তার কিয়ারা। কিয়ারার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার কিছু সময়ের ব্যবধানেই মেয়েটির সাথে কিয়ারার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। বন্ধু হয়ে যায় তারা। মেয়েটির বড় ফুপু ও ফুপা মেয়েটিকে নিজের সন্তানের মতই ভালোবাসতেন। কোথাও গেলে সর্বদা মেয়েটিকে নিয়ে যেতেন।
একদিন মেয়েটির ফুপু মেয়েটিকে তাদের সাথে ঘুরতে নিয়ে যান। সারাদিন ঘুরে এদিক সেদিক ঘুরে বিকেলের দিকে তারা সকলের জন্য কেনাকাটার জন্য বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স চলে যান। যখন তারা কেনাকাটা করছি তখন শপিংমলের উপরের তালায় আগুন লেগে যায়। মুহূর্তেই সেটা চারদিকে ছড়িয়ে যায় আর নিচের দিকে নেমে আসে। আগুন লাগার ফলে চারদিকে হট্টগোল লেগে যায়। ছোটাছুটি শুরু হয় সকলের। শপিংমলের লিফট আর এক্সেলেটরও বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে শর্টসার্কিট না হয়। মেয়েটির ফুপু আর ফুপা ভিতরের কিয়ারা আর মেয়েটিকে নিয়ে দিকে ছিল বলে শোরগোলের কারণ আয়ত্ত করতে পারেনি। যতক্ষণে তারা সামনে এগিয়ে আসে ততক্ষণে চারদিকে আগুন ছড়িয়ে গিয়েছিল। তারা আটকে পড়ে গিয়েছিল সেই ফ্লোরটি। তাদের সাথে আরও অনেকেই ছিল যারা আটকা পড়ে যায় সেই ফ্লোরে। আগুনের উত্তাপ বাড়তে থাকে। দাউ দাউ করে জ্বলছে থাকে সকল দোকানপাট। কান্নার কলধ্বনি ভেসে উঠে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে। বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ফায়ারসার্ভিস থেকে লোক আসে সকলকে উদ্ধার করতে। কিছু মানুষকে উদ্ধার করতে পারলেও বেশিরভাগ মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর সেই তালিকায় মেয়েটির ফুপু আর ফুপাকেও ছিল। কেন না তারা কিয়ারা আর সেই মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেন। কিয়ারা আর সেই মেয়েটিকে হসপিটালে নেওয়া হয়। কেন না তাদের কিছু অংশ আগুনে জলসে গিয়েছিল। মেয়েটির পরিবার যখন এই খবরটি পায় তারা ছুটে আসে হসপিটালে। দুইজনের অবস্থা আর মেয়েটির ফুপু ও ফুপার মৃত্যু সংবাদ শুনে সকলে একদম ভেঙে পড়ে। কিন্তু এর মাঝেও মেয়েটির দাদিমা মেয়েটিকে দোষ দিতে ভুললেন না। শ’খানেক গাল-মন্দ করে অপয়ার তকমা লাগিয়ে মৃত্যুর দোষটা লাগানো হলো মেয়েটির উপর। সেই সাথে একের পর এক ঘটনার প্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে মেয়েটির পরিবারের কম-বেশি সকলে মেনে নেয় মেয়েটা অপয়া। যা হয়েছে সব তার জন্যই হয়েছে।
দিন যায়, কিয়ারার প্রতি সকলের মায়া বেড়ে যায় আর সেই মেয়েটির প্রতি সকলের অনিহা সৃষ্টি হয়। কিয়ারার যাতে অনাথ হিসাবে পরিচয় না পায় তাই দাদিমার কথায় সেই মেয়েটির বাবা-মা কিয়ারাকে দত্তক নেয়। মেয়েটির বড়বোন হিসাবে পরিচয় দেয় সকলকে। এইদিকে দাদিমা সকলের সাথে কিয়ারার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেন মেয়েটি ছিল কিয়ারার বাবা-মার খুনি। মেয়েটির জন্যই কিয়ারার বাবা-মা আজ এই পৃথিবীতে নেই। কিয়ারাও সেটা মেনে নেয় এবং দাদিমার সাথে মিলে মেয়েটির সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে। কিয়ারা মেয়েটিকে খারাপ কিছু বললেও পরিবারের কেউ কিছু বলতো না। এমনকি মেয়েটির বাবা-মাও কিয়ারাকে কিছু না বলে মেয়েটিকেই বুঝ দিত কিয়ারার মানসিক অবস্থা এখন ভালো না। তাই ওকে যাতে সে কিছু না বলে।
