নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-৩০+৩১

0
5410

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_৩০||

দেখতে দেখতে কোন দিক দিয়ে একমাস চলে গেল বুঝতেই পারলাম না।
ইদানীং কোনোকিছুই তেমন ভালো লাগে না। শরীরটাও অসম্ভব মাত্রায় দূর্বল লাগে। খাবারের প্রতি কেমন জানি একটা বিতৃষ্ণা ভাব তৈরি হয়েছে। কিছু কিছু খাবারের গন্ধে তো গা গুলিয়ে বমি চলে আসে।

এসব ব্যাপারে কাউকে এখনো কিছু জানাইনি। সব দূর্বলতাকে সাইডে রেখে অফিস আর পড়াশুনা সমান গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

রাতে,,,,,,
–“ইদানীং তোমার শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। কী হয়েছে বলো তো?”

জয়ের এমন কথায় আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম,
—“আমার আবার কী হবে? আমার কিছুই হয়নি।”

জয় কিছুক্ষণ আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
—“কালকে আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবে। তুমি যে অসুস্থ, তা আমি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। ”

আমি বাঁধা দিয়ে বললাম,
—“আরে, আপনার আমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে না। এমনিতেই আমার শরীরটা শুধু একটু দুর্বল। ওটা কিছু দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।”

—“তবুও ডাক্তার দেখাতে হবে তোমায়। আর এটাই ফাইনাল।”

এর সাথে আর তর্ক করে লাভ নেই। কালকে আমায় ডাক্তারের কাছে নিয়েই তবে ছাড়বে। তবে আমি ওনাকে নিয়ে যাবো না। বরং একাই যাবো। আগে নিজে জেনে নেই যে, আমার ঠিক কী হয়েছে। পরে অবস্থা বুঝে সবাইকে জানানো যাবে।

আমি এতো কিছু ভাবনায় মশগুল, এমন সময় জয় আমার ভাবনায় বাঁ হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বললো,
—“কী হলো? আবার কোন দুনিয়ায় চলে গেলে?”

—“না, মানে, আমি বলছিলাম যে, কাল তো অফিসে অনেক কাজ। বিদেশ থেকে ক্লায়েন্ট আসবে। বাবা আর ভাইয়া তো আর একা একা সব কিছু সামলাতে পারবেনা। তাই, আমার মনে হয়, কালকে আপনি অফিসে যান। আমি না হয় নিজেই গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসবো।”

জয় কিছু একটা ভেবে বললো,
—“ওকে, তবে তোমাকে কিন্তু শিয়র যেতে হবে।”

—“আচ্ছা, বাবা, যাবো। খুশি এবার।”

—“খুশি, তবে আমি তোমার বাবা নই।”

—“ওটা তো এমনি কথার কথা। ”
____________

সকাল সকালই হসপিটালে এসেছি। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতে যাবো এমন সময়ই একটা ছেলে ও মেয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হওয়ার সময় আমার মুখোমুখি হয়ে যায়। ছেলেটার চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কোনো কারণে ক্ষেপে আছে। তবে মেয়েটাকে দেখে আমার কেমন যেন অন্য রকম লাগলো। আমার দিকে বেশ অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিল মেয়েটা। আচ্ছা, ও কি আমায় চিনে? কিন্তু আমি তো ওকে কখনো দেখিনি!

এসব ভাবতে ভাবতে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলাম। ডাক্তার সবকিছু শুনে মুখে একটা হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে বললেন,
—“আপনি এখনো বুঝতে পারেননি আপনার সমস্যা? হাও ক্যান বি ইট পসিবল?”

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম,
—“আমি বুঝবো মানে? আমি কীভাবে বুঝবো?”

ডাক্তার হতাশার সুরে বললেন,
—“আরে বোকা মেয়ে, আপনি মা হতে চলেছেন।”

এ কথা শুনে আমি হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে, আবার অনেক আনন্দ লাগছে। এটা আবার কেমন অনুভূতি?

ডাক্তার হালকা হেসে বললেন,
—“আচ্ছা শুনুন। আমি আপনার মুখের কথার ওপর ভিত্তি করে এট বললাম। তবে আপনার উচিত মেডিক্যাল টেস্ট করিয়ে তারপর নিশ্চিত হওয়া।”

—“হ্যাঁ, ডক্টর। আমি আজই সব টেস্ট করাতে প্রস্তুত। ”

—“ওকে। তাহলে আমি সব ব্যবস্থা করছি।”

টেস্ট করাতে করাতে দুপুর হয়ে গেছে। আজ নাকি রিপোর্ট নিতে হলে রাত হবে। তাও বাসায় চলে এলাম। কাল সকালে গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসলেই হবে। বাসায় কাউকে কিছু এখনো জানাইনি। একদম রিপোর্ট হাতে নিয়েই বলবো। দারুণ মজা হবে তখন!!

