নিরব সে পর্ব-১২

0
1177

১১দশ পর্বের পর থেকেঃ-
”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
১২দশ পর্ব

সামনে চশমা পরা মানুষটাকে দেখে সে প্রথমে অবাক হলেও পরে জাপটে ধরল। ওয়াফিফ জিনিয়ার সামনে হাঁটু ভেঙে বসতেই জিনিয়া কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে থেকে জড়িয়ে ধরল। আর এতো জোরে জড়িয়ে ধরল, যেন ওয়াফিফ কে এখন ধরে না রাখলে সে তাকে ছেড়ে চলে যাবে, এমনটাই ভাবছে। সে বেশি সময় হয় নি বাড়ি ফিরেছে। বাড়ি ফিরে রুমে গিয়েই নিজের সাদা এপ্রোনটা বিছানায় ফেলে নিজের শার্ট এর কয়েকটা বোতাম খুলতেই দরজা বন্ধের আওয়াজ পায়। খুব জোরেই হয়েছিল আওয়াজটা। সে চমকে পিছনে তাকায়। কারণ এই কয়দিন সে বাড়িতে থেকেছে। তাই কেই নক না করে ভেতরে আসতো না। আর সারাদিন দরজা চাপানোই থাকত। জিনিয়া ছাড়া বাকিরা তেমন আসতো না আর আসলেও নক করত। তাই সে অবাক হয়। একে তো নক করে নি মানে জিনিয়া এসেছে। আর এতো জোরে দরজা লাগানোর কারণ কি। এতসব কারণ ভাবার সময়টুকুও পায় না সে কারণ এর আগেই জিনিয়ার কান্নার আওয়াজ তার কানে আসে। সে নিজেও অবাক হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। আজ পর্যন্ত সে জিনিয়াকে কাঁদতে দেখে নি। তাও নিজের বাড়িতে এসে এভাবে কান্না করার কারণ খুঁজে পায় না ওয়াফিফ। তাই সে জিনিয়ার দিকে ভালো করে তাকায়। জিনিয়া হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে কান্না করছিল। সে সোজা তার কাছে চলে সামনে। সামনে বসার পর সে জিনিয়ার মাথায় হাত রাখবে কি রাখবে না ভাবছিল। কিন্তু এর আগেই জিনিয়া নিজের মাথা তুলে। আর ওয়াফিফ কে দেখে জড়িয়ে ধরে। ওয়াফিফ কিছু বুঝতে না পারলেও ওকে নিজের দুই হাতে আগলে নেয়। কিছু সময় পর জিনিয়ার খেয়াল হয় সে কোথায় আছে। তাই ছিটকে দূরে সরে যায়। কিন্তু এর আগেই ওয়াফিফ তাকে আবার জড়িয়ে ধরে আর বলে,

–আস্তে। পিছনে দরজা। ব্যথা পাবে তো।

জিনিয়া মাথা নাড়ায় হালকা। তার পর উঠে দাঁড়ায়। ওয়াফিফ ও উঠে পড়ে ফ্লোর থেকে। জিনিয়াকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে সে নিজেও বসে পড়ে ওর পাশে। তারপর পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া পানি পান করা শেষ হলে সে জিজ্ঞেস করে,

–এখন ভালো লাগছে?

–হুম।

–তাহলে এখন রেস্ট নেও। আর বেশি চিন্তা করো না। কিছু লাগলে আমাকে বল, আমি আছি এখানে। কিছুক্ষণ আগে আসলাম তাই ফ্রেশ হয়ে আসি আমি। আর দেখে তো মনে হল দৌড়ে এলে। এই সময় দৌড়াদৌড়ি করা যাবে না এটা কি জানো না? সামনে থেকে খেয়াল রাখবে।

বলেই জিনিয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করে ওয়াফিফ উঠে পড়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়াল। জিনিয়া পিছন থেকেই জিজ্ঞেস করে উঠল,

–কেন এমন করলাম, জানতে চাইবেন না?

–নাহ, এখন না। যখন তোমার ইচ্ছে হবে তখন বল। তবে দেখো, কোন কথা বলতে যেন বেশি দেরি করে না ফেলো। বলেই ফ্রেস হতে চলে গেল ওয়াফিফ। জিনিয়া সেভাবেই সেখানে বসে থাকল। কিছু সময়ের মধ্যেই ওয়াফিফ বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে জিনিয়া সেভাবে বসে আছে। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে। ওয়াফিফ ওর কাছে যায়।

–কিছু বলবে জিনিয়া?

–হুম।

–বল।

–আজ জাবিরের সাথে দেখা হয়েছিল। কাল ও হয়েছিল। কাল আপুরা সাথে ছিল। রিতিকা আপু চিনত আগে থেকে জাবিরকে তাই ডাক দিয়েছিল। কিন্তু কাল ও আমাকে আগের মতই ইগনোর করেছিল। আজ হঠাৎ ফিরে এসে আগের মতো কথা বলা শুরু করেছিল। আমি ওকে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছি। ওকে আর কথা বলতে দিই নি। এতো মাস পর দেখা হয়েছিল তাই নিজেকে সামলাতে না পেরে কান্না করে ফেলেছিলাম। আর তখন আপনাকে দেখে খুব ভরসা পেলাম। তাই আপনাকে জ…

–আমাকে তারপর?

