#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_৩২||
রাতের বেলা একা একা বাড়ি এসেছি বলে বাবা-মা দুজনেই বেশ অবাক হয়েছে। মা কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বললো,
—“কী ব্যাপার? তুই রাতের বেলা একা কেন এ বাড়িতে এসেছিস? জামাই আসেনি?”
আমি জানতাম, আমায় এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু এটার কোনো উত্তর তো আমার কাছে নেই!
আমতা আমতা করে বললাম,
—“আসলে, আমি একটা কাজের জন্য এসেছি। আমায় এক্ষুনি একটু বের হতে হবে। ইট’স ভেরি আর্জেন্ট!”
বাবা ব্যস্ত হয়ে বললো,
—“আবার কেন বের হবি? এসেছিস যখন, কয়েকদিন এখানে থাকবি কিন্তু! একটা মাত্র মা আমার তুই। তোকে ছাড়া থাকতে অনেক কষ্ট হয়।”
মাও বাবার সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
—“থাকবে তো বটেই! জিনিসপত্র যখন গুছিয়ে এনেছে, তখন আর এতো তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে যেতে দিচ্ছি না।”
জিনিসপত্র গুলো যদি তুমি দেখতে মা! শুধু আমার সার্টিফিকেটস আর দরকারী কাগজপত্র ছাড়া এই লাগেজের ভেতর আর কিছুই নেই। ওই বাড়ি থেকে কিছুই আনিনি আমি।
মুখে মলিন হাসি ফুটিয়ে বললাম,
—“যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তাহলে আমি এখানে কিছুদিন থাকবো। এখন আমায় যেতে হবে।”
বলেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। বেশি রাত হয়ে গেলে আবার যদি ঐ ডক্টরটাকে পাওয়া না যায়।
একটা সিএনজি নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে সোজা ডক্টরের চেম্বারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম, যার চেম্বার থেকে কাল তনিমাকে বের হতে দেখেছিলাম। চেম্বারে ঢুকতেই দেখলাম, ডক্টর সাহেবা এখনো এখানেই আছেন। আমাকে দেখে হালকা পুলকিত চাহনীতে তাকিয়ে বললেন,
—“আরে, তুমি তো গতকাল এখান থেকে চেক-আপ করিয়ে গেলে! আজ রাতে এলে যে? কোনো সমস্যা হয়নি তো!”
—“না, ডক্টর। আমার কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু আমার আপনার কাছ থেকে কিছু হেল্প দরকার। যদি কিছু ইনফরমেশন দিয়ে আমায় সাহায্য করতেন, তাহলে আমার বেশ উপকার হতো!”
—“কী ইনফরমেশন লাগবে? যদি আমি জেনে থাকি, তাহলে অবশ্যই তোমায় দিবো।”
—“একটা কাপলের ব্যাপারে। গতকাল আমি আপনার চেম্বারে ঢোকার আগে তনিমা নামের একটা মেয়ে তার হাসবেন্ডকে নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলো। তাদের ব্যাপারে আমায় একটু বলুন।”
ডক্টর একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
—“বলবো, কিন্তু এটা হাসপাতালপর রুলসের বাইরে চলে যায়। তাই আমি যে তোমাকে জানিয়েছি এটা কাউকে বলতে পারবে না।”
—“আচ্ছা, আমি কাউকে কিছু বলবো না। আমার নিজের সবটা জানাটাই জরুরি এখন।”
—“ওকে, তাহলে শুনো। কালকে মিসেস তনিমাকে মূলত তার হাসবেন্ড নিবিড় শিকদার জোর করে এই হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলো। এর আগের দিন তনিমার মেডিক্যাল টেস্টে ধরা পড়ে যে, ও প্রায় চার মাসের প্রেগন্যান্ট। এতো দেরী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তনিমা বলেছিলো যে, ও আগেই বুঝেছিলো, কিন্তু ও আর ওর হাসবেন্ড নাকি দেড় মাসের মতো সময় জেলে ছিলো। তাই কিছু করতে পারেনি। তারপর যখন তনিমা নিবিড় শিকদারকে রিপোর্ট দেখায়, তখন নিবিড় জানায় যে, ঐ সন্তান তার না। কারণ নিবিড় আগে থেকেই জানতো যে, ও কখনো বাবা হতে পারবে না। পুরো ঘটনা আমার চেম্বারেই ঘটেছিলো। পরে আমি বাধ্য হয়ে তনিমার আরো কিছু টেস্ট করাই, যাতে ওর বেবিরও অথেনটিকেশন টেস্ট ইনক্লিউডেড ছিলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো নিবিড়ের সাথে বেবির পিতৃত্বের সম্পর্ক আমি মিলাতে পারিনি। ”
আমি অবাক হয়ে হতচকিত স্বরে বললাম,
—“কী?”
