নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-৩৬+৩৭

0
5313

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_৩৬||

ভোর হতে না হতেই ঘুম ভেঙে যায় মালিশার। হঠাৎ করে এভাবে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। তাই কিছুক্ষণ মাথা চেপে ধরে বসে রইলো কিন্তু পাশ ফিরে তাকাতেই নিজের পাশের বালিশটা খালি দেখতে পেল সে। অগত্যা কোনো কিনা না ভেবেই ছুট লাগালো দরজার বাইরে।

বাড়ির দোতলায় সারা বারান্দা জুড়ে ঘুরছে মালিশা আর চিৎকার দিয়ে বলছে,
—জ্যোতি! জ্যোতি! মাই লিটেল ডল! মাম্মাম তোমাকে খুঁজছে। কোথায় তুমি? আমার কাছে এসো তাড়াতাড়ি।

মালিশার চিৎকার শুনে ধরফরিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে বসে পড়লো মিরাজ। এ বাড়ির সবার রুম সাউন্ড প্রুফ হলেও মিরাজ নিজের রুমটা সাউন্ড প্রুফ করেনি শুধু মাত্র মালিশার জন্য।

ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে বাইরে এসে দেখলো, মালিশা সারা বারান্দা জুড়ে ঘুরছে আর জ্যোতি জ্যোতি বলে চিৎকার করছে। মিরাজের কাছাকাছি আসতেই ও মালিশার হাত ধরে আটকে দিয়ে বললো,
—এসব কী আপুমনি, হে? এভাবে বাড়িময় ছুটোছুটি করছিস কেন? কালরাতো তুই অসুস্থ ছিলি, এখনো অসুস্থ। এই অসুস্থ শরীরে এতো এনার্জি কোত্থেকে পাস তুই? ”

মালিশা মিরাজের কথায় পরোয়া না করে বলে উঠলো,
—জ্যোতি! আমাকে জ্যোতির কাছে নিয়ে চল,মিরাজ। ও কোথায়?

—আছে, মায়ের ঘরে ঘুমাচ্ছে। তুই কাল রাতে যে টর্নেডো তুলেছিলি, তাই ওকে নিয়ে মা নিজের রুমে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।

মালিশা আর এক মুহুর্ত দেরী না করে দ্রুত মালিহার ঘরে চলে গেল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলো, তার ছোট্ট পরী নানুমনির সাথে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। মালিশা নিজের মেয়ের কাছে গিয়ে ওর মুখের দিকে তাকাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। কী নিষ্পাপ লাগছে জ্যোতিকে! এই মেয়েটাই যে তার প্রাণ! ওর জন্যই তার বেঁচে থাকা। নিজের সেই অতীতের কথা মনে পড়লে তো আজও বাঁচতে ইচ্ছে হয় না। শুধু মাত্র জ্যোতির জন্যই তার বেঁচে থাকা।

মালিশা আর কিছু না ভেবে জ্যোতিকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের রুমে এনে শুইয়ে দিল। সাথে নিজেও তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল।
___________

সকাল সকাল জয়কে ডাইনিং রুমে এসে খেতে বসতে দেখে সবার চোখ কপালে।

অদ্রি জায়েদের কানে ফিসফিস করে বললো,
—জায়েদ, পাঁচ বছর পর কি আজ সূর্য পশ্চিম দিকে উঠে পূর্ব দিকে অস্ত যাবে?

—তুমি চুপ থাকো তো! ছেলেটা যখন ধীরে ধীরে ঠিক হচ্ছে, তাহলে ওকে ঠিক হতে দাও না। অযথা এখানে কমেডি করে কোনো কিছু বিগড়ে দিও না।
অদ্রি ভেংচি কেটে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।

—কেউ কি আমাকে খেতে দিবে নাকি না খেয়েই অফিসে চলে যাবো?

