#নিভৃতে_যতনে
#Part_36
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
রৌদ্রজ্বল দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছি টিএসসির মোরে। কপালে মুক্তার ন্যায় চিকচিক করছে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা। বন্ধুমহলের সকলেই আজ উপস্থিত। সকলের মধ্যেই চলছে গবেষণা। এই গবেষণার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে চিঠিটা। চিঠিটার দাতা কে? চিঠি দাতা কি আমার পূর্বপরিচিত? সে কি আমার আশেপাশেই থাকে নাকি? এই ভার্সিটির কেউ? সে কি আসলে কি চায়? সে কি জানতো না আমি বিবাহিত? সে সামনে আসছে না কেন? এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সকলের মনে। কিন্তু উত্তর মিলছে না একটারও। একসময় এইসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সকলেই। বিরক্তি ভঙ্গিতে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে অনায়াসে। হঠাৎ ইফতি মুখ-চোখ ঘুচে বলে উঠে,
— এত রহস্য করার কি আছে বাল। সাহস দেখিয়ে যখন চিঠি দিসে তখন সামনে আসতে পা কাঁপে কে পোলার? বুকের পাটা শেষ?
আদিব তাল মিলিয়ে বলে,
— শালারে একবার সামনে পাইয়া লই। এমন কেলানি দিমু যে মরণের আগ পর্যন্ত প্রেমপত্রের নাম শুনলেও প্যান্ট ভিজিয়ে দিব।
স্নেহা আদিবকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— হুহ! দেখুম নে। কে কার প্যান্ট ভিজায়।
আদিব ফুঁসে উঠে বলে,
— স্নেহার বাচ্চা চারকোনাইচ্চা দেখতে পেত্নী, মুখে বেয়াদব। ঠাডা পরুক তোর উপর। আবিয়াত্তা মোর আজীবন।
স্নেহা রেগে দুই একটা কথা শোনাতেই আমি গলা উঁচিয়ে বলি,
— থামবি তোরা? এমনেই চিঠিটা নিয়ে মাথা খারাপ হয়ে আছে তার উপর তোরা দুইটা শুরু করেছিস। কোন গর্দভে যে চিঠিটা দিসে আল্লাহ জানে৷
হঠাৎ সুরাইয়া দুঃখী দুঃখী গলায় বলে,
— মিঙ্গেলরাই খালি প্রপোজাল পায় কেন? আমার মত কিউট পিউর সিঙ্গেল মাইয়াকে কি এদের চোখে পড়ে না?
নূর রসিকতা করে বলে,
— চিন্তা নেই দোস্ত আমি দোয়া করে দিলাম, তুই সারাজীবন সিঙ্গেল বলে হায়-হুতাশ করতে করতেই মরবি। নো চাপ, জাস্ট চিল।
সুরাইয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নূরের দিকে তাকিয়ে বলে,
— হারামি একটা। তোর মত বন্ধুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঘষেটি বেগমের জন্যই আজ আমার মত মেয়েরা প্রতারিত হয় বুঝলি। তোর মত ঘষেটি বেগমের বাঁচার অধিকার নাই। এখনই এক বালতি পানিতে ডুবে মর তুই।
নূর ভেংচি কেটে বলে,
— বললেই হলো? হুহ!
আদিব মাঝ দিয়ে বলে উঠে,
— তুই নিজে মর না বইন আমার বউরে মরতে বলোস কেন? এমনেও সিঙ্গেল মানুষ আছোস মরলে তেমন কেউ কষ্ট পাইবো না।
সুরাইয়া সেন্টি খেয়ে বলে,
— অহ আচ্ছা। এই ছিল তোদের মনে? বন্ধু নামে কলঙ্ক তোরা।
আমি হেসে বলি,
— তোরা পারিসও বটে।
হঠাৎ স্নেহা বলে উঠে,
— সিয়া তুই স্বীকার কর আর নাই কর, চিঠিটা কিন্তু সেই ছিল। আহা অনুভূতি যেন কাপ ভরে ঢেলে ঢেলে দিসে। ইশশ!
