নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-২৩+২৪

0
6840

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_২৩ (বোনাস)||

বিছানায় শুয়ে শুয়ে টেবিল ল্যাম্টের সুইচ বারবার অন-অফ করছে আহিল। রাত দুটো বেজে গেলেও তার চোখে ঘুম নেই। বারবার কানে শুধু কথার বলা কথাগুলো বাজছে। তার কি সত্যিই উচিত মুনের জীবন থেকে সরে যাওয়া? কথা তো ঠিকই বলেছে। মুন কোনো দিন ওকে ভাইয়ের চেয়ে বেশি কিছু ভেবে ভালোবাসতে পারবে না। আর জয়ের জন্য এতোকিছু করার পর আবার ওর কাছ থেকে সুখ কীভাবে কেড়ে নিবে সে?

কথা তার জন্য এতোটা ফিল করে, তা আজ অনেকটা বুঝতে পারছে আহিল। ওর সাথে যেদিন শেষ দেখা হয়েছিল, সেদিন,,,


আহিল বিছানায় আরাম করে ঘুমাচ্ছে। কথা ওর মুখের সামনে বসে মুখ চেপে কাঁদছে, কিন্তু সেটা আহিল জানে না। হঠাৎ আহিল আড়মোড়া ভেঙে নড়েচড়ে উঠতেই কথা উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দিতে নেয়। এমনসময়ই টেবিলের ওপর থাকা গ্লাসটা ফ্লোরে পড়ে ধপাস করে ভেঙে যায়।

কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে আহিল চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলো, কথা দৌড়ে রুম থেকে বের হচ্ছে। আহিল সাথে সাথে উঠে বসে রাগী গলায় বললো,
—“কথা, দাঁড়া!! আমার সামনে আয়।”

কথা একটা শুকনো ঢোক গিলে পিছনে ঘুরে তাকালো। কিন্তু আহিলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।
—“কী হলো, বললাম না সামনে আসতে!!”

আহিলের ধমক শুনে কথা কেঁপে ওঠে আরো নেতিয়ে যায়। আহিল আর উপায় না পেয়ে ওর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললো,
—“কেন এসেছিস আমার ঘরে? তোকে বলেছিলাম না আমার রুমের আশেপাশেও যেন তোকে না দেখি? আর এবাড়িতে তুই বারবার কেন আসিস?”

কথার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। এতো তাচ্ছিল্য করে কেউ কাউকে বলে?? কথার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আহিল ওর দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
—“তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি!! ড্যাম ইট!! ”

কথা কাঁপা কাঁপা গলায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
—“আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল যে, তুমি দূরে কোথাও চলে যাবে আমাকে ছেড়ে। তাই ছুটে এসেছি একটু দেখতে।”

আহিল দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো,
—“তোর মনে হলেই কি আমি দূরে চলে যাবো? আর তোর থেকে দূরে চলে গেলে আমি অনেক খুশি হবো। তুই জানিস তোকে আমি কতটা স্নেহ করতাম? শুধু মাত্র তোর এই ভালোবাসি, ভালোবাসি নামক বেহায়াপনার জন্য আমার তোকে এখন বিরক্ত লাগে। ”

কথা ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
—“সবার সাথে তুমি কি সুন্দর মজা করে কথা বলো। তোমার ডায়ালগ গুলোকেই আমি প্রথম ভালোবেসেছি। কিন্তু আমার সাথে কেন এতো বাজেভাবে কথা বলো?”