জয়ের কঠিন সুর শুনে আয়েশা তাড়াহুড়ো করে বললো,
—দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি।

জায়েদ খেতে খেতে বললো,
—আমাদের হাতে একটা নিউ প্রজেক্ট এসেছে, জয়। একসাথে অনেক কাজ সামলাতে সামলাতে আমি ক্লান্ত। তুই কি নতুন প্রজেক্টের দায়িত্ব নিতে পারবি?

জয় সম্মতি জানিয়ে বললো,
—আচ্ছা, সমস্যা নেই। আমি এখন থেকে রেগুলার অফিসে যাবো।
বলেই উঠে চলে গেল।

সবার মুখেই প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। যাক, ছেলেটা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে-এটাই তাদের প্রত্যাশা।
____________

—গুড মর্নিং, মাই ডিয়ার পেশেন্ট!! মে আই কাম ইন।

সকাল সকাল নিজের কেবিনে বসে বসে কাজ করছিল মালিশা। হঠাৎ করে এমন উদ্ভট কথা শুনে সামনে তাকিয়ে দেখলো, ডক্টর নিখিল মুখে হাসির রেখা টেনে দাঁড়িয়ে আছে। মালিশা বিরক্তি ফিল নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
—এসে গেছে। এখনি শুরু করে দিবে।

—কিছু বললে?

—না, কী বলবো? আপনি এই সকাল বেলা আমার অফিসে কেন?

নিখিল কেবিনে ঢুকে চেয়ার টেনে বসে বললো,
—দেখতে এলান আমার জান…… না মানে পেশেন্ট কেমন আছে? কাল রাতে তো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে!

মালিশা দাতে দাত চেপে বললো
—আপনার সব পেশেন্টকেই কি সকাল বেলা দেখতে যান? ব্যাপারটা একটু বেশিই উইয়ার্ড লাগে না?

নিখিল থতমত খেয়ে বললো
—-না, মানে। আমি তো জাস্ট……

মালিশা হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললো
—জাস্ট শাট আপ। আপনি আমার ডক্টর, ডক্টরের মতোই থাকবেন আশা করি। আমার একটা মেয়েও আছে। ইভেন, আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানেন আপনি। সো, নেক্সট টাইম নিজের লিমিট ক্রস করার কথা ভাববেন। তা নাহলে আমি আমার লিমিট ক্রস লরতে বাধ্য হবো। আর আমি যে কতোটা ভয়ংকর হতে পারি, সেটা আপনার কল্পনারও বাইরে!

বলেই রহস্যময় হাসি দিলো মালিশা আর চেয়ারে ভালো করে হেলান দিয়ে বসে নিজের হাতের রিভলবারটা ঘুরাতে লাগলো।

নিখিল আর কথা বাড়ালো না, উঠে চলে এলো। সে ভালো ভাবেই জানে, এই মেয়ের সাথে কথা বলে লাভ নেই। ওর ওপর কোনো বিশ্বাসও নেই। কখন আবার গুলি চালিয়ে বসে।

নিখিল চলে যাওয়ার পরেই মালিশা নিজের ম্যানেজারকে নিজের কেবিনে ডাকলো। ম্যানেজারের দিকে খুব শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—হাও ইজ দ্য ইনফরমেশন অফ মাই কোম্পানি গোয়িং টু এনাদার কোম্পানি?

ম্যানেজার ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে বললো,
—ম্যাম, আই ডোন্ট নো।

বলার সাথে সাথেই মালিশা ম্যানেজারের কপাল বরাবর গুলি চালিয়ে দিলো। লোকটার দেহ মুহূর্তেই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো।

মালিশা লোকটার মৃতদেহের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
—আমি সবকিছু সহ্য করতে পারি, তবে প্রতারণা সহ্য করতে পারি না। তুই যদি বিশ্বাসঘাতকতা করার পরও স্বীকার করতি, তাহলেও তোকে শাস্তি দিতাম। বাট, দ্যাট উড নট বি ডেথ। কিন্তু তুই সেটা করিস নি। তাই তোর মতো বিশ্বাস ঘাতকদের বেচে থাকার কোনো অধিকার নেই।

