নীড় হারা পাখি পর্ব-২১

0
254

#নীড়_হারা_পাখি
#২১তম_পর্ব

থাই গ্লাসে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুলিকা। স্থির বাহিরের দিকে। রোদ্দুর তাকে কিছু বলবে। কিন্তু পাঁচ মিনিট যাবৎ চুপ করেই আছে। তুলিকা শান্ত স্বরে বললো,
“কি বলবে, বললে না তো”

বুক চিরে জমায়িত দীর্ঘশ্বাসটি ফোঁস করে বের করে গাঢ় স্বরে বললো,
“আমি তোমাকে মুক্ত আকাশ দিতে চাই তুলিকা। কিন্তু সেই অধিকারটা আমার নেই। তোমার কাছে সেই অধিকারটি চাই। দিবে আমায়?”
“কেনো?”

নিস্পৃহ কন্ঠে প্রশ্নটি করলো তুলিকা। তার শান্ত দৃষ্টিতে এখনো রোদ্দুরের প্রতিচ্ছবি। রোদ্দুর ম্লান কন্ঠে বলল,
“আমি যে তোমায় ভালোবাসি”

রোদ্দুরের কথাটি চুপ করে শুনলো তুলিকা। মস্তিষ্ক জুড়ে “ভালোবাসি” কথাটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্রচন্ড ভার অনুভূত হলো মস্তিষ্কে। কিছু ভঙ্গুর, ঝাপসা স্মৃতি মূহুর্তেই চোখের সম্মুখে সেলুলয়েডের ক্যামেরার নেগেটিভের মতো ভাসতে লাগলো। বুকের কোনে চিনচিনে ব্যথার সঞ্চার হলো তুলিকার। তীব্র যন্ত্রণায় ছেয়ে গেলো অন্তস্থল। মনে হলো কেউ গলা টিপে ধরেছে। ধোঁয়াশা একটি অবয়ব মসিষ্ক তৈরি করছে। কিন্তু সেই অবয়বটির মুখখানা দেখতে পারছে না তুলিকা। ঈষৎ কাঁপতে লাগলো শরীরটা। মস্তিষ্কে চাপ বাড়লো। হাতজোড়া দিয়ে চেপে ধরলো মাথাটা। পাজোড়া জোড়ায় জোর কমলো। ধপ করে টাইলসের উপর ই বসে পড়লো। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে যেনো। চাপা চিৎকার বের হলো কন্ঠ চিরে,
“ওকে চলে যেতে বলো, ম/রে যাবে। তুমি ম/রে যাবে। চলে যাও। চলে যাও”

সাথে সাথেই বলিষ্ঠ হাতজোড়া জড়িয়ে ধরলো তাকে।
“কি হয়েছে তুলিকা?”

কন্ঠে উৎকন্ঠা। হৃদয় কাঁপছে ক্রমশ। বলিষ্ঠ হাত এই প্রথম কাঁপছে। কে বলেছে ডাক্তাররা পাষান। তাদের মনে ভয় ডর থাকে না। সম্মুখের মানুষটি যখন হৃদয়ের সন্নিকটের হয়, তবে সকল ডাক্তারের হাত কাঁপে। প্যানিক নামক শব্দটি ধীরে গ্রাস করে ডাক্তারদের। সকল জ্ঞান বৃথা লাগে। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যায়। রোদ্দুরের ক্ষেত্রেও অন্যথা হলো না। তুলিকার অবস্থার বিপর্যয় তাকে মূহুর্তেই নাড়িয়ে দিলো। শান্ত, স্থির, ধৈর্য্যশীল মানুষটি হয়ে উঠলো অধৈর্য্য, অস্থির, অশান্ত। দৃঢ় হলো রোদ্দুরের বাহুর বন্ধন। গাঢ় কন্ঠে বললো,
“শান্ত হও”
“চ…চলে যাও। তাড়াতাড়ি সরে পরো। ও…ওরা তোমাকেও মে…মে/রে ফেলবে”
“কারা?”
“ও………ওরা, ওকেও মে…রে ফেলেছিলো”

