নিভৃতে যতনে পর্ব-৪৪+৪৫

0
966

#নিভৃতে_যতনে
#Part_44
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

বনানীর এক বাফেট রেস্টুরেন্টে আরহান ভাইয়ার জন্য পাত্রী দেখতে এসেছি আমরা সকলেই। সকলে বলতে আমি, রোয়েন, তানিয়া ফুপু, রিশাদ ফুপা, আরহান ভাইয়া,জেরিন, ছোট ফুপু ও ছোট ফুপা। ঘটা করে নাহলেও মোটামুটি আয়োজন করেই এসেছেন তানিয়া ফুপু ছেলের পছন্দের মেয়েকে দেখার জন্য। একমাত্র ছেলে হওয়া সুবাদে আরহান ভাই কাউকে পছন্দ করে শুনে ফুপু তৎক্ষনাৎ মেয়ে পক্ষের সাথে দেখা করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সরাসরি দেখা করে সকল তথ্য সংগ্রহ করে পরবর্তীতে যাচাই-বাচাই করবে বলে ভাইয়াকে বাড়তি কিছুই জিজ্ঞেস করেননি। শুধু মেয়ে কিসে পড়ে, কি করে তা নিয়েই একটু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। এর ব্যতীত কিছুই না। এমনকি মেয়ের ছবি পর্যন্ত দেখেননি। অবশ্য ছবি না দেখার পিছনে যথার্থ কারণও লুকায়িত আছে। তার ভাষ্যমতে, এখনকার সকল মেয়েরাই ফিল্টার দিয়ে বেশি ছবি তুলে। যার দরুন তাদের ছবি আর বাস্তবে পুরোই পৃথক দেখায়। তিনি প্রথমে ছবি দেখে মেয়েকে পছন্দ করে পরে হতাশ হতে চান না বলেই ছবি দেখতে চাননি।
পাত্রীপক্ষ এখনো আসেনি। আরহান ভাইয়া খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো, রাস্তায় নাকি জ্যাম তাই আসতে তাদের একটু দেরী হচ্ছে। সকলেই অপেক্ষা করছে আর নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলছে। আমিও মাঝে মধ্যে তাদের সাথে তাল মিলাচ্ছি। আরহান ভাইয়া আমার সাথে ভাব জমাচ্ছে। কেন না, আমার বিয়ের সময় তিনি দেশে ছিলেন না। আমার বিয়ের পর এই প্রথম দেশে এলেন। তাকে আমি প্রথম দেখছি সেও আমায়। তাই আমার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন বেশ। অবশ্য ভাইয়ার মজার মানুষ তাই কথা বলতে খারাপ লাগছে না। সকলে কম-বেশি কথা বললেও রোয়েন আমার পাশেই চুপটি মেরে বসে আছেন। দৃষ্টি তাঁর নত হাতে থাকা মুঠোফোনের জন্যে। ভাবভঙ্গী দেখেই বুঝা যাচ্ছে তিনি এই পরিবেশে এসে বেশ বিরক্ত। তাই নিজের মনোযোগ মুঠোফোনের মাঝে নিবদ্ধ করে রেখেছেন। ক্ষণেই আমি চাপা কন্ঠে বলে উঠি,

— বিরক্তবোধ করছেন?

রোয়েন সচকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,

— তা নয় তো কি? পাত্রী দেখার নামে যে সার্কাস চলছে তাতে নিশ্চয়ই আমার খুশিতে আপ্লূত হওয়ার কথা না?

আমি বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করি,

— সার্কাস কই পেলেন?

— চারপাশে অভাব আছে?

— আপনিও না! কি হয় একটু সকলের সাথে কথা বললে? এত চুপচাপ কিভাবে থাকে মানুষ?

রোয়েন আমার দিক থেকে নজর সরিয়ে মুঠোফোনের দিকে নজর বুলাতে বুলাতে বলেন,

— কি জানি!

আমি বিরবির করে বলে উঠি,

— খারুশ কোথাকার।

— তোমার বরই।

হঠাৎ রোয়েন কথাটা বলে উঠায় আমি পিলে চমকে তাকালাম। তার মানে তিনি শুনে ফেলেছেন। হায় আল্লাহ! তাঁর শ্রবণশক্তি এত তীক্ষ্ণ কেন? হুয়াই? এর জন্য বিরবির করে কথা বলাও দায় আমার। হুহ!