—“হ্যাঁ, এরপর আমি নিবিড় শিকদারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওনি কারো ওপর সন্দেহ করেন কিনা বা তার স্ত্রীর সাথে অন্য কারো সম্পর্ক ছিল কিনা? নিবিড় আমায় জয় মাহমুদ নামের একজনের কথা বলেছিলেন, যার কমপ্লিট চেক-আপ এর রিপোর্টের সফট কপি আমাদের কাছে ছিলো। কেননা জয় মাহমুদ আর তার ফ্যামিলি প্রতি বছর এই হাসপাতাল থেকেই তার কমপ্লিট চেক-আপ করায়। আমি প্রথমে বপশ অবাক হয়েছিলাম। পরবর্তীতে সবকিছু জাস্টিফাই করতে গিয়ে আমি আরো বেশি অবাক হয়েছি। কেননা তনিমার গর্ভে বেড়ে ওঠা ভ্রুণের জিনের সাথে জয় মাহমুদের জিনের ৭৫-৭৭% মিল আছে, তাছাড়া জয়ের মিউকাস ঝিল্লির গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর আমাকে এটাই ডিসিশন নিতে হয়েছিল যে, তনিমার সন্তানের বাবা জয় মাহমুদ-ই।”
আমি পাথরের মতো তাকিয়ে আছি। তার মানে, সবকিছুই সত্যি ছিলো। কিন্তু আমার কেন বিশ্বাস হচ্ছে না। হঠাৎ ডাক্তার বলে উঠলো,
—“কী হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন? ”
আমি কাঁদছি? গালে হাত দিতেই ভেজা ভেজা অনুভূত হওয়ায় বুঝলাম, আমার চোখ দিয়ে আপনা-আপনিই পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। আমি চোখ মুছে বললাম,
—“না, তেমন কিছু না। আচ্ছা, আপনি কি আমায় জয় এবং তনিমার রিপোর্টটা আলাদাভাবে দিতে পারবেন। আমি একবার মিলিয়ে দেখতে চাই। ”
—“হ্যাঁ, কেন নয়। তবে শুধু দেখতেই পারবে। আমি তোমায় দিয়ে দিতে পারবো না। বুঝতেই তো পারছো, অন্য পেশেন্টের ইনফরমেশন দেওয়াটা রুলসের বাইরে। ”
—“লাগবে না। আমি শুধু নিজের চোখে দেখতে চাই। ”
ডক্টর নিজের কম্পিউটারে রিপোর্টের কপি খুঁজে বের করে তা প্রিন্ট করে আমার হাতে দিলেন। আমি সব মিলিয়ে দেখতে গিয়ে দেখলাম, আসলেই তনিমার বেবির সাথে জয়ের জিনের অনেক বেশি মিল যা কেবল পিতা এবং সন্তানের ক্ষেত্রেই সম্ভব। আর দেখা সম্ভব নয়। আমি ডক্টরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।
রাতের ব্যস্ত রাস্তায় এলোমেলো পায়ে হেটে চলেছি আমি। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়েই চলেছে। পানি মুছতেও ইচ্ছে করছে না। আমার সাথেই সবসময় এমনটা হয়। কিন্তু কেন হয়? কাউকে বিশ্বাস করাটাই কি আমার অপরাধ? আমি সত্যিই অনেক বোকা! জয়ের সাথে তনিমার এতো বছরের রিলেশন ছিল। জয় যতোই বলুক না কেন, ওরা ইন্টিমেট না হওয়াটা অনেকটাই অস্বাভাবিক।
