নিরালায় ভালোবাসি পর্ব-৬+৭

0
304

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
৬ .

তৃপ্তি দেবী সিঁড়ি দিয়ে একটু হলেই স্লিপ খেয়ে পড়তে গিয়েও বেঁচে গেলেন। এই সাত সকালে সিঁড়ি মোছা হয়েছে দেখে তিনি যেনো চমকে গেলেন। এখন কম করে সাড়ে পাঁচটা বাজবে। এই শীতের ভোরে কেউ এতো সকালে ঘুম থেকে উঠেছে কিনা সন্দেহ। সেখানে কিনা কেউ ঘর মুছেছে! নীরবের বিয়ে উপলক্ষ্যে এই বাড়িতে এসেছেন তিনি। কয়েকদিন হলো ডায়বেটিস ধরা পড়ছে। তাই তিনি প্রতিদিন সকালে একটু হাঁটতে বেরোন। এখানে এসেও তার ব্যতিক্রম নেই।

– ” বৌদি তাড়াতাড়ি এসো, কী হয়েছে দেখে যাও।”

রুমা দেবী ঘর থেকেই বেরোচ্ছিলেন চাবি হাতে। গেটের তালাটা না খুলে দিলে তার ননদ বাইরে বেরোতে পারবে না। হঠাৎই তৃপ্তি দেবীর চিৎকারে তিনি প্রায় ছুট লাগলেন। ভাবলেন কোনো বিপদ হয়েছে নাকি। অপর দিকে চিৎকার শুনে নীরব ও তাথৈও ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো।

– ” কী হলো রে তৃপ্তি, চিৎকার করছিস কেনো? কিছু হয়েছে?”

উপরের রেলিঙে রুমা দেবী কে দেখে তৃপ্তি দেবী বললেন,” সাবধানে নীচে নেমে এসো বৌদি।”

– ” আরে কি হয়েছে, সাবধানে কেনো?”
সিঁড়িতে পা দিতেই রুমা দেবীর পা ঠাণ্ডায় ছ্যাঁক করে উঠলো। আশা এই বাড়িতে কাজ করে প্রায় পাঁচ বছর। সে তো এত সকালে কাজ করতে ঘুম থেকে ওঠে কিনা সন্দেহ। আশার আগে রুমা দেবী যখন একা বাড়ির সব কাজ করতো তখনও এমন কাজ করেনি। তবে আজ কে করলো? পরক্ষনেই কিছু একটা ভেবে ছুটে নীচে নেমে গেলেন তিনি।

ইচ্ছে মন দিয়ে রান্না ঘরটা মুছে কাল রাতের এঁটো বাসন গুলো মাজছিল। কিন্তু হুট করেই তৃপ্তি দেবীর চিৎকারে হাত থেকে কাঁচের প্লেটটা পরে ভেঙে যায়। প্রচন্ড ভয়ে বেসিনের গায়ে জড়ো সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।

– ” এই তুই কি করছিস? এতো সকালে এইসব কে করে?”

রুমা দেবীর কথায় আরও জড়ো হয়ে যায় ইচ্ছে। ভয়ে হাত গুলো বারবার চেপে ধরছে। রুমা দেবী জোর করে ইচ্ছের হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলো।

– ” কী করছিস তুই এইসব? তোকে কে বলেছে এই সব কাজ করতে। এই বাড়িতে এতো কাজ নেই যে তোকে এই ভোর বেলা ঘরের কাজে হাত লাগাতে হবে। তাছাড়া এই কাজের জন্যে রুমকি আছে। যা ঘরে যা। হাতের কী অবস্থা। ঠাণ্ডায় যেনো জমে গেছে। যা ঘরে যা। তাথৈ ওকে ঘরে দিয়ে আয় যা। ”

নীরব এতক্ষণ হাঁ করে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে ছিল। কী হলো সব মাথার উপর দিয়ে গেলো। এই মেয়ে এতো কী করে সংসারী হলো কে জানে। ইচ্ছে চলে যেতে তৃপ্তি দেবী বললেন, ” ইচ্ছের মতো বৌমা পেয়ে তো তুমি ধন্য হয়ে গেলে বৌদি।”