আহিল নিজের দুহাত পকেটে গুজে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
—“কারণ তোকে আমার এখন সহ্য হয় না! তোর এসব ন্যাকামো গুলো আমার জাস্ট অসহ্য লাগে। ”

কথা আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“আহিল ভাই!!! ”

—“এতোগুলো কথা শুনালাম! এতো অপমান করলাম! তাও বেহায়ার মতো কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? তোকে আমার অনুরোধ যে, আমায় আর কখনো জ্বালাস না আর তোর এই মুখটা আমায় দয়া করে আর দেখাস না।”

আহিলের মুখে এমন কথা শুনে কথা হাত দিয়ে মুখ চেপে ফুপিয়ে কেঁদে কেঁদে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

আজ ওসব কথা মনে পড়তেই নিজের ওপরই নিজের ঘৃণা লাগছে আহিলের। এসব জঘন্য কথা কী করে বললো সে? কথা তো আর তাকে ভালোবেসে কোনো অন্যায় করেনি! শুধু নিজে একটু ভালোবাসার আবেদন করেছিলো। তার জন্য ওকে কতোটাই না কষ্ট দিয়েছে আহিল! তার দুদিন পরেই আহিলের ওপর একটা বড় কেসের দায়িত্ব আসে, যার পেছনে থাকা ক্রিমিনাল অনেক পাওয়ারফুল ছিল। তাই সে নিজের পরিবার ছেড়ে আত্নগোপন করতে বাধ্য হয়, যাতে ভালোভাবে ইনভেস্টিগেশন করতে পারে আর কারো ক্ষতিও না হয়।

ভাবতে ভাবতে নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে আহিল। আবার সাথে সাথে চোখ খুলে বলে উঠলো,
—“কথা বলেছিল আমি ওর থেকে দূরে চলে যাবো। আর বাস্তবে তাই হয়েছে। আমার চোখের ভাষা কথা অনায়াসে বুঝতে পারে। ওর পবিত্র ও নিখাঁদ ভালোবাসাকে আমি সারাজীবন অবহেলা করে এসেছি। তবে আমি কী করবো? আমি যে ফিহুকে ভালোবাসি! ওকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ভাবা কীভাবে সম্ভব? কিন্তু ফিহু আর জয়ের মাঝখানে যাওয়াটা আমার একদমই উচিত না। এখন আমি কী করবো? ”
_____________

একমাস পর,,,,,
আমি আমার কেবিনে বসে বাজেটিং করছি। এমনসময়ই আমার পিএ এসে বললো,
—“ম্যাম, জয় স্যার আপনাকে ডাকছে।”

—“ওকে, তুমি যাও। আমি আসছি।”

আমি ফাইল গুলো গুছিয়ে রেখে জয়ের কেবিনের দিকে হাঁটা দিলাম।
—“আমায় ডেকেছিলেন?”

জয় চোখ তুলে আমার দিকে তাকাতেই, আমি ভয়ে দুপা পিছিয়ে গেলাম। এ ব্যাটা তো আবার রেগে লাল টমেটো হয়ে আছে। আমি কি কিছু ভুল করেছি?

—“তোমায় এই অফিসে এপয়েন্ট করার আগে কী শর্ত দিয়েছিলাম। ”

বলেই জয় আমার সামনে এসে দাড়ালো। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললাম। আজ সকালে একাউন্টেন্টের সাথে বাজেটিং নিয়ে একটু ডিসকাস করেছিলাম বলে এখন অনেক আফসোস লাগছে। আজ তো মে গ্যায়া!!

—“কোনো ছেলে মানুষের সাথে কথা বলতে নিষেধ করেছিলেন।”

জয় দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—“আর তুমি কী করেছো?”

আমি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছি। উত্তর দেওয়ার মতো কিনা পাচ্ছি না।

জয় আমার দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন,
—“আনসার মি। আই সেইড স্পিক আপ, ড্যাম ইট! ”

এবার অসম্ভব রাগ উঠছে। আমি তো দরকারের জন্যই কথা বলেছি, নাকি? কপট রাগ দেখিয়ে জয়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
—” আপনার কি মনে হয় না যে, আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। এতো কনজার্ভেটিভ হওয়ার কী আছে? আমি ধরনের, তা আপনার ভালো ভাবেই জানা আছে। কোনো প্রয়োজন ছাড়া আমি কারো সাথে অসদুদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলবো এটা ভাবলেন কী করে আপনি?”

