নিরবতায় হৃদয় কোনে পর্ব-০২

0
289

#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০২

সাত সকালে নাস্তা তৈরি করে টিউশনের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো মিতালী। এসব কাজকর্ম আগ বাড়িয়ে তাকে আর মাকেই করতে হয়। বাবা ক্ষুধা সহ্য করতে পারেননা। ভাবি এত তাড়াতাড়ি উঠবেনা, আর না নাস্তা বানানোয় হাত দেবে।

পেছন থেকে মাহবুবের গুরুগম্ভীর ডাক,
-“আজ বাড়িতে উপস্থিত থাকবি। জরুরি আলাপ আছে সবার লগে।”

মিতালী ভেবে পেলোনা ভাইয়ের তাদের সাথে কি এমন জরুরি আলাপ থাকতে পারে। মাহবুব তো তাদের গন্যই করেনা, আর না তাদের মধ্যে খেজুরে সম্পর্ক। মিতালী কৌতুহল দেখালো। এমনি এমনি কারণ ছাড়া টিউশন, ক্লাস মিস দেওয়া যায়না। বলল,
-“কী এমন জরুরি কথা, যে আমাকে বাড়িতে থাকতে হবে।”

মাহবুব তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-“কৈফিয়ত চাওয়া শিখা গেছস দেখতাছি।”

মিতালী কঠিন মুখে বলল,
-“আমাকে যেহেতু থাকতে হবে, তাহলে অবশ্যই কৈফিয়ত দিতে বাধ্য।”

মাহবুব তে*ড়ে এসে বলল,
-“খুব চটাং চটাং কথা শিক্ষালাইছস।”

মিতালী হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলো মাহবুবকে।
-“দূরে থাকো, গায়ে হাত তো*লা*র চেষ্টা করলে নারী নির্যাতনের মা*ম*লা ঠু*কে দেবো।”

মাহবুব আগুন চোখে তাকিয়ে বলল,
-“বাড়িতে বি*চা*র বসবো, আমার পক্ষে এতগুলা বোঝা টা*না সম্ভবনা। আমি চেয়ারম্যান চাচারে খবর দিছি।”

মিতালীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। শেষ বয়সে এসে বাবা মায়ের জন্য বিচার বসাবে? বিষণ্ণতা আকাশ ছুঁলো, চোখের কোনে জল জমা হলো। বাবা-মা এখনো কিছুই জানেনা। শুনলে কতটা কষ্ট পাবে?

মাহবুব নিজের কাজে যেতে যেতেই বলল,”এগারোটার মধ্যে বাড়িতে থাকবি।”

মিতালী থমকে যাওয়া পা জোড়া টে*নে বেরিয়ে গেলো। ছাত্রীর বাসায় গিয়ে দেখলো সে আগে থেকেই বসে আছে।
পড়ানোর মাঝে ঝুমুর বলল,”ম্যাম, আপনার কি মন খারাপ?”

মিতালী জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি টে*নে বলল,
-“নাহ্, তুমি পড়ায় মন দাও।”

ঝুমুর আর কথা বাড়ালোনা।
মেয়েটাকে পড়িয়ে বের হলো। রাস্তায় নির্ভীক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো। মিতালীকে দেখে একগাল হেসে বলল,
-“চল, যাওয়া যাক।”

মিতালী ভনিতা ছাড়াই বলল,
-“তুই যা, আমি আজ ক্লাস করবোনা।”

নির্ভীক খেয়াল করলো মিতালীর মুখশ্রী। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
-“শরীর খা*রা*প তোর? ক্লাস কেন করবিনা?”

মিতালী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“বাড়িতে আজ কাজ আছে। আমি ঠিক আছি। তুই যা।”

ভ্রু কুঁচকে তাকালো নির্ভীক। বলল,
-“কী কাজ? তুই না বললি তোর আজকের ক্লাস ইম্পরট্যান্ট।”

মিতালী হাঁপিয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে বলল,
-“তোর জেরা করা শেষ হলে আমি বাড়িতে যাই। কী কাজ সেটা পরে জানাবো।”

মিতালী হাঁটা ধরলো। নির্ভীক ও আর গেলোনা ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। মিতালীর পেছনে ছুটলো। দুজনের বন্ধুত্ব সেই স্কুল জীবন থেকে। একই এলাকায় বাস। স্কুল থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত দুজনের বন্ধুত্ব এলাকার সকলের জানা। সবাই জানে তারা দুজন খুব ভালো বন্ধু। কেউ কেউ বলে দুজনের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক ও আছে।
দুজনের ভার্সিটি এক হলেও ডিপার্টমেন্ট আলাদা। মিতালী ম্যাথেমেটিকস নিয়ে পড়ছে আর নির্ভীক ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট।
পাশাপাশি হেঁটে মিতালী জিজ্ঞেস করলো,
-“যাবিনা?”