রুমা দেবী বাইরের দরজার তালা খুলতে খুলতে বললো, ” এবার থেকে তুই চিৎকার কম করিস, একটু হলেই আমি হার্ট ফেল করতাম। আর ইচ্ছেকে দেখেছিস, তোর চিৎকারে কাঁপছিল কেমন।”

– ” আমার গলার আওয়াজ এই জন্মে কমবে না। সে যাই হোক আমি বাগানে যাচ্ছি। তুমি এলে এসো।”

তৃপ্তি দেবী চলে যেতেই রুমা দেবী নীরবকে বললো,
” ও যখন উঠে এলো তখন তুই কি করছিলিস? তোকে বলেছি না ও এখনও পুরোপুরি সুস্থ না। পরের দিন থেকে এটা খেয়ালে রাখবি। এতো সকালে এই ভাবে জল ঘাটলে শরীর খারাপ করবে। এমনিতেই কয়েকদিন হলো ও হসপিটাল থেকে বাড়ি এসেছে। এই সময় ঠাণ্ডা লাগানো ওর একদম উচিত না। যা ঘরে যা, মেয়েটা একা আছে।”

নীরব মুখ ফুলিয়ে ঘরে চলে গেল। এতে ওর দোষ কোথায়? ও কী জেগে জেগে ইচ্ছেকে পাহারা দেবে নাকি। পাহারা দিত যদি জানতো ইচ্ছে এই ভাবে উঠে আসবে। কিন্তু বোঝার ব্যাপার এতো সকালে ইচ্ছে বাড়ির কাজ করলো কেনো? তবে কি কিছু ভাবতে ভুল করছে নীরব। মাথায় হাজারো চিন্তা নিয়ে নীরব ঘরে প্রবেশ করলো। ইচ্ছে তখন চুপ করে বিছানায় বসে ছিল। নীরব বিছানায় উঠে ইচ্ছের কোলে মাথা রেখে মাথাটা কম্বল দিয়ে চাপা দিয়ে দিলো। আর ইচ্ছে হাঁ করে নীরবের দিকে তাকালো। কী হলো এটা ও তো বুঝতেই পারলো না। কম্বলের ভিতর থেকে নীরব বললো, “এটা তোর শাস্তি। আমি এইভাবেই শুয়ে থাকবো। কাল থেকে তোকে যদি এই ভোরে উঠে কাজ করতে দেখি না তাহলে দেখিস তোর কী করি! ”

নীরব ভেবেছিল ইচ্ছে হয়তো ওর সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেবে। কিন্তু এখনও ইচ্ছে কে চুপ করে থাকতে দেখে নীরব কম্বল থেকে মাথা বের করে বললো, ” কাল থেকে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসবি। তুই মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিস না?”

ইচ্ছে একবার মাথা নাড়িয়ে চোখ সরিয়ে নিলো নীরবের থেকে। প্রথম কোনো ছেলের এতোটা সংস্পর্শে এসে বেশ অসস্তি হচ্ছে ওর। এটা ঠিক যে আগে ও একবার নীরবকে জড়িয়ে ধরেছিল। কিন্তু সেটা ছিল হারিয়ে ফেলার দুঃখে, কষ্টে। সেইদিন তো ও চেয়েছিল নীরব যেনো ওর কষ্টটা অনুভব করে। যদিও বা সেই দিন তো তা হয়নি। কিন্তু আজ অনুভূতি গুলো যেনো নতুন করে জীবন্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছে তো তা চায় না।

