নিভৃতে যতনে পর্ব-৩৮+৩৯

0
1026

#নিভৃতে_যতনে
#Part_38
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি হলুদ রাঙ্গা আকাশের পানে। বিষিয়ে আছে মনটি। নয়ন দুইটিতে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। না চাইতেও রোয়েনের ব্যবহারগুলো বার বার ভাবাচ্ছে আমায়। ভার্সিটি থেকে আসার পর ঘরের কোথাও রোয়েনের দেখা মিলে নি। পলি আন্টিকে তাঁর কথা জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, তিনি নাকি অফিসে গিয়েছেন। কথাটা শোনামাত্র খানিকটা সময়ের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। কোন ভাবেই হিসাব মিলাতে পারছিলাম না। কেন না, সকালে আমি যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, অফিস যাবেন কি-না তখন তিনি অকপটে নাকচ করে দিয়েছিলেন। তার মানে কি উনি আমায় মিথ্যে বলেছিলেন? কিন্তু কেন? প্রশ্নটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই হতাশামূলক নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। অভিমানে সিক্ত হয়ে আসে নয়ন দুইটি। হঠাৎ করেই রোয়েনের মধ্যে আসা পরিবর্তনগুলো মেনে নিতে পারছিনা। তাঁর ব্যবহারগুলো বেশ পোড়াচ্ছে আমায়। সেই সাথে ভাবাচ্ছেও। দুইদিন আগেও তিনি স্বাভাবিক ছিলেন। আমাকে নিয়ে ঘুরেও এসেছিলেন। আমার প্রতি তাঁর ব্যবহারগুলো ছিল অতি স্নিগ্ধ। কিন্তু হুট করে তাঁর কি হয়ে গেলো কে জানে? এত জলদি এতটা পরিবর্তন, আদৌ কি সম্ভব?
কিছুটা প্রহর অতিবাহিত হতেই চারদিকে ভেসে উঠে এক মধুর ধ্বনি। মাগরিবের আযান দিচ্ছে। আযানের কলধ্বনি কর্ণধারে এসে বারি খেতেই নিজের স্তম্ভিত ফিরে পাই আমি। ক্ষণেই মাথায় কাপড় টেনে রুমে চলে যাই। ওযু করে নামাজ আদায় করে নেই। অতঃপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিজের এসাইনমেন্টগুলো নিয়ে বসে পড়ি।

রাত নয়টা প্রায় ছুঁই ছুঁই। এখনো রোয়েনের আসার নাম গন্ধ নেই। আমি মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে বার বার পায়চারী করছি। মনে মাঝে কু ডাকছে। উনি তো সহজে এত দেরি করেন না। তাহলে আজ কেন? বেশ কয়েকবার ফোন মিলিয়েছি রোয়েনের নাম্বারে। রিং হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কেউ ফোনটা তুলছে না। এতক্ষণ চিন্তা হলেও এখন ভয় হচ্ছে প্রচুর। কাউকে যে বলবো সে উপায়ও নেই। কেন না এতে অন্যরাও চিন্তায় পড়ে যাবে। তার উপর এখন পাশেও কেউ নাই। রোয়েনের দেরি হচ্ছে বলে পলি আন্টি চলে গিয়েছেন ঘন্টাখানিক আগেই। যার দরুন সব এখন নিজেকেই বইতে হইছে। সময় যত গড়াচ্ছে ততই চিন্তা আর ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে রোয়েনের এক্সিডেন্ট করা সেই রাতের কথা। যার ফলে কোনভাবেই ক্ষান্ত হতে পারছি না। ক্ষণেই ঠান্ডা হয়ে আসছে হাত-পা। নিজেকে বড্ড অগোছালো লাগছে৷
অবশেষে আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাত দশটায় রোয়েন এসে হাজির হোন। দরজা খুলে তাকে দেখামাত্র সকল অভিমান ভুলে জড়িয়ে ধরে তাকে। কম্পিত কন্ঠে বলে উঠি,

— আপনি ঠিক আছেন তো? কিছু হয়নি তো আপনার? এত দেরি কেন করলেন আপনি? ফোন কেন ধরেন নি আমার? আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানেন?