নির্ভীক আগ্রহ দেখালোনা। বলল,
-“ভালোলাগছেনা।”

মিতালী হাসলো। দুজনে এখনও সেই আগের মতোই আছে। একজন ক্লাস মিস দিলে অপরজন ও একই কাজ করে। বাড়িতে যাওয়ার পথেই কাশেম চাচা বললেন,
-“কিরে মিতালী, কী শুনতাছি এগুলা? মাহবুব নাকি তোগো বাড়িত তোর আব্বার লাইগা বিচার বসাইবো? আমারেও যাইতে কইছে।”

মিতালীর চোয়াল মলিন দেখালো। পাশ থেকে নির্ভীক ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল,
-“কিসের বিচার?”

মিতালী কিছু বলতে পারলোনা, শুধুই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নির্ভীকের প্রশ্নের উত্তরে কাশেম চাচা বললেন,
-“মাহবুব তোমার মামারেও খবর দিছে। গেলেই বুঝা যাইবো ক্যান বিচার সভা ডাকছে।”

এতক্ষণে নির্ভীক মিতালীর ক্লাস না করার কারণ ধরতে পারলো। দুজনের কেউই আর কথা বাড়ালোনা। যে যার বাড়িতে পৌঁছে গেলো।

★★★

ঘড়ির কাঁ*টা এগারো এর ঘরে। বাড়ির সামনে উঠান সদৃশ জায়গায় চেয়ার পাতা হয়েছে। সেখানে উপস্থিত চেয়ারম্যান চাচার সাথে নির্ভীককে ও দেখা গেলো। চেয়ারম্যান সাহেব নির্ভীকের মামা হন।
ও যখন মায়ের গর্ভে ছিলো, তখন তার বাবা ভারতের আসামে চলে গিয়ে আর ফেরেননি। আর না খোঁজ নিয়েছেন তার মায়ের। সেই থেকেই নির্ভীকের মামা তার মাকে নিয়ে এসেছেন। নির্ভীকের মা ও আর বিয়ে করেননি। ছেলেকে বুকে নিয়েই বাবার বাড়িতে পড়ে রইলেন।

মিতালী মাথায় কাপড় দিয়ে চায়ের ট্রে রেখে বাবার পাশে দাঁড়ালো।
তার বাবা মতিন সাহেবের চোখের কোনে পানি। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।
চেয়ারম্যান সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-“সবাইকে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ডেকেছো। তুমি তোমার কথা শুরু করো।”

মাহবুব বলল,
-“আপনেরা তো জানেন আমার ইনকাম কেমন। মিতালীর লাইগা কয়েকবার সমন্ধ আনার চেষ্টা করেছি। এবারে আমেরিকান পোলা নিয়া আসছি। ওয় বিয়া বইবোনা। আমি চাইছি ওরে একটা লাইন করাই দিমু। ওয় জামাই নিয়া সুখে থাকবো, আর আমি আব্বা-আম্মা আর মাহারে নিয়া আছি। কিন্তু মিতালী কি করলো?
পাত্রপক্ষের সামনেই আমাগোরে অপ*মান করলো। পাত্রপক্ষ চইলা গেলো। আপনেরাই কন, আমার পক্ষে এতজনের ভরণপোষণ, পড়নের খরচ দেওয়া সম্ভব?”