আমি মুখ ঘুচে বলি,
— থাপ্পড় খাইতে না চাইলে এখনোই মুখ অফ কর। অনুভূতি তো ছিলই না, ছিল এক বস্তাপঁচা সিনেমার পুরানো ডায়লগ। অনুভূতির আসল গভীরতা যদি জানতে হয় তাহলে উ..
‘উনার’ বলার আগেই থেমে গেলাম আমি। কি বলতে নিচ্ছিলাম তা ভেবেই জুতা পারতে ইচ্ছে করছে নিজেকে। এদের সামনে যদি এখন রোয়েনকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলি তাহলে হইসেই। আমার উপর সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়বে ডিটেলস জানার জন্য। আর এদের মত নির্লজ্জদের সামনে কিছু বলা মানেই আজীবনের জন্য নিজের পায়ে কুড়াল মারা। আমাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে আদিব ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— তাহলে ‘উ’ কি? কার কথা বলতে চাইছিস?
আদিবের কথায় সব তাল মিলাতে শুরু করলে আমি আমতা আমতা স্বুরে বলি,
— উ…উ..উইলিয়াম শেক্সপিয়রের কথা বলতে চাচ্ছিলাম আমি। তার গল্পের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ খুবই নিখুঁত বুঝলি।
কথাটা বলে মেকি হাসি দিলাম। সকলে কিছুক্ষণ আমার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অন্য টপিকে চলে যায় আর আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর যেই না উঠতে যাব ঠিক তখনই আমাদের একটা হ্যাংলা-পাতলা গড়নের ছেলে এসে হাজির হয়। পড়নে জিন্স আর ব্ল্যাক শার্ট। চোখের নীল রাঙ্গা রোদচশমা। আমরা সকলে ছেলেটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলে,
— হাই!
পিছন থেকে ইফতি বলে উঠে,
— তুমি রিফাত না? আমাদের ডিপার্টমেন্টেই তো পড়ো তাই না?
রিফাত নামের ছেলেটি চুলের হাত গলিয়ে বলে,
— হ্যাঁ।
আমি একবার ভালো মত রিফাতকে দেখে নিলাম। ও আমার পূর্বপরিচিতই। ভালো স্টুডেন্ট হওয়া সুবাদে মিড এক্সামের সময় কিছু নোটসের জন্য ওর থেকে হ্যাল্প নিয়েছিলাম আমি। তখনই মোটামুটি পরিচয় হয় ওর আমার সাথে। ক্লাসেও কয়েকবার কথা হয়েছে। কিন্তু আজ হঠাৎ এইখানে কি চায়? আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব তার আগেই আদিব জিজ্ঞেস করে উঠে,
— কোন দরকার?
রিফাত মাথা দুলিয়ে বলে,
— হ্যাঁ! সিয়াশাকে দরকার।
আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,
— আমাকে কেন?
রিফাত অস্ফুটস্বরে বলে,
— ইয়ে না মানে..
— কি?
— কাল তোমাকে চিঠিটার উত্তরটা জানতে চাইছিলাম।
কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র সকলের ঠোঁটযুগলের মধ্যভাগে কিঞ্চিৎ ফাঁক সৃষ্টি হয়ে যায়। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রিফাতের দিতে। আমি তো অবাকে কিংকর্তবিমূঢ়। নিজের মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। মানে কেমনে কি ভাই? পাশ থেকে নূর বলে উঠে,
— তার মানে ওই চিঠিটা তুমি গিয়েছিলে?
রিফাত মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
— হ্যাঁ।
বেশ কিছুক্ষণ লাগে আমার নিজের স্তম্ভিত ফিরে পেতে। অতঃপর আমি কাঠ কাঠ গলায় বলি,
— তুমি কি জানো আমি বিবাহিত?
কথাটা শোনার পর রিফাতের নয়ন দুইটির মাঝে ফুটে উঠে অপার বিস্ময়। ঠোঁট দুইটি আপনা-আপনি ফাঁক হয়ে তার। সে অবিশ্বাস্য সুরে বলে,
— তুমি মজা করছো তাই না?