মালিশা নিজের লোকদের ফোন দিয়ে ডেকে লোকটাকে নিয়ে যেতে বললো।
____________

বিকেলে,,,,
মালিশা নিজেদের বাড়িতে ফিরে এসে দেখলো আসিফ, রনি আর জ্যোতি গান গাইছে। বলাবাহুল্য, আসিফ আর রনি বাঙালি। তারা এবাড়িতেই থাকে মালিশার গার্ড হিসেবে।

আসিফ আর রনি নাচছে আর গান গাইছে,
—আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!

জ্যোতিও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে গাইছে
—আহা কী আনন্দ চৌধুরী ম্যানশনে!

মালিশা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
—কী হয়েছে? তোমরা এভাবে নাচানাচি করছো কেন?

জ্যোতি ছুটে মালিশার কাছে গিয়ে বললো,
—মাম্মাম, অনেক বড় একটা গুড নিউজ আছে।

—কী নিউজ, মা?

মালিহা খুশি মনে বললো,
—কী আবার? মিরাজের বিয়ে ফাইনাল হয়ে গেছে।

মালিশা মুখ চুপসে বললাম,
—সেটা তো কবে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। তোমার বাঁদর ছেলেটাই তো ক্যারিয়ারের বাহানা দিয়ে বিয়েটা ঝুলিয়ে রেখেছে।

আসিফ মালিশার হতাশা দূর করার জন্য বললো,
—আর ঝুলে থাকবে না, ম্যাম। তবে গুড নিউজ সেটা না।

—তাহলে??

রনি এক্সাইটেড হয়ে বলে উঠলো,
—আমরা সবাই বাংলাদেশ যাচ্ছি এবং কালই।

বাংলাদেশের কথা শুনেই মালিশার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। যতো যা কিছুই হোক না কেন, মালিশা কোনো দিনও বাংলাদেশে পা রাখবে না। এটা ও দেশ ছাড়ার আগেই ভেবেছিল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর থমথমে গলায় বললো,
—তাহলে তো ভালোই! তোমরা যাও, আমি এদিকটা সামলে নেব।

মালিহা এই ভয়টাই পাচ্ছিলো। যতো যাই হোক না কেন, মালিশা যে বাংলাদেশে যেতে চাইবে না, সেটা তিনি আগে থেকেই জানতেন।

আসিফ উৎকন্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
—সে কী কথা, ম্যাম? আপনি যাবেন না?

—না। আমি যাচ্ছি না।
মালিশার কাটকাট জবাব।

জ্যোতি মুখ কালো করে বললো,
—মাম্মাম, আমরা কেন বাংলাদেশে যাবো না। ডু ইউ নো, আমি কত এক্সাইটেড ছিলাম?

—সরি মা। আমি তোমার এই কথাটা রাখতে পারবো না। আমার ওপর তোমার বিশ্বাস আছে না? আমি যা ডিসিশন নেই, সেটা সবার ভালোর জন্যই, তাই না?

জ্যোতি মাথা নাড়িয়ে বললো
—হুম, ঠিক আছে।

—কিছু ঠিক নেই। আমার বিয়ে আর আমার বড় বোন যাবে না, এটা অন্য সবাই মেনে নিলেও আমি নেব না।

মিরাজ দাঁতে দাঁত চেপে বললো কথা গুলো। মালিশা ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো,
—দেখ মিরাজ, বোঝার চেষ্টা কর। তোরা সবকিছু জেনে বুঝে কেন জেদ করছিস?

—কারণ তোর মতো জেদি মানুষের সাথে জেদি হতে হয়। কান খুলে শুনে রাখ, তুই যদি বিয়েতে না থাকিস, তাহলে আমি বিয়েই করবো না।

মালিশা অবাক হয়ে বললো
—এটা কী ধরনের কথা?