ভীত কন্ঠে কথাখানা বললো তুলিকা। গলা যেনো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। টলমল করছে তার পৃথিবীটা। ঘোলাটে চোখে ভিড় করেছে বিষাদের মেঘমালা। একটা সময় শরীর নিস্তেজ হতে লাগলো। ভার সপে দিলো আলিঙ্গনরত থাকা পুরুষটির বুকে। পুরুষটিও বিনা সংকোচে বক্ষস্থলে লেপ্টে রাখলো। প্রলাপের মাত্রা ক্ষীন হলো। একটা সময় মূর্ছা গেলো সে। মায়াবন বিহারিনীর ভীত, সন্ত্রস্ত, চেতনাহীন দেহটির দিকে তাকিয়ে রইলো প্রেমিক। পড়ন্ত বিকেলের কমলা আলো তখন আঁছড়ে পড়ছে তার ফ্যাকাসে, প্রাণহীন মুখশ্রীতে_______

*******
শুভ্র বিছানায় শায়িত চেতনাহীন তুলিকা। শুষ্ক ঠোঁট, ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখশ্রী। হাতে ক্যানোলা। স্যালাইন চলছে। তাকে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করার ঔষধ দেওয়া হয়েছে। যেনো উদ্বিগ্নতা কমে। তার পাশে দুহাতে মাথা ঠেকিয়ে চিন্তিত মুখে বসে রয়েছে সুরভী। তার মুখশ্রী পাংশু ধারণ করেছে। হাত, পায়ে হীম ধরছে। এমন কিছু হবে কল্পনাটিও করে নি। ভেবেছিলো নিষ্পাপ মেয়েটিকে রোদেলা আকাশে উড়ার উপহার দিবে, রুপকথা রাজকুমার ঘোড়ায় চড়ে আসবে তার বিক্ষিপ্ত স্বপ্নগুলো জুড়তে। কিন্তু তেমনি কিছুই হলো না, রুপকথায় পাতাগুলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। আষাঢ়ের মেঘমেদুরে ঢেকে গেলো রোদেলা আকাশ। বিক্ষিপ্ত স্বপ্নগুলো ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ের রক্তক্ষরণে রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। হায় নিষ্ঠুর নিয়তি! রোদ্দুর পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে। শ্যাম মুখখানায় মলিনতার ছাপ। মায়াবন বিহারিনীর এখনো জ্ঞান ফিরে নি। যখন মূর্ছা যাওয়া দেহটি বুকে লেপ্টে ছিলো মনে হচ্ছিলো এক মূহুর্তেই বিশ্রী শূন্যতা হৃদয়কে গ্রাস করছে। চূর্ণ বিচূর্ণ করে খা/ব/লে খাচ্ছিলো তার সর্বস্ব। এতোটা মোহ তো ছিলো না কারোর প্রতি। কখন জন্মালো এই টান? কবে এতোটা আবেগে ভাসলো নির্লিপ্ত হৃদয়?

ভাবনায় ছেদ পড়লো সুরভীর মোবাইলের কর্কশ শব্দে। নিস্তদ্ধ ঘরের নীরবতা ভেঙ্গে গেলো মূহুর্তেই। একপলক মোবাইলের দিকে দেখলো সে। তারপর শান্ত গলায় বললো,
“ওকে দেখো, আমি কথা বলে আসছি”

রোদ্দুর মাথা দোলালো। সুরভী উঠে চলে গেলে ধীর পায়ে বসলো তুলিকার বেডের পাশের চেয়ারে। ক্যানেলা দেওয়া নরম হাতটিতে রক্ত জমে আছে, আলতো হাতে ছুলো হাতটি। মাথা ঠেকালো। বক্ষস্থলে জমা তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। এর মাঝেই অনুভূত হলো ঈষৎ শরীরে সঞ্চালন হচ্ছে। মাথা তুলে দেখলো চোখ মেলে তাকিয়েছে তুলিকা। স্মিত কন্ঠে বললো,
“এখন কেমন লাগছে?”