আজ মিথ্যে হয়ে গেছে আমার বিশ্বাস, আমার এতোদিনের অতি যত্নে গড়ে তোলা অনুভূতি। ভেতরে ভেতরে মরে গেছে আমার অস্তিত্ব। কিন্তু আমাকে বাঁচতে হবে। শুধু মাত্র আমার অনাগত সন্তানটার জন্য বেঁচে থাকতে হবে। ওর জীবনে কাউকে আসতে দিবো না আমি। কারো ছায়াও পরতে দিবো না। কোনো আঁচড় লাগতে দিবো না। কিন্তু তার জন্য আমার একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাসায় পৌঁছে জায়েদ ভাইয়াকে ফোন দিলাম। ভাইয়া ফোন রিসিভ করে বললো,
—“কী রে, তুই ঠিক মতো পৌঁছেছিস তো! আর বাড়ি ছেড়ে কেন চলে গেলি?”
আমি ভাঙা গলায় বললাম,
—“বাদ দাও তো ওসব কথা! তোমায় একটা রিকোয়েস্ট করার জন্য ফোন দিয়েছি, ভাইয়া।”
—“কী রিকোয়েস্ট? এমন করে কথা বলছিস কেন? ”
—“এটাই যে, আমার বাবা-মাকে একটু দেখে রেখো। জানোই তো, ওনাদের আমি ছাড়া আর আপন বলতে কেউ নেই।”
—“কী যা তা বলছিস? তুই তো আছিসই! আমাকে কেন দেখতে হবে?”
—“তোমাকেই দেখতে হবে। আমার বাবা-মা আজ থেকে তোমার দায়িত্বে। দেখে রেখো তাদের। রাখছি।”
বলেই ফোন কেটে সিম কার্ডটা খুলে ভেঙে ফেললাম। কালকে ভোরের আলো ফুটবার সাথে সাথে শুরু হতে চলেছে আমার জীবনের নতুন প্রহর। আমাকে শক্ত হতে হবে। কিন্তু আজ আমি কাঁদবো! শুধুমাত্র আজকের রাতটার জন্য আমি কাঁদবো। নইলে দম বন্ধ হয়ে আসবে আমার।
___________
জয় রুমের ভেতর ফ্লোরের উপর এলোমেলোভাবে বসে আছে। তার জীবনের ওপর দিয়ে এটা কেমন ঝড় বয়ে চলেছে, বুঝে উঠতে পারছে না সে। সব কিছু পেয়েও আবার হারিয়ে ফেলার মতো ফিলিং আসছে। কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতেই পারলো না! সত্যিই সবার কপালে সুখ সয় না। কিন্তু তার সুখ নষ্ট হওয়ার জন্য মুলত সে নিজেই দায়ী! দোষ তো তারই!
হঠাৎ কাধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ তুলে তাকালো জয়।
-চলবে…….
#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_৩৩||
হঠাৎ কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে তাকালো জয়। সামনে দাড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটাকে দেখে মুহূর্তেই মাথায় রক্ত উঠে গেল। আজ তার দুরবস্থার জন্য এই মেয়েটাই দায়ী। ওকে নিজের জীবনের সাথে জড়ানোটাই ছিলো জয়ের সবচেয়ে বড় দোষ।
জয় চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তনিমার চুলের মুঠি ধরে বললো,
—“কেন করলি এমনটা? আমার জীবনে আসার সাথে সাথে আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়া শুরু করেছিস! নির্লজ্জ, দুশ্চরিত্র মেয়ে একটা!!”
