নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-৪৪

0
6150

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_৪৪ (রহস্যভেদ-২)||

আহিল অবাক হয়ে তাকিয়েই প্রশ্ন করলো,
—কিন্তু সেই প্লেন অ্যাকসিডেন্ট? ওর তো ইউকে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ও অস্ট্রেলিয়া গেল, আর ইউকে যাওয়ার পথে প্লেন অ্যাকসিডেন্টে আমরা খবর পেলাম ফিহু বেঁচে নেই। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

মিরাজ হেসে দিয়ে বললো,
—ওটা আমাদের দেখা হওয়ারও দুমাস আগের কাহিনী।

—মানে?

—বলছি, বলছি। একদিন আপুমনির পাসপোর্টে ইউকে এর ভিসা লাগানো দেখে বেশ অবাক হয়ে যাই। কারণ ভিসায় কোনো সিল ছিল না। দ্যাট মিনস, ও ইউকে যায়নি। আর ডেটটাও আমাদের দেখা হওয়ার টু মান্থস আগের। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ও আগে ইউকে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু যায়নি। তাই এক পর্যায়ে ওকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।

সেদিন,,,
মালিশা ল্যাপটপে কাজ করছিল এমন সময় মিরাজ এসে তার সামনে বসলো।

—কিছু বলবি?

প্রশ্ন শুনে মিরাজ নিঃসংকোচে বলে উঠলো,
—আচ্ছা, তোর পাসপোর্টে ইউকে এর ভিসা লাগানো কেন?

মালিশা অবাক হয়ে মিরাজের দিকে তাকালো। মিরাজ পাত্তা না দিয়ে বললো,
—এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। যা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বল।

মালিশা ল্যাপটপ অফ করে সোজা হয়ে বসে বললো,
—সবাইকে ছেড়ে চলে আসার পর আমি চট্টগ্রামে একটা লেডিস হোস্টেলে উঠেছিলাম। সেখানে থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে ইউকে যাওয়ার জন্য সব প্রসেসিং সেরে ফেলি। আমি জানি, সবাই আমাকে খোঁজার জন্য সারা শহর ভেজে ফেলবে। কিন্তু চট্টগ্রামের নাম কারো মাথায় আসবে না। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো ফ্লাইটের দিন। আমি ইমিগ্রশনে আমার পেপার সাবমিট করেই দিচ্ছিলাম এমন সময় একটা লোক এসে ইমিগ্রেশনে দায়িত্বরত সবাইকে বলে যে, ফাহমিদা আহমেদ মুন নামের কেউ যদি আসে, তাহলে তাদের ইনফর্ম করতে। আমি তখনই বুঝে যাই যে, এটা আমার গোয়েন্দা ভাইটার কান্ড ছাড়া আর কারো কাজ নয়। তারা যখন কথা বলায় ব্যস্ত, তখন আমি কৌশলে কোনো কথা না বলেই সেখান থেকে চলে আসি। কিন্তু ভুলবশত আমার ফ্লাইটের সাথে রিলেটেড সব কাগজগুলো সেখানে ফেলে আসি, শুধু পাসপোর্ট টা আমার সাথে ছিল। আমি গিয়ে কাগজগুলো আনতে চেয়েছিলাম, পরে ভাবলাম গেলে যদি আবার ধরা খেয়ে যাই! তাও ভেতরে গিয়ে একবার দেখে এসেছিলাম, অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল ঐ কাগজের ওপর আমার নাম মনে হয় দেখেনি কেউ। আমি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আবার চট্টগ্রাম ব্যাক করি।

মিরাজ অবাক হয়ে বললো,
—ব্যাক করলি কেন? যেতেই তো পারতি! আই মিন কৌশলে অনেক কিছু করা যায়!

—মাথা খারাপ! তোর কি মনে হয় ইমিগ্রেশন কোনো রকমে পার হলেই আমি ছাড় পেতাম? পুরো এয়ারপোর্ট সিআইডি ঘেরাও করে ফেলেছিলো!

—ওহহ, সো স্যাড! তারপর, তারপর!

—রাতে নিউজ পাই ইউকে এর ঐ ফ্লাইট নাকি ক্র্যাশড হয়েছিল! সমুদ্রে বিধ্বস্ত হওয়ায় কোনো যাত্রীই বেঁচে ছিল না।

—ও মাই গড! তাহলে তো আল্লাহ তোকে অনেক বড় বাচানো বাঁচিয়েছে। আমার মনে হয়, আমাদের কিউট ডল জ্যোতির জন্যই এরকমটা হয়েছে।

—হয়তো বা! এরপর আমি চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী চলে যাই। এক জায়গায় এতোদিন থাকলে যদি আবার ধরা টরা পড়ে যাই এই ভয়ে। রাজশাহীতে প্রায় একমাস থাকার পর আমার মনে হয়েছিল, হয়তো এখন এয়ারপোর্টে আর গার্ড লাগায়নি আমায় খুঁজে বের করার জন্য। আমি ইউকে এর চিন্তা বাদ দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জন্য ভিসা লাগালাম। তারপর সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে এসে দেখলাম, সব ঠিকঠাকই আছে। ততোদিনে দুমাসেরও বেশি সময় পেড়িয়ে গেছে। তাই, আমাকে মনে হয়, এতোদিনে খোজাখুজি বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর তো প্লেনে তোর সাথে দেখা!