এইদিকে, দিন যত যায় দাদিমা কিয়ারার মনে মেয়েটির নামে বিষ ঢুকিয়ে দিতে থাকেন। মাস খানেকের মধ্যেই কিয়ারার চিরন্ত শত্রু হয়ে উঠে মেয়েটি। দুই চোখে দেখতে পারতো না সে মেয়েটিকে। যার দরুন কিয়ারা সবসময় মেয়েটিকে মারতো আর খারাপ খারাপ কথা বলতো। মেয়েটি যখন এইসব কথা তার বাবা-মাকে জানাতো আর তারা কিয়ারাকে ডেকে এনে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতো তখন সে অনায়াসে মিথ্যা বলে দিত যে, ‘সে এইসব কিছু করেনি বরং মেয়েটি তাকে মেরেছে আর বকেছে।’ তখন মেয়েটির বাবা কিয়ারার কথা বিশ্বাস করলেও মেয়েটির মা করতো না। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারতো না।
ধীরে ধীরে, কিয়ারাকে সকলে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। মেয়েটির বাবা-মাও কিয়ারাকে বেশি ভালোবাসতে শুরু করে। কিয়ারার প্রতি সকলের ধ্যান হলেও মেয়েটির প্রতি কারো কোন ধ্যান ছিল না। এতে মেয়েটির খুব রাগ হয়। সে এই বিষয় নিয়ে কিয়ারার সাথে ঝগড়া করে। একসময় দুইজনের হাতাহাতি শুরু হয়। কিয়ারা মেয়েটিকে ধাক্কা দিলে সেও তাকে ধাক্কা দেয়। কিয়ারা পুনরায় মেয়েটিকে ধাক্কা দিতে আসলে মেয়েটি সরে যায় আর কিয়ারা তাল সামলাতে না পেরে খাটের কোনে গিয়ে বারি খায়। সাথে সাথে তার কপাল ফেটে ফিনিকে রক্ত বেরিয়ে আসে। মুহূর্তেই রক্তে লেপ্টে যায় তার মুখশ্রী। মেয়েটি রক্ত দেখে এক চিৎকার দিতে বাড়ির সকলে এসে হাজির হয় সেখানে। কিয়ারার এমন অবস্থা থেকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যায়। অতঃপর সেখানে চিকিৎসা করার পর যখন সকলে কিয়ারাকে জিজ্ঞেস করে,’ এই দুর্ঘটনা কিভাবে হলো?’ সে অকপটে বলে উঠে, ‘মেয়েটা তাকে ধাক্কা দিয়েছিল। যার ফলে সে খাটের কিনারে গিয়ে বারি খায় আর তার কপাল ফেটে যায়।’ সব শুনে মেয়েটা চেঁচিয়ে বলেছি, ‘সে এমন করেনি। বরং তাকে আঘাত করতে গিয়ে কিয়ারা নিজে ব্যথা পেয়েছে।’ কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করেনি। সকলে তাকে দোষারোপ, এমনকি তার আপন বাবাও। এইদিকে দাদিমা রটিয়ে দেন যে, ‘মেয়েটি কিয়ারাকে মারতে চায়।’ এর সাথে আরও অনেক বানোয়াট কাহিনী রটান। অবশেষে মেয়েটির বাবা সেদিন প্রথমবারের মত মেয়েটির গায়ে হাত তুলেন। তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে রুমের মধ্যে বন্দী করে দেয়। মেয়েটি সেদিন অনেক আকুতি মিনতি করে কিন্তু কেউ তার কথা শুনেনি। মায়াও করে নি। একমাত্র তার মা আর তার বড় চাচাতো বোন ছাড়া। সকলের কাছে যখন মেয়েটা অবহেলার পাত্রী হয়ে উঠে তখন সেই দুটো মানুষই তাকে আগলে নেয়। বাড়ির সেই দুটো মানুষ বাদে সকলের তুচ্ছতাচ্ছিল্য নয় বছর বয়সী মেয়েটির মনে গভীর দাগ টানে। ক্ষিপ্ত হয়ে যায় সবার প্রতি। সব দিক বিবেচনা করে মেয়েটির মা মেয়েটিকে কঠোর হতে বলেন আর এইসবে কান না দিয়ে নিজের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী হতে বলেন। পড়ালেখা করে নিজের যোগ্যতা অর্জন করে সকলের চোখে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিতে পারে তার নিজের অবস্থান। প্রুভ করতে নিজেকে যা হয়েছে তা তার জন্য নয় বরং ভাগ্যে এমনটা লিখা ছিল বলে হয়েছে। আর যতক্ষণ না সেই দিন আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু চুপচাপ সহ্য করে যেতে। মেয়েটিও তার মায়ের কথা শুনে তাই করে গেল। কিন্তু একটা জিনিস বিপরীত হয়েছি তা ছিল মেয়েটি শান্ত থাকার বদলে ধীরে ধীরে মেয়েটা জিদি আর বেপরোয়া হয়ে উঠে। স্কুলে মারামারি শুরু দেয়। যার দরুন বাসায় তার নামে অভিযোগ আসতে শুরু করে। সম্মানহানি হতে শুরু করে পরিবারটির। তাতে মেয়েটির বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং মেয়েটি অনেক বকা ঝকা করে। মেয়েটি রাগে তার বাবার সাথে তর্ক জড়িয়ে যায়। অতঃপর সেদিন দ্বিতীয় বারের মত তার বাবা মেয়েটির গায়ে হাত তুলেন। দাদিমাও এতে উস্কানি দেয় এবং বলেন মেয়েটিকে যাতে বোর্ডিং স্কুলে দেওয়া হয়৷ পরিবার থেকে দূর গেলেই নাকি মেয়েটা বুঝবে পরিবারের মর্ম। অতঃপর বছরের শেষের দিকে দাদিমার কথায় সকলে মেয়েটিকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। ছিন্ন করে দেয় মেয়েটিকে পরিবার থেকে।
প্রথম প্রথম মেয়েটি খুব কান্না করতো বাসায় যাওয়ার জন্য। পাগলামো করতে। ফোন করে কেঁদে বলতো সে আর কখনো ঝগড়া,মারামারি করবে না। সে শুধু বাসায় যেতে চায়। কিন্তু তাও তাকে কেউ নিতে আসেনি। দিনের পর দিন সে আশায় থাকতো কেউ তাকে নিতে আসবে। কিন্তু দিন শেষে কেউ আসেনি। মাঝে তার অনেক জ্বর হয়। যা সপ্তাহ খানিক থাকে। ছোট সেই মেয়েটি তখন বার বার মা-বাবাকে কাছে চাইতো। কান্নাকাটি করতো। কিন্তু আফসোস! তাকে দেখতে তার মা আর তার চাচাতো বোনটি বাদে কেউ আসেনি। মেয়েটির মায়ের অনুমতি ছিল তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার তাই তার মা সেখানেই বসে মুখে আঁচল চেপে কাঁদতো। ইদের ছুটিতে যখন মেয়েটা বাসায় যেত তখন বাড়ির দুইজন সদস্য বাদে কেউ তার প্রতি আগ্রহ দেখাত না। সে পরে থাকতো বাসার এককোনে। সকলের এমন অনাগ্রহ,অবহেলা আর অপবাদে পরবর্তী সময়ে মেয়েটা হয়ে উঠে কঠোর আর বেপরোয়া। কারো কথাই সে গায়ে মাখতো না। পড়ালেখা ঠিক রেখে নিজের মন-মর্জি মত চলত। নিজের জীবন নিয়ে বুনতে থাকে হাজারো স্বপ্ন। কিন্তু তাও হয়তো তার পরিবারের কারো সহ্য হয়নি। ইন্টারমিডিয়েট দেওয়ার পর যখন সে বাসায় যায় তার তিনদিনের মাথায় তার বিয়ে ঠিক করে দেওয়া হয়। সবকিছু এত দ্রুত হওয়ায় মেয়েটা ভড়কে যায়। সব বুঝে উঠার আগেই তার