নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-১৫

0
6514

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_১৫||
;
;
;

হঠাৎ আহিল তাদের সামনে এসে চেয়ার টেনে বসে বললো,
—“আমি আপনাদের সাহায্য করবো, যদি আপনারা চান।”

নিবিড় আর তনিমা আহিলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
নিবিড় ভ্রুকূটি কুঞ্চিত করে বললো,
—“কে আপনি? আর কিসের সাহায্যের কথা বলছেন?”

আহিল হেসে বললো,
—“আমি আহিল আহরার। জয়ের বাচ্চাকালের ফ্রেন্ড। কিন্তু এখন আমাদের মধ্যে না আছে ফ্রেন্ডশিপ আর না আছে কোনো যোগাযোগ! ”

তনিমা বললো,
—“তার কারণ? ”

আহিল হেসে বললো ,
—“সেটা জেনে আপনাদের কোনো লাভ আছে বলে আমার মনে হয় না। আপনারা বলুন জয়ের সাথে আপনাদের কিসের শত্রুতা?”

নিবিড় সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“আপনাকে কীভাবে বিশ্বাস করবো আমরা? আর আপনার হঠাৎ করে এখানে আগমন ঘটা টাও তো ঠিক হজম করতে পারছি না। ”

—“আমাকে সন্দেহ করছেন? বেশ ভালো তো! সন্দেহ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ। আই অ্যাপ্রিশিয়েট ইউর থট। কিন্তু প্রয়োজনটা আপনার, সেটা একবার ভেবে দেখুন। ইন দ্য মিডওয়ে, আমারও কিছু লাভ আছে অবশ্যই। তবে টাকা তো আপনারই দরকার, তাই না? ”

নিবিড় তনিমার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো
—“আসলেই আমার টাকার দরকার। এই রানিং প্রজেক্টটা দাঁড় করানোর জন্য যে করেই হোক জয়ের কাছ থেকে টাকা হাতাতে হবে। কিন্তু জয়ের যে অবস্থা, তনিমাকে টাকা নাও দিতে পারে। তাহলে এই আহিলের কাছ থেকেই সাহায্য নিতে হবে। ”

—“এতো ভাবাভাবির কিছু নেই। বলুন, জয় আপনার কী ক্ষতি করেছে?”

নিবিড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো,,,

তিন বছর আগে,,,,
জয় আর নিবিড়ের প্রথম দেখা হয়েছিল একটা পার্টিতে, যেখানে ওদের দুই কোম্পানির মধ্যে একটা ডিল সাইন আপের সেলিব্রেশন করা হয়। ঐদিন পার্টিতে শুধু জাহিদ মাহমুদ আর জয়ই গিয়েছিল, কারণ ঐ প্রজেক্টের সম্পূর্ণ দায়িত্ব জাহিদ জয়ের ওপর দিয়েছিল।

—“হ্যালো মি. জয়। আ’ম নিবিড় শিকদার। শিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান। ”

নিবিড় জয়ের দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো। জয়ও হাত মিলিয়ে বললো,
—“হ্যালো, আ’ম জয় মাহমুদ। জে.এম. কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট এন্ড সিইও। ”

সেদিন থেকেই নিজেদের ব্যবসায়িক সম্পর্কের তাগিদে রেগুলার যোগাযোগ শুরু হয়, যা কয়েকদিনের মধ্যে বেশ গাঢ়ো বন্ধুত্বের সম্পর্কে রূপ নেয়। জয় জানতো নিবিড় বিবাহিত, কিন্তু নিবিড়ের স্ত্রীর সাথে তার কখনোই দেখা হয়নি। আর নিবিড়কে শুধু জয় আর জাহিদ ছাড়া আর কেউ চিনতোও না।