—এটাই ঠিক কথা। এবার তুই ভেবে দেখ কী করবি।
মালিশা বেশ ভালো ভাবেই ফেসে গেছে। একদিকে নিজের পরিবার তো আরেক দিকে নিজের অতীত। তবে যতো যাই হোক, এ পরিবারের কাউকে সে কষ্ট দিতে পারবে না। তারা যে তাকে নতুন একটা জীবন দিয়েছে, নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে, উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যৎ তৈরি করে দিয়েছে। সব দিক থেকেই এ পরিবারের কাছে সে ঋণী। তাই তাদের জন্য এটুকু করা যেতেই পারে।

—ওকে, ওকে, আমি রাজী। আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি।

মালিশার কথায় মিরাজ অবাক হয়ে বললো,
—সত্যি!!!

—হুম।

মাঝখান থেকে জ্যোতি আনন্দে নাচতে নাচতে মিরাজের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
—ডেডাজি, ফাইনালি আমরা অস্ট্রেলিয়া টু বাংলাদেশ যাচ্ছি। ইয়েএএএএ।

—হ্যাঁ, আমার পাকনা বুড়ি।

মালিশা হাসি মুখে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। তার একটা হ্যাঁ বলায় সবাই কতো খুশি!

—আমিও এসে গেছি। আমাকেও তো তোমরা নিয়ে যাবে, তাই না?
মেইন ডোর দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললো ডক্টর নিখিল।

মালিশা অবাক হয়ে বললো,
—আপনি এই অসময়ে এখানে কী করছেন?

মিরাজ বলে উঠলো,
—আরে নিখিল ভাইয়াও তো যাচ্ছে আমাদের সাথে!

—পুরো বিয়ে বাড়িকে কমেডি শো বানানোর লোক নিয়ে যাচ্ছিস। ভালোই হবে।
দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো বলে চলে গেল মালিশা।
_____________

রাতের বেলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে মালিশা। সবার সামনে শামুকের মতো কঠিন থাকলেও রাতের একাকিত্ব তার সে উপরের খোলস খুলে দেয়।
—আমাদের মেয়েটা একদম আপনার মতো দেখতে হয়েছে, জয়। পুরো আপনার কার্বন কপি। তবে আমি চাই না, আপনার মতো একটা প্রতারকের সাথে আমার মেয়ের কখনো দেখা হোক। আপনার ছায়াও যেন না পড়ে ওর ওপর। আচ্ছা, আপনার আর তনিমার বেবিটাও কি আপনার মতোই দেখতে হয়েছে?

—কী রে, ওভাবে একা একা কি আকাশের তারা গুনছিস?

মালিহার কথায় হকচকিয়ে গিয়ে তার দিকে তাকালো মালিশা। মালিহা ওর চোখ মুখ দেখে বললো,
—“কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই?

মালিশা চুপ।

—বুঝেছি। আবারও সেই আগের কথা মনে করছিস,তাই না? কী দরকার ওসব ভেবে কষ্ট পাওয়ার? অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে শুধু কষ্টই পাবি। তার চেয়ে, নিজেকে নিয়ে ভাব, তোর মেয়েটাকে নিয়ে ভাব। ওসব পুরোনো কথা ভুলে যা।।

—ভুলে যা বললেই কী আর ভুলে যাওয়া যায়, মা? আমাকে দেখলে তো মাঝে মাঝে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। যেই আমি একটা ভীতু মেয়ে ছিলাম, সে কিনা এখন কী অবলীলায় মানুষ মেরে ফেলি! যেই আমি কতো ভদ্র আর শান্ত ছিলাম, সেই কিনা এখন উগ্র, বদমেজাজি ও রাগী একটা ব্যবসায়ী। নিজের এ পরিবর্তন গুলো মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু আমার কষ্ট গুলো যে আমায় প্রতিটা মুহুর্তে ক্ষতবিক্ষত করে!