—“কী হলো? তুমি সেই তখন থেকে মিটিমিটি হাসছো কেন বলো তো? আজ আসার পর থেকেই তোমায় অনেক এক্সাইটেড লাগছে। ব্যাপার কী?”

জয় আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি থতমত খেয়ে গিয়ে বললাম,

—“আরে তেমন কিছু না। এমনি জাস্ট কিছু ফানি ফানি কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো।”

—“মিথ্যাটাও তো গুছিয়ে বলতে পারো না। তোমায় নিয়ে ভারী বিপদে আছি আমি। ”

আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম,
—“ম,,,মানে।”

—“কিছু না। এখন বলো, ডাক্তার আজ তোমায় দেখে কী বললো? এটা নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে বললে তোমার খবর আছে। ”

—“কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলবো না। টেস্ট করিয়েছে। কালকে রিপোর্ট দিলে জানা যাবে। তবে সিরিয়াস কিছু না।”

—“আচ্ছা তবে এখন ঘুমাও। এতো বেশী রাত জেগে কাজ নেই। এমনি অসুস্থ তুমি। ”

—“হুম। যথাআজ্ঞা, মহারাজ। ”
___________

কথা নিজের ব্যাগের ভেতর কিছু ফাইল ঢোকাতে ঢোকাতে আহিলের উদ্দেশ্যে বললো,
—“আমি লাঞ্চ টাইমে তোমার জন্য ওয়েট করবো কিন্তু! একদম আমাকে ছেড়ে একা একা খাবার খাওয়ার চিন্তা করবে না।”

আহিল নিজের শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বললো,
—“তোর কি আমাকে এতোটাই স্বার্থপর মনে হয়? এ কদিনে এক বেলাও তোকে ছাড়া খেয়েছি নাকি আমি?”

—“খাওনি, তবে খাবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?”

—“কী বললি?”

এমন সময়ই আহিলের ফোন বেজে ওঠে। ফোনের দিকে তাকাতেই আহিল নিজের হালকা শান্ত করে বেশ মনযোগী হয়ে কল রিসিভ করে বললো,
—“হ্যাঁ, বলো। কোনো ইম্পর্ট্যান্ট নিউজ আছে?”

—,,,,,,,,,,

—“হোয়াটটট, আর কিছু জেনেছো?”

—,,,,,,

—“ওকে, কিপ আপ ট্রায়াল।”

আহিল চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে বসে কপালে আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে লাগলো। কথা আহিলের পাশে বসে ওর কাধে হাত রেখে বললো,
—“কী হয়েছে? এনিথিং সিরিয়াস?”

—“হুম। এক নতুন বিপদের আভাস দেখতে পাচ্ছি। ”
______________

রিপোর্ট যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। আমার মধ্যে সত্যি সত্যি একটা নতুন অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে ভাবলেই মনটা আবেশে-আনন্দে ভরে ওঠে।

বাসায় এসে জয়ের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি।ওকেই সবার আগে এই গুড নিউজটা জানাবো। বাসার সবাই অনেক খুঁচিয়েছে, কী হয়েছে জানার জন্য? আমি কাউকেই বলিনি।
মশাই কখন আসবে কে জানে? প্রতিদিন তো বিকেলেই আসে। আজ এখনো কেন আসছে না?

অবশেষে সব অপেক্ষার প্রহরে ইতি টেনে জনাব বাসায় ফিরেছেন।

—“এতোক্ষণ লাগলো কেন আপনার? আমি সেই কখন থেকে ওয়েট করে বসে আছি। ”

জয় অবাক হয়ে বললো,
—“আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি না তো! তোমাকে তো আমি বাড়ি ফেরার পর ধারে কাছে পাই না। আর আজ তুমি আমার জন্য ওয়েট করছো?”

—“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওয়েট করছিলাম। আপনি এতো লেট কেন করলেন আজ?”