জয় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বললো,
—“আমি কখন তোমায় এসব বললাম? ”

—“বলেননি, কিন্তু ইনফার তো করেছেন! নয়তো আমি কেন কারো সাথে কথা বলতে পারবো না। আপনি কী মনে করেছেন আমি কিছু বুঝি না? আজ তনিমা আপনাকে ঠকিয়েছে বলে আপনি আমায় মেনে নিতে চাচ্ছেন। তনিমা থাকলে আপনি কোনোদিন আমায় ভালোবাসতে চাইতেন না।”
বলেই গটগট করে হেটে চলে আসলাম।

এদিকে জয় যেন পুরো আকাশ থেকে পড়লো। মুন ওকে এসব কথা বললো কীভাবে? জয় একটা মেকি হাসি দিয়ে বললো,
—“তুমি আমায় বুঝবে না! কেউই আমায় বুঝে না। আমি তোমায় এখন ব্যবহার করছি না। তোমার জায়গায় তনিমা থাকলে আমার কোনো কিন্তু যায়-আসতো না। কিন্তু তুমি আছো বলেই সহ্য করতে পারি না। তোমার পাশে কাউকে দেখা আমার পক্ষে একদম অসম্ভব। ”
___________

গাড়িতে জয়ের পাশে বসে আছি আর জয় ড্রাইভ করছে। এ পর্যন্ত একটা কথাও বলিনি আর জয়ও না। হঠাৎ জয় মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে বললো,
—“চলো গিয়ে আইসক্রিম খাবে। আজ অনেক গরম পড়েছে। ”
বলেই গাড়ি থেকে নেমে গেল আর আমাকেও টেনে বের করে নিয়ে গেল। রোড ক্রস করে রাস্তার ওপারে নিয়ে গেল আমায়

অনেকটা জোর করেই খেলাম আইসক্রিম। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে করতে আমি অভ্যস্ত। তাই তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।
—“আমি গিয়ে গাড়িতে বসছি।”

—“ওকে যাও। আমি বিল পে করে আসছি।”

আমি জয়ের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে গাড়ির উদ্দেশ্যে রাস্তা পাড় হতে লাগলাম। অসম্ভব বিরক্ত লাগছে আমার।

এদিকে জয় ওয়ালেট থেকে টাকা বের করার সময় পাশে তাকাতেই দেখলো, একটা বড় ট্রাক ওপাশ থেকে আসছে আর মুন রাস্তা পাড় হলেও অনেক স্লো মোশনে আনমনে হাঁটছে। জয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে বললো,
—-“মুনননননন!!”

আমি জয়ের হঠাৎ চিৎকার শুনে ওর দিকে তাকতে গেলেই দেখলাম একটা বড় ট্রাক আমার দিকে ধেয়ে আসছে। আমার সারা শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে, নড়তে পারছি না একদম।

জয় বুঝতে পারছে মুনের অবস্থা। হঠাৎ আকস্মিক কোনো বিপদে মানুষের মস্তিষ্ক স্থবির হয়ে যায় এবং কোনো কিছু ক্যাচ করতে অনেক সময় নেয়। কিন্তু এতো সময় তো নেই। ট্রাকটাকে থামানো যাবে না। জয়ের কেনো যেন মনে হচ্ছে ও ওর প্রাণ এখনি হারিয়ে ফেলবে। মুনের কিছু হলে ও কোনো ভাবেই সেটা সহ্য করতে পারবে না।
—“না এটা হতে পারে না।”
বলেই ছুটে গিয়ে মুনকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দিলো জয়। ট্রাকটা থামলো ঠিকই, কিন্তু জয়কে ধাক্কা দেওয়ার পরই থামলো।

আমি মাটি থেকে মুখ তুলে ঘুরে তাকাতেই দেখলাম জয়ের রক্তাক্ত দেহ রাস্তায় পড়ে আছে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে ওর কাছে গিয়ে ওর মাথাটা আমার কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

—“জয়, আমার দিকে তাকান। আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা? কেন করলেন এমনটা? কেন আমার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিলেন? আমি এখন কীভাবে কী করবো?”

