নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-২৬+২৭

0
5770

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_২৬+২৭||

সকাল সকাল বাসার কলিং বেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ শুনে মেজাজটা পুরোই তুঙ্গে উঠে গেছে আহিলের। এক সপ্তাহ আগে নিজের বাড়িতে ফিরে এলেও একটুও শান্তি পায়নি সে। রোজ রোজ কেউ না কেউ আসবেই তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু এই সাত-সকালে আরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে কে উদয় হলো কে জানে?

ঘুমঘুম চোখে গিয়ে দরজা খুলে সামনে তাকাতেই চোখ কপালে উঠে গেল আহিলের। এই অসময়ে এখানে কী করছিস- বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। আর কত বাজে ব্যবহার করবো মেয়েটার সাথে?

—“কী হলো? ঢুকতে দিবে না? নাকি আজও দূর দূর করে তাড়িয়ে দিবে?”

কথার কথা শুনে ভাবনার দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এলো আহিল। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
—“না, আয় ভেতরে।”

কথা ভেতরে গিয়ে সোফায় বসতে বসতে বললো,
—“মামনি নেই বাড়িতে? তুমি এই সময়ে দরজা খুললে যে?”

আহিল দরজা লাগাতে লাগাতে বললো,
—“মায়ের রুমটা সেকেন্ড এপার্টমেন্টে। দুদিন আগে শিফট হয়েছে। তাই এই দিকের দরজায় বেল বাজালে মা কিছু শুনতেই পাবে না।”

—“ও, এজন্যই তো বলি,তুমি কেন আজ দরজা খুললে? এ বাড়িতে এসেই তোমায় দেখতে পাবো ভাবিনি।”

আহিল কিছু বলতে যাবে তার আগেই,,
—“কী রে আহিল, কেউ কি এসেছে নাকি?”
বলতে বলতে ড্রয়িং রুমে ঢুকলো আহিলের মা আনিয়া আহরার।

কথাকে দেখে আনিয়া খুশি হয়ে ওকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
—“কেমন আছিস, মা? কতোবছর পর তোকে দেখলাম! আমাকে তো ভুলেই গেছিস মনে হয়! একবার দেখা করতেও এলি না!”

কথা মলিন হেসে বললো,
—“সব দিক মিলিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম। আর মায়া বাড়িয়ে লাভ কী? যার জন্য মায়া বাড়াবো, সেই যদি না বুঝে!”

আনিয়া একবার আহিলের দিকে তাকিয়ে আবার বললো,
—“তাই বলে কি আমরা তোর কিছু হই না? আমার মেয়ের জায়গাটা তো আমি তোকে আর ফিহুকেই দিয়েছি!”

কথা ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললো,
—“হুম, জানি। এখন বাদ দাও এসব ইমোশনাল কথা-বার্তা। ”

আনিয়া হেসে কথাকে নিয়ে বসে বললো,
—“হুম, বাদ দিলাম। এখন বল এতো সকালে চট্টগ্রাম থেকে কীভাবে এলি? মাঝরাতে রওয়ানা দিয়েছিলি নাকি?”

এমন কথা শুনে কথা জোরে শব্দ করে হেসে ওঠে। আহিল কথার এমন হাসির শব্দ শুনে সচকিত চোখে ওর দিকে তাকায়। আহিল এতো বছরে কখনো কথাকে এমন প্রানখুলে হাসতে দেখেনি। সবসময়ই ঠোঁট দুটোর দুই কোণা টেনে একটা মলিন হাসি দিতো। সেই মলিন হাসির আড়ালে এতো প্রাণোচ্ছল একটা হাসি লুকিয়ে আছে, সেটা আহিল চোখে আজ ধরা দিলো।

কথা হাসতে হাসতে বললো,
—“কী যে বলো না তুমি, মামনি!! মাঝরাতে কেন রওনা দিতে যাবো? আমরা তো গতকালই আমাদের ঢাকার বাড়িটাতে শিফট হয়েছি একমাসের জন্য।”

আহিল একমাসের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেল। আনিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“একমাসের জন্য কেন?”