অবশেষে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শেষ হয় এই প্রজেক্টের কারনেই। প্রজেক্টের ডিওরেশন ছিল তিন মাস আর সব প্রোডাক্ট তৈরির দায়িত্ব ছিল নিবিড়ের কোম্পানির ওপর। নিবিড় প্রোডাকশন কস্ট মিনিমাইজ করার জন্য নিম্ন মানের সব কাঁচামাল ব্যবহার করতে শুরু করে যার বেশিরভাগই ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। প্রোডাক্ট তৈরির সব কাজ শেষ হওয়ার কিছু দিন পর জয়ের সিক্রেট এজেন্ট খবর দেয়, নিবিড় প্রোডাকশন প্রসেসের ব্যাপারে। এটা জানার পর জয় প্রজেক্টের ফাইল ঘেঁটে দেখে যে, আর মাত্র দুদিন পর সব প্রোডাক্ট সারাদেশের বাজারে ছাড়া হবে। জয় তৎক্ষনাৎ নিবিড়ের অফিসে গিয়ে তার কেবিনে ঢুকে বলে,
—“তোর কোম্পানির সাথে আমার কোম্পানির সব প্রজেক্ট আমি এই মুহুর্তে ক্যান্সেল করে দিলাম। ”
বলেই ওদের মাঝে হওয়া কন্ট্র্যাক্ট পেপার এক টানে ছিড়ে ফেললো।

নিবিড় অবাক হয়ে বললো,
—“মানে? কিসব বলছিস তুই? কী এমন হয়েছে যে, তুই ডিল ক্যান্সেল করে দিচ্ছিস?”

—“তুই প্রোডাক্টসে ভেজাল মিশিয়েছিস!! তুই ভাবলি কী করে এটা দিয়ে আমি বিজনেস করবো?”

নিবিড় অবাক হয়ে বললো,
—“তোকে কে বললো, আমি ভেজাল মিশিয়েছি? কোনো প্রমান ছাড়াই তুই বিশ্বাস করে নিলি।”

জয় অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“আমি প্রমাণ ছাড়া কোনো কাজ করি না। এই দেখ।”
বলেই নিবড়ের টেবিলে একটা ফাইল ছুড়ে মারে।

নিবিড় ফাইলের কাগজ পত্র উল্টেপাল্টে দেখে, ও দুই মাস আগে যে ডেটওভার কাঁচামাল আমদানি করেছে তার লাইসেন্স, মেমো, চালান, ইনসিউরেন্স পেপার সহ সব কাগজ সেখানে। এটা দেখে নিবিড়ের সারা শরীর ধরধর করে ঘামতে থাকে। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে!!

—“এখন তোর আর কোনো কুয়েরিস নেই আশা করি! ”

নিবিড় জয়ের দুহাত ধরে বললো,
—“প্লিজ জয়, বোঝার চেষ্টা কর। আমি এই প্রজেক্টের জন্য অনেক টাকা লোন করেছি। এটা ইমপ্লিমেন্ট না করলে আমি সেগুলো কীভাবে শোধ করবো?”
জয় নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
—“সেটা তোর আগে বোঝা উচিত ছিল। এগুলো দিয়ে ব্যবসা করলে, আমার ব্যবসা লাটে ওঠবে। কেসও হবে। ”

—“সেটা আমি বুঝে নিবো। তুই মেনে নে তাহলেই আর চিন্তা নেই। ”

—“ইম্পসিবল!! কয়েকটা টাকার জন্য আমি মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে পারবো না। সো, তুই কী করবি কর। আর তোর এ কুকীর্তি আমি বাইরে ফাঁস করলাম না, শুধু মাত্র তোর পরিবারের কথা ভেবে। নয়তো এখন তোর জেলের ভাত খেতে হতো।”
বলেই চলে গেল।

নিবিড় নিজের চোখ খুলে বললো,
—“সেদিনের পর থেকে আমার জীবনের দুঃখ শুরু হয়। নিজের কোম্পানি তো শেষ হয়ই, তার ওপর আমার ব্যক্তিগত অনেক সম্পত্তি বিক্রি করে আমি ঋণ শোধ করেছি।”

—“কিন্তু সব শুনে তো আমার মনে হচ্ছে না, জয় কোনো ভুল করেছে। দোষ মুলত আপনারই ছিল। যাইহোক, এজন্যই আপনার স্ত্রী কে দিয়ে জয়ের সাথে রিলেশন করাচ্ছেন? ”
বলেই ডেভিল হাসি দিলো আহিল।

নিবিড়, তনিমা অবাক হয়ে বললো,
—“আপনি কী করে জানেন?”