বেশ কিছুক্ষণ পর আরহান ভাইয়ের ফোন আসলো। পাত্রীপক্ষ থেকে ফোন এসেছে। তারা নাকি চলে এসেছেন কিন্তু ঠিক রেস্টুরেন্টটা চিনতে পারছেন না। আরহান ভাইয়া তাদের এগিয়ে আনতে নিচে চলে যান। অতঃপর গুটিকয়েক মিনিটের মাঝেই আরহান ভাইয়া তাদের নিয়ে আসে। দুইপক্ষ মুখোমুখি হতেই সকলের চোখ-মুখে বসতি স্থাপন করে একরাশ বিস্ময়। সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেও আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সামনে। সকলকে পর্যবেক্ষণ করছি সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে। সময়ের চক্র যে ঘুরে অতীতকেই টেনে আমার সামনে এনে হাজির করবে তা কে জানতো? পরক্ষণেই আরহান ভাইয়ার কন্ঠে সকলে সচকিত তার পানে তাকায়। আরহান ভাইয়া প্রফুল্ল সুরে বলছেন,

— মা ও হচ্ছে হৃদি৷ যার কথা আমি তোমায় বলেছিলাম।

আমি এইবার হৃদিপুর দিকে তাকালাম। হ্যাঁ হৃদিপু! হৃদিপুই হচ্ছে পাত্রী আর পাত্রীপক্ষ হচ্ছে আমার পরিবার। না! আমার পরিবার কথাটা ভুল বললাম। এদের সাথে তো এখন আমার কোন সম্পর্কেই নেই। তাহলে এরা আমার পরিবার কিভাবে হয়? কিন্তু সেটা এখন না চাওয়া সত্ত্বেও জুড়ে যাবে। মিথ্যে জোড়াতালি লাগবে সকলের চক্ষুদ্বয়ের স্বচ্ছ পর্দায়। কেন না, ভিতরের খবর তো আর বাহিরের মানুষ জানে না। আর আমি জানতেও ইচ্ছুক না। হঠাৎ রোয়েন আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি ক্ষণেই তাঁর দিকে তাকাতেই তিনি চোখ দিয়ে শান্ত থাকতে ইশারা করলেন। সেই সাথে, আশ্বস্ত করলেন তিনি আছে আমার পাশে। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে ক্ষান্ত হলাম।
একপলক সকলের দিকে তাকালাম। হৃদিপুর সাথে বলতে বাসার সবাই এসেছে। বড় চাচা,চাচী, ওসমান সাহেব ও মা। তাদের দৃষ্টি অবশ্য আমার উপরই নিবদ্ধ। নিজেকে স্বাভাবিক করতেই তানিয়া ফুপু বলে উঠেন,

— এনারা তো আমাদের পূর্বপরিচিত৷ তোর সিয়াশা ভাবীর বাড়ির লোকজন এনারা। এনাদের সাথে তো আমাদের আত্মীয়তা বেশ পুড়ানো।

কথাটা শুনে আরহান ভাইয়ার মুখ অবিশ্বাস্য ভাবটা জ্বলজ্বল করে উঠে। হয়তো এমনটা আশা করেননি। কিন্তু সেই ভাবটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। পরক্ষণেই আগের চেয়ে দ্বিগুণ প্রফুল্লিত দেখালো তাকে। সকলে উঠে কুশল বিনিময় করতেই মা আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমি উঠে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। অতঃপর হৃদিপুর কাছে এগিয়ে গেলাম, জড়িয়ে ধরে টুকটাক কথা বললাম। ভদ্রতার খাতিরে ওসমান সাহেব আর চাচা-চাচীকে সালাম দিলাম আর ছোট করে ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করে সরে আসলাম।
সকলে এইবার মুখোমুখি হয়ে বসে পড়লো। আমি রোয়েনের পাশে বসতেই তিনি আমার হাতটি তাঁর হাতের শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ করে নিলেন। নিভৃতেই যেন আশ্বস্ত করলেন, ‘ চিন্তা নেই তিনি আছেন,আমি যাতে দূর্বল না হই।’ আমিও মিষ্টি হেসে একদম স্বাভাবিক থাকি। এইদিকে পূর্বপরিচিত হওয়ায় নতুন করে কিছু জিজ্ঞেস করলো না কেউ। বরং নিজেদের মত কথা বলতে লাগলো। দুইপক্ষই যে এই বিষয়ে অনাগত ছিল তা নিয়েই বেশ আলোচনা হলো। অতঃপর আলোচনা হলো সম্মোধনটা নিয়ে।