তুলিকা উত্তর দিলো না। চোখ মুখ বিকৃত করে তাকালো হাতের দিকে। ক্যানোলার কারণে হাতে তীক্ষ্ণ ব্যথা করছে। রোদ্দুর শান্তভাবে বললো,
“এটা থাকবে দু-এক দিন। তারপর ঠিক হয়ে যাবে”
“ভাবী কোথায়?”
“কথা বলতে গিয়েছে”
“ওহ”

তুলিকা উঠে বসতে চাইলে রোদ্দুর তাকে সাহায্য করার জন্য তৎপর হলো। তুলিকা কিছুটা সংকোচবোধ করলো বটে, কিন্তু রোদ্দুর তা উপেক্ষা করেই তাকে উঠে বসালো। পেছনে বালিশ দিয়ে হেলান দেওয়ালো। তুলিকা অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। রোদ্দুর বুঝলো মেয়েটি তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের চিনচিনে ব্যাথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। অভিমানী স্বরে বললো,
“তুলিকা”
“কি”

অন্যদিকে তাকিয়েই শুধালো সে। রোদ্দুরের অভিমান গাঢ় হলো। গাঢ় স্বরে বললো,
“”তুমি কি আমাকে বোঝ না? নাকি বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করো?”
“পাগলকে বোঝানোর কেনো ব্যার্থ চেষ্টা করছো?”
“কে বলেছে তোমায়, তুমি পাগল?”
“পাগল নই, পাগল নই। আমি হলাম সে/য়া/না পাগল। জাতে মা/তা/ল তালে ঠিক। তাই ওসব ম/রা/র ভালোবাসা দিয়ে আমাকে বেকুব বানাতে পারবে না”

বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো তুলিকা। ঘোলাটে চোখজোড়ায় সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ছে। রোদ্দুর অপলক নয়নে তার হাস্যজ্জ্বল মুখখানা দেখছে। নিষ্ঠুর স্নিগ্ধতার মাঝেও কোথাও যেনো আক্ষেপ রয়েই যায়, না পাওয়ার আক্ষেপ। প্রতিনিয়ত হৃদয়ের অন্তস্থলে দগ্ধ অনুভূতিগুলোর বিসর্জনের আক্ষেপ। হয়তো এটাই তার নিয়তি__________

সুরভী যখন ফিরে এলো কেবিনে, রোদ্দুর তখনও ঠায় বসে ছিলো সেখানে। একবিন্দু নড়ে নি। তুলিকা তখনো হাসছে। সুরভীকে দেখতেই উঠে দাঁড়ালো রোদ্দুর। ম্লান স্বরে বললো,
“বাড়ি যান ভাবী, তুলিকা এখন ঠিক আছে”

সুরভীকে দ্বিতীয়বার উত্তর দেবার সুযোগটি দিলো না সে। বেড়িয়ে গেলো কেবিন থেকে। সুরভী তুলিকার দিকে তাকালো। সে হাসছে। যেনো খুব মজার কিছু হয়েছে। অথচ রোদ্দুরের মুখখানা ছিলো ম্লান, বিবর্ণ, চৈত্রের খরায় দগ্ধ মাঠের ন্যায় কঠিন। সুরভী বললো,
“হাসছিস কেনো?”
“ও আমাকে ভালোবাসে ভাবী। হাসবো না? তুমিও হাসো। পাগলের ডাক্তার পাগলকে ভালোবাসে”

বলেই আবারো খিলখিল করে হেসে উঠলো। সুরভী কিছু বললো না। ভাগ্যের উপহাসে ভাষাহীন সে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। রুপকথার শেষ পাতাটি তবে এই ছিলো। নীড় হারা পাখির গল্পটি এখানেই শেষ__________

