নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-২০

0
5334

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_২০||
;
;
;

—“কী মশাই! এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন? কেমন লাগছে আমায় বললেন না যে!!”
সিঁড়ি দিয়ে নেমে ডিরেক্ট জয়ের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললাম।

জয় দাত কিড়মিড় করতে করতে বললো,
—“একদম পেত্নীর মতো লাগছে!!”

আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
—“কী বললেন?? আমায় পেত্নীর মতো লাগছে!!”

—“তা নয়তো কী? শাড়ি পড়েছো ভালো কথা, তাই বলে এসব গহনা দিয়ে সাজতে হবে কেন? এসব আর্টিফিশিয়াল বিউটিফিকেশনে কোনো সৌন্দর্য খুঁজে পাই না আমি।”

—“তাহলে কী দিয়ে সাজবো?”

জয় আমার হাত ধরে বললো,
—“চলো দেখাচ্ছি। ”
বলেই আমার হাত টানতে টানতে উপরে নিয়ে গেল।

আহিল এতোক্ষণ যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। কতদিন পর আজ তার প্রিয় মানুষটির অনাকাঙ্ক্ষিত দেখা পেয়েছে সে। সব কথা তার কানে ঢুকলেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। সে যে তার প্রেয়সীকে দেখতে ব্যস্ত ছিল!! কতবছর ধরে যে না দেখে আছে তার ক্ষুধা যেন হাজার বছর তাকিয়ে থাকলেও মিটবে না। কিন্তু জয় ওকে ওভাবে টেনে নিয়ে চলে গেল কেন? এটা দেখে বড্ড রাগ লাগছে আহিলের।

আহিলকে দেখে রাদিফ অর্ণবের কানে ফিসফিস করে বললো,
—“ওই, এইটা মুনের খালাতো ভাই, আহিল না? এই শালায় এইখানে কী করে রে?”

—“আমিও সেটাই ভাবতেছি। এরে আমার কোনো কালেই ভাল্লাগে না। ”

—“আমারও না। এই ব্যাটায় যে মুনরে পছন্দ করে, সেই ব্যাপারে আমি বহুত আগে থেইকাই শিয়র।”

—“আর আজ কেমন করে তাকিয়ে ছিল, ছেলে হয়ে ছেলেদের চোখের ভাষা ঠিকই পড়তে পারি।”

ওরা দুজন ফিসফিস করার মধ্যে ব্যস্ত এমন সময় রুহি আর অনিতা আহিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রুহি হেসে বললো,
—“আরে আহিল ভাইয়া, আপনি এখানে? কতদিন পরে দেখলাম। আজ আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে।”

রুহির কথা শুনে আহিল একটা জোরপূর্বক হাসি দিলো।

এদিকে রাদিফ রুহির মুখে আহিলের প্রশংসা শুনে রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
—“সুন্দর ছেলে দেখসে আর শুরু কইরা দিসে!! এই ছ্যাড়িরে তো আমি আজকে,,,,,!!”
বলেই রুহির দিকে দুপা এগুতেই পিছন থেকে অর্ণব আটকে দিয়ে বললো,
—“আরে কই যাস? এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করিস না তো! আর তোর এতো ফাটে ক্যান?”

রাদিফ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
—“আমার কোনো ফাটে-টাটে না। বুঝছোস?”

—“বুঝি আমি, বেশ ভালোই বুঝি।”

এদিকে আহিলের হাসি দেখে অনিতা বললো,
—‘আজ শুধু সুন্দর লাগছে না, সবসময়ই সুন্দর লাগে। কিন্তু ভাইয়া তো আগে থেকে আরো বেশি সুন্দর হয়ে গেছেন। অনেক হ্যান্ডসাম দেখায় এখন।”

একথা শুনে অর্ণব দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—“হ্যান্ডসাম দেখায়, না? আজ তোর একদিন নয়তো আমার একদিন!! শালার,,,,”
বলেই ওদের দিকে এগুতে যাবে এমন সময় রাদিফ আটকে দিয়ে বললো,
—“কী,,,? এখন কার ফাটে?? অনেক তো আমারে কইলি, এইবার নিজের বেলায়? এবার আমি বলি, এখানে সিনক্রিয়েট করিস না? ”

—“তোর বলা লাগবে না, আমি কিছুই করমু না।”
___________

—“নাও এসব গহনা-ঘাটি খোলো। ”

আমি অবাক হয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—“কেন? এসব খুললে, আমি পরবো কী?”