——————————–

বিকেলের দিকে নীরব ইচ্ছেকে নিয়ে বাড়ির পাশের পার্কে নিয়ে যায়। ইচ্ছেকে সবসময় মন মরা করে বসে থাকতে দেখতে নীরবের এতটুকু ইচ্ছে করছে না। কই ইচ্ছে আগে তো এমন ছিল না। আগে সবসময় হাসি মজা করতো। কিন্তু এখন ইচ্ছেটা কেমন যেনো পাল্টে গেছে। এই যে নীরব সেই এসে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে এতে ওর কোনো অনুভূতি তো দূর কোনো অসস্তি ও হচ্ছে না। এসে থেকেই তাকিয়ে রয়েছে এক দিকে। সেখানে দল মিলে সকলে হেসে চলেছে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার ইচ্ছে তা দেখেও হাসছে না। নীরবের তো এখন মনে হচ্ছে ওর আবার পাগলের সাথে বিয়ে হলো না তো। কিন্তু ইচ্ছে পাগল না সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তবে কোথাও গিয়ে অনুভূতিটা হয়তো মরে গেছে।

নীরব কতকটা গম্ভীর গলায় বলল, ” শোন ইচ্ছে এখন থেকে তুই যেহেতু আমার বউ তোর সব থেকে প্রধান কর্তব্য হলো একটু কম বকা। মানে তোকে এই রকম চুপ করে থাকতে বলছিনা। ধর আমি পাঁচটা কথা বললাম, তাহলে তুই অবশ্যই চারটা কথা বলবি। আমি তো বুঝতেই পারছি না তুই এত চুপ কেনো?”

নীরব কোনো উত্তরই পেলো না। তাই পুনরায় বললো, ” বুঝেছি। তোকে আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম বলে তুই আমার উপর রাগ করেছিস, তাইতো। আচ্ছা যা, আমি খুব দুঃখিত। কিন্তু দেখ আমরা কিন্তু এক সুতোয় বাঁধা পড়েছি। এইটাই হয়তো হওয়ার ছিল। বিষয়টা হয়তো তুই মানতে পারিস নি। আমিও পারিনি। কিন্তু আমি মানছি না এমন না। একটু তো সময় লাগবেই তাই না।”

নীরবের কথায় ইচ্ছে ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। কী বলবে খুঁজে পেলো না ঠিক। ধীর এসেছিল রুমা দেবীর থেকে জেনে যে ইচ্ছে আর নীরব এই পার্কে এসেছে। এখানে এসে ও দেখে নীরব কিছু বলছে। শেষের কথা টুকুই ও কেবল শোনে।

– ” যদি কখনো মানতে না পারিস তাহলে কাউকে জানাস আর না জানাস আমাকে জানাস। আমি আমার বোনকে তোর কাছে রাখবো না।তোর দয়াতে ও ওখানে থাকবে না। ”

নীরব এই মুহূর্তে ধীরকে এইখানে দেখে একটু চমকে যায়। এখন তো ওর অফিসে যাবার কথা। সরাসরি তাই জিজ্ঞেসই করে বসে।

– ” অফিস যাসনি শালা?”
– ” মুখের ভাষা ঠিক কর নীরব।”
– -” যা বাবা, ভুল কী বললাম। তুই তো আমার শালাই। তুই আর নীর যেহেতু ইচ্ছেই ভাই সেই হেতু আমার শালা। তো এবার বল অফিস যাসনি?”
– ” না, ছুটি নিয়েছিলাম। কাল থেকে যাবো। ”
– ” ওহ।”
নীরব এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎই বসতে গেলেই ধীর বললো, ” আইসক্রিম নিয়ে আয় তো নীরব।”

নীরব খুশি হলো। ওর মনে হলো এই যেনো ধীর ওর উপর সহজ হলো। নাহলে একটু আগেও পর্যন্ত কেমন করে যেনো কথা বলছিল।

– ” কোন ফ্লেবার?”
– ” যা ইচ্ছে।”
নীরব ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে বললো, ” চল ইচ্ছে।”

– ” ও কেনো যাবে। আমি কি ওকে বলেছি। তোকে
বলেছি যে, নীরব আইসক্রিম নিয়ে আয়।”
– ” তুইই তো বললি, যা ইচ্ছে।”

