#নিভৃতে_যতনে
#Part_40
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
কথায় আছে, ‘বিপদ যখন ঘরে আসে ভালোবাসা তখন জানাল দিয়ে পালায়।’ কথাটা শতভাগ সত্য নাহলেও, মিথ্যেও নয়। আমাদের চারপাশে এমন অনেক দাম্পত্য আছে যারা বিপদের সময় একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারে না। হতে পারে না সুখ-দুঃখের সঙ্গী। বরং টাকার মোহে জড়িয়ে বিলাসিতার পিছেই ছুটে যায় অনেকেই। যার দরুন সুখ নামক পাখিকে ধরতে গিয়েই হ্রাস হয়ে যায় অজস্র সম্পর্কের স্থায়ীত্ব। অথচ মানুষ বেমালুম ভুলেই যায় যে, সুখ হচ্ছে মরীচিকা। একে যেই ধরতে যাবে সেই মুখের উপর থুবড়ে পড়বে। আর এইটাই বাস্তবতা। তাই ‘চাই! চাই!’– না করে যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা শ্রেয়। এতে অল্পেই প্রকৃতি সুখের দেখা মিলে।
রোয়েনের কোম্পানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে আজ প্রায় দুই মাস হতে চললো। তথাকথিত সমাজের নজরে এখন তিনি বেকার। আর তাঁর এই বেকারত্ব জীবনে একান্ত সঙ্গী আমি। এই দুই মাসে অনেক কিছুই বদলেছে। বদলেছে আমাদের জীবনের গতানুগতিক ধারা। খানিকটা ভিন্নতা এসেছে সম্পর্কে, সেই সাথে এসেছে ম্যাচুরিটি। প্রগাঢ় হয়েছে একে অপরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। হাতের বাঁধন মজবুত হয়েছে শতগুণ।
কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কারণে রোয়েন তাঁর ন্যায্য বেতন পাননি। তার মোট চার মাসের দিনমজুর পাওনা হলেও পেয়েছিলেন দুইমাসের। অবশ্য সকলে মিলে নিজের ন্যায্য দাবী করেছিল ঠিকই কিন্তু কাজ হয় নি। আপাতত রোয়েনের সেভিং আর বেতন দিয়ে চলছে আমাদের সংসার। বেশ হিসেব করেই চলছি আমরা দুইজন। অহেতুক খরচ প্রায় কমিয়ে দিয়েছি। পলি আন্টিকেও না করে দিয়েছি আমি। কেন না মাস শেষে তাকে মোটা অংকেরই বেতন দিতে হয় যা আপাতত দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথমে অবশ্য তিনি যেতে চাননি, এতবছর ধরে কাজ করার দরুন মায়া জন্মে গিয়েছে আমাদের প্রতি। সেই মায়ার টানেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। তাকে আমি আমাদের অবস্থা বুঝিয়ে-টুঝিয়ে বিদায় করেছি আর আস্থাও দিয়েছি, পরিস্থিতি ঠিক হলে তাকে আবার নিয়োগ করবো আমরা। পলি আন্টি যাওয়ার পর ঘরের সকল কাজ রোয়েন আর আমি মিলে ভাগাভাগি নেই।
ফ্ল্যাটটা ছিল ব্যাংক লোনে নেওয়া। এতদিন তিনি কিস্তিতে পরিশোধ করছিলেন ঋণটা। কিস্তি প্রায় শেষের দিকে বলে রোয়েন ব্যাংকের সাথে বোঝাপড়া করে সময় নিয়ে নেন। মূলত গ্যাস,পানি,বিদ্যুৎ বিল আর খাওয়া-দাওয়া, যাতায়াতের খরচই টানতে হচ্ছে আমাদের। সেই সাথে মাস শেষে বাবা-মার জন্যও নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তো আছেই। মাঝে মধ্যে হিসাবে গড়মিল হলেও সামলে নেই দুইজনে মিলেই।
কিন্তু এইসবের মাঝেও রোয়েন নিজের বেকারত্বের কথা জানাননি কাউকে। এমনকি বাবা-মাকেও না। তার ভাষ্যমতে, বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানার পর সকলেই করুণা করতে চাইবে। অহেতুক সান্ত্বনা ছুড়ে মারবে যখন তখন। হয়তো কেউ অনুগ্রহ করে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাইবে। যা রোয়েনের একদমই সহ্য হয়-না। তিনি না খেয়ে মরবেন তাও কারো নিকট করুণার পাত্র হতে রাজি নন। অবশ্য মানুষটা বেশ আত্মসমপর্ণ। কারো নিকট সে সাহায্য নিতে বা অনুগ্রহের পাত্র হতে রাজি নন। এমনকি টাকা নিতেও তার আত্মসম্মানে লাগে। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি এই স্বভাবের দোষেই তিনি বিয়ের পর আমার বাড়িতে গিয়ে ওসমান সাহেবের থেকে টাকা নেননি। রোয়েনের এই আত্মসম্মানই তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরও বারিয়ে দেয়।