জয় বিরক্ত হয়ে বললো,
—“সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। যেটা বলেছি সেটা করো।”

অগত্যা আমায় সব গহনা খুলে ফেলতে হলো। জয় আলমারি থেকে একটা বড় ঝুড়ি বের করে আনলো যেটাতে গোলাপ ও বেলীফুলের মালা সহ আরো অনেক কিছু। আমি হা করে ঝুড়িটার দিকে তাকাতেই বললাম,
—“এসব আপনি কখন আনলেন আর কোথায়ই বা লুকিয়ে রেখেছিলেন? আমি তো দেখিনি।”

—“মেনেজ করেছি, এখন আয়নার সামনে বসো।”

মাথার একসাইডে কাঁচা লাল গোলাপের সমাহার, গলায় লাল গোলাপ ও বেলীফুলের ভারী মালা আর দুই হাতে দুটো ছোটো-ছোটো মালা বেঁধে দিলেন এবং খোঁপায় গুঁজে দিয়ে বললেন,
—“এখন বলো, এই প্রকৃতির রঙে রাঙানো, শুভ্র সজীব ও লাল ফুলে আবৃত হওয়া সাজে কেমন দেখাচ্ছে? ”

আমি আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম,
—“আমাকে একদমই চেনা যাচ্ছে না। এতো ফুলের মাঝে আমায় অনেক অন্যরকম লাগছে! ”

জয় হেসে আমার মাথার ওপর নিজের চিবুক বসিয়ে বললো,
—“অনেক অন্যরকম নয়, বরং খুবই সুন্দর লাগছে। একদম রাণীর মতো মনে হচ্ছে। ”

—“আগের সাজেও তো খারাপ লাগেনি। আপনি আমার দিকে তাকিয়ে যেভাবে বিড়বিড় করছিলেন!”

জয় থতমত খেয়ে বললো,
—“তখন তো হঠাৎ তোমার ঐ রূপটা ঠিক হজম করতে পারিনি। তাছাড়া এই নীল শাড়ির সাথে লাল গোলাপ ই বেশি মানায়। কিন্তু ভাবিনি, তোমায় এতো সুন্দর লাগবে! ”

—“আপনি এই কাঁচা ফুল এতো পছন্দ করেন? জানতাম না তো!”

—“পছন্দ করি না, কিন্তু আজ আমার ইচ্ছে হলো তোমাকে এভাবে সাজাতে। জানো তনিমা অনেক গুছিয়ে রাখতো নিজেকে। কিন্তু ওকে দেখে আমার কখনো ইচ্ছে হয়নি কোথাও বেড়াতে যাই, ওকে এভাবে সাজতে বলি, অনেক অনেক গল্প করি…… হয়তো ওর প্রতি আমার আবেগ কাজ করতো, কোনো অনুভূতি ছিল না।”

—“এখন আমাদের বিয়ের কন্ট্র্যাক্ট পেপারের কী করবেন?”

—“ওটা তো সকালেই ছিড়ে ফেলে দিয়েছি।”

—“আমার সাথে কথা না বলে ছিঁড়েছেন কেন?”

—“তোমার এতো কিছু বলতে আমি বাধ্য নই। তুমি আমায় ভালো না বাসলে একটা কথা ছিল। কিন্তু আমি এখন কারো ভালোবাসা হারাতে ইচ্ছুক নই। বরং সেটাকে যত্ন করে ও ভালোবেসে সারাজীবন আগলে রাখতে চাই। সো, এব্যাপারে যেন তোমার মুখে আর একটা কথাও না শুনি। এখন চলো, নিচে সবাই ওয়েট করছে। ”
কী মানুষ রে বাবা! যখন-তখন এভাবে রাগ দেখালে ভাল্লাগে?

জয় আমার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। হাত ছাড়াতে চাইলেই এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন আমায় আস্ত গিলে ফেলবে।

নিচে এসে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! এ আমি কাকে দেখছি!! আহিল ভাই এখানে!!
আমি জয়ের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

আহিল অনিতা আর রুহির সাথে কথা বলছে। কথা বলছে বললে ভুল হবে বরং তাদের কথাগুলো অনিচ্ছাকৃত ভাবেই গিলছে। উত্তরে শুধু হু-হা বললেও আহিলের মাথায় এখন শুধু একজনই ঘুরছে।

আমি আহিল ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে অস্ফুটস্বরে বললাম,
—“আহিল ভাই,,, ”