কথার ফাঁকে হঠাৎ ওসমান সাহেবের দিকে নজর যেতেই দেখি তিনি নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টি তাঁর কাতরতাপূর্ণ। আমি তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নেই। আনমনে ভাবি, ‘এখন এই দৃষ্টির মানে কি? আদৌ কি কোন মানে আছে?”
ক্ষণেই মনের দুয়ারে পুরনো স্মৃতি আঁচড়ে পড়ে, নাসরিন বেগমের মৃত্যুর পরে আমার সাথে কেউ তেমন একটা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি৷ দুই একবার ঘরের ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন এসেছিল কিন্তু আমি ধরিনি। আমি এইসবের ধার না ধরে মুভ অন করে গিয়েছিলাম। তিক্ততায় ঘেরা স্মৃতিকে মনের কোন একস্থানে মাটি চাপা দিয়ে নতুন জীবনের সূচনা রটেছিলাম৷ বলা বাহুল্য, আমি একটু হলেও ভেবেছিলাম হয়তো সেই ঘটনার পর সকলে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হবে, ক্ষমা চাইবে। সম্পর্ক ঠিক করতে চাইবে। কিন্তু নাহ! ধারণা ভুল ছিল আমার,এমন কিছুই হয়নি। বরং সব সেই আগের মতই ছিল৷ কথাটা ভেবেই তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম আমি। আগের ঘটনা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে হালকা হাসার চেষ্টা করলাম।
সবাই যখন টুকিটাকি কথা বলছে তখন হঠাৎ জেরিন বলে উঠলো,

— ভাবী, তুমি তো দেখছি এখন দুইপক্ষের লোক হয়ে গিয়েছ। তা তুমি কার পক্ষ হয়ে সব করবে? মানে কোন দলে থাকব?

আমি একবার সকলের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলি,

— অবশ্যই আমি আমার দেবরের দলে। জানোই তো, বিয়ের পর বরের বাড়িই নিজের বাড়ি। এর ব্যতীত তার নিজের বলে কোন স্থান নেই। তো আমি এখন নিজের বরের পক্ষে না থেকে কোন পক্ষে থাকি বলো?

ক্ষণেই জেরিন খুশি হয়ে যায়। আমি অবশ্য, কথাটা কিছুটা রসিকতার সুরেই বললাম যাতে কেউ সন্দেহ না করে। সেই সাথে আড়চোখে একবার হৃদিপুর পরিবারের সকলকে দেখে নিলাম। সকলের মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। হয়তো মজার ছলে বলা আমার কথার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছে। আমি সেসব তোয়াক্কা না করে সামনে তাকালাম। এদের নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমার নেই। ফুপুরা কেউ এই বিষয়ে মাথা ঘামান-নি বরং তারা অন্য কথায় চলে গিয়েছে। অতঃপর বড়রা একান্ত কিছু কথা বলবে বলে আমাদের ছোটদের অন্য টেবিলে পাঠিয়ে দেন এবং আমরা যাতে খাওয়া শুরু করি সেই নির্দেশনাও দেন।
আমরাও তাদের কথামত যে যার মত উঠে হাতে প্লেট নিয়ে খাবার নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমি ঘুরে ঘুরে খাবার নিচ্ছি এমন সময় হৃদিপু সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি তাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলি,

— কিছু বলবে?

হৃদিপু কয়েকবার পলক ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— ভালো আছিস?

— খারাপ থাকার কথা বুঝি?

— বড্ড বেশি বুঝিস।

— আচ্ছা সরি। তা তলে তলে এইসব ষড়যন্ত্র করেছ তাই না? সবশেষে বোন থেকে আমার ভাবী হয়ে গেলে? কি ষড়যন্ত্র রে বাবা। একবার আমাকে জানালে কি হতো? তোমার ভাবী হওয়া বয়কট করতাম আমি? এত খারাপ ভাবো আমায়?

শেষের কথা দুঃখী দুঃখী গলায় বললাম। হৃদিপু আমার পিঠ ধুম করে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলে,

— তুই আর সুধরাবি,না? আর আমি কি জানতাম নাকি ও তোর জামাইয়ের বংশের কেউ? ওর পরিবারকে আমি নিজেও আজ প্রথম দেখছি।

আমি মুখ ঘুচে বলি,

— হ্যাঁ তাও ঠিক। প্রেম তো তুমি ভাইয়ার সাথে করসো, তার ফ্যামিলি বা ১৪ জাতগোষ্ঠীর সাথের না। বুঝবা কেমনে?

— ফাজিল! মজা নিচ্ছিস আমার সাথে?

— নিতেই পারি। একমাত্র বোন প্লাস ভাবী বলে কথা।

কথাটা বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলাম। হৃদিপু মুখ ঘুচে বলে,

— হুহ!

আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বলি,

— তা তুমি বিয়ে করছো আমায় জানাও নি পর্যন্ত। এই তোমার ভালোবাসা? ভাইয়ার পক্ষ ছিলাম বিধায় জেনেছি নাহলে ঠুস করে বিয়ে করে ঠাস করে বাচ্চাও পয়দা করে নিতা আর আমি খবরও পেতাম না। হুহ!