—“বলছি। সেটার জন্যই তো এখানে আসা।”
বলেই ব্যাগ থেকে একটা ব্লু কালারের কার্ড বের করে আনিয়ার হাতে দিলো।

আনিয়া অবাক হয়ে বললো
—“এটা কী?”

কথা মলিন হেসে বললো,
—“আমার বিয়ের কার্ড। আগামী শুক্রবার ডেট ফিক্সড করা হয়েছে। ”

বলেই নিজের দুহাত থেকে দুটো মোটা ধাঁচের স্বর্ণের চুড়ি খুলে আনিয়ার হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,
—“এই বালা দুটো তুমি দিয়েছিলে আমায়। কিন্তু যেটা ভেবে দিয়েছিলে, সেটা আর কখনো সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। তাই এটা তুমিই রাখো। ভবিষ্যতে কাজে লাগলেও লাগতে পারে। ”

আনিয়া চুড়ি দুটোর দিকে একবার তাকিয়ে ছলছল চোখে কথার দিকে তাকালো।
—“তুই যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, তা একদম ঠিক। আমাদের ভাগ্য খারাপ যে, তোকে পেয়েও পেলাম না। তুই বস, আমি তোর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছি।”

কথা বাঁধা দিয়ে বললো,
—“না, মামনি। আমি কিছু খাবো না। অফিসে যেতে হবে আমায়। এমনিতেও এক সপ্তাহ অফিসে যেতে পারবো না। তাই এখন থেকেই কিছু কাজ এগিয়ে রাখতে হবে।”

আনিয়া চোখ রাঙিয়ে বললো,
—“একদম চুপ করে এখানে বস। আমি কোনো বাহানা শুনতে চাই না। ”
বলেই ভেতরে চলে গেল। কথাও তাই বাধ্য মেয়ের মতো সেখানে বসে রইলো।

এদিকে আহিল কথার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সেটা কথা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। কিন্তু এখন আর মায়া বাড়িয়ে সাথে সাথে নিজের কষ্ট টাও বাড়াতে চাচ্ছে না সে। তার জীবনে মায়া এবং কষ্টের মধ্যে যে ধনাত্মক সম্পর্ক বিদ্যমান। নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসছে সে। আর নতুন করে সেখানে কোনো ছুরিকাঘাত চায় না কথা।

—“বিয়েটা কি স্বেচ্ছায় করছিস, নাকি নিজের ওপর জোর করে? আংকেল-আন্টি তো আর তোকে কোনোদিন জোর করে বিয়ে দিতে পারবে না।”

আহিলের প্রশ্ন শুনে কথা হালকা হেসে বললো,
—“যেভাবেই করি, করছি তো! আর এটাই তো তুমি চাইছিলে, তাই না?”

আহিল নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে বললো,
—“নিজের মনের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করলে কখনো সুখী হওয়া যায় না। অযথা নিজের ওপর জোরাজুরি করাটা আমি কখনোই সাপোর্ট করি না।”

—“তোমায় নিজের অস্তিত্বের মাঝে জায়গা যেদিন দিয়েছি, সেদিনই আমার জীবন থেকে সুখ নামক বস্তুটা হারিয়ে গেছে। কী পেয়েছি আমি তোমায় ভালোবেসে? রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছো আমার, মুখের হাসি মুছে দিয়েছো তুমি, বুকের ভেতর একটা চাপা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি আমি। কখনো আমার হাসির দিকে খেয়াল করে দেখেছো? সেখানে আনন্দ দেখতে পেয়েছো বা খুঁজে দেখেছো? দেখোনি। আমি তোমায় বলেছিলাম, কিন্তু তুমি বুঝনি, ইভেন বোঝার চেষ্টাও করোনি! তবে এখন আর বলে বোঝাবো না। তোমার জন্য তৈরি হওয়া অনুভূতি গুলোর জন্য আমি ঋণী। এখন সেগুলো শোধ করে দিবো।”
বলেই একটা প্যাকেট আহিলের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

আহিল এতোক্ষণ কথার প্রতিটি বক্তব্য অতি মনযোগ সহকারে শুনছিলো। প্রতিটা শব্দগুচ্ছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হাহাকার ও আর্তনাদ যেন আহিলকে ঘিরে ধরেছে। কীভাবে পারে একজন মানুষ এতোটাও সহ্য করতে? কথাকে না দেখলে হয়তো সেটা অজানাই রয়ে যেত আহিলের! মুনকে হারানোর পরেও এতোটা কষ্ট আহিল পায়নি, যতোটা না কথা পেয়েছে।

প্যাকেটটা দেখে আহিলের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেলো।
—“কী আছে এটার ভেতরে?”