আমি ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিৎ হাসি ঝুলিয়ে বলি,
— একদম না! বিয়ে নিয়ে বুঝি কেউ মজা করে? অবশ্য তোমার যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে আর কয়েকটা মাস করো। ইনশাআল্লাহ মামা ডাকটা শুনিয়ে বিশ্বাস করিয়ে দিব।
কথাটা শোনামাত্র রিফাত কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অপমানে মুখটা ছোট হয়ে আসে তার। আমতা আমতা করে বলে,
— না মানে, আমি জানতাম না। সরি!
কথাটা বলেই সে দ্রুত কেটে পড়ে আর এইদিকে সকলে দম ফাটানো হাসিতে মেতে উঠে। স্নেহা হাসতে হাসতে বলে উঠে,
— কি উত্তর দিলিরে দোস্ত। আমি তো পুরা ফিদা হয়ে গেলাম।
আমি হালকা হেসে বলি,
— ফিদা পড়ে হইস আগে ক্লাসে চল। বিপ্লব স্যারের ক্লাস শুরু হতে বেশি দেরি নেই।
____________________
সময়ের স্রোত যে কিভাবে অতিবাহিত হয় তা বুঝাই যায় না। সময়ের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে সবই যেন একেক করে স্রোতে ভেসে যায়। একমাস হতে চললো দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছি। পুরো দমে ইঞ্জয় করছি ভার্সিটি লাইফটা। রোয়েনের সাথেও দিন যাচ্ছে আমার বেশ। খুনসুটির মাঝে অতিবাহিত হচ্ছে আমাদের দিনগুলো। এইতো, কয়েক মাসের ব্যবধানেই রোয়েন আর আমার বিয়ের দুইবছরও পূর্ণ হয়ে যাবে। এখন পিছনের দিকে তাকালে সবই যেনো মনে হয়, এইতো কালকের কথা। সবই যেন এখন নিছক স্বপ্ন মনে হয়।
নিশিরাতের মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে সকলে। আঁধার প্রগাঢ় হতেই সকলে তলিয়ে যাচ্ছে ঘুমের তলদেশে৷ শৈত্যপ্রবাহ হওয়ায় নিশাচর পাখি ডাক শোনা যাচ্ছে প্রখরভাবে। আমি গায়ে মোলায়েম কম্বল জড়িয়ে আয়েস করে ঘুমিয়ে আছি। ঠিক এমন সময় নাকে সিগারেটের কড়া গন্ধ এসে বারি খেতেই ঘুম ছুটে যায় আমার। ক্ষণেই সিগারেটের গন্ধ তীব্রতর হয়ে আসে। আমি আর থাকতে না পেরে উঠে বসি। পাশে তাকাতেই দেখি রোয়েনের জায়গায় খালি। আমার অন্ধকারের মধ্যেই বৃথা চেষ্টা করলাম তাঁকে খোঁজার। বাথরুমে লাইট অফ বলে বুঝতে পারলাম উনি সেখানে নেই। হঠাৎ সিগারেটের গন্ধের কথা মনে পড়তেই আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে। গন্ধটা বারান্দা থেকে আসছে বলে সেই দিকে এগিয়ে যাই। বারান্দার সামনে এসে রোয়েনকে নজরে পড়েই। সেই সাথে দৃষ্টি আমার আটকে যায় উনার হাতে থাকা সিগারেটের দিকে। ক্ষণেই আমি থমকে যাই, অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে থাকি সেদিকে।
#চলবে
#নিভৃতে_যতনে
#Part_37
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
নিশিরাতের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে সকলে। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। আঁধার প্রগাঢ় হওয়ার সাথে সাথেই তলিয়ে যাচ্ছে সকলে ঘুমের রাজ্যে৷ শৈত্যপ্রবাহ হওয়ায় নিশাচর পাখি ডাক শোনা যাচ্ছে প্রখরভাবে। আমি গায়ে মোলায়েম কম্বল জড়িয়ে আয়েস করে ঘুমিয়ে আছি। ঠিক এমন সময় নাকে সিগারেটের কড়া গন্ধ এসে বারি খেতেই ঘুম ছুটে যায় আমার। ক্ষণেই সিগারেটের গন্ধ তীব্রতর হয়ে আসে আমার নিকট। আমি গন্ধটা সহ্য করতে না পেরে উঠে বসি। পাশে তাকাতেই দেখি রোয়েনে নেই। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে আসে আমার। অন্ধকারের মধ্যেই বৃথা চেষ্টা করলাম তাঁকে খোঁজার। বাথরুমে লাইট অফ বলে বুঝতে পারলাম উনি সেখানে নেই। এত রাতে তিনি গেলেন কোথায়? পুনরায় সিগারেটের গন্ধ নাকে এসে বারি খেতেই আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে। গন্ধটা বারান্দা থেকে আসছে বলে এগিয়ে যাই সেইদিকেই। বারান্দার সামনে আসতেই রোয়েনকে নজরে পড়ে। সেই সাথে দৃষ্টি আটকে যায় উনার হাতে থাকা জলন্ত সিগারেটের দিকে। ক্ষণেই আমি থমকে যাই, অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে থাকি সেদিকে। এই দেড় বছরের সংসারে আমি কখনো তাকে সিগারেট খেতে দেখিনি। এমনকি সিগারেটের ধারের কাছেও যেতে দেখিনি। অথচ আজ তিনি অনায়াসে জলন্ত সিগারেট ঠোঁটের মাঝে চেপে বাতাসে দগ্ধ ধোঁয়া ওড়াচ্ছেন। কিভাবে সম্ভব এইটা? সব চোখের সামনে হওয়া সত্ত্বেও কেন যেন আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। আমি বেশ কিছুক্ষন থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। তাঁর কাছেই আসতে সিগারেটের গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। গন্ধের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে কেশে উঠি আমি। কাশির আওয়াজ শুনে ক্ষণেই রোয়েন ঘাড় ঘুরিয়ে আমার পানে সচকিত দৃষ্টিতে তাকায়। আমি বেশ কিছুটা সময় লেগে যায় নিজেকে সামলাতে। নিজেকে সামলে আমি রোয়েনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাই। তাঁর মুখভঙ্গি আমার নিকট এতটা পরিষ্কার না-হলেও অনুমান করতে পারছি তিনি কিছুটা হলেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। হয়তো এইসময় আমাকে আশা করেন নি বলে। বেশ কিছুটা সময় নিরব থাকার পর রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,
— ঘুমাও নি?
আমি বেশ কিছুটা দূরত্ব বুজিয়ে রেখে স্বগতোক্তি কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,
— আপনি সিগারেট খান?
তিনি কিছুক্ষণ আমার পানে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেন। অতঃপর গমগমে গলায় বলে উঠেন,
— কেন খেতে পারি না?
কথাটা বলেই তিনি পুনরায় জলন্ত সিগারেট ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরলেন। সাথে সাথে আমার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। কোন এক অদৃশ্য কারণেই আমার বেশ খারাপ লাগতে শুরু করলো। কারণটা ঠিক আমার নিকট স্পষ্ট নয়। আমি কোনমতে নিজেকে সামলে বলি,
— আগে তো খেতেন না।
উনি অকপটে স্বীকার করলেন,
— এখন খাই।
— কিন্তু কেন? কি এমন কারণ যে আপনার এই বাজে জিনিসকে ছুঁতে হলো?
রোয়েন একপলক আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
— ইচ্ছে হয়েছে তাই ছুঁয়েছি। আবার ইচ্ছে ফুরিয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলবো। নট এ বিগ ডিল।
আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠি,
— আপনি এখনই ফেলবেন এইটা৷ এমন বাজে জিনিস খাওয়ার মানে হয়না। এখনই ফেলুন বলছি।
উনি রুদ্ধদ্বার কন্ঠে বলে উঠেন,
— সেটা আমার ইচ্ছা আর আমি কি করবো না করবো তা বলার তুমি কে?