চির-পরিচিত কন্ঠ শুনে আহিল চট করে পাশ ফিরে তাকাতেই তার চোখ আটকে গেল। এভাবে সেজে না আসলে কি খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেত? এতো বছরের এতো প্রতিক্ষা শেষে প্রিয় মানুষটিকে দেখে চোখ দুটো বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে আহিলের। ইচ্ছে করছে দু’হাতে ঝাপটে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে। কিন্তু কোনো একটা অদৃশ্য দেয়াল তাদের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে, যার কারণে আহিল তাকে ছুঁতে গেলেও বাঁধা পাচ্ছে।

জয় এসে আমাকে বললো,
—“মুন, পরিচয় করিয়ে দেই। ও হচ্ছে আহিল, আমার একদম স্কুল লাইফের বন্ধু।”

জয়ের কথা শুনে আমি অবাক হয় ওর দিকে তাকালাম।
—“আপনি তো কখনো বলেননি যে, আহিল ভাই আপনার বন্ধু! ”

জয় ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“আহিল ভাই মানে? তোমরা কি একে অপরকে আগে থেকে চেনো নাকি? ”

আহিল কারো কোনো কথা কানে না নিয়েই আমার গালে হাত রাখতে যাবে ওমনি আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম,
—“এতো বছর পর কোত্থেকে এসেছো তুমি? নিজের পরিবার-পরিজন সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। একবার যোগাযোগ তো করতে পারতে? নিজের পেশাটা তোমার কাছে এতটাই বড় হয়ে গিয়েছে যে, নিজের বাবা-মায়েরও কোনো মূল্য নেই।”

আহিল অশ্রুসিক্ত চোখে হেসে বললো,
—“রাগ করেছিস, ফিহু? আমি কথা দিচ্ছি এবার আমি বাসায় ফিরে যাবো। একটা বড় কেসের জন্য এই পাঁচ বছর সবাইকে ছেড়ে দূরে ছিলাম। আমি চাইনি আমার জন্য আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি হোক। এবার একটু হাস, কতোদিন ধরে তোর হাসি মুখটা দেখি না! এভাবে কাঁদলে তোকে জঙ্গলি রানী থেকে পেত্নীর মতো লাগবে।”

আমি নিজের চোখের পানি মুছে হেসে দিলাম। আহিল ভাইকে আজ পেয়েছি, আমায় আজই ওকে জানাতে হবে। না জানি এখনো আহিল, আহিল করে চোখের জল ফেলছে।

—“কিন্তু ফিহু তুই এখানে কীভাবে এলি? এ বাড়িতে কী করছিস তুই? ”

আহিল ভাইয়ের কথা শুনে জয় আমাকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
—“আরে এটাই তো আমার বউ! মিসেস জয় মাহমুদ। ”

এটা শুনে যেন আহিলের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, যেন সারা পৃথিবী থমকে গেছে তার। এতো বছরের এতো সাধনা, এতো অপেক্ষা কি তাহলে নিমেষেই শেষ হয়ে গেল? তার থেকে দূরে চলে যাওয়াটাই কি আহিলের জন্য ভুল ছিল? মুন এবং জয়কে এতো কাছাকাছি স্বামী-স্ত্রী হিসেবে দেখে যেন আহিলের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তার সাথেই কেন এমন হলো? এরকমটা হওয়া কি খুবই দরকার ছিল? বারবার কানে শুধু একটা কথাই ঝনাৎ ঝনাৎ করে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, “এটাই তো আমার বউ। মিসেস জয় মাহমুদ!! ” তার ভালোবাসার মানুষ আজ অন্যের জীবনসঙ্গী, অন্য একজনের অধিকারে চলে গেছে সে। সেই ছোট্ট বেলা থেকে মনের ভেতর জমিয়ে রাখা অনুভূতিগুলো, আগলে বাচিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো আজ এক নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

—“কিন্তু আমায় আগে এটা বলো যে, তোমাদের মধ্যে কিসের সম্পর্ক? ”

জয়ের প্রশ্ন শুনে আমি বললাম,
—“আহিল ভাই আমার কাজিন। তবে ভাই হলেও ওনি আমার অনেক কাছের একজন মানুষ, আমার ছোট বেলার খেলার সাথী।”

—“ওহহ, তাহলে আহিল আমার বন্ধু থেকে শালা হয়ে গেলি! হোয়াট আ সারপ্রাইজ, ইয়ার!!”

আহিলের গলাটা বারবার ধরে আসছে। কথা গুলো খালি দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। তাও সেটা যেন কেউ না বুঝতে পারে, সেজন্য একটা জোরপূর্বক হাসি দিলো আহিল।

-চলবে…….