হৃদিপু অভিমানী সুরে বলেন,

— এই আট-নয় মাসে একবারও নিজে ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছিস আমার? যোগাযোগ রেখেছিস যে বলবো? এখন আসছে আমার ভালবাসা নিয়ে প্রশ্ন করতে।

কথাটা বলে হৃদিপু মুখ ঘুচে নিলে আমি অসহায় দৃষ্টিতে হৃদিপুর দিকে তাকাই। আপন ভাবনায় বলি, কিভাবে বলি তোমায় এই কয়েকমাস আমি কিসের মধ্যে ছিলাম। পরিস্থিতি খারাপ ছিল সেই সাথে পুরো সংসারের দায়িত্ব। চেয়ে তো পারি যোগাযোগ রাখতে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি মধ্যে কাটতো সময়। কতটা চাপে ছিলাম তা শুধু আমি জানি। ফোন হাতে নিয়ে দেখার সময় ছিল নাকি তখন? নেহাৎ রোয়েন পাশে ছিল বলে নির্বিঘ্নে কষ্টগুলো সুখ বলে গণ্য করে নিয়েছিলাম। বিসর্জন দিয়েছিলাম নিজের সকল অভিযোগ,ক্লান্তি। হাসি মুখেই সামলিয়েছি সব। একমাত্র আপন মানুষটার জন্য।
ক্ষণেই হৃদিপুর তেতো কন্ঠ কর্ণধারে এসে বারি খেতেই সচকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই।

— সমস্যা তো আমার সাথে ছিল না। তাহলে যোগাযোগ বন্ধ করলি কেন আমার সাথে? মাঝে মধ্যে ফোন দিলেও তেমন রেসপন্স করতি না। তখন কত খারাপ লাগতো জানিস?

আমি মুখটা ছোট করে বলি,

— সরি আপু! আসলে এই কয়েকটা মাস অনেক ব্যস্ত ছিলাম। তার উপর বাবা মারা যাওয়ার পর সকলের পুরো দায়িত্বটাই আমার উপর এসে পড়েছিল। তাই এইসবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।

— আঙ্কেল যে মারা গিয়েছে তা জানিয়েছিলি একবারো আমাদের? তোর শ্বাশুড়ির সাথে চাচীর কথা না হলে জানতামও তো না। শেষ দেখাটা নাহলেও দেখে আসতো একবার সকলে। জানি, তুই এই বাড়ির কাউকে আপন ভাবিস না কিন্তু জানানো দরকার ছিল।

— ওসব বাদ দাও। সেই বিষয়ে নিয়ে কথা বলে লাভ নেই৷ আর তুমি রাগ করে থেকো না প্লিজ। আই প্রমিস আর এমন হবে না। এইবারের মত মাফ করে দাও। এমনেও আমার দেবরকে বিয়ে করছো, সো ভ্যাট ইজ প্রযোজ্য। আমার আবার বেশি ডিমান্ড নেই,ভ্যাট হিসাবে মাফ করে দিলেই হবে।

আমার কথা শুনে হৃদিপু ফিক করে হেসে দেয়। আমি পাশ দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরতেই হৃদিপু আমায় জড়িয়ে ধরে বলে,

— দিলাম!

ক্ষণেই দুইজনে একত্রে হেসে দিলাম।

#চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_45
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

বিয়ের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আরহান ভাইয়ার বাসায় লোকজনের আনাগোনা প্রচুর। মেহমানে পরিপূর্ণ আনাচে-কানাচে। দুইদিন বাদেই আরহান ভাই আর হৃদিপুর বিয়ে। পূর্বপরিচিত হওয়ার সুবাদে কথা পাকাপাকি হতে সময় লাগেনি। সবকিছু পাকাপাকি হতেই বিয়ের ডেট ঠিক করা হয়। সবকিছু দ্রুত হওয়ার কারণ হচ্ছে আরহান ভাইয়া। কেন না তিনি পাঁচ মাসের ছুটিতে দেশে এসেছেন। আর এরমধ্যেই তিনি বিয়ের পর্ব চুকিয়ে হৃদিপুর জন্য ভিসা,পাসপোর্টের জন্য অ্যাপ্লাই কর‍তে চান। তার ইচ্ছা আছে একবারে হৃদিপুকে নিয়ে যাওয়ার। কারো এতে বেশ একটা সমস্যা না হওয়ায় সকলেই তার এক কথাত রাজি হয়ে যায়। বিয়ের আয়োজনে তোড়জোড় লাগিয়ে দেয় দুইপক্ষেই।