ধীরের এই মুহূর্তে নীরবকে লাথি মারতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মনের ইচ্ছে মনে রেখে বললো, ” তোকে যা ইচ্ছে আইসক্রিম আনতে বলেছি।”

– ” ও। বুঝতে পারি নি। এই জন্যেই ছোটো বেলায় বলেছিলাম তোর বোনের নাম ‘ ইচ্ছে ‘ রাখিস না। কিন্তু সেই ‘ইচ্ছেই ‘রাখলি। দেখলি কী হলো।”

ধীর রেগে নীরবের দিকে তাকালে নীরব ছুটে রাস্তার ওপারে আইসক্রিম ভ্যানের দিকে এগিয়ে গেল। ধীর গিয়ে ইচ্ছের পাশে বসতেই ইচ্ছে মলিন হাসলো।

– ” কী রে ওখানে সব ঠিক তো? নীরব তোকে কিছু উল্টো পাল্টা বলেনি তো? ”

ইচ্ছে মাথা নেড়ে না করলো। দাদার কাঁধে পরম শান্তিতে মাথাটা এলিয়ে দিল। ধীরের মনের ভয়টা ইচ্ছে বুঝতে পারলো। এই ভয়টা ওর ও ছিল। কিন্তু ভয়টা যেনো হুট করেই কেটে গেল। সব যেনো ম্যাজিক হলো। কেনো হলো। শুধুই কি ইচ্ছেকে ওরা চেনে!

– ” শোন বোন, যদি তোর ওখানে কোনো অসুবিধা হয় আমাকে কিন্তু জানাবি। মনে থাকবে?”

কিন্তু ইচ্ছে সেই সব শুনলো কিনা কে জানে। ও তো তাকিয়ে রয়েছে রাস্তার ওপারে নীরবের দিকে। নীরব বেচারা বোস কাকুর কুকুরকে দেখে এপারে আসতে পারছে না ভয়ে। হাত দেখিয়ে কুকুরটাকে খালি হুশ হুশ করছে। ইচ্ছের হাসি পেলো। মৃদু হাসি, যা ধীরের চোখের আড়াল হলো না। এতদিন পর হয়তো ইচ্ছেকে ও জোর করে না হেসে প্রাণবন্ত ভাবে হাসতে দেখলো। ওর বেশ ভালোই লাগলো। অপর দিক থেকে নীরব চিৎকার করে বললো, ” ওই ধীর এইদিকে আয়, এই ভলুকে সরা। নির্ঘাত এর জন্যে আমাকে চোদ্দোটা ইনজেকশন নিতে হবে। ”

ধীরকে যেতে হলো না। তার আগেই যার কুকুর সে ওখান থেকে ভলুকে নিয়ে গেলো। ধীরের হঠাৎ বোধোদয় হলো এই ছেলেটা এখনও কুকুরকে ভয় পায়। এমনকি ইনজেকশন নিতেও এর জ্বর। তাহলে ওর বোনকে কী করে ও সামলাবে।

( চলবে )

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
৭ .

আজ সকালে ইচ্ছের যখন ঘুম ভাঙলো এতো অবাক
হলো যে বলার মতো না। ঘুম হালকা হতেই ও একটু নড়তেই ওর বাম হাতটা কিছুর একটা টানে নীরবের পেটে গিয়ে পড়ল। ইচ্ছে কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীরব চোখ বুঝেই ওকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে। ঘুম ঘুম স্বরে বলে,

– ” ঘুমো ইচ্ছে। এখনও ছয়টাও বাজেনি। ছয়টা বাজলেই অ্যালার্ম বাজবে।”