********

তপ্ত সূর্যের কিরণে ঝলসে যাচ্ছে ধরনী। শুষ্ক পাতায় ঢেকে গেছে শহরতলীর পিচডালা রাস্তা। সেই পাতায় ঝাড়ুর স্পর্শে এক সম্মোহনী শব্দ কানে আসছে। বাতাসে গাদা ফুলের স্নিগ্ধ সুবাস। শীতের তীব্রতা আজ ক্ষীন। পাতলা শালেও শীত লাগছে না অভিলাষার। অবশ্য শরীরের হরমোন্যাল ডিসব্যালেন্সের জন্য শরীরে গরমের পরিমাণ বেড়েছে। ঘুম ঘুম চোখে রোদেলা শহরটিকে দেখছে সে। মনটা আজ ভালো নেই। কেনো যেনো কু ডাকছে হৃদয়। মনে হচ্ছে কিছু একটা অশুভ হবে। কাঁপছে হৃদয়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ঘুমন্ত মানুষটির দিকে। গভীর ঘুমে লিপ্ত তিমির। গতরাত সারারাত সে পড়াশোনা করেছে। আগামী পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু। এবার ভালো ফলাফল করার জন্য সে কঠোর পরিশ্রম করছে। গত তিনদিন অফিস ও যায় নি। অভিলাষা শুধাতেই তাকে বলেছিলো,
“পরীক্ষা তাই ছুটি নিয়েছি”

অভিলাষা কথা বাড়ায় নি, যদিও জানে মিথ্যে বলেছে তিমির। পরীক্ষার কারণে ছুটি সে নেয় নি। এমন সময় দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। ঘড়িতে এখন সময় সাতটা তিরিশ। এখন তিতিরের ফেরার কথা নয়।তবে কে? পেটটা আগলে দরজা অবধি গেলো অভিলাষা। দরজা খুলতেই খাকি পোশাক পরিহিত দুজন ব্যাক্তিটিকে দেখলো সে। বুঝতে বাকি রইলো না এরা পুলিশ। অভিলাষার হৃদয়ে কামড় পড়লো। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই তাদের একজন বলে উঠলো,
“এটা কি তিমির আহমেদের বাসা?”
“জ্বী”
“উনাকে ডেকে দিন তো, উনার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে……………”

চলবে

#নীড়_হারা_পাখি
#২১তম_পর্ব (বর্ধিতাংশ)

এমন সময় দরজায় কলিং-বেল বেজে উঠলো। ঘড়িতে এখন সময় সাতটা তিরিশ। এখন তিতিরের ফেরার কথা নয়।তবে কে? পেটটা আগলে দরজা অবধি গেলো অভিলাষা। দরজা খুলতেই গাঢ় নীল পোশাক পরিহিত দুজন ব্যক্তিটিকে দেখলো সে। বুঝতে বাকি রইলো না এরা পুলিশ। অভিলাষার হৃদয়ে কামড় পড়লো। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই তাদের একজন বলে উঠলো,
“এটা কি তিমির আহমেদের বাসা?”
“জি”
“উনাকে ডেকে দিন তো, উনার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে”

মস্তিষ্ককে ঘিরে ধরলো নানারকম বিশ্রী খারাপ চিন্তা। আবেগপ্রবণ মনটির আকাশে কালবৈশাখী ঝড়ের আগাম আভাস জানালো। মধ্যবিত্ত পরিবারে পুলিশ শব্দটি আতংকের দ্বিতীয় নাম। তাদের পোশাক দেখলেই বক্ষস্থলের এক কোনের লুকায়িত ভয়টা মাথাচাড়া দেয়। হাত পা গুলো অসার হতে থাকে। পুলিশদের আশেপাশে দেখলেই যেখানে এড়িয়ে চলে মানুষগুলো, সেখানে যদি সেই পুলিশ ই সকাল সাতটা তিরিশে নিজের দর্শণ দেয় তবে উল্টোপাল্টা চিন্তা মস্তিষ্ককে ঘায়েল করবে এটাই স্বাভাবিক। অভিলাষার চিন্তার সুঁতোয় ছেদ পড়লো যখন এস আই আবদুল্লাহ বলে উঠলেন,
“উনি বাসায় নেই?”
“জি আছেন, কিন্তু উনাকে কেনো প্রয়োজন”

ভীত কন্ঠে শুধালো অভিলাষা। এস.আই কিছু বলতে উদ্ধত হচ্ছিলেন। কিন্তু নারী কন্ঠ কানে আসতেই থেমে গেলেন। হিমা বেগম তখন রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। অভিলাষাকে দরজার সম্মুখে ভুতের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধীর কন্ঠে বললেন,
“কে এসেছে?”