বিয়ের কথাও পাকা হয়ে যায়। নিজের সব স্বপ্ন ভাসতে যেতে দেখে মেয়েটা বিয়েটায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু কাজ হয়না। অবশেষে যখন মেয়েটি বাবাও তাকে অপয়া আর সন্তান হিসাবে কলঙ্ক ঘষিত করেন মেয়েটি বিনাবাক্যে বিয়ের পীড়িতে বসে যায়। নিজের কঠোরতা বজিয়ে রেখে পা দেয় নতুন জীবনে। কিন্তু তখনও সে জানতো না তার নতুন জীবনটাই হবে তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
একদমে পুরো গল্পটুকু বলে আমি ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেই। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করি। অতঃপর নিজে সামলে ঠোঁটের কোনে শ্লেষের হাসি ঝুলিয়ে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে দেখি উনি আমার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাঁর চোখের মনি কিছু একটা জানার আকাঙ্খা। আমি সেই অর্থ বুঝতে পেরে নমনীয় কন্ঠে বলি,
— জিজ্ঞেস করবেন না গল্পের মেয়েটা কে? থাক করতে হবে না আমিই বলছি। মেয়েটা হচ্ছি আমি আর বাকি গল্পের সকল চরিত্র হচ্ছে আমার পরিবারের সদস্য।
#চলবে
#নিভৃতে_যতনে
#Part_33
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
রোদের প্রখরতা বেরে চলেছে। পাখিদের গুনগুনানো ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। পরিবেশটা বেশ নিরিবিলি। আমি বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। রোয়েনের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি তাঁর শীতল দৃষ্টি আমাতেই নিবদ্ধ। বেশ কিছুক্ষণ পর রোয়েনের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ কর্ণধারে এসে বারি খায়। আমি একপলক রোয়েনের দিকে তাকাই। শ্লেষের হাসি হেসে জিজ্ঞেস করি,
— এখনো বলবেন ওই বাসায় আমার যাওয়া উচিৎ? নাসরিন বেগমের সাথে দেখা করা উচিৎ?
রোয়েন আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
— উচিত-অনুচিত নিয়ে আমি কিছু বলছি না। কেন না, এই পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে কুসংস্কারে জড়িত। আমাদের তথাকথিত সমাজের বিকৃত মস্তিষ্কের পরিচয় এইটা। যার ভোগান্তির শিকার তোমার মত হাজারো সিয়াশা। এই বিষয় নিয়ে বললেও যা, না বললেও তা। নাথিং উইল বি চেঞ্জড। আমি শুধু এতটুকু বলতে চাই, যার শুরু তোমার জানা তার শেষ কেনই বা অজানা থাকবে?
আমি রোয়েনের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করি,
— মানে?
— একটা গল্প বা উপন্যাস যখন আমরা পড়ি তখন তার শুরুটা কেমন তা নিয়ে আমাদের কৌতূহল থাকে না।কৌতুহল থাকে উপন্যাসের শেষটা সার্থক কি’না। সার্থকতা উপলব্ধি নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্য’ই উপন্যাসটা পড়ি! জীবনটা উপন্যাসের শেষ পাতার মতো।এইখানে,শুরুটা কেউ মূল্যায়ন করে না কিন্তু শেষ দাড়ি টা পর্যন্ত তখন গননা করে যদি তুমি স্বার্থক হও।
— আপনি কি তাহলে চাইছেন আমি ওই বাসায় যাই? মহান সেজে সব ভুলে গিয়ে মাফ করে দেই?