কয়েকজনই মাহবুবের সাথে একমত হলেন। একজন বললেন,
-“মাহবুব তো ঠিক কথাই কইলো। মাইয়্যাটার ভালা চাইছে বইলাই সমন্ধ নিয়া আসছে।”

মতিন সাহেব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। মিতালী বাবাকে থামিয়ে বলল,
-“শান্ত হও আব্বা। আমি বলছি কথা।”

এরপর সবার উদ্দেশ্যে বলল,
-“আমার পড়ালেখার খরচ আমি নিজে চালাই। আব্বা অসুস্থ হয়েছে দুমাস। মাহা উপবৃত্তি পায়।
এর আগে পরীক্ষার ফি আব্বা দিতো। সামনে মাহার পড়ার চিন্তা আমার।
তাই আমাদের পড়ালেখার খরচ বহন করা কথাটি সম্পূর্ণ মি*থ্যা।
তারপর ভরণপোষণ, ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত উনাকে কখনো দেখিনি আমাদের দুই বোনকে বা মা আর আব্বাকে একটা সুতা দিতে। আমি টিউশনি করি। নিজের পড়ার খরচের পর গত দুমাসে আব্বার ঔষধ খরচের জন্য আমি হাতের বাকি টাকা দিয়েছি। যদিও সব ঔষধ আনা সম্ভব হয়নি স্বল্প টাকায়।
এতে একটা কড়িও তিনি দেননি। শুধু বাজারটাই তিনি করছেন। এই যে আমরা তার খাই, এর জন্য বাড়ির সমস্ত কাজ আমার মাকে করতে হয়। আমিতো নিজের পড়া আর টিউশনের জন্য বাড়িতে থাকতে পারিনা।
এবার আপনারাই তার বলা কথাগুলো যাচাই করুণ। সে কি সত্যিই আমাদের সম্পূর্ণ খরচ বহন করে?”

চেয়ারম্যান চাচা মনযোগ দিয়ে শুনলেন মিতালীর সব কথা। তিনি মেয়েটাকে ভালো জানেন। তাছাড়া মতিন সাহেবও ভালো মানুষ, ছেলে সম্পর্কে ও জানেন। এর মাঝে মাহবুবের বউ খেঁকিয়ে উঠলো,
-“বাড়ির কাজ আমি করিনা, তোর মায়ে করে? বা*ন্দির বা*চ্চা মি*থ্যা বলার জায়গা পায়না।”

চেয়ারম্যান চাচা ধমক দিলেন পিয়ালীকে।
-“অস*ভ্যের মতো ব্যবহার কেন তোমার? তুমি এই এলাকার বউ, মুখ দিয়ে ময়লা বের হচ্ছে কেন? তোমাকে এখানে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়েছে, যে তুমি কথা বলছো?”

মাহবুব অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো পিয়ালীর দিকে। সে সুযোগে সুযোগে ঘাড় থেকে বো*ঝা নামাতে চাইছে। এই বে*দ্দ*প মহিলা সব ভেস্তে দিচ্ছে।
চেয়ারম্যান চাচা বললেন,
-“মাহবুব, মিতালী যা বলছে সব সত্যি?”

মাহবুব এবার খোলস ছেড়ে আসল রূপে ফিরলো।
-“আমার দ্বারা এতগুলা বোঝা টা*না সম্ভব না। মিতালী ও তো এখন রোজগার করে। আব্বা-আম্মার খাওয়া ভাগ করে দেন। আমার ঘরে পনেরো দিন, মিতালীর ঘরে পনেরো দিন।”

মিতালী হাসলো বোধহয়। সে জানতো মাহবুব এমন কিছু বলবে।
চেয়ারম্যান চাচাকে গম্ভীরমুখে দেখা গেলো। তিনি সবার সাথে আালাপ করে ভেবেচিন্তে বললেন,
-“কিন্তু মিতালীর পক্ষে এখনই এতসব কিভাবে সম্ভব? কয়েকটা টিউশনি দিয়ে এতদিক সামলাবে কিভাবে?”

মাহবুব জবাবে বলল,
-“সেইটা আমার দেখনের বিষয় না। সবাই ওর দিক চিন্তা করে, আমার দিক কেউ চিন্তা করেনা। আমারও তো ভবিষ্যত আছে।”

প্রচন্ড ক্রো*ধ আর আত্মসম্মানের দাপটে মিতালী বলে দিলো,
-“বাকি পনেরো দিন ও আমি খাওয়াতে পারবো। আব্বা আর মা আমার আর মাহার সাথেই থাকবে।”

মাহবুবের চোখ চকচক করে উঠলো।
চেয়ারম্যান চাচা বুঝলেন মেয়েটা উত্তেজনার বশে এরকম একটা কথা বলে দিলেও তার পক্ষে সবার ভার বহন করা সম্ভব নয়। তিনি কৌশলে মাহবুবকে বললেন,
-“মিতালী তার বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিজেই নিয়ে ফেলেছে। এতে তোমার কি মতামত?”