তনিমা ব্যথায় গুঙিয়ে উঠে বললো,
—“জয়, ছাড়ো আমায়। আমার লাগছে!”
—“লাগুক। মরে যেতে পারলি না তুই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে অপবাদ দেওয়ার আগে। আমার ভেতরটায় কতোটা পুড়ছে, তা শুধু আমিই জানি!”
তনিমা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে জয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
—“তুমি অস্বীকার কেন করছো আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। এটা তোমার আর আমার সন্তান। কেন মানতে চাইছো না?”
জয় পুরো ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
—“জাস্ট শাট আপ। আর কতো নাটক করবি, হে? তোকে কোনোদিন টাচও করিনি আমি! কী ভেবেছিস আমি কিছু বুঝিনা? নতুন চাল নিয়ে হাজির হয়েছিস তুই আর নিবিড়, সেটা আমি বেশ ভালো ভাবেই জানি।”
মুহূর্তেই তনিমার মুখশ্রীর হাবভাব পরিবর্তন হয়ে গেল আর তাতে ফুটে উঠলো একরাশ বিজয়ের পৈশাচিক আনন্দ। কন্ঠে জোর এনে বললো,
—“বাহ্, তোমার বুদ্ধি তো বেশ বেড়েছে দেখছি। তা এর ফুল ক্রেডিট কি মুনের নাকি? তোমার মতো বোকাসোকা ছেলেটাকে এভাবে লাইনে এনে ফেললো! ”
জয় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বললো,
—“তার মানে সত্যিই সবটা তোমাদের চক্রান্ত। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ! তোমায় দেখে আজ আমার ঘেন্না হয়। কেন যে এসেছিলে আমার জীবনটা নরক করে তোলার জন্য? ”
তনিমা তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললো,
—“এসেছি নরক বানানোর জন্য, তোমাকে ধ্বংস করতে দেওয়ার জন্য। সেটা করেই আমি চলে যাবো।”
—“তাহলে তোমার বাচ্চাটা নিবিড়েরই। মিথ্যে বলেছো সবাইকে আমায় নিয়ে। ”
—“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেছি। নয়তো আমার উদ্দেশ্য অর্জন হতো না। আজ তুমি সবার কাছে অপরাধী। নিজের পরিবার তো সহজেই তোমায় ভুল বুঝলো, কিন্তু তোমার বউ বুদ্ধি খাটিয়ে আসল খবর বের করতে গিয়েছিলো। তবে হিতে বিপরীত হয়ে গেল। এখন সে-ও তোমায় ভুল বুঝবে। অবিশ্বাস করবে তোমায়।”
—“মানে!!!”
—“মানেটা তো খুবই সহজ! তোমার বউ আসল সত্যিটা জানার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে কী জেনে এসেছে জানো? তুমি সত্যিই আমার সন্তানের বাবা। প্ল্যানটা দারুণ ছিল, তাই না? ধ্বংস করে দিয়েছি তোমাকে জয়। শেষ হয়ে যাবে তুমি।”
জয় এ কথা শুনে প্রচন্ড রেগে গেল। তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে, কপালের রগ ফুলে উঠছে। হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
—“বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে। তোর মতো নোংরা মেয়ের এখানে থাকা মানায় না। যে নিজের সতীত্বে কালি লাগাতেও দ্বিতীয়বার ভাবে না, শুধু মাত্র নিজের স্বার্থের জন্য, তার চেয়ে জঘন্য মেয়ে আর কে হতে পারে? বের হ।”
বলেই তনিমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দরজা লাগিয়ে দিলো জয়। তনিমা মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। আসলে ধাক্কাটা জয় এমনভাবেই দিয়েছিল, যাতে তনিমা মাটিতে না পড়ে। তনিমা রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বসার ঘরে গিয়ে বসে রইলো। আজ তাকে এ বাড়ির প্রতিটা মানুষের ওপর নজর রাখতে হবে। বলা তো যায় না, গতবারের মতো এবারও যদি প্ল্যান টা ভেস্তে যায়!