আজ আরহান ভাইয়া আর হৃদিপু হলুদ। দুইপক্ষ একসাথে অনুষ্ঠানটি না করে পৃথক পৃথকভাবেই করছে। আমি যেহেতু আগেই বলেছি আমি আরহান ভাইয়ার দলে তাই আমি তাদের হয়ে কাজ করছি। আজ হলুদ বলে কাজের চাপ বেশি। তাই বড় ফুপুর কাজে হাত এগিয়ে দিতে মা আর আমি সকাল সকালই এইখানে এসে পড়েছিলাম। রোয়েনও আসেন বড় ফুপাকে কাজে সহযোগিতা করার জন্য। আমি আর মা আসার সময় নিজেদের সাথে তৈরি হওয়ার জন্য পোশাক নিয়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম পরে এইখানেউ রেডি হয়ে সোজা অনুষ্ঠানে যোগ দিব। রোয়েন নিজের গৃহস্থল ব্যতীত আর কোথাও আরামদায়ক বোধ করেন না বিধায় নিজে তৈরি হওয়ার জন্য পোশাক আনেনি। তিনি বরং বিকেলের দিকে বাসায় গিয়ে একবারে রেডি হয়ে আসবেন।
বিকেলে সব কাজ শেষে আমি যখন রুমে তৈরি হতে যাই তখন দেখা যায় আমি শাড়ির সাথে ব্লাউস পিসটাই আনতে ভুলে গিয়েছি। সকালে তাড়াহুড়ো করার ফল আরকি। রোয়েন তখনও বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হয়নি বিধায় তিনি আমাকে নিয়েই বাসার উদ্দেশ্য রওনা হন। পুনরায় সেখানে গিয়ে তৈরি হওয়াটা বেশ সময়ের ব্যাপার বলে বলি সব জিনিসপত্র বাসায় নিয়ে আসি৷ আর একাই তৈরি হতে থাকি।

শাড়ি পড়ার প্রতি আগ্রহ না থাকলেও বড় ফুপু নিজ হাতে আমায় হলুদের জন্য একটা শাড়ি দিয়েছেন বলে বাধ্য হয়ে পড়তে হচ্ছে। উপরন্তু, আমার একান্ত আপন মানুষটারও শাড়ি বেশ প্রিয়। দৃষ্টির অগোচরে বলেছিলেন একবার আমায়৷ তাই তো মাঝে মধ্যে নিজের বিরক্তি ঠেলে দিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেই শাড়ি।
আমি যখন কুচিগুলো হাতে নিয়ে সামাল দিচ্ছি তখনই রোয়েন পাঞ্জাবীর হাত ফোল্ড করতে করতে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসেন। গায়ে কাঁচা হলুদ রাঙ্গা পাঞ্জাবি আর ব্লু জিন্স। পাঞ্জাবীর উপর স্কায় ব্লু কালার কুর্তি। চুলগুলো এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে কপালে। কোন এক কারণে শ্যামবর্ণ মুখখানি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে বেশ। আমি তাঁর দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাঁকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ক্ষণেই তিনি আমার সামনে এসে তুরি বাজিয়ে উঠতেই আমি পিলে চমকে উঠি। মুহূর্তেই হাতে থেকে কুচিগুলো পড়ে এলোমেলো হয়ে যায়। আমি একপলক তাঁর দিকে তাকিয়ে একটু পিছিয়ে যাই। নিচু হয়ে শাড়ির কুচিগুলো কুড়িয়ে নিয়ে তা ঠিক করার কাজে লেগে পড়ি। হঠাৎ রোয়েন আমার পায়ের সামনে হাটু ভেঙে বসেন। আলতো হাতে কুচিগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে স্বগোতক্তি কন্ঠে বলে উঠেন,

— বলেছি না একবার, তার কুচিগুলো সামলে রাখার দায়িত্ব আমার? সে দায়িত্বে হস্তক্ষেপ কেন করো তুমি? ষ্টুপিড!

কথাটা শোনামাত্র আমি কিছুটা ভড়কে যাই, ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তাঁর পানে। তিনি আমার দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে কুচি ধরে মৃদু টান দিতেই আমি দ্রুত হাতে কুচিগুলো গুছিয়ে নেই৷ নাহলে পরবর্তীতে তাঁর একটা বকাও মাটিতে পড়বে না।

কাঁচা হলুদ রাঙ্গা শাড়ির সাথে মিলিয়ে গলায় ও কানে কাঁচা ফুলের গহনা এবং দু’হাতে দুইমুঠো রেশমি চুড়ি পড়ে ক্ষণেই তৈরি হয়ে নেই আমি। রোয়েনের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে উঠি,

— আমি রেডি। চলুন!

রোয়েন একপলক ভালো করে আমায় পর্যবেক্ষণ করে নিলেন। অতঃপর ক্ষীণ স্বরে বলে উঠেন,

— দুটো জিনিসের কমতি রয়ে গিয়েছে।

আমি কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— কি?