আমি বিস্ময়ের সুরে বলি,
— আমি কে মানে? আমি আপনার স্ত্রী।
— তো তাই বলে কি এখন তোমার সব কথা শুনতে হবে?
আমি নরম স্বরে জিজ্ঞেস করি,
— আপনি ঠিক আছেন তো? এমন উদ্ভট আচরণ কেন করছেন?
রোয়েন বিশুদ্ধ হাওয়ায় নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে বলেন,
— আ’ম ফাইন।
— কিন্তু..
রোয়েন আমার কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
— এই নিয়ে আমি কথা বাড়াতে চাই না। যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো৷
আমি অস্ফুটস্বরে বলি,
— এমন…
রোয়েন আবারও আমায় বলতে না দিয়ে কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠেন,
— বলছি না ঘুমাতে যেতে তোমায়? একা থাকতে চাচ্ছি আমি। একা থাকতে দাও আমায়।
রোয়েন এই কথার পৃষ্ঠে আর কথা বলার ক্ষমতা থাকলো না আমার। বাক্যহারা হয়ে গেলাম যেন। নয়ন দু’টি হয়ে উঠলো সিক্ত। আমি আর কিছু না বলে নিঃশব্দে চলে আসি রুমে। ক্ষণেই গা এলিয়ে দেই বিছানায়। চোখের পাতা দুইটি বন্ধ করতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। রোয়েনের এমন ব্যবহার আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। বেশ কষ্ট হচ্ছে আমার। গলাটা বার বার ধরে আসছে। নিজেকে বার বার বুঝ দিচ্ছি, তাঁর এমন আচরণের পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। তিনি এইভাবেই একরোখা মানুষ। নিজের সমস্যার ব্যাপারে কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেন না। এইবারও হতে পারছেন না যার দরুন তিক্ত হয়ে এমন রুদ্ধ আচরণ করছে।
নিজেকে এতটা বুঝ দেওয়ার পরও শেষে এসে সব ছন্নছাড়া হয়েই যাচ্ছে। পারছি না মানতে আমার প্রতি মানুষটা এমন আচরণ। না চাইতেও ক্ষণে ক্ষণে দেখা দিচ্ছে অশ্রুজল। কিছুক্ষণের মাঝে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নিজের অশ্রুসিক্ত নয়ন দুটি মুছে নেই। অন্যপাশে কাত হয়ে গায়ে কম্বল জড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকি। নীরবে অপেক্ষা করতে থাকি রোয়েনের ভিতরে আসার। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে যে কখন ঘুমিয়ে পড়ি তা বুঝে উঠতে পারলাম না।
______________________
নিকষ কালো আধার ভেদ করে সূর্যি উঁকি দিয়েছে পৃথিবীর বুক চিরে।সোনালি রৌদ্দুরের আভা গাছের পাতায় পাতায় নুইয়ে পড়ছে আদর মাখা পরাশে। সদ্য ঘুম ভাঙা পাখির কলতান মুখরিত হচ্ছে ব্যস্ত শহরের গাড়ির হর্ণের সাথে।শুভ্র প্রহরের রেশ আকাশের কোল জুড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। এক ফালি রোদের ঝলকানি চোখে এসে বিঁধতেই আমার ঘুম হালকা হয়ে আসে। ঘুম চোখেই একটু নড়েচড়ে উঠতে নিলেই বুঝতে পারি আমি কারো উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ। আমি একটু ঘাড় কাত করে পাশে তাকাতেই রোয়েনের ঘুমন্ত মুখখানি ভেসে উঠে। মুহূর্তেই ঠোঁটের কোনে ভেসে উঠে সরু হাসির রেখা। মনের মাঝে ছেঁয়ে যায় একরাশ মুগ্ধতা। প্রতিদিন সকালেই তার আলিঙ্গনে নিজেকে আবিষ্কার করা যেন এখন নিত্যদিনের ব্যাপার। কিন্তু তাও প্রত্যেকবারই এক আলাদা ভালোলাগা কাজ করে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই পেরুতেই হঠাৎ আমার কালকের কথাটা মস্তিষ্কে টনক নাড়ে। মুহূর্তেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠা হাসিটা মিইয়ে যায়৷ চোখ মুখে ছেঁয়ে যায় এক রাশ অভিমান। আমি নিজেকে রোয়েনের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসি। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যাই ফ্রেশ হতে।
নাস্তার টেবিলে বসে রুটি আর ভাজি চিবুচ্ছি আর আড়চোখে দেখছি রোয়েনকে। তিনি এক হাতে কফির কাপটা আর অন্য হাতে মুঠোফোন। খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছেন মুঠোফোনে। আমি কোন রকম শব্দ না করে নাস্তা করতে থাকি। রোয়েন কফিটা শেষ করেই উঠে পড়েন। আমি তা দেখে চট জলদি জিজ্ঞেস করি,
— নাস্তা করবেন না?