–আপনাকে…

–হুম, আমাকে , তারপর কি জিনিয়া?

–তারপর আর কিছু না। তারপর আমি এখানে।

জিনিয়ার উত্তর শুনে ওয়াফিফ শব্দ করে হেসে উঠল। জিনিয়া সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকল। এই হাসিটা বেশ পছন্দ হয়েছে জিনিয়ার। ওয়াফিফ তারপর নিজেকে শান্ত করে বলল,

–আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু নিজেকে এতো নরম করে গড়ে তুলো না। সবার সামনে দুর্বল হয়ে গেলে দুনিয়াতে টিকে থাকতে পারবে না। কঠিন হতে শিখো। কথায় কান্না না করে জবাব দিতে শিখো। সব সময় আমি নাও থাকতে পারি। এক সময় যদি আমার কিছু হয়ে যায় তখন…

–প্লিজ, এমন কিছু বলবেন না।

এর থেকে বেশি বলতে পারল না জিনিয়া। তার চোখে পানি টলমল করছে। ওয়াফিফ সেটা দেখে কষ্ট পেল। তাই সে বলে উঠল,

–এমন কিছু তো হতেও পারে। তাই তোমার উচিত শক্ত হওয়া। যাতে নিজেকে প্রটেক্ট করতে পারো। বুঝেছ আমার বাবুর আম্মু?

শেষের কথাটা ওয়াফিফ একটু টেনেই বলল। ওর কথা বলার ধরণ শুনে জিনিয়া হেসে ফেলল। আর মাথা উপর নিচ নাড়াল। বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়াতে দেখে ওয়াফিফ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।


সকালে জিনিয়া আফিয়া রহমানের সাথে কথা বলতে বলতে দরজার দিকে যাচ্ছিল। দরজায় বেল বেশ কিছু সময় ধরে বাজছিল। কিন্তু কেউ খুলছিল না হয়তো। তাই অনবরত বেজেই চলেছে। জিনিয়া তখন আফিয়া রহমানের সাথে কথা বলছিল বলে বেশি খেয়াল করে নি। কিন্তু বার বার বাজতে শুনে বিছানায় শুয়ে থেকেই ওয়াফিফ বলে উঠে,

–জিনিয়া দেখো তো, কে এতক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছে।

জিনিয়া দেখছি বলেই দরজার দিকে হাঁটা ধরল। কানে ফোন ধরে আছে সে এখনো। আর শাশুড়ির কথা শুনে যাচ্ছে। রোজ ফোনে আধাঘণ্টা ধরে কথা বলা ওদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যেন। দিনে ২ বার করে কথা বলে। কিন্তু সে যেতে যেতে দেখল আরেক ঘটনা।

দরজা ততক্ষনে সারিকা খুলে দিয়েছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে শিশির । সে এখানকার এক এনজিও তে কাজ করে। সেই এনজিও এর পরবর্তী কর্মসূচী সম্পর্কে প্রতিটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলছে। তাই জিনিয়াদের বারিতেও এসেছিল। আর সারিকা দরজা খুলে সেই যে দাঁড়িয়েছে। আর কোন কথা বলে নি। শুধু হা করে তাকিয়েছিল। জিনিয়ার কথা শেষ হলে সে ফোন কেটে সেখানে যায় আর শিশির কে ভিতরে আসতে বলে মা আর বাবা কে ডাক দেয়। সকাল সকাল হওয়ায় ওয়াফিফ সহ বাকিরাও বাড়িতে ছিল। তারা বের হয়ে আসে আর শিশিরের সাথে কথা বলতে থাকে। এদিকে সারিকা আপু তখন ও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। জিনিয়া সারিকাকে হা করে থাকতে দেখে তার পাশে যায় আর বলে,

–আপু, মুখ খুলে রেখেছ কেন? বন্ধ তো কর।

সারিকা জিনিয়ার আওয়াজ পেয়ে মুখ হুড়মুড় করে বন্ধ করে ফেলে। পাশ থেকে রিতিকা বলে উঠে,

–৭৮ নং ক্রাশ তোর?

–নাহ, ৭৯ নং।

–তাহলে ৭৮ নাম্বার টা কে? আমাকে বলিস নি তো।

রিতিকার কথা শুনে সারিকা ভড়কে যায় । কারন এবার সে ওয়াফিফের উপর ক্রাশ খেয়েছিল। সেটা তো আর বলা যাবে না। তাই সে জবাব দেয়,

–ওই একদিন খেয়েছিলাম।

–আচ্ছা।

এদিকে জিনিয়ার মুখ হা হয়ে গিয়েছে। সারিকার মুখ বন্ধ করতে এসে নিজের মুখ খুলে গিয়েছে ২ বোনের কথা শুনে। একটা মানুষ কি করে এতো ক্রাশ খেতে পারে? জিনিয়া অবাক হয়ে বলে উঠে,

–৭৮ টা? আপু, কি করে?