—“কোথায় লেট করলাম? আমি প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় ই বাড়ি ফিরি। আজও সেইম টাইমেই ফিরেছি। তুমি আমার জন্য ওয়েট করছিলে বলেই তোমার সময় এগুচ্ছিলো না।”

—“হ্যাঁ, আসলেই তো। ”

—“হুম, এখন বলুন ম্যাডাম, কিসের জন্য এতো তোড়জোড় আপনার।”

আমি খুশি হয়ে বললাম,
—“আপনি জানেন, আমরা,,,,, ”

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই মা এসে বললেন,
—“মুন, তোর সাথে একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে। অনেক দরকার বলছে। মনে হয়, কোনো ইমার্জেন্সি।”

—“আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। আচ্ছা মা, চলো। আর জয়, আমি এসে আপনার সাথে কথা বলছি।”

জয় আমায় আশ্বাস দিয়ে বললো,
—“আমিও আসছি। তুমি যাও।”
_________

আমি নিচে গিয়ে দেখলাম, কালকের হাসপাতালের সেই মেয়েটা। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো, তার আগেই কোত্থেকে যেন অদ্রি ভাবি ছুটে এসে বললো,

—“এই মেয়ে, তুমি তনিমা না? তুমি এ বাড়িতে ঢোকার সাহস পেলে কী করে? ”

-চলবে…….

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_৩১||

আমি তনিমার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। শুধু আমিই না; মা, বাবা, অদ্রি ভাবি, জায়েদ ভাইয়া, সবাই বেশ অবাক হয়ে গেছে।

আয়েশা রাগী স্বরে বললো,
—“ও, তার মানে তুমিই সেই জঘন্য মেয়েটা, যার জন্য আমার সুন্দর সংসারটা নষ্ট হতে যাচ্ছিলো। আজ আবার নতুন কোনো চাল চালার আগে দূর হও আমার বাড়ি থেকে। ”

তনিমা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—“আমি কোনো নতুন চক্রান্ত নিয়ে আসিনি বিশ্বাস করুন। আমার তো মুনের সাথে একটা কথা ছিল। আমি জাস্ট সেটা বলেই চলে যাবো।”

অদ্রি চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো,
—“কিসের কথা? এখানে কেউ তোমার ন্যাকামো শোনার জন্য বসে নেই। তুমি যে কতো বড়ো ধড়িবাজ মেয়ে, তা আমরা বেশ ভালোভাবেই জানি।”

—“কী হয়েছে, ভাবি? এতো চিৎকার-চেঁচামেঁচি,,,,,,”

তনিমার দিকে চোখ যেতেই জয়ের মুখ অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে গেল আর মুহূর্তেই চোখ দুটো রক্ত বর্ণ ধারণ করলো।

নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে জয় বললো,
—“তুমি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষার সাহস পেলে কোথা থেকে? তোমাকে পারমিশন দিলো কে বাড়িতে ঢোকার?”

তনিমা একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
—“আমি তোমার সাথে কোনো কথা বলতে আসিনি, জয়। আমি তো মুনের সাথে দেখা করতে এসেছি। আমার দরকারটা ওর সাথেই।”

জয় শক্ত গলায় বললো,
—“তোমার কোনো দরকার শোনার সময় এখানে কারো নেই। সুতরাং এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।”

অগত্যা তনিমা ছুটে এসে আমার পায়ের সামনে বসে পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—“প্লিজ মুন, হেল্প মি। তুমি ছাড়া আমায় আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না। তুমি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আমার যে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।”

সবাই যেন বেশ অবাক হয়েছে তনিমার কথায় শুধু জয় আর জায়েদ বাদে। কারণ ওরা স্বচক্ষে দেখেছে তনিমা আর নিবিড়ের কাহিনী। তাই এটা যে নতুন কোনো যড়যন্ত্র হবে না, এ ব্যাপারে প্রবল সন্দেহ আছে।

জয়ের তনিমার এমন কান্নাকাটি প্রচুর বিরক্তিকর লাগছে। জায়েদের দিকে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে তাকাতেই জায়েদ হাত দিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বললো। এখন ঝামেলা করলে পরবর্তীতে আরো গন্ডগোল হওয়ার চান্স আছে, এটাও বুঝিয়ে দিলো। অগত্যা জয়কে মুখ বন্ধ রাখতে হলো।

আমি দ্রুত তনিমাকে আমার পায়ের কাছ থেকে উঠিয়ে দাড় করিয়ে বললাম,
—“আরে, কী করছেন আপনি? এভাবে কারো পায়ে পড়া উচিত নয়। কী হয়েছে সেটা তো বলুন!”