তিনি নীরবে উঠে চলে যান ডেসিং টেবিলের সামনে। ছড়িয়ে থাকা মেকাপ সামগ্রীর মাঝে খানিকটা সময় ধরে কিছু একটা খুঁজে কাজলটা হাতে তুলে নিলেন। তাঁর কাজলটা দেখা মাত্র জিভে আলতো এক কামড় দিলাম। মানুষটা যে কাজল পড়া পছন্দ করে তা আজ একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আগে কাজল না পড়লেও এখনএকমাত্র তাঁর জন্যই আমায় কাজল পড়তে হয়। সবসময় নয় মাঝে মাঝে। তিনি কাজলটা হাতে নিয়েই এগিয়ে এলেন আমার দিকে। পেন্সিল কাজলটা আমার সামনে এগিয়ে দিতেই আমি সেটা নিয়ে নেই। দ্রুত আয়নার সামনে দিয়ে টুপ কাজলটা পড়ে নেই। অতঃপর তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— কি ঠিক আছে এইবার?

— উঁহু!

— আর কি বাকি?

রোয়েন কিছু না বলে নীরবে বারান্দায় চলে যান। আমি উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করি তিনি কি করতে চাইছেন। তিনি নিজের প্যান্টের পকেট হাতরে কি যেন খুঁজছেন। তা দেখে আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে আয়নায় নিজেকে আরেকবার ভালো মত দেখে নিতে থাকি। এমন সময় রোয়েন আমার পিছনে এসে দাঁড়ায়। আমি আয়নার মধ্য দিয়ে তাঁকে ইশারা করতেই তিনি আমার খোঁপায় হাত দেন। আমি পিলে চমকে উঠে পিছনে ঘুরতে নিলে তিনি তাঁর শক্ত হাত দু’টির মাঝে চেপে ধরে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলেন,

— একদম নড়বে না। খোঁপা নষ্ট করছি না আমি তোমার। ষ্টুপিড!

আমি কড়া চোখে তাঁর দিকে তাকাতে তিনি দৃষ্টি সরিয়ে নেন। খুবই সপ্তপর্ণে কি যেন গুঁজে দেন আমার খোঁপার মাঝে। অতঃপর তিনি সরে দাঁড়াতেই আমি আয়নায় পিছনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে দেখি তিনি আমার খোঁপায় বেলীফুলের মালা গুঁজে দিয়েছেন। তাও একটা নয় কয়েকটা। ক্ষণেই আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে সরু হাসি৷ হঠাৎ তিনি বলে উঠেন,

— তাঁর সৌন্দর্য এখন পরিপূর্ণভাবে পূর্ণতা পেল।

_____________________

তানিয়া ফুপুদের বাসার ছাদেই হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে লোকজন এসেও পড়েছে। কিছুক্ষণের মাঝেই হতো ভাইয়াকে এনে স্টেজে বসিয়ে দেওয়া হবে। আপাতত ভাইয়া ছাদের এককোনায় দাঁড়িয়ে রোয়েনের সাথে কথা বলছেন। আমি টেবিলের উপর মিষ্টি আর ফল সাজিয়ে উঠে দাঁড়াতেই দুইজনের উপর চোখ যায়। তাদের দেখে মনে হচ্ছে কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন৷ আমি বেশ কিছুটা সময় তাদের পর্যবেক্ষণ করলাম। দুইজনেই দুই বছরের পিঠাপিঠি। এইখানে, আরহান ভাইয়া বড় আর রোয়েন তাঁর ছোট। কিন্তু দুইজনের চালচলনের জন্য বিষয়টা বুঝা বড় দায়। সকলে সর্বদা রোয়েনের গাম্ভীর্য ভাবের জন্য তাকেই বড় মনে করেন। যেমন আমি নিজেও মনে করেছিলাম। কথাটা ভেবেই এক গাল হাসলাম। হঠাৎ বড় ফুপুর ডাক পড়তেই আমি সেদিকে এগিয়ে যাই। আমি তাদের সামনে আসতেই তানিয়া ফুপু আমাকে দেখিয়ে একজন বয়স্ক মহিলাকে বলেন,

— ও হচ্ছে আমাদের রোয়েনের বউ সিয়াশা। আর সিয়াশা এনি হচ্ছে আরহানের দাদী।

আমি দাদীকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলাম। তিনি এইটা সেটা জিজ্ঞেস করছেন আমায়। এর মাঝে জেরিন এসে জানায় তানিয়া ফুপুকে নিচে সবাই খুঁজছে। কথাটা শোনামাত্র তানিয়া ফুপু জেরিনকে নিয়ে নিচে চলে যান। আমি পড়লাম এইবার বিপাকে। দাদী তো আমায় একটার পর একটা প্রশ্ন করেই চলেছে থামার আর নাম নেই। হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করে উঠেন,

— তোমগো বিয়ার কত দিন হইলো?

