নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-১৮

0
7754

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_১৮||
;
;
;

জয় ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার ভেতর কেন যেন কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। একটা সত্য প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে তার জীবনটা এখন বড্ড এলোমেলো ও অগোছালো লাগছে।

আহিল জয়ের দুই বাহু ধরে বললো,
—“এতো বেশি ইন্ট্রোভার্ট হলে কষ্ট পোহাতে হয়, এটা তোকে আমি সেই কলেজলাইফে থাকতেই বলেছিলাম। নিজের মনের কথা গুলো অন্যের সাথে শেয়ার করতে হয়, বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। একজন মানুষকে বিশ্বাস করা উচিত, তবে অন্ধবিশ্বাস না।”

জয়ের চোখ দুটো বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। আজ যে সে বড্ড অসহায়! পৃথিবীর সব কষ্ট সহ্য করা যায়, কিন্তু প্রিয় মানুষগুলোর প্রতারণা সহ্য করাটা অনেক কঠিন। তনিমা তার প্রিয়মানুষ ছিল কি না তা নিয়ে আজ তার মনে একরাশ সন্দেহ বাসা বেঁধেছে। যারা প্রিয় মানুষ হয়, ভালোবাসার মানুষ হয়; তাদের নাকি শত সহস্র অন্যায়ের পরও, অজস্র বিশ্বাসঘাতকতার পরও মন থেকে মুছে ফেলা যায় না, ঘৃণা করা তো দূরে থাক। কিন্তু জয়ের তো এখন তনিমার দিকে তাকাতেই ঘৃণা করছে! তাহলে কি তার ভালোবাসায় খাদ ছিলো নাকি তা আদৌ কোনো ভালোবাসা ছিল না? তনিমা তার কাছে যাই হোক না কেন, ওর জন্য জয়ের মনে যে একটা সফট কর্ণার সৃষ্টি হয়নি, এটা সে কখনোই বলতে পারবে না। তনিমার ভালোবাসার ডাকে সে না সাড়া দিলেই পারতো! তাহলে আর এই দুদিনের আবেগে জড়িয়ে নিজের ওপর গিভ আপ করার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। আর কষ্টটা এই সত্যটাকে ঘিরেই!!

—“যখন আমাদেরকে ধরিয়ে দেওয়াটাই আপনার স্বার্থ ছিল, তাহলে সেটা আগে করলেই পারতেন। আগেই আমার বাড়িতে নিয়ে আসতেন জয়কে, এতো নাটক করার কী এমন দরকার ছিল মি. আহিল আহরার। ”

নিবিড়ের ক্রোধমিশ্রিত কথা শুনে জয় ওর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললো,
—“তোর মতো নিচ মানুষ এ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা আছে বলে আমার মনে হয় না। নিজের স্বার্থের জন্য নিজের স্ত্রীকে ইউজ করেছিস। এর আগে তোকে ছেড়ে দেয়াটাই আমার ভুল ছিল। কাপুরষ কোথাকার!!”

নিবিড় আফসোসের সুরে বললো,
—“ডু ইউ নো, জয়? তোর ভাগ্যটা একটু বেশিই ভালো। নয়তো এতো ভালো জাল পেতেছিলাম, তাও তুই বেঁচে গেলি! ”

আহিল নিবিড়ের সুরে সুর মিলিয়ে বললো,
—“আসলেই জয়, তোর ভাগ্যটা এতো ভালো কেন বল তো? কালকেই তোরা বাঁশ খেয়ে দাস হয়ে যেতি, কিন্তু দেখ আজই তোদের সবকিছু জানতে হলো? তোর সৌভাগ্যের কিছু ছিটেফোঁটা নিবিড় ষাঁড় আর তনিমা ম্যাডামকেও দে। নিবিড় ষাঁড় তো তনিমা ম্যাডাম কে কাগজের মতো ইউজ করতে গিয়ে বসুন্ধরা টিস্যু পেপার হয়ে গেলো। আমি আবার দয়ালু মানুষ, এসব সহ্য করার এবিলিটি নাই আমার!”