অভিলাষা পেছনে ফিরলো, কাঁপা স্বরে বললো,
“পুলিশ”

*******

ঘরে পিতপতন নীরবতা। চিন্তিত, শুষ্ক মুখগুলো জানান দিচ্ছে অঘটনের আগামবার্তা। ঘড়ির টিকটিক শব্দটুকুও শোনা যাচ্ছে। নির্জীব মূর্তির মতো বসে রয়েছেন হিমা বেগম। শফিক সাহেব মাথায় হাত দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রয়েছেন। যার সন্তানকে পুলিশ নিয়ে যায় সেই পিতার ঠিক কি করা উচিত জানা নেই। ঘরের এক কোনে নতমস্তক দাঁড়িয়ে আছে অভিলাষা। মুখখানা রক্তশূন্য। হাজারো অশুভ চিন্তার ভিড়ে পিষছে সে। সময়টা যেনো নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর লাগছে। তিতির ঘরে ফিরতেই দেখলো সদর দরজাটি হাট করে খোলা। সে প্রবেশ করতেই ঘরের মানুষগু্লোর বিষন্ন মুখগুলো দেখলো। কিছু শুধানোর পূর্বেই দেখলো সুরভী এবং তুরান নিজেদের ঘর থেকে বের হলো। শফিক সাহেবকে আশ্বাস দিলো তুরান। গাঢ় কন্ঠে বললো,
“চিন্তা করো না বাবা, তিমিরের কিছুই হবে না”

কিছুক্ষণ পূর্বে তিমিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমতলা থানায় নিয়ে গেছেন এস.আই আবদুল্লাহ। যে কোম্পানিতে সে কর্মরত ছিলো তারা আসলে ঢপের কোম্পানি। রপ্তানিমূলক ব্যাবসার মোড়কে তারা আসলে ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল অ্যামফিটামিন মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে পাচার করতো। গত শনিবার তাদের ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ থেকে ১২ কেজি অ্যামফিটামিন উদ্ধারের পর পাচারের সহযোগিতা করায় একটি বহুজাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের তিন কর্মকর্তাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। পরে অধিদপ্তরের তদন্তেই এই আসামিদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তাঁদের সবাইকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তদন্তের মাধ্যমে তিমিরের কর্মরত কোম্পানির নাম আসে। কোম্পানির মালিক সহ সকল স্টাফকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই তিমিরকে নিয়ে যাওয়া। পুলিশকে দেখেই হিমা বেগমের হাত পায়ে হীম ধরলো। অস্থির হয়ে উঠলো শান্ত মস্তিষ্ক। উদ্বিগ্নতা আঁকাশ ছুলো যখন চোখের সম্মুখে ছেলেকে জিপে পুরা হচ্ছিলো। যদিও তারা তিমিরের হাতে হ্যান্ডকাফ দেয় নি, চামারের মতো আচারণ করে নি। কিন্তু তবুও মায়ের বুক খা খা করছিলো। আবদুল্লাহকে অনুনয় করে বলছিলেন,
“আমার ছেলে কিছু করে নি”

তিমির যাবার সময় মায়ের হাতজোড়া ধরে বলেছিলো,
“মা, খিঁচুরি বেড়ে রেখো। আমি এসে খাবো”

সেই থেকেই হিমা বেগম সোফায় মূর্তির মতো বসে রয়েছেন। এদিকে অভিলাষা নিশ্চুপ। দেয়ালের সাথে মিশে আসে তার পিঠ। চুলগুলো অবিন্যস্ত। তিমিরকে ঘুম থেকে তুলে যখন শুধিয়েছিলো,
“পুলিশ এসেছে কেনো?”
“আমাকে চাচ্ছে?”
“হ্যা?”