—“খুলেই দেখো!”

আহিল প্যাকেট টা নিয়ে খুলতেই দেখলো ভেতরে অনেক গুলো ডায়েরি। আহিল কপালে ভাজ ফেলে বললো,
—“এতোগুলো ডায়েরি কিসের? এগুলো দিয়ে আমি কী করবো?”

—“এখানে এগারো টা ডায়েরি আছে। পাঁচ বছর ধরে আমি এই দশটা ডায়েরি গুলোতেই নিজের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করেছি। আর এগারো নাম্বার টা রিসেন্টলি স্টার্ট করেছিলাম। সেটাও দিয়ে দিলাম। হয় তো পড়তে একটু কষ্ট হবে। লেখা বুঝা যাবে না তেমন। তবুও তুমি মন চাইলে পড়ো।”

—“এই একমাস তাহলে দেরি করলি কেন? আরো আগেই সেরে ফেলতি বিয়ে টা।”

—“জয়ের জন্য। এই একমাসে জয় অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে। তাই আর দেরি করাটা উচিত না।”

আহিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো,
—“আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, যদি তুই কিছু মনে না করিস?”

কথা অবাক চোখে আহিলের দিকে তাকালো।
—“আমার মনে করা না করায় তোমার কোনো কিছু আসে-যায় আদৌও। বলো কী বলবে? মন আজ আর মনের জায়গায় নেই! ”

আহিল নিজের জড়তা ঘুচিয়ে বললো,
—“তুই সবসময় এইরকম সাদা শাড়ি পড়ে থাকিস কেন? আগে তো এসব পড়তি না!”

কথা হেসে বললো,
—“জীবন থেকে রং হারিয়ে গেছে আমার। রঙ্গিন পোশাক পরে কী হবে? রংহীন জীবনে রংহীন জিনিসই মানায়। রঙ্গিন পোশাক-আশাক এখন আমার কাছে প্রচন্ড রকমের বেখাপ্পা লাগে। ”

আহিল কিছু বলবে, তার আগেই আহিলের মা কথাকে ডাকা শুরু করে দেয়। কথাও বিনা বাক্য ব্যয়ে সেদিকে চলে গেল।
_____________

—“আপনি কোথায় যাচ্ছেন এখন? আপনার পা এখনো কিন্তু ঠিক হয়নি!”
প্রচন্ড রেগে বললাম কথা গুলো। কিন্তু তা জয়ের কান পর্যন্ত গেছে কিনা কে জানে? সে তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রেডি হতে ব্যস্ত! তে রাগটা সপ্তম আসমানে উঠে গেল।

—“কিছু বলেছি আমি আপনাকে? ”
জোরে চিৎকার দিয়ে বলায় জয় নিজের কানে আঙুল গুঁজে বললো,

—“আস্তে আস্তে, কানের পর্দা ফেটে যাবে তো! পরে সবাই তোমাকে বলবে যে, তোমার বর বয়রা (বধির)। ভালো লাগবে তখন?”

—“আমি এখন মজা করার মুডে নেই। আপনাকে বলেছি একদম কথার বিয়ের পর অফিসে যেতে! আর আপনি!”

জয় ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
—“মুন, ট্রায় টু আন্ডারস্ট্যান্ড! আজকের মিটিংয়ে আমায় এটেন্ড করতে হবে। আমি ছাড়া আর কোনো ইঞ্জিনিয়ার নেই অফিসে। সো, এটা খুবই আর্জেন্ট।”

—“আপনি এখনো খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটেন। একমাস মাত্র হলো। আরো তো এক-দুই সপ্তাহ দরকার।”

—“আজই তো যাবো, তারপর আর যাবো না।”

—“আচ্ছা, তাহলে চলুন আমিও যাবো আপনার সাথে। আমিও এতোদিন আপনার জন্য যাইনি। আজ যাবো।”

জয় আমার নাক টেনে দিয়ে বললো,
—“তুমি তো তুমিই! অফিসে না গেলেও তোমার স্যালারি তোমার একাউন্টে চলে যায়। আমার তো নিজে আয় কটতে হয়, বুঝলে?”