রোয়েন ম্লান হেসে এক হাত আমার পিঠে গলিয়ে দিয়ে বলেন,

— আমি ঠিক আছি। এত হাইপার হওয়ার কিছু নেই।

কথাটা শোনা যেন আমার জানে জান আসে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নয়ন দুইটির পাতা বুজে ফেলি। হাত-পা কাঁপছে মৃদু পরিমাণ। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত হতেই আমি তাঁর থেকে সরে এসে দাঁড়াই। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাই তাঁর মুখপানে। ক্লান্তি ভরা মুখখানিতে ম্লান হাসি। আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— এত দেরি কেন করলেন আপনি? ফোনও তুললেন না যে?

রোয়েন ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে গলার টাই কিছুটা ঢিলে করে নেন। নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,

— কাজ ছিল।

— একটা বার ফোন করে তো জানাতে পারতেন। ভয়ে ছিলাম আমি।

— মনে ছিল না।

কথাটা বলে তিনি রুমে চলে যান ফ্রেশ হতে আর আমি সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করি। রোয়েন ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে আমি খাবার গরম করে ফেলি৷ খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে চলে যাই রোয়েনকে ডাকতে। দরজা কাছে আসতেই দেখতে পাই রোয়েন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো মুছছে। আমি কোনরকম ভনিতা না করে বলি,

— খাবার গরম করেছি, খেতে আসুন।

— খাব না।

— কেন?

— খিদে নেই।

আমি কিছুটা রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— খিদে নেই বলতে? আপনি কি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন?

রোয়েন এইবার তিক্ত কন্ঠে বলে উঠেন,

— এখন কি সব কিছুর কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে?

কথাটা শ্রবণ হওয়া মাত্র আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি রোয়েনের পানে। এক রাশ অভিমান এসে ভর করে মনের মাঝে। ভারী হয়ে এর পাল্লা। রোয়েনকে কিছুটা সময় পর্যবেক্ষণ করে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসি রুম থেকে। ডাইনিং এ এসে একটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে ফেলি। খাবারটা মূলত রোয়েনের জন্য। মানুষটা রাতে না খেয়ে একদমই ঘুমাতে পারেনা। আমি তাঁর শুকনো মুখটা দেখেই বুঝেছি তিনি কিছু খায়নি। কিন্তু তাও সিউর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করেছিলাম তাকে। কথাটা ভাবামাত্র বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
তাঁর সাথে যতই অভিমান করি না কেন, তাঁকে তো হেলায় ফেলে দিতে পারিনা। দিন শেষে তাঁকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমারই।
খাবার নিয়ে আমি এগিয়ে যাই রুমে। রুমে আসতেই দেখি রোয়েন মাথায় এক হাত রেখে শুয়ে আছেন। আমি নিঃশব্দে এগিয়ে যাই তাঁর দিকে। বেড সাইড টেবিলে প্লেটটা রেখে তাঁর বাহুতে হালকা টান দেই। তিনি সচকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই আমি আমি কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠি,

— খেয়ে নিন।

তিনি গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

— বললাম তো খাব না।

— খেতে বলেছি খাবেন। এত কথা কেন বলেন? উঠুন বলছি।

এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক বিতর্কের পর রোয়েন বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে উঠে বসে। আমি আর কিছু না বলে প্লেট হাতে তুলে নেই। খুব সপ্তপর্ণে তাঁর মুখে তুলে খাবারটুকু। রোয়েন কিছুক্ষণ আমার মুখপানে তাকিয়ে থেকে বিনাবাক্যে খাবারটুকু খেয়ে নেন।

রোয়েনকে খায়িয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নেই কিছুটা। অতঃপর সব গুছিয়ে রুমে আসতেই তৃতীয় বারের মত সেই দগ্ধ পোড়া গন্ধটি নাকে এসে বারি খায়। ক্ষণেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় আমার। আমি উনার সামনে গিয়ে তিক্ত কন্ঠে বলে উঠি,

— আবার এইসব ছাইপাঁশ খাচ্ছেন? এখনই ফেলুন ওইটা বলছি।

তিনি কঠোর সুরে বলেন,

— রুমে যাও।

— আগে ফেলুন ওইটা বলছি।

— আমার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বলি নি তোমায়।

আমি তেঁতে উঠে বলি,

— আপনি বললেই হলো?