এদিকে জয় ঘরের দরজা লাগিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। কিছুক্ষণ পর দরজা হালকা ফাঁক করে দেখলো, তনিমা এখনো আছে নাকি। না, নেই। জয় আবার দরজা লক করে জানালার পর্দার পেছন থেকে ক্যামেরাটা বের করলো। কিছুক্ষণ আগের রেকর্ডেড ভিডিওটা প্লে করতেই দেখলো, তনিমা বলা কথাগুলো বেশ ভালো ভাবেই ভিডিওতে দেখা ও শোনা যাচ্ছে। এটাই তো চেয়েছিলো সে। প্রমাণ তো এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। ফাইনালি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবে এটা ভেবেই জয় তৃপ্তির হাসি দিলো।
____________
জায়েদ আর অদ্রি অনেকক্ষণ যাবৎ আহিলের নাম্বারে কল দিচ্ছে। কিন্তু বারবারই আনরিচেবেল বলছে। ওরা এখন কীভাবে কী করবে কিছু বুঝতে পারছে না। বাড়ি থেকে বের হওয়ারও কোনো উপায় নেই। তনিমা সাপের মতো ফোসফাস করে সবার ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে, যাতে কেউ কোথাও বেরুতে না পারে। এভাবে সবাইকে বাড়িতে রেখে ওর লাভ কোথায় সেটাই কেউ বুঝতে পারছে না।
ভোর হতে আরো আধঘন্টার মতো বাকি।
হঠাৎ করেই জায়েদের ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো আহিল কল দিয়েছে। জায়েদ আর কালবিলম্ব না করে দ্রুত ফোন রিসিভ করলো।
আহিল ক্লান্ত স্বরে বললো,
—“কী খবর, ভাইয়া? এতো রাতে এতো গুলো কল দিলে যে! আমি তো নেটওয়ার্ক এরিয়ার বাইরে ছিলাম। এখন নেটওয়ার্ক পাওয়ার পর মেসেজ নোটিফিকেশন এলো। কী হয়েছে? ”
—“অনেক বড় ঝামেলা হয়ে গেছে। ”
বলেই আহিলকে সবকিছু খুলে বললো জায়েদ।
—“এমনটা হওয়ারই ছিল। কিন্তু এতোটাও যে কমপ্লেক্স একটা গন্ডগোল পাকাবে, ভাবতেই পারিনি। এই নিবিড়-তনিমা কী খায়? যাই হোক, ফিহু কোথায় এখন?”