রোয়েন ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,
— তোমায় আমি ক্ষমা করতে বলেনি। শুধু এতটুকু বলছি এর শেষ বোঝাপড়াটা বুঝে নাও তুমি। এরপর না-হয় সকল সমীকরণের ইতি আজই টেনে দিও।
আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। তা দেখে রোয়েন আবার বলে উঠেন,
— তোমার জীবনের গতানুগতিক ধারা ঠিক কেমন হবে তা ঠিক করবে শুধু তুমি। অন্য কেউ না। যে মনোবল এতদূর এগিয়ে এসেছো তা আঁকড়ে ধরো। গল্পটা শুরু করেছিল অন্য কেউ ইতিটা না-হয় তুমি টানো।
আমি রোয়েনের কথা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। শীতল চাহনিতে পর্যবেক্ষণ থাকি রোয়েনকে। রোয়েনের বদলে এখন অন্য যে কেউ থাকলে হয়তো আমার প্রতি সে সর্বপ্রথম সহানুভূতি জানাতো। এরপর অনুগ্রহ অথবা সান্ত্বনা দিত। অথচ মানুষটা তা করলো না। এমনকি করুণার দৃষ্টিতেও দেখলো না। বরং আমার মনোবল শক্ত করে দিল। আমি যে দূর্বল হয়ে পড়ছি তা বুঝতে পেরে অপ্রকাশ্যেই বুঝিয়ে দিলো সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে শক্ত থাকতে হয়। সকল পরিস্থিতিতেই তিনি আমার পাশে আছে তা অন্য সকল কথার ভাঁজে বুঝিয়ে দিলেন। মানুষটা আসলেই সকলের মধ্যে অন্যান্য।
_______________________
বাসায় প্রায় শোকের আমেজ। নাসরিন বেগমের রুমে সকলের আনাগোনা। সকলের মুখে বিষন্নতা,নয়ন দু’টি অশ্রুসিক্ত। আমি চোখে-মুখে কঠোরতা বুজিয়ে রেখে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। আমার থেকে বেশ কিছু হাত দূরে রোয়েন দাঁড়ানো। আমার সামনের বিছানাতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন নাসরিন বেগম। তার চেহেরা দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার অবস্থা বেশ করুন। যেকোনো সময় আকস্মিক দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমাকে দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই সকলের দৃষ্টি আমার দিকে এসে স্থির হয়। আমার আগমন দেখে মালিহা ফুপু দ্রুত নাসরিন বেগমকে আমার উপস্থিতির কথা জানান দেন। কথাটা তার কর্ণপাত হতেই তিনি ধীরে সুস্থে চোখ খুলে তাকান। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় আমাকে তার কাছে ডাকেন। আমি বেশ কিছুটা সময় নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যাই। আমাকে এগুতে দেখে মালিহা ফুপু নিজের স্থান ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। আমি বিনাবাক্যেই সেখানে গিয়ে বসে পড়ি। অতঃপর তাচ্ছিল্যের সুরে বলি,
— আজ এই অপয়াকে কেন মনে পড়লো আপনার? শেষ সময় এসেও আমায় কথা শুনিয়ে যেতে চান বুঝি?
আমার এমন কথা শুনে সকলে চকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমি সে দিকে তোয়াক্কা না করে ভাবলেশহীন ভাবে বসে থাকি। নাসরিন বেগম খুব কষ্টে বলে উঠেন,
— তোর লগে বহুত অন্যায় করসি আহমি। অনেক কোষ্ট দিসি তোরে। এতদিন না বুঝবার পারলেও এহন ঠিকই বুঝবার পারসি। মরণের মুখে আইসা বুঝতে পারতাসি জীবনের অনেক বড় বোঝা ঘাড়ে চাইপ্পা আসে আমার। যার লিজ্ঞা আমি মইরাও শান্তি পামু না। পারলে আহমারে মাফ কইরা দিস।
আমি ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলি,
— ঠিক কোন বিষয়টার জন্য ক্ষমা চাইছেন আপনি আমার কাছে? আমার গায়ে অপয়া তকমা লাগিয়ে দেওয়ার জন্য? নাকি আমাকে সবসময় অপদস্ত করার জন্য? নাকি আমার গায়ে সকল কিছুর দোষ লাগানোর জন্য? নাকি আমার থেকে আমার পরিবার আলাদা করে দেওয়ার জন্য? নাকি আমার শৈশব কেড়ে নেওয়ার জন্য?