তনিমা আমার হাতে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললো,
—“এটা পড়ে দেখো। তাহলেই বুঝতে পারবে।”

আমি ফাইলটা নিয়ে সেটা খুলে দেখলাম যে, এটা একটা মেডিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট। কিন্তু রিপোর্টের ভেতরের লেখাগুলো পড়ে আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে, মাথা ঝিমঝিম করছে আর পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে!

আমি ফাইলটা বন্ধ করে চোখ মুখ খিঁচে চিৎকার করে বললাম,
—“এসব মিথ্যে। আপনি মিথ্যে বলছেন। এমনটা হওয়া অসম্ভব। ”

তনিমা ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে বললো,
—“সত্যি না মিথ্যে, তা তো এই রিপোর্ট গুলোই বলে দিচ্ছে। আমি জানি, আমার মুখের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।”

অদ্রি পরিস্থিতি বোঝার জন্য ফাইলটা নিজের হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। মুহূর্তেই অদ্রির চক্ষু কপালে উঠে গেল। চোখ বড় বড় করে তনিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“এই রিপোর্ট কি রিয়েল নাকি ফেইক? তুমি কি সত্যি সত্যিই চার মাসের প্রেগন্যান্ট? তুমি জয়ের সন্তানের মা হতে চলেছো?”

এ কথা শুনে উপস্থিত সবার মাঝে যেন একটা বড়সড় বাজ পড়লো। সবাই অবাক চোখে জয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এমনটা কেউ কখনো কল্পনাও করেনি। কারোরই বিশ্বাস হচ্ছে না।

জয়ের সারা শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছে। রেগে কটমট করতে করতে রাগ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থ চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ। কিন্তু কোনোভাবেই নিজেকে কন্ট্রোল করা সম্ভব হচ্ছে না। এগিয়ে গিয়ে তনিমার দুই গালে ঝড়ের গতিতে দুটো চড় বসিয়ে দিল। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“তোর সাহস কী করে হয় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার। তোকে কোনোদিন ছুঁয়েও দেখিনি আমি। তুই একটা বিবাহিতা মেয়ে। সো, তোর গর্ভে সন্তান থাকলে সেটা তোর বরেরই।”

তনিমা নিজের গালে হাত দিয়ে বললো,
—“না, এটা নিবিড়ের সন্তান না। কারণ নিবিড় সন্তান জন্মদানে অক্ষম। এজন্য নিবিড় আমায় সন্দেহ করেছিলো বলেই আমরা গতদিন মেডিক্যাল টেস্ট করিয়েছিলাম। মুনের সাথে আমার কালকে হাসপাতালে দেখা হয়েছিলো। জিজ্ঞেস করো ওকে?”

আমি এতোক্ষণ নীরব দর্শকের মতে সব দেখছিলাম। সবাই এখন আমার দিকে আমার উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। আমার মাথা দিয়ে এখন হাজারো কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। তাও কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
—“হ্যাঁ, আপনাকে আর আপনার সাথে একটা ছেলেকে দেখেছিলাম আমি। ওটাই মনে হয় আপনার হাজবেন্ড ছিল। ওনি আপনার ওপর কোনো একটা কারণে অনেক রেগে ছিল মনে হয়।”

তনিমা কেঁদে কেঁদে বললো,
—“হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই রিপোর্ট দেখার পর থেকে ও আর আমার সাথে সম্পর্ক রাখেনি। আমাকে ওর বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এখন আমি কী করবো?”

অবশেষে জাহিদ কাঠকাঠ গলায় বললো,
—“ছিঃ, ছিঃ, শেষ পর্যন্ত এইদিন দেখাও বাকি ছিলো আমার। আমি কি তাহলে আমার সন্তানদের ঠিকভাবে মানুষ করতে পারিনি? আজ নিজের ছেলের কুকীর্তি সহ্য করতে হচ্ছে। ”

আয়েশা প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠলো,
—“তোমার কি মনে হয় যে, জয় এমন একটা কাজ করতে পারে? আমার এটা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। ”