জয় অনেক কষ্টে নিজের চোখ খুলে আমার গালে নিজের রক্তাক্ত হাত রেখে মুচকি হেসে বললো,
—“আমি কীভাবে সহ্য করতাম তোমার এই অবস্থা? এখন আমার কোনো আক্ষেপ নেই। তুমি অফিসে আমায় যা বলেছিলে, তা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমি একটু আগে যখন তোমায় হারাতে যাচ্ছিলাম, তখন বুঝেছিলাম যে, তোমার প্রতি আমার অনুভূতি কতটা প্রবল! বিশ্বাস করো, আমার ভেতরটায় তুমুল ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আফসোস আমার বুঝতে সময় লেগে গেছে। তোমার সাথে হয়তো জীবন বাধতে পারবো না আমি! আমি মরে গেলে কি তুমি আমায় ভুলে যাবে? আমি কিন্তু তোমার জন্য ওয়েট করে থাকবো। ”

—“কী সব আজেবাজে কথা বলছেন আপনি? আপনার কিছু হবে না। আমাদের এখনো কত কিছু গোছানো বাকি। আমরা তো সংসার জীবনই শুরু করলাম না আর আপনি আমায় ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন? আপনাকে আমার কাছে ফিরে আসতেই হবে। ”

-চলবে….

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_২৪||

হসপিটালে জয়ের কেবিনে বসে বসে নিজের মাথার চুল টানছি। কেবিনের ভেতরে ডক্টর জয়কে নিয়ে এতোক্ষণ ধরে কী করছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

আমার সাথে সবসময়ই এমন হয়। যখন আমি কোনোভাবে একটু সুখের আলো দেখি, তখনই তা হারিয়ে ফেলি। জয়ের আজকের এই অবস্থার জন্য শুধু মাত্র আমি দায়ী। আমি কেন ওকে ঐভাবে ওসব কথা বলতে গেলাম? না বললে আজ এমনটা হতো না।

কথা আমায় শান্ত করার জন্য বললো,
—“ফিহু, কান্নাকাটি থামা। এভাবে কাঁদলে তুই নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বি! তোর চোখমুখ আর চেহারা পুরো লাল হয়ে গেছে। নিজেকে সামলা।”

আমি কান্না ভেজা গলায় বললাম
—“জয়ের আজ আমার জন্য এই অবস্থা। আমি দায়ী ওর অ্যাক্সিডেন্টের জন্য। আমায় বাচাতে গিয়ে ও কীভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারলো?”

অনিতা বললো,
—“সবকিছু ভাগ্য! এখানে তোর কোনো দোষ নেই। অযথা নিজেকে দোষারোপ করে কষ্ট পাস না।”

কথা নিজের চোখের কোণে জমে থাকা পানি এক আঙুলে মুছে বললো,
—“তোর জয় তোকে অনেক ভালোবাসে। সেজন্যই তোকে বাঁচানোর জন্য এমন একটা ঝুঁকি নিয়েছে। এখানে তোর কোনো দোষ নেই। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস।”

—“আমাকে তোমরা একটু একা থাকতে দাও, প্লিজ। আমার কিছু ভাল্লাগছে না।”

আমার কথায় সম্মতি জানিয়ে কথা, অনিতা আর রুহি অন্য দিকে চলে গেল। আমার এখন অনেক আফসোস হচ্ছে। কথা সেদিন বলেছিল যে, কারো ভালোবাসা পেলে, সেটা কখনো হারাতে নেই। আজ আমি পেতে না পেতেই হারিয়ে ফেললাম। চোখের সামনে শুধু জয়ের হাসি মুখ, ওর বলা কথাগুলো, ওর সাথে কাটানো মুহুর্ত সবকিছু বারবার ভেসে উঠছে।