তিমির দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে বসলো কিছুসময়। তারপর ম্লান কন্ঠে শুধু এটুকুই বললো,
“অভিলাষা, আমি নির্দোষ। আমাকে অবিশ্বাস করো না”

ছেলেটির গাঢ় নয়নের আকুতি হৃদয়ে ঝড় তুললো। কেনো যেনো কেঁপে উঠলো প্রাণ। মূল্যবান কিছু হারাবার ভয়টি তীব্র হলো। জিপে উঠার সময় সদর ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো অভিলাষা। মনে হচ্ছিলো বেরহম ভাগ্য তার সর্বস্ব শুষে নিচ্ছে। হাহাকার করছিলো হৃদয়। কিন্তু শরীর অসার হয়ে গিয়েছিলো। শুধু সিক্ত চোখজোড়া দেখছিলো প্রণয়নের বিদায়।

শফিক সাহেবের ভরসার স্থানটি তুরান সে যেহেতু বলেছে সবটা ঠিক হবে, তার মানে ঠিক হবেই। তাই শফিক সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“সুরভী, আমার ডায়াবেটিসটা মেপে দাও। ইনসুলিন দিবো”
“তোমার গলায় খাবার নামবে?”

প্রায় সাথে সাথেই হিমা বেগম কথাখানা বলে উঠলেন। শফিক সাহেব ম্লান হেসে বললেন,
“যে বাবা পদে পদে সন্তানদের পিষতে দেখে তার গলা থেকে সব নামে”

হিমা বেগম চোখ মুখ বিকৃত করলেন। সুরভী ধীর কন্ঠে বললো,
“খেতে চলুন মা, তিমির চলে আসবে। ওকে গ্রেফতার করে নি, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে। তাই চিন্তা করে নিজেকে অসুস্থ করবেন না মা”
“তোমরা আছো তোমাদের মতো। আমার ভেতর কি হচ্ছে আমি জানি। গিলো না আমি মানা করি নি তো, আমাকে জ্বালিও না। এমন দিন তো আসার কথা ছিলো না। এমনটা তো হতো না। ছেলে আমার লেখাপড়া করে আজ চাকরি করতো। অথচ সব উলোটপালোট হয়ে গেলো। বউপালার হিরিক উঠলো। সেই বউ এর জন্য আজ সে থানা অবধি গেলো”

হিমা বেগমের কথাগুলো কানঅবধি এলেও শুনতে পারছে না অভিলাষা। পেটে তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভূতি হচ্ছে। সেই যন্ত্রণায় সব যেনো ঝাপসা লাগছে। ঠোঁট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টা করলো অভিলাষা। পেট আকড়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। হিমা বেগমের কথা শুনেও না শোনার ভান করলো সুরভী, কথা বাড়ালো না। সে জানে শ্বাশুড়ি মা বরাবর এমন। অন্য সময় হলে হয়তো প্রতিবাদ করতো। কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে না। কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না ক্লান্ত মনের। সে তুলিকা, তিতির এবং শফিক সাহেবকে খাবার বেড়ে দিলো। এখন অভিলাষার তেইশ সপ্তাহ চলে, ফলে তার দিকে বিশেষ খেয়াল দেওয়া প্রয়োজন। ফলে শ্বাশুড়িকে উপেক্ষা করেই অভিলাষাকে বললো,
“খেতে চলো”

অভিলাষা নড়লো না। শুধু চাপা স্বরে বললো,
“ভাবী, ব্যাথা করছে”

কথাটা শুনেই সুরভীর পিলে চমকে উঠলো। তৎক্ষণাৎ ফ্লোরের নিয়ে তাকাতেই দেখলো বিন্দু বিন্দু র/ক্ত। অভিলাষার ভারী শরীরটা ভার ছেড়ে দিলো সুরভীর উপর। কাতর স্বরে বললো,
“ব্যাথা, ব্যাথা”