-চলবে

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_৩৭||

প্লেনে বসে আছে চৌধুরী ফ্যামিলির সবাই, সাথে ডক্টর নিখিল। কিছুক্ষণ আগেই ফ্লাইট টেক-অফ করেছে। জ্যোতি বসে বসে আকাশের মেঘ দেখছে, আর এটা-সেটা জিজ্ঞেস করছে। মালিশার আর অনেক ভাল্লাগছে, কারণ তার মেয়েটা আগের তুলনায় আজ অনেক বেশি হাসি-খুশি।

হঠাৎ এই ভালো লাগার মাঝে বাঁ হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ডক্টর নিখিল এসে বললো,
—মালিশা, আমি কি তোমার পাশে বসতে পারি।

মালিশা ভ্রু কুঁচকে বললো,
—আপনি আমার পাশে বসবেন মানে? আমার পাশে তো জ্যোতি বসে আছে! আর তো কোনো খালি সিট নেই!

ডক্টর নিখিল একগাল হেসে বললো,
—তো কী হয়েছে? তুমি ওকে কোলে নাও, নয়তো আমি কোলে নিচ্ছি। তাহলেই তো প্রব্লেম সলভড হয়ে যায়।

—ইম্পসিবল। আপনি যদি এখন আমার সামনে থেকে না যান, তাহলে আপনাকে এই জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিতেও আমি দ্বিতীয় বার ভাববো না! আপনার ইহলীলা কয়েক সেকেন্ডেই সাঙ্গ হয়ে যাবে।

মালিশার কথায় নিখিল একটা শুকনো ঢোক গিলে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়লো। এই মেয়ে সেই লেভেলের ডেঞ্জারাস! মানুষ মারতে ওর হাত কাপে না।

মিরাজ ডক্টর নিখিলের মুড অফ দেখে টিটকারি দিয়ে বললো,
—এবারো চান্স দিলো না তো! আমি জানতাম। আচ্ছা, এবার কী বলে হুমকি দিয়েছে তোমায়!

ডক্টর নিখিল নিজের মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে বললো,
—কী আবার বলবে? বললো যে, প্লেন থেকে ফেলে দিবে।

ডক্টর নিখিলের কথায় মিরাজ কিটকিটিয়ে হেসে বললো,
—যতো যাই বলো না কেন? বোনটা কিন্তু আমার জোস! যেই ছেলেই ওর পেছনে লাগবে, তাকেই সোজা ওপরে পাঠিয়ে দিবে, তাও আবার উইদাউট লাইসেন্স! তোমাকেও এতোদিনে পাঠিয়ে দিতো, শুধু বাবা নিষেধ করেছে, তাই!

—ওর এই উগ্রবাদী সত্তাটা আমার একদমই পছন্দ না। মেয়েটা দেখতে কতো মিষ্টি! কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায়, আস্ত একটা ধানী লঙ্কা!

—কী করবো বলো? ওর জীবনটা তো আর অন্যান্য মেয়েদের মতো সাধারণ না! বাবাই ওকে এমন উগ্রবাদী আর বদমেজাজি বানিয়েছে প্রথম প্রথম ওরও হাত কাপতো মানুষের ওপর গুলি চালাতে। কিন্তু এখন দেখো, কী সুন্দর মশা-মাছির মতো মানুষ মারে!

—তার মানে, তুমি ওকে সাপোর্ট করো।

মিরাজ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—অভিয়েসলি, সাপোর্ট করি এন্ড হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাপোর্ট করি। আমার বোন তো অন্যায় কিছু করছে না! রাস্তার সামনে যদি কীট এসে দাঁড়ায়, তাহলে সেটাকে মেরে ফেলতেই হবে। নাহলে তো আর সামনে আগানো যাবে না।

ডক্টর নিখিল আর কথা বাড়ালো না। বিড়বিড় করে বললো,
—ভাই আর বোন দুটোই এক। যদিও এদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক নেই, তবুও এরা সেইম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বলতে গেলে, পুরো পরিবারটাই এরকম। এজন্যই বোধ হয়, আল্লাহ এদেরকে মিলিয়ে দিয়েছে।

ফ্লাইট ল্যান্ডিং করলো পরেরদিন। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আসার পর জ্যোতি আশেপাশে বেশ কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিরাজের কোলে ওঠে আহ্লাদিত স্বরে বললো,
—এটাই কি বাংলাদেশ, ডেডাজি?