তিক্ত হলেও সত্য এইটাই, ‘টাকা ছাড়া দুনিয়া চলে না।’ এই ভূপৃষ্ঠে বাঁচতে হলে টাকা আবশ্যক।
একমাস হতে চললো বিল্ডিংয়ের মধ্যেই দুটো টিউশনি নিয়েছি। সেই যে ছাদে একবার মুসকানের সাথে কথা হলো এরপরই ওর আর ওর আম্মুর সাথে ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছিল আমার। যার দরুন আমি টিউশনি খুঁজছি তা জানামাত্র মুসকানের আম্মু মানে জাবিন আন্টি মুসকান ও তার বড় ছেলেকে পড়ানোর দায়িত্ব আমায় দিয়ে দিলেন। আমার টিউশনি করানো নিয়ে উনার কোন আপত্তি না থাকায় আমিও সাচ্ছন্দ্যে দুইজনকে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে নিলাম। আজই সেখান থেকে প্রথম স্যালারি পেলাম। জীবনে প্রথম আয় আমার। হোক স্বল্প কিন্তু তাও আমার জন্য এইটা অনেক। এই মূহুর্তে আমি কেমন বোধ করছি তা ভাষায় প্রকাশ্য নয়। শুধু এতটুকু জানি আমার জীবনের উপার্যিত প্রথম আয় আমি রোয়েনের হাতে তুলে দিতে চাইছি। আমি পড়ানো শেষ করে দ্রুত বাসায় চলে আসি। চঞ্চল ভঙ্গিতে চাপতে থাকি ডোরবেলের সুইচ। কিছু প্রহর অতিবাহিত হতেই রোয়েন এসে দরজা খুলে দেন। আমি হাসি মুখে ভিতরে প্রবেশ করি। ড্রয়িংরুমে আসতেই দাঁড়িয়ে পড়ি আমি। মিষ্টি হাসি হেসে রোয়েনকে উদ্দেশ্য করে বলি,
— একটু এইদিকে আসুন তো।
রোয়েন বিনাবাক্যেই আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন,
— কি?
আমি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রোয়েনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি,
— আমার প্রথম আয়। আমি চাইছি টাকাটা সর্বপ্রথম আপনাকে দিতে।
রোয়েন ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলেন,
— আমি টাকা দিয়ে কি করবো?
— আপনার কাছে রাখবেন।
রোয়েন মুখ ঘুচে বলেন,
— প্রথম আয় তোমার। এইটা নিজের কাছে রাখ আর নিজের মত ইনভেস্ট করো। আমার কাছে রাখতে হবে না।
আমি রোয়েনের হাত টেনে তাঁর হাতে টাকাটা গুঁজে প্রসস্থ হাসি হেসে বলি,
— আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাংক হচ্ছেন আপনি। যার নিকট কি-না আমি পুঁজি জমা রাখাবো আর সেটা ইনভেস্ট করে মুনাফা দেওয়ার দায়িত্ব হবে আপনার। বুঝলেন!
রোয়েন কিছু না বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঠোঁটের কিনারে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বলেন,
— সবকিছুতে আমাকে না জড়ালে হয়না?
— আপনি না বলেছিলেন আপনারই অংশবিশেষ আমি। তাহলে আপনাকে জড়ালাম কিভাবে বলুন? আমি আর আপনি তো একই সত্ত্বার দুইটি বাস।
রোয়েন হালকা হেসে আমার কপালে ভালোবাসার এক পরশ একে দিতেই লজ্জায় মিইয়ে যাই। নিজের লজ্জা রাঙ্গা চেহারা লুকাতে মুহূর্তেই জড়িয়ে ধরি তাকে। মুখ লুকাই তাঁর বুকের কোনে। এতে রোয়েন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেন। এক হাত গলিয়ে দেন আমার পিঠে। হঠাৎ নাকে দগ্ধ পোড়া গন্ধ এসে বারি খেতে চট জলদি সরে দাঁড়াই আমি। ক্রোধিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করি রোয়েনের দিকে। কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠি,
— আপনি আবার সিগারেট খেয়েছেন?