—“জানতে হয়, সবকিছু না জেনে কী আর কাজ করা যায়? এই নিন এটা আমার ফোন নাম্বার। কাল রাত আটটার পর আমায় কল দিবেন। সামনের মাসে কীভাবে টাকা মেনেজ করবেন জানিয়ে দিব। আর আমার স্বার্থ সম্পর্কেও জানাবো। আসি।”
বলেই নিবিড়ের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল।
__________________

—“রাতের খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিবে। আবার না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো না।”
জয় আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে বললো।

আমি বেডে হেলান দিয়ে বসে জানালা দিয়ে রাতের আকাশ দেখছি। এমন কথা শুনে বললাম,
—“আপনি কী কোথাও যাচ্ছেন? ”

—“হুম। আজ রাতে অফিসে থাকতে হবে। ”

—“আপনি ইদানীং অনেক ব্যস্ত থাকেন। কোনো সমস্যা হয়েছে কি? আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন।”

জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাদের কোম্পানির বর্তমান অবস্থা সব খুলে বললো।

আমি সবকিছু শুনে অবাক হয়ে বললাম,
—“এতো কিছু এতোদিন আপনারা একা একা হ্যান্ডেল করেছেন? আমরা তো কেউই জানি না।”

—“আমিই ভাইয়াকে নিষেধ করেছি জানাতে। কী দরকার, শুধু শুধু টেনশনে ফেলার? আচ্ছা, তোমার পা কাটলো কীভাবে? ”

—“মাঠ দিয়ে হাঁটছিলাম। কে জানতো সেখানে লোহার টুকরো ছিল? ”

জয় রেগেমেগে বললো,
—“চোখ দুটো কী বাসায় রেখে গিয়েছিলে? একটু ভালো করে খেয়াল করে পা ফেলতে পারো না? আর তোমায় বলেছিলাম যে, ঐসব হালকা-পাতলা জুতো বাদ দিয়ে ভালো মানের জুতো পরতে। শুনো নি, এখন ভোগো।”

আমি আর কী বলবো? সারাদিন সবার বকা শুনতে শুনতে এখন আর কোনো অনুভূতি কাজ করছে না।

জয় গটগট করে হেঁটে চলে যাচ্ছে এমনসময়ই আমি ডাক দিলাম,
—“শুনুন,,,,,”

জয় ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম,
—“আপনার অফিসে কাজের চাপ অনেক বেশীই, সেটা আমি বুঝতে পারছি। আপনি চাইলে আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি, রানিং প্রজেক্ট রিলেটেড কোনো কাজ থাকলে আমায় দিতে পারেন।”

জয় কিছু একটা ভেবে তার ব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো,
—“এটা এইমাসের ইন্টার্নাল অডিটিং ফাইল। এটা থেকে রিপোর্টিং করতে হবে। পারবে?”

আমি মোটা ফাইলটা হাতে নিয়ে বললাম,
—“পারবো মানে? এসব কাজে আমার অভিজ্ঞতা না থাকলেও আমি এসব নিয়েই পড়াশোনা করেছি। আমি একজন বিবিএ গ্রেজুয়েট, আপনার মতো সিএসই ইঞ্জিনিয়ার না।”

জয় ভাব নিয়ে বললো,
—“শোনো, আমি বাবার বিজনেসের জন্যই সিএসই তে পড়েছি। এসব অডিটিং- রিপোর্টিং এর জন্য এমপ্লয়ি আছে। তবে আমিও এসবেও ওপর কোর্স করেছি, বুঝেছো?”

আমি ভেংচি কেটে বললাম,
—“হইসে, অনেক পারেন আপনি। এবার আমায় আমার ল্যাপটপটা দিয়ে যান আর আপনি বিদায় হোন।”

জয় ল্যাপটপটা আমার সামনে রেখে বললো,
—“আমায় বিদায় করছো, না? আমারও সময় আসবে। তখন বুঝবো ‘কত ধানে কত চাল’। আর, বাইরে বের হওয়ার দরকার নেই। খুব বেশি দরকার হলে হুইলচেয়ারে বসে যেও। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটালে সেলাইয়ে টান লাগবে।”
বলেই চলে গেল। আর আমি আমার মতো কাজে লেগে পড়লাম।

-চলবে………..