নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-১৬

0
4233

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_১৬||
;
;
;

আজ আমাদের বিয়ের একমাস পূর্ণ হলো। যদিও আমি এদিনটার কথা ভালো করেই মনে রেখেছি কিন্তু জয়ের যে তা একটুও মনে নেই, সেটা বেশ ভালো ভাবেই জানি। এ কয়দিন জয় অামার অনেক কেয়ার করলেও তা সে শুধু নিজের দায়িত্ববোধ থেকে করেছে। এখন কেন যেন আর কোনো আশার আলো দেখতে পাই না। হয়তো ঐ কাগজ-কলমের সম্পর্কের কাছে আমার সকল অনুভূতি হেরে যাবে। সবশেষে আমায় নিঃস্ব হয়ে নিজের সেই আগের ঠিকানায় ফিরে যেতে হবে, যেখান থেকে এবাড়ির অতিথি হয়ে এসেছিলাম।

—“এই অসময়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনে কী ভাবছিস, হুম?”

কোনো নারীকণ্ঠ শুনে ভাবনার সুতা ছিড়ে গেল আর সে জগৎ থেকে বেরিয়ে আমি পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখলাম অদ্রি ভাবী আমার দিকে এগিয়ে আসছে, হাতে দুই মগ কফি।

আমায় একমগ কফি ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—“নে, কফি খা।”

আমি সামনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—“জানো ভাবী, আমার যেসব কাজ করতে একদম ইচ্ছে হয় না, সেই কাজ গুলোই আমায় বাধ্য হয়ে করতে হয়। এই যে, আমার এখন কফি খাওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই। তবুও আমায় খেতে হচ্ছে। ”

আমার কথা শুনে ভাবী কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
—“তোর সত্যিই অনেক ধৈর্য্য। তবে চিন্তা করিস না, নিশ্চয়ই তোর জন্য ভালো কিছু আছে। দেখবি, তুই ঠিকই সুখী হবি।”

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,
—“সুখী, তাও আবার আমি!! হাসালে তুমি। আমার ভাগ্যে কোনোকালেই সুখ লেখা নেই। সেটা আমি অনেক আগেই বুঝে গেছি। তুমি না কী শেষ চেষ্টা করবে বলেছিলে? সেটার কী খবর? ”

—“কিছু বুঝতে পারছি না। যাকে বলেছিলাম, তার নাম্বারে কল দিয়েছি অনেকবার। কিন্তু বারবার আনরিচেবেল বলে। গোয়েন্দা মানুষ! অন্য কোনো কেস নিয়ে ফেঁসে গেছে মনে হয়।”

—“হতেও পারে। কবে যে সব কিছু ঠিক হবে? ধীরে ধীরে নিরাশা চেপে বসছে। তনিমার আসল রুপটা কবে যে ধরা পড়বে? ”

অদ্রি আশ্বাস দিয়ে বললো,
—“জয় একদিন আসল-নকল ঠিকই বুঝতে পারবে। সত্য কখনো চাপা থাকে না। তনিমার আসল রূপটা প্রকাশ পাবেই।”

আমি মলিন হেসে বললাম,
—“ততদিনে অনেক দেরী না হয়ে যায়! আমার কেন যেন মনে হয়, জয় সবকিছু হারিয়ে তারপর সব জানতে পারবে। ও অনেক কষ্ট পাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি চাই না, এমনটা হোক। ”

—“এসব অলক্ষুণে কথা কেন বলছিস বল তো? আমার বিশ্বাস, জয় সব জানতে পারবে এবং খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারবে। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ।”

—“আমিও এটাই চাই। তবে মনে রেখো, যেদিন জয় সব জানতে পারবে, সেদিনই আমি ওর জীবন থেকে চলে যাবো। বিয়েটা একবছরের জন্য হলেও খেলা যদি তার আগেই শেষ হয়, তাহলে তো আমার আর কোনো কাজ নেই। শুধু শুধু একটা নিছক কাগজ-কলমের সম্পর্কে জড়িয়ে থাকার কোনো মানেই হয় না। ”

অদ্রি আর কিছু বললো না। যেটা সত্যি, সেটা কষ্টকর হলেও মানতে হবে। ভেতর থেকে শুধু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
_______________

—“তনিমা, এসবের মানে কী? প্রতি মাসেই কি তোমার টাকার প্রয়োজন হয়? এখন তো আমার মনে হয়, তুমি আমার টাকাকে ভালোবাসো, আমাকে না!”