কিছুক্ষণ পর জায়েদ, অদ্রি আর আহিল সব ফর্মালিটিস কমপ্লিট করে আমার সামনে এসে দাড়ালো। আমার যদিও সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। জয়ের বাবা, মাকে এখনো কিছু জানানো হয়নি।

জায়েদ এতোক্ষণ নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেও এখন আর পারছে না। ঠোঁট কামড়ে কান্না করতে লাগলো।
—“জায়েদ, তুমি মুনের সামনে এভাবে ভেঙে পড়লে মেয়েটা আরো পাগলামি করতে শুরু করবে।”
বলেই অদ্রি জায়েদকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

আহিল মুনের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো,
—“কথা ঠিকই বলেছে। তুই কোনোদিন আমার হবি না রে, ফিহু। তোর শহর জুড়ে এখন শুধু জয়েরই বসবাস। ”
আহিল গিয়ে মুনের পাশে বসলো।

পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আমি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি আহিল ভাই। আমি আহিল ভাইকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
—“আহিল ভাই, জয়কে বলো না তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আমার কাছে ফিরে আসতে। ও কেন আমার থেকে দূরে চলে যেতে চাইছে?”

আহিল ভাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“অনেক ভালোবাসিস না জয়কে?”

—“জানি না। শুধু এটুকু জানি যে, জয়কে আমার চাই। ওকে ছাড়া আমি থাকবো কীভাবে? ওকে আমার কাছে ফিরে আসতেই হবে। ”

একথা শুনে আহিলের বুকের ভেতর তুমুল বেগে উথাল-পাথাল শুরু করে দিয়েছে। নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখে অন্যের জন্য আবেগঘন আকুতি কতটা বেদনা বিধুর হতে পারে, তা আজ সে বুঝতে পারছে।

—“তাহলে এভাবে পাগলামি না করে আল্লাহর কাছে দোয়া কর। এখন তো সবকিছু তাঁরই হাতে! ”
আহিল ভাইয়ের কথা শুনে আমার ভাবান্তর ঘটলো। আসলেই তো! এখানে বসে বসে চোখের পানি ফেলে লাভ নেই।

—“তুমি ঠিকই বলেছো। আমি এখুনি নামাজের রুমে গিয়ে দোয়া করবো।”
বলেই চলে যেতে লাগলাম।

আহিল হালকা হেসে নিজের চোখের পানি গুলো মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
—“জয় দোস্ত, তুই সত্যিই অনেক ভাগ্যবান! এই মেয়েটা তোকে এতো ভালোবাসে! আর তুই? শালা, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ আর ফিহুর কাছে ফিরে আয়।”

—“জয় ভাগ্যবান, কিন্তু তোমার থেকে কমই।”

আহিল পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, কথা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। নাকের ডগায় বসানো ভারী চশমাটা ভেদ করে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো সে।

আহিল ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“আমার চেয়ে কম ভাগ্যবান মানে?”

কথা হেসে আহিলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“মানে এটাই যে, জয় ভালোবাসা পেয়েও সেটা গ্রহন করার অনিশ্চয়তায় আছে। আর তুমি একজনকে এতো বছর ধরে অবহেলা করছো আর সে এখনো তোমার পথ চেয়ে বসে আছে। তাহলে বলো কে বেশি ভাগ্যবান? যে ভালোবাসা পেয়ে হারাতে বসেছে নাকি যে ভালোবাসা পেয়ে অবজ্ঞা করছে?”