আপনার প্রশ্নে যে রোয়েন অপ্রস্তুত বা সংকোচিতবোধ করলেন তা কিন্তু না। উল্টো অকপটে স্বীকারোক্তি করলেন,
— হ্যাঁ খেয়েছি।
— কিন্তু কেন? আপনাকে না মানা করেছি ওইসব ছাইপাঁশ খেতে? তাও এত ত্যাড়ামো কেন করেন?
রোয়েন নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
— সবসময় তো আর খাই না।
— যখন টেনশনে থাকেন তখনই খান তাই তো? কিন্তু তাও খেয়েছেন তো। একবার এইটার নেশা লেগে কি হবে?
— কিছুই হবে না।
আমি আদেশের সুরে বলি,
— কিছু হবে কি হবে না সেটা পরের বিষয়। আপনি এইসব খাবেন না, ব্যস। আপনার জন্য এইসব নিষিদ্ধ।
— আচ্ছা।
আমি এইবার কিছুটা নিভে যাই। আলতো স্বরে বলি,
— এত টেনশন কেন করেন আপনি? কিছু না কিছু একটা হয়েই যাবে। এমন তো নয় হাত গুটিয়ে বসে আছেন আপনি। বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ তো দিচ্ছেই আপনি। একটা না একটা জায়গায় জব হয়েই যাবে।
— যতটা সহজ মনে করছো বিষয়টা ততটা সহজ বিষয়টা না। এই চাকরির বাজারে ভালো মানের একটা চাকরি পাওয়া মুখের কথা নয়। যোগ্যতা থাকলেও অনেক সময় টাকার সামনে হার মানতেই হয়।
কথাটা শুনে আমি চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকি। কথাটা সত্য যে এখনকার পলিসিই হচ্ছে, ‘টাকা পকেটে তো চাকরি হাতের মুঠোয়।’ সাধারণ পদের চাকরিতে জয়েন হতেও এখন বড় অংকের ডোনেশন দিতে হয়। আবার সকল জায়গায় যোগ্যতা অনুযায়ী পদও পাওয়া যায় না। এই জনবহুল দেশে জনসংখ্যার পরিমাণ বৃহৎ হলেও কর্মসংস্থানের পরিমাণ জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। ক্ষণেই বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘনিশ্বাস। আমি ব্যথিত চোখে রোয়েনের দিকে তাকাতেই দেখতে পাই তাঁর মলিন চাহনি। মুহূর্তেই বুকটা দুমড়ে-মুষড়ে যায় আমার। এই চাহনির পিছে যে নিজের প্রতি কতটা ক্ষোভ আর ব্যর্থতা লুকিয়ে আছে তা আমার অজানা না। আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য ঠোঁটের কোনে সরু হাসির রেখা ফুটিয়ে বলি,
— আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর রান্না করে নিচ্ছি।
— আমি রান্না করে ফেলেছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার সাজাচ্ছি।
আমি দীর্ঘ এক হাসি হেসে সম্মতি জানিয়ে চলে যাই ফ্রেশ হতে।
#চলবে
#নিভৃতে_যতনে
#Part_41
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
বিষন্নতার চাদর মুড়ি দিয়ে আকাশে ভিড় করেছে ধসূর রাঙ্গা মেঘ। দমকা হাওয়ার প্রকট, সেই সাথে মৃদু পরিমাণে মেঘের গর্জন। ধুলোবালিতে মাখোমাখো পরিবেশ। কালবৈশাখী ঝড়ের পূর্বভাস। আমি দুই কাপ কফি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে ক্ষণেই বিষন্নতা প্রগাঢ়তা কমাতে ঝুম করে নেমে পড়লো এক পশলা বৃষ্টি। আমি একপলক জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রোয়েনের দিকে এক কাপ কফি এগিয়ে দেই। অতঃপর চেয়ার টেনে জানালার ধারে বসে পড়ি আমি। একমনে তাকিয়ে থাকি বৃষ্টির পানে। ভাবতে থাকি পুরোনো স্মৃতির কথা। এক বছর পূর্বে এমনই এক অনাকাঙ্ক্ষিত বর্ষণের দিনের জানা হয়েছিল আপন মানুষটি মনের কথা। অনুভব করেছিলাম তাঁর উষ্ণ ছোঁয়া। নিভৃতে গড়া সম্পর্কটি নিভৃতেই পূর্ণতা পেয়েছিল ক্ষণেই। আর সেটার সাক্ষী ছিল এই বৃষ্টির কণাগুলো। অবশ্য এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অজস্র অনুভূতি, স্মৃতির সাক্ষীই এই বৃষ্টি কণাগুলো। হঠাৎই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে এক চিলতে হাসি। আমি বৃষ্টি হতে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাই রোয়েনের দিকে। রোয়েন আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল যার দরুন চারটি চোখ এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়। চোখের ভাষা আদান-প্রদান হতে থাকে নীরবেই। তাঁর অদ্ভুত মায়াযুক্ত চোখের পানে দৃষ্টি স্থির রাখাটা দায় হয়ে আসতেই দৃষ্টি নত করে ফেলি আমি। আলতো হাতে কানের পিঠে গুঁজে নেই অবাদ্ধ চুলগুলো। এই চোখের গভীরে যে আমার সর্বনাশ। আমি দৃষ্টি নত রেখেই ছোট ছোট চুমুক বসাতে থাকি কফির কাপে। হঠাৎ রোয়েন বলে উঠেন,
— সামনে কি করবে ঠিক করেছ কিছু?