আমার কথাগুলো চারদিকে গুঞ্জিত হতেই ওসমান সাহেব খেঁকিয়ে উঠেন,
— এইসব কোন ধরেন কথা? কখন কার সামনে কথা বলতে হয় জানো না?
আমি চোখ শক্ত করে বলি,
— না, জানি না। তা সত্য বলছি বলে গায়ে লাগছে? সত্যি অবশ্য সবসময় তেঁতোই লাগে। কিছু করার নেই। সে যাই হোক, আমি তো সকলের বেডলিস্টে পড়ি তাই আমার স্বভাবও এমনই। কিন্তু আপনাদের সকলের গুডলিস্টে থাকা এই বাড়ির বড় মেয়ে কোথায়? আসেনি নাকি?
মালিহা ফুপু ফোঁস করে বলে উঠেন,
— সে আসতে পারবে না জানিয়েছে।
আমি আফসোসের সুরে ‘চ’ উচ্চারণের মত শব্দ করে উঠে বলি,
— কিয়ারার জন্য কত কি-না করলো নাসরিন বেগম। ছোট থেকে আগলে রাখলো তাকে অথচ আজ তার শেষ সময়েই সে নেই?
হঠাৎ নাসরিন বেগম ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন,
— সবই ভাগ্যের লীলাখেলা। তাই তো এহন শেষ বয়সে আইসা ভুগতাসি আমি৷ কিন্তু দেহার মত কেউ নাই। যারে পাইল্লা বড় করলাম হেই এখন আমায় চেনে না। তুই পারলে আহমায় মাফ কইরা দিস। তোর মাফ না পাইলে যে আমি মইরাও শান্তি পাইতাম না।
আমি চোখ মুখ শক্ত করে বলি,
— মাফ করা কি এতই সহজ? দুধভাত নাকি বিষয়টা?
হঠাৎ বড় চাচী বলে উঠেন,
— মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের আবেদন কখনো ফিরিয়ে দিতে হয় না মা। এতে গুনাহ হয়।
কথাটা শুনে আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,
— অহ তাই নাকি? তা আল্লাহ বানানো সেরা সৃষ্টিকে অপয়া বা অলক্ষুণে বললে তাতে গুনাহ হয় না? মিথ্যে অপবাদ দিলে তাতে গুনাহ হয় না? যেখানে জন্ম-মৃত্যু এক আল্লাহর হাতে, সেখানে মৃত্যুর দোষ এক ছোট নবজাতক বাচ্চার উপর চাপালে গুনাহ হয় না?
মালিহা ফুপু এইবার বলে উঠেন,
— গুনাহ তো সবাই করে কিন্তু মাফ কতজনে করতে পারে? মাফ করা হচ্ছে বৃহৎ গুণ। আর যেখানে শয্যাশায়ী মানুষটা নিজেই নিজের ভুলে বুঝতে পেরে মাফ চাইছে সেখানে কথা বাড়ানোর মানে হয় না।
— তাহলে আমাকে এখন মহান হতে বলা হচ্ছে? সকলের করা অন্যায় ভুলে যেতে বলা হচ্ছে? আচ্ছা বেশ! আমিও মাফ করে দিব। কিন্তু এর আগে আমার এক শর্ত আছে।
বড় চাচা ভ্রু কুঁচকে বলেন,
— কি?
আমি নির্বিকার কন্ঠে বলে উঠি,
— হুম একটু দাঁড়ান বলছি। হৃদিপু! আমাকে একটা সাদা কাগজ এনে দিও তো।
হৃদিপু কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
— কেন?