রোয়েন এইবার তেজী গলায় বলে উঠেন,

— বলছি না এইসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে? একবারে বুঝো না কথাটা? রুমে যাও বলছি।

মুহূর্তেই নয়ন দুইটি সিক্ত হয়ে আসলো। আমি চোখের পানি লুকাতে দ্রুত সেই জায়গা থেকে সরে আসি৷ রুমের লাইট অফ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেই। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোটা নোনাজল। জলন্ত সিগারেট হয়তো রোয়েনের হাতে কিন্তু তার দহনে পুড়ছি আমি। কেন করছে এমন উনি? আমি তো আর তাঁর খারাপ চাইছি না, তাহলে? এতটা কঠোরতা কেন? পরের মত আচরণ কেন করছেন তিনি? শুনেছি, সম্পর্কের বয়স যত বাড়ে ততোই অনিহা আর অনুগ্রহ স্থান পায়। একটা গ্যাপ চলে আসে৷ আমাদের বেলাও কি তাই হচ্ছে? নাকি অন্য কিছু? আপাতত প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে ফেলে অভিমান জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরি আমি। অভিমানের বসেই সিদ্ধান্ত নেই, তিনি যেহেতু চাইছেন আমায় দূরে সরিয়ে রাখতে তাহলে তাই হোক। বলবো না আমি আর কোন কথা। হঠাৎ রোয়েনের পায়ের আওয়াজ পেতেই আমি নিজের চোখের জলটুকু মুছে নেই৷ চুপটি মেরে শুয়ে থাকি৷ ক্ষণেই রোয়েন আমার পাশে এসে শুয়ে পড়েন। দুইজনের মাঝে তখন পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ রোয়েন আমার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেন। মুহূর্তেই আমি ভড়কে যাই। ঘটনাক্রমে বুঝতে একটু সময় লাগে আমার। আমি এতে অভ্যস্ত হলেও আজ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। তাই প্রথমে একটু হাঁসফাঁস করলেও পরবর্তীতে স্থির হয়ে যাই। সিগারেটের মৃদু গন্ধ আসছে। এতে গা গুলিয়ে আসলেও আমি চুপটি মেরে শুয়ে থাকি। হঠাৎ রোয়েন বলে উঠেন,

— সিয়াশা!

নিজের নামটা তাঁর মুখে উচ্চারিত হওয়া মাত্র বুকটা মুচড়ে উঠে আমার। মনে হলো, কন্ঠটা যেন কেমন শোনালো। তাঁর এই ডাক শুনে বুকের মাঝে বয়ে যেতে শুরু করে এক ঝড়। এই ডাক যে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেননি। না চাইতেও আমি ছোট করে বলে উঠি,

— হু!

— একটা কঠিন প্রশ্নের উত্তর চাই তোমার থেকে। দিবে কি?

আমি নিচু স্বরে বলি,

— করুন।

রোয়েন তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলেন,

— আমার সাথে থাকতে গিয়ে যদি কোনদিন চরম বাস্তবতার স্বীকার হও তখন তুমি কি করবে? এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে নাকি থেকে যাবে?

আমি চকিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। হঠাৎ এমন প্রশ্ন করার মানে কি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। কেমন বাস্তবতা? আর তাঁর কেন মনে হচ্ছে আমি সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হলে সংসার ছেড়ে চলেও যেতে পারি? এত এত প্রশ্নের ভিড়ে সবকিছুই যেন এখন গোলক ধাঁধা লাগছে। যার আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না আমি। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি নিরপেক্ষভাবে উত্তর দেই,

— সেটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। সকল পরিস্থিতি যেমন এক না, তেমনই এর প্রতিকারও এক না। পরিস্থিতি বুঝেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

আমার কথার পৃষ্ঠে কোন কথা বললেন না। শুধু কয়েকটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে তার বুক চিরে। যার কলধ্বনি ছিল আমার নিকট অতি স্পষ্ট।

#চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_39
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