মিরাজ জ্যোতির নাক টেনে দিয়ে বললো,
—ইয়েস মাই প্রিন্সেস, এটাই বাংলাদেশ! কেন তোমার পছন্দ হয়নি।

—এখনো তো কিছু দেখলামই না। আগে ভালো করে ঘোরাঘুরি করে নেই, তারপর বলা যাবে।

মিহাদ চৌধুরী হাসতে হাসতে বললো,
—ওরে আমার পাকনা বুড়ি রে! আগে যাচাই করবে, তারপর রেজাল্ট দিবে। একদম আমার মতো।

মালিহা চৌধুরী ফোড়ন কেটে বললো,
—“একটুও তোমার মতো হয়নি। আমার নাতনি একদম আমার মতো হয়েছে।

মালিশা মাথায় হাত দিয়ে বললো,
—হয়েছে তোমাদের? এবার বাড়িতে চলো।দ্যান, জাস্টিফাই করা যাবে যে, জ্যোতি ম্যাডাম কার মতো।
একথা শুনে সবাই হেসে দিলো।
__________

অফিসে নিজের কেবিনে বসে বসে টেবিলের ওপরে রাখা পেপারওয়েটটা ঘুরাচ্ছে, আর কিছু একটা বেশ মনোযোগ দিয়ে ভাবছে জয়।

—ঢুকে পড়লাম। আর ফর্মালিটি ভাল্লাগে না, তোর সাথে তো একদমই না।

হঠাৎ করে কারো কন্ঠস্বর শুনে মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো আহিল পকর পকর করতে করতে ভেতরে ঢুকছে। আহিল চেয়ার টেনে বসতেই জয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,
—তুই হঠাৎ আমার অফিসে! নরমালি তো আসিস না! আজ আসলি যে?

—হুম, শুনলাম তুই এখন অফিসের কাজে রেগুলার হয়েছিস। আমার দিল খুশ হয়ে গেছে এটা শোনার পর।

—হ্যাঁ, কী আর করবো? ভাইয়ার একা হাতে সব সামলাতে অনেক কষ্ট হয়। আগে তো তাও বাবা এসে বসতো, কিন্তু এখন তো তিনিও মাঝে মাঝে আসেন। তাই ভাবলাম যে, আমিও হাতে কিছু কাজ নেই। তুই কি এটার জন্য আমার কাছে এসেছিস?

আহিল থতমত খেয়ে গিয়ে বললো,
—হ্যাঁ, তবে অন্য একটা দরকারেও এসেছি।

জয় ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল
—কী দরকার?

আহিল ইতস্তত করে বললো,
—আসলে, আমার তনিমার সেই ভিডিওটা লাগবে।

তনিমার কথা মনে পড়তেই জয়ের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেল। গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে বললো,
—কেন? কী করবি ওটা দিয়ে?

—দেখ, আজ পর্যন্ত অনেকবার তোর কাছে ঐ ভিডিওটা চেয়েছি, তুই দিসনি। তনিমা-নিবিড়কে আটকানোর দু’সপ্তাহের মধ্যে ওরা জেল থেকে বের হয়ে গেছে। তুই ভালো ভাবেই জানিস, আমার কাছে বর্তমানে ওদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। আর ঐ ভিডিওটা বেশ ভালোই কাজে দিবে ওদের আটকাতে।

জয় চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
—কী হবে ওদের আটকে? বরাবরের মতো এবারো দুদিন পর জামিন হয়ে বেরিয়ে যাবে। কীভাবে বের হবে, তুই বুঝতেও পারবি না। দ্যাটস হোয়াই, আমার এখন ওদের নিয়ে ঘাটার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। থাক না ওরা ওদের মতো! আমার যা ক্ষতি হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে!