আমি হাসি মুখে বলি,

— এইতো দাদী আড়াই বছরের কাছাকাছি।

তিনি মুখ ঘুচে বলেন,

— বিয়ার আড়াই বছর হইয়া গেল আর এহন পর্যন্ত তোমগো কোন বাচ্চা-পোলাপাইন হইলো না? এইটা কোন কথা? তোমার শ্বাশুড়ি কিছু কয় তোমারে?

আমি ইতস্তত সুরে বলি,

— ইয়ে না মানে…

— বাচ্চা-কাচ্চা লইবা নাকি? বয়স তো আর কম হইলো না। তোমগো এই বয়সে আমি চারটা মা ছিলাম। বুঝলা! আর ঘরে একটা বাচ্চা থাকলে পোলা মানুষের ঘরের প্রতি টান থাকে বেশি৷ তখন এরা বাইরে মুখ দেয় কম। তাই কইতাসি তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে নাও। নাইলে স্বামী একবার বাইরে মুখ দেওয়া শুরু করলে পরে কাইদ্দা কূল পাইবা না।

এইবার আমার মুখ বিরক্তিতে ঘুচে আসে। পেয়েছেটা কি এই মহিলা? বাচ্চা বাচ্চা করে তো আমার কানের পোকাই মেরে ফেললো। এমন ভাব যেন, আমার বাচ্চা না হওয়ায় তিনি প্রচুর হতাশ। হতাশের সাগরে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছেন। তার উপর কিসব উদ্ভট কথা ভাই? এত বেশি বুঝতে কে বলেছে তাকে? আর বাচ্চা বললেই কি নেওয়া যায়? ফিউচার প্ল্যান আর মেন্টাল প্রিপারেশন বলে কি কিছু নেই, নাকি? আজিব। নিছক বয়স্ক মানুষ বলে মুখের উপর কিছু বললেও পারছি না আবার চুপ থাকাও দায় হয়ে পড়ছে। আমি কোনমতে কেটে পড়ার পায়তারা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এমন সময় রোয়েন আমার সামনে দাঁড়ায়। স্বাভাবিক স্বরে বলে,

— সিয়াশা তোমায় মা নিচে খুঁজছে৷ যাও!

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগে দাদী বলে উঠে,

— রোয়েন বাবা এইদিকে একটু এসো তো।

রোয়েন বিনাবাক্যে দাদীর কাছে এসে দাঁড়াতেই তিনি রোয়েনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

— বিয়ে তো করেছিস অনেক বছর হইলোই৷ এখন আমগো নাতি-নাতনির মুখ দেখাবি না-কি?

রোয়েন অকপটে বলে উঠেন,

— আপাতত সেসব নিয়ে ভাবি নি দাদী।

— ভাবিস নি মানে? এইসবে জিনিসে এত ভাবাভাবির কি আছে,হ্যাঁ? বাচ্চা হচ্ছে ঘরের নূর। যত তাড়াতাড়ি বাচ্চা হইবো ততো তাড়াতাড়ি ঘর নূরে আলোকিত হইবো। আর এমনেও বিষয়ে দেরি করতে নেই৷ তাই কইতাসি তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে নে।

রোয়েন এইবার শীতল কন্ঠে বলে উঠেন,

— বাচ্চা যেহেতু আমার সেহেতু সে কখন এই পৃথিবীতে আসবে তা আমাকেই ঠিক করতে দিন দাদী। অযথা আমার না হওয়া বাচ্চাকে নিয়ে চিন্তা করে নিজের বিপি কেন বাড়াচ্ছেন বলুন তো?

কথাটা শুনে পুরাই থ বনে যাই। বিস্ময়ে পরিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকি তাঁর দিকে। শান্ত মেজাজে অপমান করা ভাই কেউ তাঁর শিখুক। হঠাৎ দাদী বলে উঠে,

— এহনকার পোলাপাইন গো এই একটা সমস্যা। বাচ্চার কথা কইকেই ফুঁস কইরা উঠে। ভালো কথার তো দামই নাই।

— যেখানে দাম আছে সেখানে কথাটা বললেই দাম পাবেন৷ ভুল জায়গায় ভালো কথা বললেও খারাপই লাগে৷ সে যাই হোক, আপনি গিয়ে চেয়ারে বসুন, আমি আপনার জন্য ঠান্ডার ব্যবস্থা করছি।