তনিমা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বললো,
—“মানে? কী বলতে চাইছো তুমি? ”

জয় শক্ত গলায় বললো,
—“তুমি ভালো করেই জানো, এতো ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলা আমার পছন্দ না। এপর্যন্ত কম টাকা নাওনি তুমি। প্রতি মাসেই এ-ই সেই বলে টাকা চেয়েছো। আমিও দিয়েছি, আজও দিতাম। কিন্তু তুমি তো এখন আমার কোম্পানির অবস্থা জানো! তাহলে কেন এতো জোর করছো? আর এতো টাকা দিয়ে তুমি করোটা কী? কই, মুনও তো একটা মেয়ে। ওর ফ্যামিলির কন্ডিশন তোমার ফ্যামিলি থেকেও লো। ওতো প্রয়োজন ছাড়া একটা টাকাও খরচ করেনা!”

তনিমা মুখ বাকিয়ে বললো,
—“বাহ্! একমাসের মধ্যে তো ভালোই বশ করে ফেলেছে তোমায়! তা বেবি কবে নিচ্ছো জয়?”

কথাটা যেন জয়ের শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। সে তনিমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“হোল্ড ইয়র টাং, তনিমা। তোমার কি মনে হচ্ছে আমি মুনের সাথে স্বাভাবিক কাপলদের মনে লাইফ স্পেন্ড করছি। এটা ভেবে থাকলে তো আমার মনে হয় তুমি আমায় কখনো বিশ্বাসই করোনি। আর ভালোবাসার সম্পর্কটা বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তোমার মনে আমার জন্য বিশ্বাস না থাকলে, আই শ্যুড কনক্লিউড দ্যাট, ইউ ডিড নেভার হ্যাভ এনি ফিলিংস ফর মি। ভালোবাসার কথা তো না-ই বললাম। ”

তনিমার এবার মনে হচ্ছে নিজের কথার জালে নিজই জড়িয়ে গেছে। একটু বেশিই বলে ফেলেছে সে যা একদমই উচিত হয়নি।

—“জয়, তুমি মিসলিডেড হচ্ছো। আমি যদি তোমায় বিশ্বাস না করতাম, তাহলে সবকিছু এতো সহজে মেনে নিতাম না। কোনো মেয়েই চায় না তার ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে শেয়ার করতে, কিন্তু আমি? আমার দিকটা একবার ভেবে দেখো তো! আমি তোমার সবকিছু মেনে নিয়েছি। তবে তুমি ওর গুণগান গাইছো, সেটা আমার ভালো লাগেনি। সেজন্যই কী বলতে কী বলে ফেলেছি!”

—“ওকে ওকে, আই আন্ডারস্ট্যান্ড। কিন্তু এধরণের কথা বলাটা তোমার মোটেও ঠিক হয়নি।”

তনিমা ন্যাকামি করে বললো,
—“হুম, আই নো। কিন্তু আমার টাকার অনেক দরকার, জয়। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো।”

জয় সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“কী প্রয়োজন তোমার? আজকে আমাকে বলতে হবে। এতোদিন কোনোকিছু না শুনেই তোমায় টাকা দিয়েছি। কিন্তু আজ আমায় জানতে হবে সবকিছু। ”

তনিমা অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বললো,
—“আমি জানি, তুমি জানতে চাইবে। তোমায় সবকিছু কমপ্লিট করে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। বাট, এখন দেখলেও তুমি সারপ্ইজড হবে।”
বলেই জয়ের দিকে একটা খাম এগিয়ে দিলো।

জয় খামটা নিয়ে সেটা খুলতেই একটা কাগজ পেল। কাগজের ভাজ খুলে সেটা ভ্রুকুটি করে কিছুক্ষণ পড়তেই অবাক হয়ে তনিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“তুমি অস্ট্রেলিয়ায় ডক্টরেট কমপ্লিশনের জন্য সিলেক্টেড হয়েছো? কবে এক্সেম দিলে?”