হাঁ করে ঘুমন্ত নীরবের দিকে তাকিয়ে রইল ইচ্ছে। ঘুমো মানে কী? ওর তো কতো কাজ। কাজ না করলে যে…., গলা শুকিয়ে গেল ইচ্ছের। গলার ভিতরের দিকটা জ্বলে উঠলো। মাঝে মাঝেই হয় এমন। পড়ে ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যায়। বোধহয় কাল রাতে ঘুমের মধ্যে কাশি হয়েছে। ধীর শুনলে নির্ঘাত রাগ করবে। ইচ্ছে কোনো মতে উঠতে গিয়ে যা বুঝলো, তা হলো নীরবের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া মুশকিল। নীরব ওর ডানহাতটা দিয়ে ইচ্ছের হাতটা চেপে ধরে রেখেছে। তার উপর কাত হয়ে বাম হাত দিয়ে ইচ্ছেকে ধরে রেখেছে। যার জন্যে ইচ্ছে নড়তে অবধি পারছে না। কিন্তু নীরবের এতো কাছে, যে ওর যেনো সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আর বারবার ওর চোখটা গিয়ে নীরবের ঘুমন্ত মুখে গিয়েই পড়ছে। কিছুতেই যেনো চোখ সরাতে পারছে না। কিন্তু নীরবের শ্বাস যতবার ইচ্ছের কপালে পড়ছে ইচ্ছে না চাইতেও নড়ে চড়ে উঠছে। যা নীরবকে অনেকটাই ডিস্টার্ব করছে। আর ওর মনে হচ্ছে ইচ্ছে উঠে আবারও হয়তো নীচে গিয়ে পুনরায় একই কাজ করবে তাই এবার ধমক দিয়েই ওকে বলে, ” খবরদার ইচ্ছে, কী করছিস কী। নড়াচড়া কম কর। হয় চুপ করে থাক আর নাহলে ঘুমো। ”

ঘুমের ঘোরে মানুষ যখন রেগে যায় তখন আমাদের একটু ভয় পাওয়াই উচিত। কারণ তাকে সেই মুহূর্তে কোনো ভাবে বিরক্ত করলে সে রেগে গিয়ে যা কিছু করতে পারে। ইচ্ছে যার সঙ্গে পূর্ব পরিচিত। তাই ও চুপ করে নীরবের গলার কাছে মাথাটা মিশিয়ে দেয়। নীরবও শীতের ঠান্ডার মধ্যে ইচ্ছের সংস্পর্শে ওকে নিজের সঙ্গে আরও মিশিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে ইচ্ছের চোখে নেমে আসে ঘুম। শান্তির ঘুম। হঠাৎই যেনো মনে হলো আর কোনো বিপদ ওকে ছুঁতে পর্যন্ত পারবে না।

নীরবের দেওয়া অ্যালার্ম সকাল ছয় টায় বাজলেও ঘুম কারোরই ভাঙ্গে না। দুইজনেই পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে ছিল। নীরবের যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রথমেই ওর একটা কথাই মাথায় আসে। শীতকাল এলেই কোনো না কোনো বন্ধু স্টাসাস দিতো, শীতকালে খুব জরুরি একটা বউয়ের দরকার। আর সেটা প্রায় সকলেই কপি পেস্ট মেরে পোস্ট করেই চলতো। ভগবান যদি সেই মুহূর্তে ওদের ইচ্ছে গুলো পূরণ করতো তাহলে হয়তো বিয়ের পাত্র পাত্রী খুঁজতে খুঁজতেই শীত ভয়েই পালিয়ে যেতো।
হেসে উঠলো নীরব। প্রাণখোলা হাসি। এখন ওর মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ভালোই করেছে। নীরবের হাসির শব্দে ইচ্ছের ঘুম ভেংগে যায়। নীরব তো একেই ইচ্ছেকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে। তার উপর ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। যার দরুন ওকে একরাশ ভয় ঘিরে ধরে। নিজেকে বিছানার সঙ্গে যেনো মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করে।