মাহবুব বলল,
-“সে নিতে চাইলে আমার তো করনের কিছু নাই।”

চেয়ারম্যান সাহেব মনে মনে হাসলেন। পরপরই নিজের চাল চেলে দিলেন।
-“মিতালী যেহেতু বাবা-মায়ের সারাজীবনের দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে, তাহলে তোমাকে স্ত্রী নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হবে। বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে না পারলে সম্পত্তির কানাকড়ি ও পাবেনা।”

চমকে উঠলো মাহবুব, পিয়ালী দুজনেই। পিয়ালী বলল,
-“তাহলে আমরা থাকবো কই?”

-“কেন? বাজারে কলনি আছেনা? সেখানে থাকবেন।”

নির্ভীকের কথায় তেতে উঠলো মাহবুব, পিয়ালী। চেয়ারম্যান সাহেব ভাগ্নেকে ধমকে উঠলো,
-“তোকে কথা বলতে বলেছে কে?”

এদিকে মিতালী চোখের ইশারায় না করছে কথা বলতে। নির্ভীক রা*গে ফে*টে পড়লেও নিজেকে দমিয়ে নিলো।
মাহবুব বলল,
-“আমি তো কইছি পনেরো দিন আমি খাওয়ামু। তাহলে বাড়ি ক্যান ছাড়ুম?”

অনেক বিবেচনার পর সিদ্ধান্ত হলো মাহবুব, মিতালী দুজনেই বাবা-মাকে মাসে পনেরো দিন করে খাওয়াবে। এছাড়া কেউ আর উপায় দেখলোনা।
মিতালী উপস্থিত সবার মাঝে আরও একটি ব্যাপার খোলসা করে বলল,
-“এই লোকের তেড়ে এসে গায়ে হাত তু*ল*তে আসা স্বভাব বাদ দিতে বলবেন। নয়তো কোনদিন রান্নাঘর থেকে ব*টি নিয়ে হাতে কো*প মে*রে বসবো।”

নির্ভীক মিতালীর এমন প্রতিবাদী রূপে ভীষণ খুশি হলো। মনে মনে বাহবা দিলো মেয়েটাকে।

সব সিদ্ধান্তের পর ক্লান্ত মিতালী রান্নায় হাত বসালো। মা কেঁদেই যাচ্ছেন। এমন হলে আর আজ খেতে হবেনা। লবনের বাটি থেকে বড় পাতিল পর্যন্ত দু’ভাগ হলো।
বিকেলের মধ্যেই ঘরের মাঝখানে লম্বা বেড়া তোলার ব্যবস্থা হবে। রান্না করতে গিয়ে মিতালী ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লো। দায়িত্ব তো কাঁধে এসে গিয়েছে। একটা চাকরি যেভাবেই হোক জোগাড় করতে হবে। টিউশন ও চালাতে হবে। চাকরি পাওয়া মুখের কথা নয়।
বাবা-মা আর মাহার প্রথম খাওয়া মাহবুবের ঘর থেকেই শুরু। মিতালীর ঘরে পনেরো দিন পর থেকে। চিন্তায় আর পেটে খাবার পড়লোনা। মুঠোফোনের শব্দ পেয়ে হাতে নিলো ফোন। ক্লাস সেভেন এর ছাত্র রিশাতের মায়ের ফোন।
সালাম বিনিময়ের পরই তিনি বিনীতভাবে বললেন,
-“মিতালী, রিশাতের বাবার ট্রান্সফার হয়েছে। আমরা আর এখানে থাকবোনা। কাল থেকে রিশাতকে পড়াতে হবেনা।”

মিতালী থমকে গেলো। হাতে একটা টাকাও নেই। টিউশনের পাশাপাশি চাকরি দরকার, অথচ হাত থেকে একটা টিউশন ছুটে গেলো।
ঘরে বাজার নেই, আজ কোনোভাবে রান্না চালিয়ে দিয়েছে। পাশের ঘর থেকে বাবার গুঙ্গিয়ে ওঠার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

#চলবে………