ফাল্গুনের মাতাল হাওয়ায় মাতোয়ারা পরিবেশ। সিঁদুর রাঙ্গা পলাশগাছের কার্নিশের বসে হাওয়ায় সুর তুলছে কোকিলের দল। শৈত্যপ্রবাহের দাপট কমে এসেছে খানিকটা। হাওয়ায় ছড়িয়েছে ফুলের মাদকতা। বন্ধুমহলের সাথে টিএসসির মোড়ে বসে হাতে এক কাপ চা নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে আছি। সকলের আড্ডার মাঝে থেকেও যেন আমি নেই৷ কেন না, আমার মন যে পড়ে আছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির তীরে। আজ পাঁচদিন হতে চললো মানুষটার সাথে আমার খাপছাড়া ভাব। দরকারবিহীন কথা হয়না একটিও। আমি কথা বলি না রাগ-অভিমানে কিন্তু সে কেন বলে না তা আমার জানা নেই। বেশিরভাগই এখন দেখা যায় তাকে আপন ভাবনায় বিভোর থাকতে। সর্বদাই কপালে পড়ে থাকে সুক্ষ্ম ভাঁজ। মাঝে মধ্যে পরিলক্ষিত হয় তাঁর হাতের ভাঁজে এক অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস। তিনি যে কোন পীড়াপীড়িতে আছেন তা আমার নিকট স্পষ্ট। এই নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিও বহুত বার কিন্তু মানুষটা যে বলতে অনিচ্ছুক। মানুষটার বুক ফাঁটবে কিন্তু মুখ ফুটবে না। তাই আমিও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। নিরব হয়ে গেছি তাঁর মতই। নিভৃতেই অভিমানের পাল্লা ভারি করছি ক্ষণে ক্ষণে। হঠাৎ আদিবের ডাকে আমার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। গোলগাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর দিকে।

— কি রে সিয়া? কার ভাবনায় এতটা মশগুল যে আমাদের ডাক তোর কানেই যাচ্ছে না?

আমি স্মিত হেসে বলি,

— আরেহ তেমন কিছু না।

সুরাইয়া পিঞ্চ করে বলে,

— তো কেমন কিছু শুনি?

স্নেহা হেসে বলি,

— আরেহ বুঝিস না কেন। জামাই কিছু।

আমি মুখ শক্ত করে বলি,

— লেগপুল করা হয়েছে তোদের?

ইফতি ভ্রু কুঁচকে বলে,

— আরেহ রাগছিস কেন? মজা করছে তো ওরা।

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই পাশ থেকে নূর বলে উঠে,

— হয়ে থাম। এই বিষয়ে নিয়ে পরে কথা বলিস এখন উঠ তোরা। ক্লাসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। চল জলদি!

নূরের কথায় সকলেই একবার সময়ের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। আসলেই সময় পেরিয়ে যাচ্ছে বিধায় সকলে বিনাবাক্যে উঠে পড়লো আড্ডা থেকে। ওরা হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছি কিন্তু আমি তার আগেই রওনা দিলাম ক্লাসের উদ্দেশ্যে। ভালো লাগছে না আর এইখানে থাকতে। অসহ্য লাগছে সবকিছুই।

______________________

পড়ার টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এসাইনমেন্টের কাগজপত্র। সামনেই মোটা তাজা একটা বই হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে । কাগজের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে পেন্সিল, রাবার ও রঙিন কলম। আমি চেয়ারে বসে কলম কামড়াচ্ছি আর একটা কাগজে চোখ বুলাচ্ছি। মাঝে মধ্যে আড়চোখে রোয়েনকেও পর্যবেক্ষণ করছি। কোলে ল্যাপটপ নিয়ে কি যেন করছেন আর বার বার বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে উঠছেন। কপালে পড়েছে সুক্ষ্ম ভাঁজ। ভাঁজটা চিন্তার নাকি বিরক্তির বলা দুষ্কর। মাঝে মধ্যে বা হাতের তর্জনী দিয়ে কপাল চাপছেন। মুখে গম্ভীরতা বিরাজমান। তাকে জিজ্ঞেস করতে বড্ড ইচ্ছে করছে, ‘কি হয়েছে আপনার? আপনি ঠিক আছেন তো?’ কিন্তু অভিমান নামক বস্তুটি পুরো হৃদয় জুড়ে বসে থাকার কারণে কিছু বল হয়ে উঠলো না আর। সব দেখেও নিরব থেকে গেলাম আমি। মনোযোগ দিলাম নিজের কাজে। হঠাৎ তাঁর ফোন বেজে উঠতে আমি সচকিত দৃষ্টিতে রোয়েনের দিকে তাকাই৷ রোয়েন ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠা নাম্বারটা দেখমাত্র কোল থেকে ল্যাপটপটা নামিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যান বারান্দায়। মূহুর্তেই আমার ভ্রু কুটি কুঞ্চিত হয়ে আসে। এই নিয়ে চতুর্থবার তিনি ফোন আসামাত্র উঠে বারান্দায় চলে গিয়েছেন। হয়তো তিনি আমার সামনে কথা বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না অথবা হয়তো তিনি চাইছেন না আমি তাঁর কথপোকথন শুনি। ক্ষণেই বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। আমি চুপচাপ উঠে বইটা বন্ধ করে, কাগজগুলো গুছিয়ে নিতে থাকি। আমার থাকাতে হয়তো তাঁর কথা বলাতে ব্যাঘাত ঘটছে, তো কি দরকার এইখানে থাকার? আমি সবকিছু গোছাচ্ছি এমন সময় রোয়েনের নিস্তেজ কন্ঠ কর্ণধারে এসে বারি খায়।