নীরব ওকে ছেড়ে সরে যায়। ইচ্ছের মনের অবস্থা হয়তো কিছুটা হলেও নীরব অনুভব করেছিল। দুজনেই তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। কম করে আটটা বেজে গেছে। একদিকে নীরবের আজ অফিস অপর দিকে ইচ্ছের ভয় করছে। কোনো মেয়ে কি শ্বশুর বাড়িতে সকাল আটটা অবধি ঘুমায় নাকি? বাড়ির বউদের ঘুম ভাঙ্গবে সকলের আগে। এমনটাই তো ইচ্ছে জানে।

নীরবকে দেখে ইচ্ছে বেরিয়ে যেতে গেলে নীরব বারণ করে। দুইজনে একসঙ্গে ব্রাশ করতে থাকে। ইচ্ছে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসতে গেলে হটাৎই সামনের আয়নায় ইচ্ছের দিকে নজর যায় নীরবের। ইচ্ছে ওর দিকে ফিরলেই নীরব ওর গলায় হাত রাখে। পিছিয়ে যায় ইচ্ছে, ভয়ে। ওর ভয় করে, মনে করে নীরব হয়তো ওকে মারবে। কিন্তু হুট করেই নীরব ওর হাত ধরে ওকে সামনে আনে। আবারও গলায় হাত রাখে। গলার কাছে একটা কাটা দাগ হয়ে রয়েছে। কালকে খেয়ালে না পড়লেও আজ হুট করেই দেখতে পেলো। সেই দাগটার পাশে হাত বুলিয়ে বলল,

– ” এটা কিসের দাগ ইচ্ছে। কই আগে তো কোনদিন দেখিনি! কবে থেকে এটা আছে? মনে হচ্ছে কোনো ভাবে তুই আঘাত পেয়েছিস!”

চুপ করে থাকলো ইচ্ছে। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নীরবের দিকে। কিন্তু উত্তর দেবার কোনো প্রস্তুতিও ওর মধ্যে দেখা গেলো না।
——————————-

নীরব ইচ্ছের জীবন টা বেশ ভালোই কেটেছে এই দুই সপ্তাহে। প্রতিদিন সকালে ইচ্ছে যদি আগে ঘুম থেকে ওঠে নীরব কীকরে যেনো হুট করেই জেগে গিয়ে ওকে ধমক দিয়ে পড়তে বসিয়ে দেয়। ইচ্ছে পড়ে আর ও ইচ্ছের পাশে বসে ঘুমোয়। নীরবের এর মাঝে এক বদ অভ্যেস ও হয়েছে। বিয়ের আগে নিজের কাজ নিজে করলেও বর্তমানে সামান্য ফোনটা চার্জ দিতে ও সে ভুলে যায়। ইচ্ছেও এখন ইউনিভার্সিটি যাওয়া শুরু করেছে। আজকে নিয়ে পাঁচ দিন সবে। মাঝে এক দিন যায়নি। রুমা দেবী ও বৌমাকে নিয়ে বেশ আছে। ইচ্ছে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরলে নয় দুজনে টিভি দেখে না হয় টুকটাক কাজ করে। তার সাথে তাথৈ ও রয়েছে।

আজ বিকেলটা একটু অন্যরকম। শীতের বিকেলকে দেখে মনে হবে এখন যেনো ঝড় উঠতে পারে আবার নাও পারে। ইচ্ছে ছাদের চিলেকোঠার বারান্দার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে এই আবহাওয়াটা অনুভব করছিল। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ও কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাও ঐখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। হুট হাট চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছে নীরবের পাগলামো গুলো। তখনই না চাইতেও মুখে হাসি ফুটে উঠছে। এই যেমন আজ সকালেও ও দেখেছিল, ঘুম ভেংগে নীরবের নিষ্পাপ মুখটা। দেখলেই মনে হবে পৃথিবীর সব থেকে শান্ত ছেলেটা বোধহয় এই। ইচ্ছে আরও বেশি অবাক হয় যখন রোজ চোখ খুলে দেখে নীরবের হাত খুব শক্ত করে ওর শাড়ির আঁচলটা চেপে ধরে থাকে। মাঝে মাঝে আবার হাতের আঙ্গুলের সাথে বেঁধেও রাখে।