— আগে আনো তারপরই বুঝতে পারবা।
হৃদিপু আর পাল্টা প্রশ্ন না করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ক্ষণেই একটা সাদা কাগজ নিয়ে আবার ফেরত আসে। কাগজটা আমায় হাতে দিতেই আমি সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকি। সকলের উৎসুক দৃষ্টি আমার পানে। আমি একপলক রোয়েনের দিকে ক্ষণেই হাতের কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলি। মুহূর্তেই অসংখ্য ভাঁজের দাগ পড়ে যায় কাগজের গায়ে। আমি পুনরায় কাগজটা মেলে ধরে সকলের উদ্দেশ্যে বলি,
— এই কাগজের সকল ভাঁজের দাগ দূর করতে পারলেই আমি সকলকে ক্ষমা করে দিব।
কথাটা শোনা মাত্র সকলে হতবুদ্ধির মত আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ ওসমান সাহেব গলা খ্যাঁকিয়ে বলেন,
— মশকরা হচ্ছে? এইটা কোন ধরনের শর্ত শুনি?
আমি শীতল কন্ঠে বলি,
— শর্তের আবার প্রকারভেদ আছে নাকি? শর্ত তো শর্তই।
মাহিলা ফুপু মাঝ দিয়ে বলে উঠেন,
— এইটা অসম্ভব। কাগজের গায়ে একবার ভাঁজের দাগ পড়লে সেটা আবার ঠিক করে কিভাবে মানুষ?
— শুনেছি, কাউকে কষ্ট দেওয়ার পর ক্ষমা চাইলে নাকি সব ঠিক হয়ে যায়। তা আমি যদি এখন কাগজটা থেকে ক্ষমা চাই তাহলে কি সে তার আগের অবস্থানে ফিরে আসবে?
বড় চাচা গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
— কি বোঝাতে চাইছো তুমি?
আমি শ্লেষের হাসি হেসে বলি,
— সামান্য কাগজের ভাঁজের দাগই আপনারা মুছে ফেলতে পারছেন না সেখানে আমাকে বলছেন আমি এত বছরের তিলে তিলে পাওয়া কষ্ট এক নিমিশেই ভুলে যাব? এই ভাঁজের দাগগুলোর মতই হচ্ছে আমার কষ্টগুলো। আমার হৃদয়ে লাগা ক্ষতগুলো। যা একবারে চিরস্থায়ী। হয়তো ক্ষমা করা যায় কিন্তু অন্তঃস্থলে লাগা এই দাগগুলো কখনো মুছা যায় না।
আমার কথা শুনে সকলে যেন বাক্যহারা হয়ে যায়। কারো মুখে নেই কোন কথা। সকলে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলি,
— কারো দোষ দেওয়ার মত যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু দোষ না দিলেও আপনারা সকলেই দোষী। যেখানে আল্লাহর হুকুম ছাড়া একটা পাতাও নড়ে না সেখানে আপনারা সকলে বিভিন্ন পরিস্থিতি আর মৃত্যুর দায়ভার আমাকে দিয়েছেন। আমার যা প্রাপ্য তা থেকে আমায় বঞ্চিত করেছেন। আমি কিয়ারার সাথে কখনোই কিছু করি নি অথচ কেউ তা বিশ্বাস করেন নি। সেদিনও কিয়ারাকে আমি ধাক্কা দেই নি। তাকে আঘাত করিনি। তখন নাসরিন বেগমও জানতে আমি নির্দোষ। সে দূর থেকে দেখেছিল ঘটনাটা। কিন্তু তাও, তিনি কিছু বলেন নি বরং আমাকেই দোষী বলে আমার পরিবার থেকে আলাদা করে দিলেন। আর সকলেও আমাকে দূরে সরিয়ে দিলেন। ক্ষণেই হয়ে উঠলাম সকলের অবহেলার পাত্রী। যখন আমার সকলের দরকার ছিল কেউ ছিল না আমার পাশে। আমি কখনো কোন কিছুতে কাউকে পাইনি। যার ফলে শৈশবটা ছিল আমার বিষাদময়। আজ এতটা কঠোর আর বেপরোয়া হয়েছি আপনাদের বদালতে। আর এখন এসে সেই আমার থেকেই আশা করছেন ক্ষমা করার?