********

হাসপাতালের বাহিরের করিডোরে বসে রয়েছে সুরভী এবং শফিক সাহেব। শফিক সাহেবের হাত কাঁপছে। বিপদ যখন আসে তখন সর্বশান্ত করেই থামে। অভিলাষার রক্তপাত দেখে স্থির থাকতে পারলো না বৃদ্ধ মানুষটি। ছেলেকে পুলিশ থানায় নিয়ে গেছে, গর্ভবতী বউমার র/ক্তপাত হচ্ছে। আর কত সহ্য করবেন। সুরভী উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে কেবিনের ভেতরে। ভেতরে ডা. ইয়াসমিন তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। এমতাবস্থায় রোদ্দুর দুকাপ গরম কফি এনে শফিক সাহেবের পাশে বসলো। কফিটি এগিয়ে দিলো শফিক সাহেবের কাছে। ম্লান কন্ঠে তিনি বললেন,
“আমি খাবো না, ভালো লাগছে না”
“ভালো লাগার জন্য দেই নি আংকেল। আপনি কাঁপছেন। তাই দিয়েছি। গরম কিছু না খেলে কাঁপুনি বাড়বে। আর এই কেকটিও খাবেন। ইনসুলিন দিয়েছেন, সুগার ফল করবে”

অসহায়ের মতো তাকালেন রোদ্দুরের দিকে। ছেলেটিকে রাস্তায় পেয়েছিলো, সে এবং সুরভী যখন ধরাধরি করে অভিলাষাকে সিএনজিতে তুলছিলো তখন ই দেখা মিলে রোদ্দুরের। অভিলাষার ভারী শরীরটিকে বহন করে সিএনজিতে তোলা কষ্টকর হয়ে উঠছিলো সুরভী এবং শফিক সাহেবের পক্ষে। রোদ্দুর তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। শক্তপোক্ত শরীরটি সিএনজিতে তোলে অভিলাষাকে। প্রথমে বেশ সংকোচবোধ করছিলেন শফিক সাহেব। কিন্তু রোদ্দুর ছেলেটি তাকে আশ্বস্ত করে,
“আংকেল, বিপদের সময় সংকোচ করতে নেই”

সেই থেকে ছেলেটি এখানে। শফিক সাহেবও তাকে যেতে বললেন না। বলা তো যায় না কখন কাজে লাগে।

ডা. ইয়াসমিন কেবিন থেকে বের হলেন। তার শ্যাম মুখখানা থমথমে। সুরভী তড়িৎ গতিতে উঠে তার সম্মুখে গেলো। চিন্তিত স্বরে বললো,
“অভিলাষা কেমন আছে?”
“আল্লাহর রহমত সিভিয়ার কিছু নয়। আমি স্ট্রেস রিলিভের ঔষধ দিয়েছি। প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, প্লাসেন্টা প্রিভিয়া নেই। মাসিকের সময় তো, স্ট্রেসের জন্য হয়েছে। বাচ্চার মুভমেন্ট ভালো। তবে ওকে সম্পূর্ণ বেড রেস্ট দিচ্ছি। যদি দুজনকেই বাঁচাতে চান তবে সম্পূর্ণ বেড রেস্ট দরকার। কোনো প্রকার স্ট্রেস নয়”

সুরভী চুপটি করে শুনলো। ডাক্তারকে তো বলতে পারছে না বাসার অবস্থাটি কি, বলতে পারলে হয়তো বুঝতো মধ্যবিত্তরা স্ট্রেস নিতে চায় না। স্ট্রেস নিজেই পা টিপে টিপে তাদের কাবু করে। এমন সময় ফোনটি বেজে উঠলো সুরভীর। ইয়াসমিন নিজ কাজে চলে গেলো। ফোনের স্ক্রিনে “তুরান” নামটি ভেসে উঠলো। ফোনটি ধরতেই তার গাঢ় কন্ঠ শুনলো সুরভী,
“আমি কিন্তু তোমার আবদার রেখেছি, এবার তোমার পালা………………

চলবে