নিবিড় রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তনিমা বললো,
—“তার মানে, এটাই ছিল আপনার স্বার্থ? ”

আহিল ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
—“হুম, সো স্যাড! আমার স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেছে, আর আপনারা ফেঁসে গেছেন। ”

—“তাহলে আরো আগেই তো সব জানিয়ে দিতে পারতেন! এতো কাহিনী কেন করলেন? ”

—“আরে আস্তে! আস্তে! কাহিনী করার দরকার ছিল বলেই তো করেছি। আপনাদের অপকর্ম গুলোর প্রমাণ তো লাগবে, তাই না? ”

নিবিড় রেগে বললো,
—“ভালো খেলা খেলেছেন আপনি! অ্যাপ্রিশিয়েটেড! এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা করে অনেক লাভবান হয়েছেন নিশ্চয়ই? ”

আহিল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থিংকিং মোডে বললো,
—“আপনিই তো সেদিন বলেছিলেন টাকা দিয়ে টাকা আনতে হয়। তাই আমিও বিশ্বাসঘাতকতা করে বিশ্বাসঘাতকদের ধরেছি। দ্যাটস ইট। যাইহোক, এখন যান একটু কারাগার থেকে ঘুরে আসেন। গাইস, নিয়ে যাও এই দু’জনকে। ”

তনিমাকে নিয়ে যাওয়ার পরপরই নিবিড়কে ধরতে যাবে, তার আগেই নিবিড় বাধা দিয়ে বললো,
—“নিয়ে যান, বাধা দিব না। তবে চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছি, একসপ্তাহের আগেই আমি জেল থেকে বেরিয়ে যাবো। খুব শীঘ্রই দেখা হচ্ছে, জয়।”

জয় দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—“বের হলেও আমার কিছু করতে পারবি না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে, তাই না আহিল?”

আহিল বাঁকা হেসে বললো,
—“হ্যাঁ, অবশ্যই। ”

নিবিড়ও ভিলেনি হাসি দিয়ে বললো,
—“কিছু করতে পারবো কিনা তা নিয়ে টেনশান নেই। জাস্ট জেলে আটকে রাখতে পারবি না আমায় কোনোদিন। ”
________________

চারপাশ থেকে ফজরের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এতোসময় হয়ে গেল ওনারা এখনো এলো না। চিন্তায় চিন্তায় নিঃশ্বাস ফেলাটাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ঘরের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে বারবার পায়চারী করছি।

—“ওফ, তুই একটু শান্ত হয়ে বসবি? কী এতো পায়চারী করছিস বল তো? ”
অদ্রি বিরক্ত হয়ে বললো।

আমি অবাক হয়ে বললাম,
—“তুমি এতো নিশ্চিন্তে কীভাবে বসে আছো আমার মাথায় সেটাই ঢুকছে না। এদিকে আমি টেনশনে মরে যাচ্ছি আর অন্য দিকে তুমি কী দিব্যি বসে বসে পা দুলছো!”

অদ্রি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—“কারন, একটু আগে জায়েদ আমায় মেসেজ পাঠিয়েছে! ”

আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম,
—“কী বলেছে? সবকিছু ঠিক আছে তো?”

—“বলবো না। তবে আমার সেই মজা লাগছে। যাই একটু নামাজ পড়ে ঘুম দেই গিয়ে। অনেকদিন পর একটা আরামের ঘুম দেওয়া যাবে। আর তুইও নামাজ পড়ে নে। সাথে দুই রাকাআত নফল নামাজও পড়িস।”
বলেই চলে গেল। আমি ভাবীর কথা শুনে টাস্কি খেয়ে দাড়িয়ে আছি। কীসব বললো, আগামাথা কিছুই বুঝিনি! তবে এটা ভেবে শান্তি লাগছে যে, জয় আর ভাইয়া সেইফ আছে। নয়তো ভাবী এতো নিশ্চিন্তে থাকতো না!
_____________

জয় বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখলো তার বাবা-মা হলরুমে বসে আছে। এতো ভোরে তো তারা ঘর থেকে বের হননা, তাহলে আজকে কেন? তার মানে কি ভাইয়া সবাইকে সবটা জানিয়ে দিয়েছে? এসব ভাবতে ভাবতে জয় এগিয়ে যেতে থাকে, এর মধ্যে জায়েদ অদ্রি হলরুমে প্রবেশ করে।

জয় সব ভাবনা বাদ দিয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য শিড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই জাহিদ কাঠকাঠ গলায় বললেন,
—“জয়, দাঁড়াও। আমরা এখানে সবাই দাঁড়িয়ে আছি দেখেও তুমি পা চালিয়ে উপরে যাচ্ছো? ”

জয় বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“কিছু বলবে?”

জাহিদ কিছু বলতে নিবে তার আগেই আয়েশা বললো,
—“আমি বলবো তোমায়। কারো কোনো কিছু বলার না থাকলেও আমার বলার আছে।”

জয় তার মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আয়েশা ধীরে ধীরে জয়ের সামনে এসে দাড়ালো। জয় নিজের মুখ খোলার আগেই আয়েশা কষে এক চড় বসিয়ে দিলো ওর গালে।

চড়ের শব্দে সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। আয়েশা এটা করবে কেউ ভাবতেই পারেনি!