—“জানি না, কিছুক্ষণ আগে আমায় কল দিয়ে বললো, ওর বাবা মায়ের খেয়াল রাখতে আর এসব ব্যাপার যেন ওর পরিবার কিছু না জানতে পারে।”
—“হোয়াটটট?? যা সর্বনাশ হওয়ার ছিল, তা হয়ে গেল বলে! আচ্ছা এখন রাখো। আমি দেখছি ব্যাপারটা।”
বলেই ফোন কেটে নিজের গাড়ি নিয়ে ছুট লাগালো আহিল। কিন্তু যে লম্বা রাস্তা কমসেকম দুই ঘন্টা লাগবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলো, শর্টকাট রাস্তায় যাওয়ার। যদিও এটা একটু রিস্কি হয়ে যায়। কারন এতো রাতে রাস্তা পুরোটা ফাঁকা থাকবে, তার ওপর রাস্তার অবস্থাও ভালো না। কিন্তু কোনো উপায় নেই। এই রাস্তা ধরে গেলে একঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যেতে পারবে আহিল।
____________
ফজরের আযানের ধ্বনি কানে আসতেই আমি ওজু করে নামাজ পড়ে নিলাম। নামাজ শেষে দু-হাত তোলার পর থেকে কোনো কিছু চাইতে পারছিলাম না। চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ছে। এতো কষ্ট আমি আমার জীবনে কোনোদিন পাইনি। তবুও শুধু আল্লাহর দরবারে একটা দোয়াই চাইলাম, তিনি যেন আমায় সব প্রতিকূলতায় সাহায্য করেন। আমার অনাগত সন্তানের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
ভোরের আলো এখনো ফোটেনি। আমি দ্রুত একটা ব্যাগে আমার দরকারী সকল কাগজপত্র, ল্যাপটপ আর কিছু কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিলাম। ঘর থেকে বের হয়ে বাবামায়ের ঘরের দরজা একটু ফাঁক করে তাদের মুখটা শেষবারের মতো দেখলাম। বেশিক্ষণ দেরী না করে দ্রুত চোখ মুছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।
ভোর হতে না হতেই আহিল মুনের বাড়িতে এলো। বাসায় এসে কলিং বেল বাজাতে গেলে বেশ অবাক হলো। কারণ দরজা লক করা না, বরং খোলা। আহিল দ্রুত পা চালিয়ে ভেতরে ঢুকে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে চিৎকার করতে লাগলো। মুনের মা শোয়া থেকে উঠে এলো। মুনের বাবা উঠেনি, কারণ তিনি কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমান। আপাতত তার ঘুম ভাঙবে না।
মুনের মা আহিলকে দেখে খুশিও হলো, আবার অবাকও হলো। কারন এতো সকালে এখানে আসার মানে কী? তিনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন, তার আগেই আহিল উত্তেজিত হয়ে বললো,
—“মনি, ফিহু কোথায়? ওকে ডাকো তাড়াতাড়ি! ”
—“ফিহু তো ওর ঘরেই আছে! আমি ডাকছি।”
বলেই রুমে গিয়ে দেখলো পুরো ঘর ফাঁকা।
আহিল হতাশার সুরে বললো,
—“নেই, নেই। ও বাড়িতে নেই। আমি আটকাতে পারলাম না ওকে। বাট ওকে আমি দূরে যেতে দিবো না।”
বলেই ছুটে বেরিয়ে গেল আহিল।
এদিকে মুনের মা কিছু না বুঝলেও এটা ঠিকই বুঝেছে যে, তার মেয়ে এখন কোথায় গেছে তা কেউ জানে না! ভাবতেই তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠলো।
______________
আহিল জয়দের বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো, তনিমা সোফায় আরাম করে বসে আছে। চোখে হালকা ঘুমের আবেশ থাকলেও নজরটা বেশ সচেতন। আহিলের তনিমাকে দেখার সাথে সাথে প্রচুর রাগ উঠছে। কিন্তু না, এখন সে রাগ দেখাবে না। একটু খেল দেখাবে।
আহিল মুখে নকল হাসি টেনে তনিমাকে বললো,
—“কী খবর, মিসেস নিবিড় শিকদার। জেল থেকে ফিরে তো বেশ জম্পেশ আছেন দেখছি।”
তনিমা আহিলকে দেখে বিরক্ত হলেও তা মুখে প্রকাশ করলো না। মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
—“তা আবার বলতে! তবে আমি একমাস যাবৎ জেলের বাইরে আছি।”
আহিল না জানার ভান করে বললো,
—“ও, তাই নাকি। আমি তো জানতাম না। তবে আমার একটা বিষয়ে অনেক কৌতুহল বোধ হয়। ”
—“কী বিষয়? ”
—“আচ্ছা, আপনি আর নিবিড় কি আমাদের মতো ভাত খান, নাকি চাল খান। আমার তো মনে হয় না, আপনারা আমাদের মতো ভাত খান। তাহলে আপনাদের মাথায় এতো প্যাচ আসতো না।”
–চলবে……