— এমন তো নয় আমি হাত গুটিয়ে বসে আছি। আমি তো আপ্রাণ চেষ্টা করছি সবদিকে সামাল দেওয়ার।

এরপর নীরবতা। না চাইতেও কৌতূহলবসত আমি বারান্দার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। পুনরায় শোনা গেলো তাঁর কন্ঠ। তিনি বলছেন,

— সকলের সাথেই আমি কথা বলেছি। কেউ রাজি হচ্ছে না।

এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা। অতঃপর তিনি আবার বলে উঠেন,

— যা হওয়ার তাই হবে, এখন আমার করার আর কিছুই নেই। রাখছি।

কথাটা বলে তিনি ক্ষোভে রেলিং-এর গায়ে একটা বারি দেন। চাপা কন্ঠে বলে উঠেন, ‘ড্যাম’। আমি নীরবে দরজার কাছ থেকে সরে এসে দাঁড়াই। চুপচাপ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকি। ভাবতে শুরু করি তাকে নিয়ে,রোয়েন তো শান্ত মেজাজের মানুষ। কখনো কোন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে রেগে যান না তিনি। কারো উপর নিজের রাগ প্রকাশও করেন না। এতটুকু তো চিনেছি আমি তাঁকে। কিন্তু এইবার তিনি তাঁর স্বভাবের একদম বিপরীত আচরণ করছেন। এমন তো হওয়ার কথা না। তাহলে কি এর পিছনের কারণটা বৃহৎ? যার ফলে তিনি এতটা উগ্র আচরণ করছেন? এতদিন বিষয়টা ধরতে না পারলেও আজ পারছি। যার দরুন রোয়েন রুমে আসা মাত্র আমি সকল অভিমান দূরে ঠেলে দিয়ে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। নির্লিপ্ত দৃষ্টি তাঁর দিকে নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করি,

— কি হয়েছে আপনার? কোন সমস্যা?

রোয়েন আমার পানে কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বলেন,

— কিছু হয়নি।

রোয়েন বিছানায় গিয়ে বসতেই আমি পুনরায় তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— বলুন না কি হয়েছে আপনার? কয়েকদিন ধরে দেখছি আপনায়, কেমন উগ্র আচরণ করছেন। ঠিক মত খাচ্ছেন না,ঘুমাচ্ছেন না। সারাক্ষণ কোন এক চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন। বলুন না কি হয়েছে আপনার?

তিনি এইবার রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠেন,

— বললাম তো কিছু হয়নি আমার। আর আমার বিষয়ে নাক গোলাতে হবে না তোমায়। যাও নিজের কাজ করো তুমি।

— তাই করছি। আপনি আজ যত যাই বলুন না কেন আমি আপনার সমস্যা না জানা পর্যন্ত হাল ছাড়ছি না। আজ আপনায় বলতেই হবে হয়েছেটা কি? এতটা চিন্তিত কেন আপনি?