আমি একপলক রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলি,
— উঁহু।
অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভিতরে কথাগুলো খানিকটা গুছিয়ে নিলাম আমি। নরম সুরে বলি,
— এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেই নি আমি। কিন্তু ভাবছি এখন নিয়ে নিব।
আমার কথার মাঝে রোয়েন ফোড়ন দিয়ে বলেন,
— সেমিস্টার গ্যাপ দিবে তাই তো?
আমি স্মিত হেসে বলি,
— হু! আর এক সেমিস্টার গ্যাপ দিলে কিছু হবে না। পরে সেমিস্টার কমপ্লিট করে নিব নে।
রোয়েন কিছু না বলে শুধু আমার পানে তাকিয়ে থাকেন। অতি মলিন তাঁর চাহনি। আমি পুনরায় একপলক তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টিতে সরিয়ে নেই৷ তাঁর চোখে চোখ রাখার দুঃসাহসিকতা আমার নেই। এখন তো একদমই নেই। কেন না, এই দৃষ্টি যে আজকাল ব্যর্থতায় ভরা। তার দৃষ্টি স্পষ্ট বলে উঠছে, টাকার সামনে হেরে গিয়েছেন তিনি। অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনযাত্রার মান। যার দরুন আজ সে জোড় গলায় আমায় বলতেও পারছেন না, “তোমার সেমিস্টার গ্যাপ দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমি ব্যবস্থা করে নিব।” মানুষটাকে আগে কখনো এতটা মলিন চাহনিতে দেখিনি। সর্বদা শক্ত-পোক্ত আর নির্মল-শীতল চাহনিতেই দেখেছি। অথচ আজ পরিস্থিতির থাবার নিচে পরে বদলে গেছে সবটাই। আমি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকে সামাল দেওয়ার জন্য বলে উঠি,
— আগে না-হয় সংসার গুছাই তারপর না-হয় ক্যারিয়ারটা গোছাবো। আর আপনি তো সর্বদা আছেনই আমার পাশে। আমাকে সাপোর্ট করতে৷ কি আছেন না পাশে?
রোয়েন আমার কথা শুনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। তা দেখে আমি আশ্বস্ত দিয়ে বলি,
— ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। চেষ্টা তো দুইজনই করছি, কারো না কারো তো চেষ্টা সফল হবেই।
রোয়েন তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলেন,
— হু।
আমি প্রসস্থ এক হাসি হেসে কফির কাপটা টেবিলের উপর রেখে এগিয়ে যাই রোয়েনের দিকে। তাঁর একটি বাহু টেনে বলি,
— ছাদে চলুন, বৃষ্টিতে ভিজবো।
তিনি ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলেন,
— কি করতে?
আমি দাঁত কেলিয়ে বলি,
— উষ্টা খেতে। এখন চলুন তো।
তিনি একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলেন,
— তো একা গিয়ে খাও না। আমায় কেন টানছো?