উপরের গ্রিলে একটা রডের মধ্যে ঝুলে থাকা খাঁচাটায় ইরা মাঝে মধ্যে “পিকু” বলে ডেকে চলেছে। আর ড্যাবড্যাব করে ইচ্ছের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই তো কয়েকদিন আগের কথা, ইচ্ছে এই চিলেকোঠার ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল। সময়টা এমনই বিকেলের দিকে। হঠাৎ করেই কেউ ‘ পিকু’ বলে ডাকে। ইচ্ছে নিজের ভুল ভেবে নিজের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু আবারও যখন একই কথা শোনে তখন পিছন ফিরে দেখে নীরব একটা কাকাতুয়ার খাঁচা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিস্ময়ে ইচ্ছে ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। নীরব গিয়ে পাখির খাঁচাটা মাথার কাছে রডে রেখে ইচ্ছের কাছে গিয়ে বলে,

– ” বিয়ের রাতে বর বউকে কিছু উপহার দেয়। আমার বিবাহিত সব বন্ধুরা নয় সোনার আংটি আর নাহয় সোনার হার দিয়েছে। কিন্তু আমার সব কিছু ইউনিক তাই তোকে দিলাম এই যে আমাদের ইরাকে। তোর আর আমার নামে এর নাম ‘ ইরা ‘। মনে থাকবে? ”

ইচ্ছে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে ইরার দিকে এগিয়ে যায়। পাখিটা মাঝে মাঝেই খাঁচার দেওয়ালে ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাচ্ছে। ইচ্ছের খুব পছন্দ হয়। ইরা যেখানটায় ঠোকর মারে ইচ্ছে গিয়ে সেই খানে হাত রাখে। ওমনি ইরা আবারও ওখানে ঠোকর মারতে ইচ্ছে ভয়ে হাত সরিয়ে নেয়। ইচ্ছের খুশি দেখে তৃপ্তির হাসি হাসে নীরব। এক পা এক পা করে ইচ্ছের কাছে এগিয়ে গিয়ে খাঁচায় রাখা ইচ্ছের হাতের আঙ্গুলটা ধরে ফাঁকা জায়গা দিয়ে আঙ্গুলটা খাঁচার ভিতর ঢুকিয়ে দেয় নীরব। ভয় পায় ইচ্ছে। ভয়ে ভয়ে নীরবের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু হাতে কামড়ের অনুভব না করে খাঁচার দিকে দেখে। ইরা মাঝে মাঝে ইরার আঙ্গুলে নিজের মাথা ঘষছে। হেসে দেয় ইচ্ছে। নীরব ইরার দিকে তাকিয়ে বলে,

– ” ইচ্ছে আর ইরার কিন্তু আজ থেকে বন্ধুত্ত্ব হয়ে গেলো। তো দুজনেরই দুটো কাজ। ইরা সবসময় ইচ্ছের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখবে। দেখবে আমার বউটা যেনো মুখ ফুলিয়ে না রাখে। আর ইরার বন্ধু ইচ্ছে ইরাকে কথা শেখাবে। নতুন নতুন কথা। মনে থাকবে? ”

ইচ্ছে ঘাড় বেঁকিয়ে নীরবের দিকে তাকালো। পাখিটার কী হলো কে জানে, ‘পিকু’ বলে ইচ্ছের আঙ্গুলে পুনরায় মাথা ঘষলো।

———

– ” এই ইচ্ছে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। নীরব এলেই বেরোতে হবে।”
রুমা দেবীর কথা শুনে ইচ্ছে বাস্তবে ফিরলো। রুমা দেবী নীচ থেকে ডাকছে ওকে। ইরার খাঁচাটা নিয়ে নীচে নেমে গেলো ইচ্ছে। ইরা ওদের ঘরের বারান্দাতেই থাকে। এতক্ষণ দুই বন্ধুতে আকাশ দেখতে এসেছিল।

( চলবে )
{ বিঃ : হ্যাপি রিডিং। }