আমি হেসে বললাম,
—“হুম, বুঝলাম। এখন চলুন।”

জয় হালকা চিন্তিত ভাবে বললো,
—“আচ্ছা, কথার বিয়েটা কি সত্যিই হয়ে যাবে? এই আহিল বলদটা কি এখনো বুঝবে না মেয়েটাকে? ”

আমি হতাশা নিয়ে বললাম,
—“কিছুই বুঝতে পারছি না। যদি কথার বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে কথা কি কখনো সুখী হবে? আর আহিল ভাইয়ের যে কোথায় সমস্যা, সেটা আমি আজও বুঝলাম না।”

জয় আমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
—“চিন্তা করো না। যা হবে, তা ভালোই হবে। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো।”
______________

এদিকে আহিল নিজের ঘরে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। যার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, বিচার শক্তি আর তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ ধর্মী চিন্তা ভাবনার কারণে আজ বড় বড় ক্রিমিনালদের কাছে সমালোচিত, সিআইডির সর্বোচ্চ আসন যে দখল করে বসে আছে; আজ সে একটা সামান্য সাইকোলজিক্যাল টার্মের সাথে পেরে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে।

কথার দেওয়া ডায়েরি গুলো সবগুলো খুলে দেখে বুঝেছে যে, চোখের জলে অনেক লেখার কালি লেপ্টে গেছে। কতাট কান্না কাটি করেছে মেয়েটা। পাঁচ বছর আগেও কথার চোখে চশমা ছিল না। আজ ওর চোখে মোটা ফ্রেমের ভারী গ্লাসের চশমার কারণটা বেশ ভালো ভাবেই বোধগম্য হচ্ছে আহিলের।

—“এখন আর ভেবে কাজ নেই। তোর কাছ থেকে অনেক মূল্যবান একটা জিনিস হারিয়ে গেছে রে, আহিল।”

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে তার দিকে অসহায় চোখে তাকালো আহিল।

—“ওভাবে তাকিয়ে আর কী হবে? কালকে কথার বিয়ে। তোর ভাগ্যটা বড্ড মন্দ। নয়তো ওমন মিষ্টি দেখতে কোমল মনের অধিকারী একটা মেয়েকে তুই চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেললি!!”

—“মা, তুমি সবকিছু জেনেও এসব বলছো?”

আনিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
—“হ্যাঁ, বলছি। কারন কথাকেই আমি অনেক আগে থেকে তোর বউ করে আনবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। তুই যাকে ভালোবাসিস, তার নাম কখনো আমায় বলছিস?”

—“মা, প্লিজ। আমি তোমায় ওর নাম বলতে পারবো না। আগেও বলেছি। আর ওর বিয়ে হয়ে গেছে, এটাও বলেছি।”

—“তাহলে এভাবে তুই কী সারাজীবন কুমার হয়ে থাকবি? কথা তোকে কতোটা ভালোবাসে, সেটা কি তুই উপলব্ধি করতে পারিস না?”

আহিল নিজের মাথা নিচু করে ফেললো। আনিয়া নিজের চোখের জল মুছে বললো,
—“আমি তোর মা। আর মা হয়েই বলছি, কথার প্রতি তোরও একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। যদি তা না-ই হতো, তাহলে তুই এখনো ওকে আগের মতোই দূর দূর করতি। কিন্তু তুই করতে পারিস না সেটা। আর কখনো পারবিও না। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য তোকে অনেক পস্তাতে হবে, আহিল। অনেক পস্তাতে হবে। যদি না তুই সঠিক সিদ্ধান্ত না নেস।”

-চলবে…..

(সবাইকে কথার বিয়েতে নিমন্ত্রণ রইলো। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)