জয় নিজের গালে হাত দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“মা, তুমি,,,,”
জয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়েশা হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললো,
—“চুপ, একদম চুপ। তোমার ওই মুখ দিয়ে আমায় মা বলে ডাকবে না।”

জয় করুন স্বরে বললো,
—“মা!!”

নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে জয়ের সারাশরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। একটা বাইরের মেয়ের জন্য তার পরিবারকে সে কতটা কষ্ট দিয়েছে!!

জায়েদ ওদের দিকে এগিয়ে যাবে, এমন সময় অদ্রি বাধা দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—“চুপচাপ এখানে দাঁড়াও। এক পা নড়েছো তো পা দুটো কেটে হাতে ধরিয়ে দেব। ”

জায়েদ আবার যাওয়ার চেষ্টা করে বললো,
—“ছাড়ো তো! দেখছো না মা ছেলেটাকে মারছে! এমনি ও কতো বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে!! ”

অদ্রি ভেংচি কেটে বললো,
—“আহা রে! ভাইয়ের জন্য দরদ উতলে উঠছে! ও যে মুনকে কতো কষ্ট দিয়েছে চোখে পড়েনি তোমার? ওকে আরো কতো গুলো চড় দেওয়া দরকার। ”

জায়েদ আর এগোলো না। সত্যিই তো! জয়েরও দোষ আছে।

আয়েশা নিজের চোখের জল মুছে বললো,
—“কী ভেবেছিস তুই, হে? তুই এতোটা নিচ মনের কবে থেকে হয়ে গেলি, জয়? এই শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছি আমি তোকে? কীভাবে পারলি তুই নিজের স্বার্থের জন্য একটা নিষ্পাপ মেয়ের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে? তার জীবন টাকে নিয়ে খেলতে তোর বিবেক একবারো বাঁধা দিলো না? ”

জয় অবাক হয়ে বললো,
—“তোমরা কীভাবে এসব জানলে? মুন তোমাদের সব কিছু বলে দিয়েছে? “অদ্রি হাত তুলে বললো,
—“আমি বলেছি। মুন কাউকে কিছু বলেনি। আসলে আমি আগে থেকেই সব জানতাম। তোমাদের বিয়ের রাতেই আমি তোমাদের কথা শুনে ফেলেছিলাম। মনে করে দেখ।”

জয় মনে করে দেখলো, সত্যিই সেদিন দরজা খোলা ছিল বলে অদ্রি সব শুনে ফেলেছে হয়তো! জয় অপরাধ বোধ থেকে নিজের মাথা নিচু করে নিল।

আয়েশা আবার জয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“মেয়েটাকে তুই আজও চিনলি না। আজ তনিমা তোকে যে কষ্ট দিয়েছে, সেটা তোর কেমন লেগেছে একবার ভাব তো! আর তুই যে আমার মেয়েটাকে এতোদিন ধরে ব্যবহার করে গেলি, ওর নরম মনটাকে নিয়ে খেলে গেলি, তাহলে ওর কেমন লেগেছে ভাবতে পারছিস? ”

জয়ের এবার ভাবোদয় হলো। আজ নিজে যখন জেনেছে যে, সে তনিমা আর নিবিড়ের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে, তখন তার যে পরিমান কষ্ট হয়েছিল, মুনের মনে সে তার চেয়েও শতসহস্র গুণ বেশি কষ্ট দিয়েছে। কারণ জয় নিজে জানতো না যে তাকে টাকার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, আর মুন সব কিছু জেনে বুঝে সহ্য করে গেছে।

এসব ভাবতেই জয় ছুটে নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
____________

এদিকে আমি এতোক্ষণ উপর থেকে সবকিছু দেখছিলাম। যাক, সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, এটা ভেবে শান্তি লাগছে। আমায় নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, তবে যা হয়েছে তা নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। ভাগ্যে যা লেখা থাকে, সেটা হবেই। অযথা আক্ষেপ করে লাভ নেই। এবার আমি যত তাড়াতাড়ি পারি এবাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।

জয় উপরে আসছে দেখে আমি তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে সোফায় বসে পড়লাম।
এদিকে জয় একদৌড়ে ঘরে এসে আমার সামনে বসে পড়লো। আমার কোলে মাথা রেখে বলে উঠলো,
—“আই নিড ইউ।”

আমি একদমই অবাক হচ্ছি না। কারণ বাস্তবতা দেখে দেখে আমি অভ্যস্ত। জয়ের মাথায় হাত না দিয়ে বরং নিজের দুইপাশে দুইহাত দিয়ে সোফা চেপে ধরে মেকি হেসে বললাম,
—“আগেও প্রয়োজন ছিলাম,
আজও আমি প্রয়োজন আপনার!!
প্রিয়জন হতে পারিনি তবুও!!”

-চলবে…….

( ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। 💚💚)