জাহিদ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
—“বিশ্বাস না হওয়ার কী আছে? সবদিক থেকেই তোমার ছেলে অপরাধী প্রমাণিত হয়। ওর এই মেয়েটার সাথে তিন বছরের সম্পর্ক ছিল। এটা অস্বাভাবিক কিছুই না। নিজের সন্তানকে বিশ্বাস করা ভালো, কিন্তু অন্ধবিশ্বাস করা ঠিক না, আয়েশা। এ দিন দেখার আগে আমার মৃত্যু কেন হলো না?”
বলেই গটগট করে হেঁটে উপরে চলে গেল।

তনিমা আমার হাত ধরে মিনতি করতে করতে বললো,
—“মুন, তুমি তো বুঝতে পারছো আমার অবস্থা! আমি না হয় খারাপ মেয়ে। আমার বলা কথা গুলো না হয় মিথ্যে। কিন্তু এই কাগজ গুলোকে তুমি কোনো ভাবেই মিথ্যে প্রমানিত করতে পারবে না। আমি,,,,,,”

তনিমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি চলে এলাম।

পুরো ড্রয়িং রুমে সুনশান নিস্তব্ধতা। অদ্রি এতোক্ষণ গলা উঁচিয়ে এটা-সেটা বললেও এখন মুখে তালা মেরে বসে আছে। বলার মতো কিছু খুঁজেও পাচ্ছে। একদিক দিয়ে মনে হচ্ছে সব মিথ্যে, আবার অন্য দিক দিয়ে মনে হচ্ছে এই কাগজ গুলো কীভাবে মিথ্যে হয়? তার ওপর তনিমার ফিজিক্যাল কন্ডিশন দেখে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, ও প্রেগন্যান্ট। দোটানায় পড়ে চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে অদ্রি!

এদিকে জায়েদ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে এটা বুঝেছে যে, সবকিছু একটা বেশ নিখুঁত ষড়যন্ত্র হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে এখন খুব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

—“ভাইয়া, ড্রাইভার কাকাকে একটু ডেকে দেও তো! এমনি রাত হয়ে গেছে। এসময়ে একা যাবো না।”
বলতে বলতে লাগেজ টেনে নিচে নামলাম।

আমাকে এভাবে কোথাও যেতে দেখে জয় পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললো,

—“কোথায় যাচ্ছো তুমি? তোমারও কি আমায় বিশ্বাস হয় না যে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছো?”

আমি ছলছল চোখে জয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—“এতো কিছু দেখার পর, শোনার পর আমায় কীভাবে বলছেন এখনো আপনাকে বিশ্বাস করতে? সবদিক থেকে যা প্রমাণিত হয়, আমাকে তো সেটাই বিশ্বাস করতে হবে।”
বলেই জয়ের পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।

হঠাৎ পিছন থেকে একটা ছোট বাচ্চা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি কান্নার শব্দ অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম জুনায়েদ তার ছোট ছোট হাত দিয়ে বারবার চোখ মুছছে, আর নাক টেনে টেনে কাঁদছে।
আমি ওর কাছে গিয়ে হাটু মুড়ে বসে বললাম,
—“এ কী, তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? ”

—“তুমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছো, তাই না ছোট মাম্মাম? আর কখনো আমাদের কাছে আসবে না?”

—“কে বলেছে আসবো না? তোমাকে ছাড়া আমি থাকতেই পারবো না। ”

—“সত্যি আসবে? প্রমিস তো?”

—“হুম, প্রমিস।”
বলেই দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে এলাম। এ বাড়িতে আমার আবার আসা হবে, সেটা যেন অতি শীঘ্রই হয় এটাই শুধু চাওয়া।

জয় বাঁধা দিতে গিয়েও দেয়নি। চোখের কোণে পানি জমে চিকচিক করছে। নিজের ভেতরেও ভীষণ রকমের তোলপাড় অনুভূত হচ্ছে।

গাড়িতে বসে রাতের প্রকৃতি দেখছি। কিন্তু কেন যেন এই স্নিগ্ধ হাওয়াও আজ নিজের কাছে বিষের মতো লাগছে! আমার মনে হয়, আপনি নির্দোষ, জয়। যদি সত্যিই নির্দোষ হয়ে থাকেন, তাহলে আমায় ক্ষমা করে দিবেন। মূলত সবকিছুর আড়ালে অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে, যার উত্তর পাবো একটা জায়গায়তেই। আর সেখান থেকে যদি জানতে পারি যে, এটাও নিবিড় আর তনিমার একটা ষড়যন্ত্র ছিল, তাহলে যে ওদের সাথে কী হবে, তা ওরা কল্পনাও করতে পারবে না।

-চলবে…….