—“দুমাস আগে। তিনটা ইনস্টলমেন্টের মধ্যে দুটো পেইড করেছি। আরো একটা বাকি আছে, সেটা কালকের মধ্যে শোধ করতে হবে। এজন্যই টাকা চাইছি।”

জয় খুশি হয়ে বললো,
—“সেটা আগে বলবে না? এটার জন্য তুমি এতোদিন টাকা নিতে। আমি সত্যিই সারপ্রাইজড হয়েছি। এই চেক দিয়ে টাকা তুলে নিও। ”
বলেই একটা চেক তনিমার হাতে ধরিয়ে দিল।
____________

তনিমা আর নিবিড়ের বাসার ড্রয়িং রুমে বসে আছে আহিল।
নিবিড় আহিলকে একটা টাকার বান্ডেল বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—“থ্যাংক ইউ মি. আহিল আহরার। আপনার জন্যই আজ আমরা টাকা গুলো পেয়েছি। এটা আমাদের পক্ষ থেকে ছোট্ট একটা টোকেন অফ গ্রেটিচিউট।”

আহিল হেসে টাকাটা নিয়ে বললো,
—“ওয়েলডান মিসেস তনিমা রাহমান। জয় বুঝেনি তো যে, স্কলারশিপ পেপারটা ফেইক ছিল?”

তনিমা আশ্বাস দিয়ে বললো,
—“একটুও বুঝেনি। ও আমায় অনেক বিশ্বাস করে। আর আপনি যেভাবে পেপারটা বানিয়েছেন, বুঝার কোনো প্রশ্নই ওঠে না!”

আহিল বাঁকা হেসে বললো,
—“যাক, তাহলে সবকিছু সুন্দরভাবেই সেট আপ হয়েছে। আপনাদের প্রজেক্ট হাতে পাওয়া তো পাক্কা!”

নিবিড় ডেভিল হাসি দিয়ে বললো,
—“তা তো অবশ্যই। অনেকগুলো টাকা ডোনেশন দিতে হয়েছে এই কাজটা পাওয়ার জন্য। আর জয় তো মনে করছে, আমার কোম্পানি অনেক দক্ষ। কিন্তু ওরা তো আর জানে না, টাকা দিয়েই টাকা আনতে হয়। ঘুষ ছাড়া প্রজেক্ট পাওয়া এখন একদমই সম্ভব না।”

—“তবে আপনি ডোনেশন না দিলে জয়ই প্রজেক্ট পেতো, তাও আবার ঘুষ না দিয়েই! বুঝলেন? ”

তনিমা তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললো,
—“পেতো, বাট এখন আর পাবে না। বাই দ্য ওয়ে, আপনি আমাদের এতো হেল্প করলেন; কিন্তু এখানে আপনার স্বার্থটা কী সেটা তো এখনো জানতে পারলাম না। ”

আহিল আবারো অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বললো,
—“জানবেন, জানবেন। আহিল আহরার স্বার্থ ছাড়া কোনো কাজ কর না। খুব শীঘ্রই জানবেন। ”

নিবিড় নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে বললো,
—“আমার স্বপ্ন আর কয়েকদিনের মধ্যেই বাস্তবায়িত হতে চলেছে। খুব শীঘ্রই দেখা হচ্ছে আমাদের, জয়! আর ইউ রেডি ফর মাই রিভেঞ্জ? ”
_____________

জয় রুমে ঢুকে সোফার ওপর ধপ করে বসে পড়লো। এতোদিন ধরে এতো পরিশ্রম করেছে, সব অবশেষে বৃথা যাবে বলে মনে হচ্ছে।

-চলবে……..