কথাটা বলে তিনি দাদীকে চেয়ারে বসিয়ে কাউকে ডেকে এনে দাদীকে এক গ্লাস শরবত দিতে বলে আমার হাতের কব্জিতে হাত গলিয়ে টেনে নিয়ে যান সিড়ির দিকে। সিড়ি ভেঙে নিচে নামতে নিলে আমি বলে উঠি,

— দাদীর সাথে এইভাবে কথা না বললেও হতো। বয়স্ক মানুষ তিনি৷

তিনি আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলেন,

— তাই বলে আমি আমার পার্সনাল লাইফে কাউকে হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়নি৷ আর মাঝেমধ্যে চুপ থাকার চেয়ে মুখের উপর বলে দেওয়া ভালো।

— কিন্তু তাও..

— বেশি বুঝতে হবে না তোমায়। আর এইসব বাচ্চা-টাচ্চার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো৷ নিজে তো এক বাচ্চা, আসছে আবার সকলে তাকেই আরেক বাচ্চার কথা বলতে। ডিসকাস্টিং!

কথাটা কর্ণগোচর হইতেই আমি রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাই রোয়েনের দিকে? কি বুঝাইতে চাইলেন তিনি, আমি বাচ্চা? আমাকে বাচ্চার কথা বলা যায় না? আমি ফুঁসে উঠে বলি,

— আমি বাচ্চা? এই আমাকে আপনার কোন দিক দিয়ে বাচ্চা মনে হয় হ্যাঁ?

রোয়েন একপলক আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,

— বাচ্চা নয়তো কি তুমি? এখনো ম্যাচুরিটির কিছু তো দেখলাম না তোমার মাঝে যে তোমায় বড় বলে গণ্য করবো। প্রায় সময়ই তো বাচ্চামি করো।

আমি অকপ্ট রাগ দেখিয়ে বলি,

— তো এই বাচ্চার সাথে যখন বড়দের কাজ-কারবার করেন তখন লজ্জা করে না? পরের বার আমার কাছে এসে দেইখেন একবার, সোজা শিশু নির্যাতনের কেস ঠুকে দিব একদম। হুহ!

রোয়েন এক সিড়ি ভেঙে উপরে উঠে আমার নাক আলতো করে টেনে উঠে বলেন,

— বাচ্চা হলেও কি বউ তো আমারই নাকি?

কথাটা কর্ণগোচর হতেই কান গরম হয়ে আসে আমার। ক্ষণেই গালের দুইপাশে ছড়িয়ে যায় রক্তিম আভা। রাগটা গলে পানি হয়ে যায় মূহুর্তে। এমন একটা মানুষের উপর আদৌ রাগ করে থাকা যায়? হঠাৎ রোয়েন হাত টেনে নিচে নিয়ে যেতে যেতে বলে,

— এখন বাচ্চামো শেষ হলে চলো। মা খুঁজছে তোমায়।

____________________

আরহান ভাইয়াকে ছোঁয়ানো হলুদ হৃদিপুর বাসায় পৌঁছাতে হবে বলে ফুপু রোয়েন, জেরিন,শুভ ভাইয়া আর আমাকে পাঠালেন। সেই সাথে বিয়ের ডালাও পাঠিয়ে দিলেন আমাদের হাতেই। সকলে সকল জিনিসপত্র গুছিয়ে হৃদিপুর বাসায় এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা বেজে যায়। এইখানেও বাসার ছাদেই হলুদের আয়োজন করা হয়েছে৷ বরপক্ষ হতে হলুদ এখনো না আসায় অনুষ্ঠান এখনো জমজমাট হয়নি। আমরা বাসার ভিতর আসতেই হৈ-হুল্লোড় লেগে যায়। একেক করে সকল ডালা ও মিষ্টির প্যাকেট টেবিলের উপর রাখতেই বাড়ির লোকজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আমাদের আপ্যায়নের জন্য৷ সকলে সোফার রুমে বসলেও আমি রোয়েনকে জানিয়ে উঠে চলে যাই হৃদিপুর রুমের দিকে। আপুর পক্ষে নাইবা থাকলাম কিন্তু বোন তো সে আমারই নাকি? একবার সামনাসামনি অভিনন্দন জানানো উচিৎ, সেই সাথে হলুদের দিন তার লেগপুল না করলে কি হয়? হৃদিপুর রুমে সামনে তাকে ডাকতে গিয়েও থমকে গেলাম, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম দরজার ধারেই। মুহূর্তেই মনের দুয়ারে উঁকি দিলো কিছু তিক্ত স্মৃতি। স্মৃতিগুলো মাথা চাড়া দিতেই চোয়েল দু’টি শক্ত হয়ে দৃষ্টি কঠোর হয়ে উঠলো আমার।

#চলবে
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।