—তাই বলে তুই ওদের এমনি এমনি ছেড়ে দিবি? ভুলে যাস না, ওরা তোর স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যুর জন্য দায়ী!

—ভুলিনি আমি। তোর কী মনে হয়, আমার কষ্ট হয় না? আমারও ভেতরটা পোড়ায়। আর যারা অন্যায় করে, তারা অন্যায়ের শাস্তি পাবেই। নিবিড়-তনিমাও পাবে। এটা আমার বিশ্বাস। আর ওরা এখন খুব সুখেও নেই! তাই সবকিছু ওপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দে।

আহিল আর কথা বাড়ালো না। ও ভালো ভাবেই জানে, জয় এখন কিছুই করবে না। তার চেয়ে বরং আহিল নিজেই কোনো একটা উপায় বের করবে। কিন্তু কী উপায় যে বের করবে, সেটা জানা নেই।
_________________

পুরো অফিসের সব ওয়ার্কার আর অফিসারদের তাদের কোম্পানির মালিককে দেখে গলা শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।

সবার মুখে একটাই কথা, “এটা কি মেয়ে, নাকি অন্য কিছু?” কারণ এমন রাগী আর বদমেজাজি মেয়ে সাধারণত দেখা যায় না।

—সো, আপনিই বাংলাদেশে আমার কোম্পানির শাখার ম্যানেজার?

মালিশা গভীর মনোযোগ সহকারে একটা ফাইল দেখতে দেখতে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল। ম্যানেজার হালকা হেসে বললো,
—ইয়েস, ম্যাম। আমি সেই প্রথম থেকেই এ কোম্পানিতে আছি।

—ভালো কথা। কালকে একটা সরকারি প্রজেক্টের জন্য মিটিং হবে এবং দুটো কোম্পানি সিলেক্ট করা হবে যারা যৌথভাবে কাজ করবে। ঐ প্রজেক্টটা আমা চাই, এট এনি কস্ট।

—আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

মালিশা আরও কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ওর ফোন বেজে ওঠে। হাতে নিয়ে দেখলো, মিরাজ ফোন দিয়েছে।

—ওকে, ইউ ম্যায় গো নাও। লিভ।
বলেই কল রিসিভ করলো। এরই মধ্যে ম্যানেজার চলে গেল।

—কী হয়েছে? তোর তো এখন নিজের অফিসে থাকার কথা! আমায় কল করলি যে?

মালিশার কথায় মিরাজ উশখুশ করতে করতে বললো,
—একচুয়েলি আপুমনি, একটা কথা বলতে চাইছিলাম। কিন্তু তোকে সামনাসামনি কীভাবে বলবো? তাই ভাবলাম ফোন দিয়ে বলি।

মালিশা কপাল কুঁচকে বললো,
—তোর আবার কী হলো? কী বলতে চাইছিস যে, ডিরক্টলি বলতে পারছিস না?

—আপুমনি, আই থিংক তোর একবার নিজের অতীত সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ নেওয়া উচিত। আমার এদেশে আসার পর বারবার শুধু মনে হয়েছে, সামথিং ইজ ভেরি ফিশ্যি, সামথিং ইজ ভেরি রঙ্। আর তাছাড়া,,,,

মালিশা মিরাজকে থামিয়ে দিয়ে বললো
—আমি ফোন রাখছি। তুই নিজের বিজনেস সামলা। আমার কাজ আছে।

বলেই ফোন কেটে দিবে এমন সময় মিরাজ বলে উঠলো,
—তুই যদি ফোন কাটিস, তাহলে বুঝে নিবি আমি আর তোর সাথে কখনো কোনো কথা বলবো না। আর তুই ভালো ভাবেই জানিস, আমি যেটা বলি সেটাই করি।

#Chapter_02

-চলবে……

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)