আহিল কথার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো। কথা সেটা বুঝতে পেরে বললো,
—“তুমি বুঝবে না! সত্যিই তুমি কোনোদিনও বুঝবে না। আমারই ভুল, তোমার কাছ থেকে কিছু আশা করা। তবে মনে রেখো, যদি আমায় কোনোভাবে হারিয়ে ফেলো, তাহলে একসময় অনেক পস্তাবে, আমায় অনেক খুঁজবে। কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে যাবে।”
____________

আমি একমনে জায়নামাজের ওপর বসে হাত তুলে চোখের পানি ফেলছি। আমার আর এ জীবনে কিচ্ছু চাই না, শুধু জয়ের সুস্থতা ছাড়া। আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ ভাবে কিছু চাইলে নাকি তিনি ফিরিয়ে দেন না। আমার বিশ্বাস, আমাকেও ফিরিয়ে দিবেন না।

রাত হয়ে গেছে অনেক আগেই। জায়েদ, অদ্রি, অনিতা, রুহি, রাদিফ, অর্ণব, কথা, আহিল জয়ের কেবিনের সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কখন ডক্টর হবেন? সবারই চোখে মুখে চিন্তার ছাপ।
আহিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত বারোটা বাজে। এখনো কোনো আপডেট পেল না।

হঠাৎ দরজা খুলে একজন ডক্টর এবং দুজন নার্স বের হলো।
জায়েদ উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে গিয়ে বললো,
—“ডক্টর, পেশেন্টের কী অবস্থা এখন? ও ঠিক হয়ে যাবে তো!”

ডক্টর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
—“হি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার নাও। সো, নো নিড টু বি ওয়ারিড।”

ডক্টরের কথা শুনে সবার মুখ মুহূর্তেই খুশিতে চিকচিক করে উঠলো। জায়েদ খুশি হয়ে ডক্টরের হাত ধরে বললো,
—“আপনি সত্যি বলছেন, ডক্টর! আমার ভাই সুস্থ হয়ে যাবে?”

ডক্টর হেসে বললো,
—“ইয়েস মাই সন। তবে একটা ব্যাপার আছে। ”

সবাই ভ্রুকুটি করে ডক্টরের দিকে তাকালো।

—“এই ধরনের অ্যাক্সিডেন্টে ওনি ভালোই আঘাত পেয়েছেন এটা ঠিক। আমরা ভেবেছিলাম ওনার স্মৃতি শক্তি চলে যেতে পারে, যেহেতু মাথায় সবচেয়ে বেশি চোট লেগেছে। কিন্তু ওনার ব্রেনের রেসপন্স দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি। বলতে গেলে এটা মিরাকেল ছাড়া আর কিছুই নয়। যাইহোক, আজ জ্ঞান ফিরবে না। কাল সকালের দিকে ফিরতে পারে। আপনারা গিয়ে দেখে আসতে পারেন। ”
বলেই ডক্টর চলে গেল।

আহিল সবাইকে বললো,
—“যাক, সবকিছু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। এবার ফিহুকে গিয়ে ডেকে আনা উচিত। মেয়েটার অনেকক্ষণ ধরে কোনো খবর নেওয়া হচ্ছে না।”

রাদিফ বললো,
—“আমি আর অর্ণব গিয়ে নিয়ে আসতেছি। ও যে একটুতেই ভাইঙ্গা পড়ে, সেইটা আমরা ভালো কইরাই জানি।”
____________

রাদিফ আর অর্ণব নামাজের রুমে গিয়ে দেখলো, মুন জায়নামাজের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ওরা কাছে গিয়ে মুনের কাধে হাত রাখতেই ও ঢলে পড়ে গেল।
—“বইন, বইন, তুই ঠিক আছিস?”

রাদিফের এমন কথা শুনে অর্ণব চরম বিরক্ত হয়ে তেজদীপ্ত গলায় বললো,
—“শালা, ও যে সেন্সলেস হইয়া পইড়া আছে, সেটা বুঝোস না? জিগাস ঠিক আছে কিনা? ও ক্যামনে তোরে উত্তর দিবে? ফিডার খাস এই বুইড়া কালে! যতোসব বলদ মার্কা কথাবার্তা! কোলে তোল ওরে।”

রাদিফ অর্ণবের কথায় রেগে ফায়ার হয়ে ওকে একটা বাংলা গালি দিয়ে তারপর মুনকে কোলে তুলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেড়িয়ে গেল।

-চলবে…………