কথাগুলো শুনে কারো মুখে রা নেই। সকলেই নিশ্চুপ। তা দেখে আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,
— কিয়ারা আর আমি দুইজনই ছিলাম এই বাড়ির মেয়ে। অথচ আমাদের বৈষম্য করা হতো। কিয়ারা ভুল করেও সব পেয়েছে আর আমি ভুল না করেও কিছু পাইনি। কিন্তু এর জন্য কিয়ারাকে আমি ঈর্ষা করি না। কিন্তু ও আমার সাথে যা করেছে তার জন্য আমি ওকে ঘৃণা করি। প্রচন্ড ঘৃণা করি।
নাসরিন বেগম আবার ডুকরে কেঁদে উঠে ক্ষমাপ্রার্থী হন। বাসার সকলেই কম বেশি এক বলতে থাকে। দুই-একজনের সুরে অনুতাপের রেশ। আমি চোখ শক্ত করে সেগুলো শুনতে থাকি। অতঃপর কাঠ কাঠ গলায় বলি,
— কাউকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো কি-না জানি না।।বলবও না চেষ্টা করবো। তাই এই নিয়ে আমায় আর কিছু বলবেন না। আপাতত এই বাড়ির সাথে আমি আর কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না। এই বাসায় আজ আমার শেষ আসা। আশা করি, এরপর থেকে কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না বা ক্ষমা চাওয়ার অযুহাত খুঁজবেন না। এখন আসি!
কথাটা বলে আমি উঠে দাঁড়াই। একপলক মা আর হৃদিপুর দিকে তাকিয়ে বলি,
— চিন্তা নেই তোমাদের দুইজনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবো। ভালো থেক।
এই বলে আমি রোয়েনের সাথে বেরিয়ে আসলাম। সিড়ি ভেঙে যখন নিচে নেমে এসে দাঁড়াই। চোখ প্রচন্ড জ্বালা করছে আমার। বার বার আমি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ কচলাচ্ছি। তা দেখে রোয়েন শীতল কন্ঠে বলে উঠেন,
— সবসময় কান্না দূর্বলতার পরিচয় বহন করে না। কিছু কান্না হয় একান্ত নিজের, যা জীবনের পথচলায় সাহায্য করে। তাই মাঝে মধ্যে নিজের জন্য হলেও কাঁদা উচিৎ।
ক্ষণেই আমার নয়ন দুইটির বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়ে অজস্র অশ্রুমালা। আমি কিছু না ভেবে রোয়েনকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। রোয়েনও সপ্তপর্ণে আমায় আগলে নেন। আমার মাথার পিছে হাত গলিয়ে দেন। আজ আমি কেন কাঁদছি জানি না। শুধু জানি বড্ড হালকা লাগছে আজ আমার। ভারি মনটা এতদিন পর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। যার ফলে আজ নিজেকে ধরে রাখা দুষ্কর আমার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর শীতল কন্ঠে বলেন,
— আমি আছি তো।
কথাটা কর্ণধারে এসে বারি খেতেই আমি স্থির হয়ে যাই। অশ্রুর গতানুগতিক ধারা কমে আসে। হঠাৎই মনের মাঝে খেলে যায় প্রশান্তি উতলা ঢেউ। কথার ভাঁজে লুকিয়ে থাকা নির্ভরতা হ্রাস করে দিল আমায় ক্ষণেই। মনে হতে থাকলো, এই স্বার্থপর দুনিয়াতে আমার আপন বলে কেউ একজন আছে। যে কি-না একান্ত আমার। যার তীরেই কি-না আমার নির্ভরযোগ্য স্থান। এই মানুষটি আমার পাশে থাকলে যে আমার আর কিচ্ছু চাই না। কিচ্ছু না!
#চলবে
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। ❤️