রোয়েন আমার কথায় স্থির হয়ে দাঁড়ান। নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠেন,
— না।
— নাস্তাটা করে নিন। নাহলে পড়ে শরীর খারাপ করবে।
তিনি তিক্ত কন্ঠে বলে উঠেন,
— সেটা আমি বুঝে নিব।
কথাটা বলেই তিনি রুমে চলে যান আর আমি ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে বসে থাকি। কেন যেন, এই রোয়েনকে আমার বড্ড অচেনা লাগছে। মানতে পারছি না তাঁর এমন খাপছাড়া ব্যবহার। ধীরে ধীরে ভারী হতে থাকলো অভিমানে পাল্লা। আমি কোনেমতে নিজের সামলে নাস্তাটা সেড়ে উঠে পড়ি। ভার্সিটি যাব বলে রেডি হওয়ার জন্য রুমের দিকে এগিয়ে যাই। রুমে আসতেই পুনরায় সেই দগ্ধ পোড়া গন্ধ নাকে এসে বারি খায়। আমি বারান্দায় উঁকি দিতেই দেখি রোয়েন সেখানে এবং হাতে তাঁর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস। সিগারেট। আমি হতাশাজনক নিঃশ্বাস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যাই। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি রোয়েন ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন। আমি একপলক তাঁর দিকে তাকিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রোয়েনের তো অফিসের সময় হয়ে গিয়েছে তাহলে উনি অফিসের জন্য রেডি হচ্ছেন না কেন? তিনি কি আজ অফিস যাবেন না? তিনি তো কখনো অফিস কামাই দেন না। কাজের প্রতি তিনি প্রচুর সিরিয়াস। আচ্ছা তাঁর আবার শরীর খারাপ করেনি তো? নাকি অন্য কোন সমস্যা? নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে আমি জিজ্ঞেস করে উঠি,
— আপনি আজ অফিস যাবেন না? সময় চলে যাচ্ছে তো।
রোয়েন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন,
— আজ যাব না।
আমি তাঁর দিকে এগিয়ে এসে বলি,
— আপনার শরীর খারাপ করছে? কোন সমস্যা? বললেন না তো কিছু।
রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
— তেমন কিছুই না।
আমি প্রশ্নবোধক কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,
— তাহলে?
— বললাম তো কিছুই না। আর আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না, তুমি ভার্সিটির জন্য রেডি হও। দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার৷
কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র আমি স্থির হয়ে যাই। ব্যথিত নয়নে তাকিয়ে থাকি তাঁর পানে। মনে মনে প্রশ্ন করে উঠি, ” আপনাকে নিয়ে চিন্তা করবো না তো কার জন্য চিন্তা করবো? আমার আপন বলতে আছে কে আর? যদি কোন সমস্যা থাকে তাহলে আমাকে কি তা বলা যায়না?
কেন করছেন এমন ব্যবহার আমার সাথে? কেন?” কিন্তু মুখ ফুটে আর কিছু বলা হলো না আমার। আরও ভারী হয়ে আসলো অভিমানের পাল্লা। কিছুক্ষণ রোয়েনের পানে তাকিয়ে থেকে আমি নীরবে রেডি হয়ে বেরিয়ে আসলাম বাসা থেকে।
#চলবে