আমার কন্ঠের তেজ শুনে রোয়েন নীরব বনে যান। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আমার মুখ পানে। আমি তাঁর চোখে চোখ রাখতেই বুঝতে পারি তাঁর চাহনি আজ বড্ড অগোছালো। কিছু তো একটা তিনি বলতে চাচ্ছেন আমায় কিন্তু পারছেন না। হয়তো আড়ষ্টতা কাজ করছে। আমি এইবার নরম সুরে বলি,

— আপনাকে বুঝার দায়িত্ব আমার ঠিকই কিন্তু আপনি খুলে সব না বললে বুঝবো কিভাবে বলুন? আপনার সুখের ভাগিদার যেমন আমি তেমনই আপনার কষ্টের ভাগিদারও হতে চাই আমি। যদি নিজের বরের কষ্টের ভাগই বসাতে না পারি তাহলে কেমন স্ত্রী আমি বলুন তো?

রোয়েন কিছু না বলে তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। হাঁসফাঁস করতে থাকে কিছুক্ষণ। বুঝাই যাচ্ছে তিনি চেয়েও বলতে পারছেন না। হয়তো তিনি ইন্ট্রোভার্ট বলেই তাঁর সমস্যা গুলো প্রকাশ করতে এতটা আড়ষ্টতা কাজ করে। আমি তাঁর দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলি,

— প্লিজ বলুন না কি হয়েছে? এমন কি হয়েছে যার দরুণ বাজে অভ্যাসগুলো আয়ত্ত করে নিয়েছে? আমাকে দূরে সরিয়ে রাখছেন? বলুন না।

রোয়েন মুখ ঘুরিয়ে বলেন,

— তোমাকে কোন রকম টেনশনে ফেলতে চাই না আমি।

আমি শ্লেষের হাসি হেসে বলি,

— তা এখন বুঝি আমি টেনশনে নেই? জানেন আপনার এই উগ্র ব্যবহার কতটা পোড়াচ্ছে আমায়? দূরত্ব সৃষ্টি করছেন আপনি আমাদের মাঝে। বুঝতে পারছেন বিষয়টা? কথাগুলো অন্তরে চাপিয়ে না রেখে আমার নিকট প্রকাশ করে দিন। দেখবেন নিজেকে বড্ড হালকা লাগছে।

রোয়েন কিছু না বলে হুট করে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে। আমি ক্ষনিকের জন্য ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলে নেই। ধীর গতিতে তাঁর চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দেই। শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— আমার কাছে এতটা ইন্ট্রোভার্ট হলে চলে? আমি কি পর নাকি? আপনার আপন মানুষই তো আমি। আপনি নিরদ্বিধায় বলতে পারেন আমায় সব।

রোয়েন কিছুটা প্রহর চুপ থেকে বলেন,

— কখনো যদি শুনো,আমার চাকরি নেই আমি তোমার ভরণপোষন করতে হিমশিম খাচ্ছি। সেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার পাশে থাকতে পারবে তো? করতে পারবে তো আমায় ভরসা? থাকতে পারবে আমার পাশে?

আমি বিস্মিত সুরে বলি,

— আপনার চাকরির সাথে আমার থাকার বা না থাকার কি সম্পর্ক? বিয়ে তো আমি আপনাকে করেছি, আপনার চাকরিকে নয়।

রোয়েন মাথা তুলে আমার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

— বাস্তবতা কিন্তু তোমার কথাগুলোর মত এত সহজ না। অনেক কঠিন বুঝলে। তোমাকে ভালো রাখা দায়িত্ব আমার। কিন্তু যখন দেখবে আমি তোমায় ভালো রাখতে পারছি না, কষ্টের জীবনযাপন করতে হচ্ছে তোমায় তখন আর তোমার আমার সাথে থাকতে ইচ্ছে করবে না। এখনকার কথাগুলো তখন লাগবে নিছক হাস্যকর। কষ্ট এমন এক জিনিস যা কেউ চায় না, সবাই এই ধরণীর বুকে সুখী থাকতে চায়।

আমি ছোট ছোট চোখ করে বলি,

— সুখ কষ্ট মিলিয়ে তো জীবন নাকি? ভালো সময় আসলে, খারাপ সময়ও আসবে। এইটাই নিয়ম। এখন সেই সময় কে কতটা শান্ত আর শক্ত থাকে এইটাই দেখার বিষয়।