রিতিকা জবাব দেয়,

–৭৮ মানে একশ আটাত্তর। ওটা তো শর্টকাটে বলেছিলাম।

জিনিয়ার মুখের হা আরও বড় হয়ে যায়। ওয়াফিফ জিনিয়ার এই অবস্থা দেখে সে জিনিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সারিকা ততক্ষনে শিশিরকে ভালো করে দেখতে ওর আরও কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। রিতিকাও ওদের আলোচনা শুনতে জিনিয়ার মায়ের পাশে বসে পড়ে। তাই সেখানে ওয়াফিফ আর জিনিয়া একা দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করে ওয়াফিফ বলে উঠে,

–এবার তো মুখ বন্ধ কর। দিনের বেলা মশা না থাকলেও মাছি থাকে, সেটা তোমার মুখে ঢুকে যাবে।

জিনিয়া নিজের মুখ বন্ধ করে ফেলে সাথে সাথে। ওয়াফিফ আবার বলে,

–কি জন্য এতক্ষণ ধরে মুখ খুলে রেখেছিলে? ওয়েট, তুমি এই ছেলের উপর ক্রাশ খাও নি তো?

–না না না।

দ্রুত বলে ওঠে জিনিয়া।

–ওটা তো সারিকা আপু…

–সারিকা কি?

ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে ওয়াফিফ।

–মানে সারিকা আপুর কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

–কি বলেছিল? যে তোমার মুখে হাঁটি ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

–আপনাকে বলা যাবে না।

ওয়াফিফ কিছু বলতে যাবে তার আগেই জিনিয়ার বাবা ডাক দেন ওয়াফিফকে। তাই সে কিছু না বলেই চলে যায় সেখান থেকে। জিনিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।


তারপরের দিন রিতিকা আর সারিকা রা চলে যাওয়ায় জিনিয়া আবার একা হয়ে পড়ে। বাড়িতে ও আর ওর মা থাকে যেখানে ওর মা বেশিরভাগ সময় কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকে। বিকালে জিনিয়া তাই চলে যায় ওই মাঠে আর দোয়া করে যেন জাবির আর সেখানে না আসে। হঠাৎ করে মামি অসুস্থ হয়ে পড়ায় রিতিকাদের চলে যেতে হয়েছে। জিনিয়া সারাদিন মায়ের সাথে থাকে। তবে বিকালে মা ঘুমাতে চলে যায়। আর জিনিয়া তখন ঘুমাতে পারে না কারণ সে দুপুরেই ঘুমিয়ে থাকে। তাই সোজা মাঠে চলে যায়। কিন্তু পর পর কয়েক দিন মাঠে যাওয়ার পর তার জাবিরের সাথে দেখা হয়। সে ভাবে যে এখান থেকে চলে গেলে আর মাঠে আসতে পারবে না। তাই মাঠে যেত সে। কিন্তু জাবির রোজ তার সাথে কোন না কোন বাহানা দিয়ে কথা বলতে আসে। আশেপাশে মানুষ থাকায় জিনিয়াও বেশি জোরে কোন কথা বলতে পারে না। জাবিরকে বুঝিয়েছে। কিন্তু টানা ৩ দিন বিকালে জাবির জিনিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছে। আর জাবিরের সেই এক কথা,

–তুমি রোজ আমার সাথে মজা করছ? তোমার তো বিয়ে হয় নি, তাই না? এখনো রেগে আছো? ঠিক আছে, আমি তোমার রাগ ভাঙ্গিয়ে দিব। কিন্তু এমন করো না যে তুমি আমাকে চিন না।

জিনিয়া সব কথাই ওয়াফিফকে জানিয়েছে। এর পর আবার সে জিনিয়ার বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছিল আজ দুপুরে জিনিয়ার সাথে কথা বলতে। তাই জিনিয়া সরাসরি ওয়াফিফকে ফোন করে বলে,

–আজ আপনি কখন আসবেন?

–বিকালে।

–কয়টায়?

–৪.৩০ টা ৫ টা র মধ্যে।

–আসার সময় আমাকে বাড়ির সামনের মাঠ থেকে নিয়ে যাবেন।
–কেন?

–একটা জিনিস কিনব। কিন্তু বারবার টাকা নিতে ভুলে যাই। আর বাড়ি ফিরে গেলে মা আর বের হতে দিবে না। আমার ও বের হতে ইচ্ছে করবে না। তাই।

–ওরে অলস।

–হুহ।

–আচ্ছা রাগ করো না। আমার অপেক্ষা করো। আমি এসে কিনে দিব।

–হুহ।

–এখনো রেগে আছো?

–নাহ।

–রাখছি, বিকালে দেখা হবে।

বলেই ফোন কেটে দেয় ওয়াফিফ। আর জিনিয়া অপেক্ষা করতে থাকে বিকাল হওয়ার। সে বিছানায় শুয়ে পড়ে ঘুমানোর জন্য।

চলবে।

[রিচেক করি নি, ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ]
Sadia Hq Sr.