নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-২৫

0
4053

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_২৫||

চোখ খুলে নিজেকে হাসপাতালের কেবিনে আবিষ্কার করলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমি এখানে কী করছি? আর আমায় এখানে আনলোই বা কে? জয়ের কথা মনে পড়তেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম। শরীরের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে হাতে লাগানো স্যালাইন এটেচ্ড ক্যানোলা একটানে খুলে দৌড়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলাম। হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। কিন্তু আমার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

জয়ের কেবিনের সামনে আসতেই দেখলাম সবাই এখানেই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। আমায় এখানে এভাবে আসাটা মনে হয় কেউ আশা করেনি।

—“তুই এখানে? হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে কেন? ”

আহিল ভাইয়ের কথা উপেক্ষা করে আমি বললাম,
—“জয়, জয়ের কী অবস্থা? আমি জয়ের কাছে যাবো।”
বলেই আহিল ভাইকে পাশ কাটিয়ে জয়ের কেবিনে ঢুকতে যাবো, এমন সময় আহিল ভাই আমায় বাঁধা দিয়ে বললো,
—“যাস, কিন্তু আগে তোর হাতে যে ব্লিডিং হচ্ছে, সেটাতো ঠিক করতে হবে।”

—“লাগবে না, আমাকে যেতে দাও।”

—“কিন্তু,,, ”

আহিল কিছু বলার আগেই কথা বলে উঠলো,
—“ফিহু, তুই জয়ের কাছে যা। আমি ততক্ষণে তোর হাতের রক্ত পড়া থামানোর ব্যবস্থা করছি। ”

কথার কথা শুনে ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু কথার এতে কোনো ভাবান্তর নেই।

আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম, জয় বেডে চোখ বন্ধ করে বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। তার মানে কি ওর জ্ঞান ফিরেছে? ওর মাথায় ব্যান্ডেজ, বাম হাত ও পায়ে ব্যান্ডেজ করা। এই অবস্থায় জয়কে দেখবো তা আমি কোনোদিন কল্পনায়ও ভাবতে পারিনি। নিজেকে আজ বড্ড অপরাধী বলে মনে হচ্ছে।

গুটি গুটি পায়ে হেঁটে গিয়ে জয়ের পাশে গিয়ে বসলাম। চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু বিন্দু ঝরছে।

ডান হাতে পানির স্পর্শ পেয়ে চোখ দুটো পিটপিট করে খুলে তাকালো জয়। তার জ্ঞান অনেক আগেই ফিরেছে। সারা শরীরের তীব্র ব্যথায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। এখন চোখ মেলে তার প্রিয় মানুষটির মুখ দেখে হাজার যন্ত্রণায়ও ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। জয় ওর মাথায় হাত রাখলো।

হঠাৎ নিজের মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে চট কর মাথা তুলতেই দেখলাম, জয় আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটে হাসি, কিন্তু চোখে জল। আমি ওর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। জয় আমার মাথায় হাত দিয়ে বললো,
—“এই বোকা মেয়ে, এভাবে কাঁদছো কেন, হুম? একদিনেই নিজের কী হাল করেছো তুমি? ”

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
—“আমার জন্য, শুধু মাত্র আমার জন্য আজ আপনার এই অবস্থা। আমি কেন যে আপনাকে ওসব বাজে কথা বলতে গিয়েছিলাম? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেকে কী অনায়াসেই না সঁপে দিলেন!! ”

—“চুপ, কোনো কিছুর জন্য হুট করে নিজেকে দায়ী করাটা বাদ দিতে পারো না! যা হয়, তা ভালোর জন্যই হয়। এই ঘটনা টা না ঘটলে আমার নিজের অনুভূতি টা বুঝতে অনেক দেরি হয়ে যেত। ”

আমি উঠে বসে জয়ের হাত, পা, মাথার ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
—“অনেক ব্যথা করছে, না?”

জয় হেসে বললো,
—“ব্যথা ধীরে ধীরে কমছে। পেইন কিলার ইনজেকশন দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তাছাড়া এটা আর কী এমন ব্যথা? ব্যথা তো তখন করছিল, যখন তোমার ওপর ট্রাকটা উঠে যাচ্ছিলো।”

—“তাই বলে আপনি ওভাবে আমায় ধাক্কা দিয়ে নিজে ট্রাকের ওপর ঝাপিয়ে পড়বেন? জানেন আমার কী অবস্থা হয়েছিল? ”

জয় ব্যস্ত হয়ে বললো,
—“খুব জোরে ধাক্কা দিয়েছিলাম নাকি? অনেক ব্যথা পেয়েছিলে, তাই না? ”

আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
—“মজা করছেন আমার সাথে? আমি আমার শরীরের অবস্থার কথা বলিনি, আমার মনের অবস্থার কথা বলেছি।”

—“আমি কী ওতোসতো ভেবেছিলাম নাকি? তোমায় ধাক্কা দেওয়ার সাথে সাথে আমি নিজে ধাক্কা খেলাম। তাও এটা ভেবে মনে শান্তি লাগছিলো যে, তুমি ঠিক আছো।”

—“আপনি জ্ঞান হারানোর আগে আমায় কী বলেছিলেন? আপনি চলে গেলে আমি আপনাকে ভুলে যাবো কিনা? আপনি আমার জন্য ওয়েট করে থাকবেন? এখন আমি বলছি, একটু সুস্থ হোন। আমি আপনার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। আপনার সাথে আর থাকবো না।”

জয় জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো,
—“এই না না না। সরি বলছি। অনেক সরি। তুমি চলে গেলে কীভাবে হবে? জানো আজ সকালে আমার জ্ঞান ফেরার পর আমার মনে হচ্ছিল, আমি স্বপ্ন দেখছি। নিজের চোখ বন্ধ করে আমি আমাদের আগামী দিনের কথাগুলো ভাবছিলাম। ”

আমি ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বললাম,
—“আগামী দিনের কথা মানে?”

জয় মুচকি হেসে আমার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো,
—“আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে। যেখানে তুমি, আমি আর একটা রাজকন্যা বা রাজকুমার থাকবে। যদিও আমার রাজকন্যার প্রতি ইচ্ছে বেশি। আমরা প্রতি শুক্রবার বিকেলে ঘুরতে বের হবো। রাতে জ্যোৎস্না বিলাস করবো, সকালে বৃষ্টি বিলাস। তুমি পড়াশোনা, অফিস সব একসাথে করে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তখন আমরা বিকেলের স্নিগ্ধ হাওয়া উপভোগ করবো।”

—“আপনাদের রোমান্স করা শেষ হলে আমাদের একটু নোটিফাই করবেন। উই আর ইগারলি ওয়েটিং। ”

কারো মেয়েলি কন্ঠ শুনে আমি সাথে সাথে জয়কে ছেড়ে দিলাম আর পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখলাম আহিল ভাই আর কথা দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে কথাই ওভাবে বলছিল! এখন ওরা কী ভাববে!

এদিকে আহিল মেকি হেসে বিড়বিড় করে বললো
—“যখন তাহারে পাই না, তখন তাহারে চাই;
যখন তাহারে পাই, তখন তাহারে আবারো হারাই!”

পাশ থেকে কথা আহিলের বিড়বিড় শুনে নিজেও আহিলের কানে বিড়বিড় করে বললো,
—“‘যখন তাহারে পাই, তখন তাহারে চাই না ;
যখন তাহারে চাই, তখনই তাহারে হারাই!’
এটাও বলার জন্য রেডি হয়ে নাও।”

আহিল কথার দিকে তাকাতেই কথা অন্য দিকে ফিরে নিজের চোখ দুটো মুছে নিলো। সেটা বুঝতেও আহিলের বেশি বেগ পেতে হলো না।

জয় জোরপূর্বক হেসে বললো,
—“আরে, আহিল এন্ড কথা, তোমরা ওখানে দাঁড়িয়ে কী ফিসফিস করছো? ভেতরে এসো। আহিল তুইও আয়।”

কথা আমার কাছে এসে হাতে রক্ত পড়া জায়গায় একটা তুলো চেপে দিয়ে বললো,
—“ভাইয়া, আপনার জন্য আমার বোনুটা কতো পাগলামি করেছে, জানেন? কাল থেকে এখন পর্যন্ত কিছু খায়নি। রাতে সেন্সলেস হয়ে যাওয়ায় ওকে নিয়েই টানাটানি। আপনিও কি অন্যদের মতো মানুষের ভালোবাসা বুঝেন না নাকি?”

কথা যে আহিলকে ফোঁড়ন কেটে কথাগুলো বলছে, তা বুঝতে আর কারো বাকি নেই। জয় একবার আহিলের দিকে তাকিয়ে তারপর মুচকি হেসে বললো,
—“আরে বাদ দাও। সময়ই সবাইকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। তোমারও উচিত সময়ের অপেক্ষা করা।”

কথা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—“নিজের বুঝ হওয়ার পর থেকেই সময়ের অপেক্ষা করছি। সবারই ধৈর্যের একটা পরিধি আছে, সেটা আমার শেষ হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করতে পারবো না। যা করার, আমার মা-বাবাই করবে।”

#চলবে