— এখন এইগুলো বলছো কারণ এখনো বাস্তবতার মুখোমুখি হও নি কিন্তু যখন হবে তখন বুঝবে।

আমি রোয়েনের কাছে হাটু মুড়ে বসে তাঁর হাত দুটি আমার হাতের মাঝে নিয়ে শীতল কন্ঠে বলি,

— এমন আধা-উধা কথা না বলে কি পুরো কথা বলা যায় না আমায়? পুরো ঘটনাটা খুলে বলুন না আমায়।

রোয়েন দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন,

— এক সপ্তাহ আগে ফ্যাক্টরিতে কিভাবে যেন আগুন লেগে যায়। এতে প্রায় কয়েক’শ হাজার কোটি টাকার পণ্য আগুনে বিনষ্ট হয়ে যায়। বেশিরভাগ সকল মেশিনও নষ্ট হয়ে যায়। বেশ আগেই কোম্পানির শেয়ারগুলো নেমে এসেছিল। যার দরুন আমাদের সকলের দুই মাসের বেতন আটকে ছিল। কোম্পানির সুনাম ফিরে পেতেই নতুন এক প্রজেক্টের কাজ চলছিল। যার জন্য অনেক টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছিল। প্রজেক্টটা কমপ্লিট হলেই কোম্পানির নিজের অবস্থান ফিরে পেত। কিন্তু ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে যাওয়ায় এখন কোম্পানি পুরো লসে ডুবে গিয়েছে। সেই সাথে কোম্পানির করুন অবস্থা দেখে শেয়ারহোন্ডাররাও হাত গুটিয়ে নিয়েছে। কোম্পানি এখন দেউলিয়া প্রায়। যখন তখন কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর যদি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে…..

কথাটার ইতি টানার আগেই রোয়েন দীর্ঘ নিশ্বাস নেন। আমি চোখ ছোট ছোট করে বলি,

— আপনার কি মনে হয়? আপনার জব না থাকলে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাব? এত তুচ্ছ আপনি? আর আমি যেতে চাইলেই আপনি যেতে দিবেন? এই আপনার অধিকারবোধ?

রোয়েন আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

— মানুষ সব জায়গায় ধরা না খেলেও পরিস্থিতির নিকট একটা না একটা সময় ধরা খেয়েই যায়। আর সেটাই হয় তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময়।

— আপনার হাত এই জন্য ধরেনি যে বিপদ বা পরিস্থিতির মুঠোয় পড়ে তা ছেড়ে দিব। যে মানুষটা আমার জীবনের অধিকাংশ জুড়ে তাকে কি এইভাবেই ছুড়ে ফেলা যায়? বলুন? যত যাই হোক, আপনাকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছাড়ছি না আমি।

রোয়েন স্মিত হেসে বলেন,

— বুঝে শুনে বলছো তো নাকি আবেগের বসে বলে যাচ্ছ? যখন আমি পারবো না তোমার আবদার পূরণ করতে, তোমার পড়াশোনার খরচ বহন করতে, তোমায় ভালো পোশাক-আশাক,খাবার দিতে খাওয়াতে, কাজের মানুষ রাখতে,সুনিশ্চিত জীবন দিতে তখনও কি বলতে পারবে এই কথা গুলো?

— হ্যাঁ পারবো। আর দুমুঠো ভাত হলেই হবে আমার। বাদ বাকি আমি গুছিয়ে নিব। আর ভুলে যাবেন না হোস্টেলেই বড় হয়েছি আমি। পরিবার থেকে দূরে একা একা থেকেছি আমি। সেই ছোট বয়স থেকে নিজের কাজ নিজেই করতে জানি আমি। কষ্ট কি তাও ভালো করেই আমি জানি। তাই এইসব নিয়ে ভাববেন না।

রোয়েন কিছু না বলে আমার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আমি তাঁর পানে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলি,

— যে হাতটি আমায় আমার কঠিন সময়ে আগলে রেখেছিল সেই হাতটি আমি কিভাবে ছাড়ি বলুন? আপনাকে ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব না। একদমই না!

কথাটা ভেবেই তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম আমি। হঠাৎ উঠে রোয়েনের কপালে ভালোবাসার ছোট পরশ এঁকে দিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,

— চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি আপনার পাশে।

#চলবে
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।