— আপনি আমার জামাই তাই।
কথাটা বলেই তাঁর হাত ধরে টানতে শুরু করলাম। আগাত তাঁকে উঠতে হলো। একরকম বাধ্য হয়েই পা বাড়ালেন আমার সাথে ছাদের উদ্দেশ্যে। ছাদে আসতেই আমি তাঁকে টেনে দাঁড় করাই বৃষ্টি মাঝে। মিষ্টি হাসি হেসে বলি,
— হাজারো দুঃখের মাঝে বিন্দু বিন্দু সুখ খুজে পাহাড় সম সুখ উপভোগ করার চেষ্টা করতে হয়।নাহলে একসময় জীবন বিষাক্ত হয়ে উঠে।
রোয়েন কিছুক্ষণ আমার পানে তাকিয়ে থেকে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠেন,
— তুমি কি জানো, তুমি আমার ভাবনার চাইতেও বেশী শক্ত?
আমি কিছু না বলে মৃদু হাসি। তাঁর থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে দুই হাত ছড়িয়ে দেই দুইপাশে। চোখ দুইটি বন্ধ করে উপভোগ করতে থাকি বৃষ্টির একেকটা শীতল শিহরণ৷ প্রাণভরে কাঁচামাটির গন্ধ নিঃশ্বাসে ভরতে থাকি। কিছুক্ষণের জন্য জীবনের সকলের গ্লানি,কষ্ট ভাসিয়ে দেই বৃষ্টির স্রোতে।
____________________
আমি মুসকার আর মাহিরকে পড়াচ্ছি এমন সময় জাবিন আন্টি ট্রেতে করে কিছু ফল আর শরবত নিয়ে আসলেন। টেবিলের একপাশে সেগুলো রাখতে রাখতে বলে উঠেন,
— ভালো আছো তুমি?
আমি সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলি,
— জ্বী আলহামদুলিল্লাহ আন্টি। আপনার শরীর ভালো আছে?
— এইতো। তা তোমার সাথে কিছু কথা ছিল আমার।
কথাটা শোনা মাত্র হাসির মাত্রাটা কমে আসে।ক্ষণেই বুকটা ধক করে উঠে। ভীতি ঢুকে যায় মনে, ‘টিউশন হাতছাড়া হয়ে যাবে না-তো?’ আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠি,
— জ্বী আন্টি বলুন।
— তুমি কয়েকদিন আর কিছু টিউশনির খোঁজ করছিলে না?
— করছিলাম তো।
— তো আমার কাছে একটা প্রস্তাব ছিল তোমার জন্য।
আমি ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলি,
— কি প্রস্তাব?
— আমার বোনের ভাসুর একটা কোচিং সেন্টার চালায়। সেখানে নতুন কিছু টিচার নিয়োগ করবে বলে আমাকে বলছিল। তখন আমি তোমার কথা বলেছিলাম। তা তুমি কি কোচিং সেন্টারে পড়াতে চাও?
আন্টির কথা শেষ হতেই প্রাণে প্রাণ ফিরে পাই আমি। প্রশান্তির এক নিঃশ্বাস নিয়ে জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বিনয়ী সুরে বললাম,
— আমি পরে আপনাকে জানাবো৷
— আচ্ছা সমস্যা নেই। জানিও পরে।
কথাটা বলেই তিনি চলে গেলেন। আমিও বুক ভরা আশা নিয়ে পড়াতে শুরু করলাম।
____________________
কফির কাপে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছি আর আড়চোখে রোয়েনকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি। তিনি মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপ চালাচ্ছেন। আমি মনে মনে বার বার কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু তাও কিভাবে কথাটা শুরু করবো তাই বুঝে উঠতে পারছি না। কেন না আমি চাইছি, টিচার হিসাবে রোয়েন নিয়োগ হোন। তিনি আপাতত কিছু একটা করুন। এইভাবে এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় দৌড়াতে দৌড়াতে তো একসময় হতাশ হয়ে পড়বেন। ভেঙে পড়বেন একসময়। এর চেয়ে ভালো কিছু একটা না-হয় করুক। মন অন্য কোথাও স্থির হোক।
আমি কথা খুঁজে না পেয়ে বেশ কয়েকবার গলা ঝেড়ে উঠি। রোয়েন তা বুঝে বলে উঠেন,
— কিছু বলবে?
আমি মিনমিনে সুরে বলি,
— হু।
রোয়েন ল্যাপটপের দিকে নজর রেখেই বলেন,
— বলো।
আমি জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নেই। কোন ভূমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করি,
— মুসকানের আম্মু তার পরিচিত একটা কোচিং সেন্টারের কথা বলছিলেন। সেখানে নাকি কিছু টিচার লাগবে। তা আমি চাচ্ছিলাম যে, আপনার কথা বলতে। ইন্টারভিউ দেওয়া বাদে তো ফ্রিই থাকেন বেশির ভাগ। আপনার কাছে যেহেতু সময় আছেই সেহেতু সময়টাকে কাজে লাগালে তো মন্দ হয়না।
তিনি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন,
— এইসবের মধ্যে আমি নেই। পড়ানো বিষয়টা এখন আর আমার দ্বারা সম্ভব না।
আমি তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলি,
— চেষ্টা করতে সমস্যা কি?
তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন,
— আমার বদলে না-হয় তুমি করো।
আমি খানিকটা ভড়কে গিয়ে বলি,
— আমি?
— হুম। দুইটা স্টুডেন্ট তো একসাথে পড়াচ্ছোই। এইবার না-হয় দশ-বারোজন পড়ালে।
আমি ইতস্তত করে বলি,
— কিন্তু….
রোয়েন আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
— তুমি করলে সমস্যা বা কোথায়? সুযোগ যেহেতু আসছে সেহেতু সেটা কাজে লাগাতে শিখো।
___________________
আমি সকল ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছি আর বার বার জালানা দিয়ে বাইরের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করছি। ঘনকালো মেঘের আবরণে ঢেকে আছে বিশাল আকাশটি। বিকেল হওয়া সত্ত্বেও চারদিকে ছড়িয়ে আছে নিকষ অন্ধকার। থেমে থেমে বইছে ঝোড়ো হাওয়া। ঝড় না নামলেও মুষলধারে বৃষ্টি ঠিকই নামবে আজ। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে পুনরায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে মনোযোগী হলাম। এই কোচিং সেন্টারে টিচার হিসাবে নিয়োগ হয়েছি প্রায় একমাসের ছুঁইছুঁই। রোয়েন কথাতেই আমি জাবিন আন্টিকে হ্যাঁ বলেছিলাম। অতঃপর জাবিন আন্টিই আমাকে এইখানে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেন। অবশ্য আমার নিয়োগ হওয়ার আগে রোয়েন কোচিংটির সম্পর্কে সকল তথ্য ভালো মত যাচাই বাছাই করে নিয়েছিলেন। সব ঠিক আছে নিশ্চিত হওয়ার পরই আমি নিয়োগ হয়েছিলাম এইখানে। রোয়েনও এখন একবারে বেকার বসে নেই। ফ্রিল্যান্সিং-এর দিকে জোড় দিচ্ছেন কিছুটা। যতদিন না ঠিকঠাক মনের মত একটা জব পাচ্ছেন ততোদিন ফ্রিল্যান্সিং করবে বলে জানিয়েছেন৷ এতে অবশ্য আমার আপত্তি নেই। মানুষটা একবারে খালি বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করুক এইটাই আমার কাম্য।
পড়ানো শেষ করে আমি অফিস-রুমে চলে যাই। কিছু পেপারের কাজ ছিল বিধায় বের হতে খানিকটা সময় লেগে যায়। কাজ শেষ হওয়া মাত্র কাঁধে ব্যাগ চেপে বেরিয়ে পড়ি আমি। সিড়ি ভেঙ্গে নামতে নামতেই ধরণীর বুকে নেমে পড়ে মুষলধারে বৃষ্টি। নিচে গেটের সামনে এসে বৃষ্টির দাপট দেখে বিরক্তি মুখ ঘুচে আসে আমার। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখি রাস্তা-ঘাট একদম খালি। মানুষজন তেমন নেই বললেই চলে। ছাত্র-ছাত্রীরাও চলে গিয়েছে সব। আজ আবার এক ইন্টারভিউ আছে বিধায় রোয়েন আমায় নিতে আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন। তাই যেতে হলে আজ একাই যেতে হবে। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে তাতে রিকশা পাওয়া দুষ্কর ঠেকছে এখন। ব্যাগে কিছু দরকারী কাগজ না থাকলে ভিজেই যাওয়া যেত কিন্তু সেটা তো এখন সম্ভব নয়। আমি বিরক্তিতে মৃদুস্বরে বলে উঠি, ‘ধ্যাত!’
বেশ কিছুক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করলাম। সেই সাথে যাতায়াতের জন্য যানবাহনের সন্ধান করলাম বহুক্ষণ। কিন্তু শেষে বৃষ্টি প্রলেপ বাড়তেই হাল ছেড়ে দেই আমি। চারদিকটা একদম জনমানবশূন্য বলে আমি উপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াই। ঠিক তখনই পিছন থেকে ভেসে আসে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সুমধুর কন্ঠ।
#চলবে