—আমি এখন তোর গোয়েন্দা ভাই টাকে পেলে না, তার গালে একটা চুম্মা দিয়ে বলতাম, “থ্যাংকিউ, তোমার জন্যই আমি আমার বোনুকে ফিরে পেয়েছি। ”

মিরাজের কান্ড দেখে মালিশা হাসতে লাগলো

বর্তমান,,,,
আহিল চোখ কপালে তুলে গালে হাত দিয়ে বললো,
—এ্যাএএএ, আমার গালে চুমু। ওহ নো!!

মিরাজ ভ্রু নাচিয়ে বললো,
—ওও, তো আপনিই সেই ডিটেক্টিভ মহাশয়! আপনাকে দেখেই তো আমি ক্রাশড, একটা চুমু দেওয়াই যায়।

মিরাজ আহিলের কাছে আসতে নিলেই আহিল দূরে সরে গিয়ে বললো,
—আস্তাগফিরুল্লাহ!! লাগবে না, ভাই। দুদিন পর তোমার বউ হবে, আমার তো অলরেডি আছেই। ওরা জানলে না ঘরে ঢুকতে দিবে না।

সবাই এসব কাহিনি দেখে হাসতে লাগলো। আহিল সবার হাসির মাঝে আবার বলে উঠলো,
—তার মানে, ঐ প্লেনে ফিহু ছিল না। ও যেসব পেপারস ফেলে এসেছিল, ডেটা এন্ট্রির সময় ওগুলো ইনক্লিউডেড ছিল। তাই আমাদের কাছে নিউজ এসেছিল।

জয়ও গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। তবে তার এটা ভেবে খুশি লাগছে যে, ফাইনালি তার বিশ্বাস ভুল ছিল না।
সবাই সবার মতো হাসাহাসি করছে এমনসময়ই আমি বাড়িতে প্রবেশ করলাম। আমার দিকে তাকাতেই সবার চোখ ইয়া বড়বড় হয়ে গেল। আজ সবাই শুধু আমায় দেখে অবাকই হচ্ছে, হওয়ারই কথা।

আহিল ভাই অবাক হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকাতে তাকতে বললো,
—তুই কি কসাই-টসাই হয়ে গেলি নাকি! সাদা জ্যাকেট, সাদা কেডস লাল বানিয়ে আনলি কীভাবে?

আমি চুল ঠিক করতে করতে বললাম,
—শুনলে হজম করতে পারবে তো!

মাঝখান থেকে জয় গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
—কতোকিছুই তো হজম করে ফেললাম! এটা আর কী এমন ঘটনা!

মিহাদ চৌধুরী সোফায় বসতে বসতে বললেন,
—এটা সবকিছু থেকে অন্য রকম, তাই? মালিশা, মাই প্রিন্সেস। ইজ ইয়র ওয়ার্ক কমপ্লিটলি ডান?

আমি প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললাম,
—অল ডান, বাপি।

জায়েদ আর অদ্রি বলে উঠলো,
—আমরা কিছুই বুঝছি না!

আমি সবার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললাম,
—একচুয়েলি, আমি তিনটা মার্ডার করেছি।

আমার কথা শোনার সাথে সাথে সবাই একটা বড়সড় শক খেলো। আমি জানি, এসব ভালো কিছু না। কিন্তু কিছু কাজ নিজের হাতে করতে হয় যখন অন্যের দ্বারা সেটা সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না।

ফ্লাশব্যাক,,,,
অন্ধকার ঘর। বাহির থেকে জানালার ফাঁক দিয়ে তীরের মতো ক্ষীণ আলো আসছে। হঠাৎ ঘরের ভেতর হলুদ আলো জ্বলে উঠলো। তিনটা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে নিবিড়, তনিমা আর একটা মহিলা।

হঠাৎ ঘরের ভেতর প্রবেশ করা ব্যাক্তিটাকে দেখে তাদের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। তনিমা অবাক হয়ে বললো,
—মুন, তুমি? তুমি বেঁচে আছো? কিন্তু আমরা তো জানি,,,

আমি একটা চেয়ার টেনে পায়ের ওপর পা তুলে বসে বললাম,
—কী জানো? আমি মরে টরে গেছি? সত্যিই আমি মরে গেছিলাম। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে তো তোরাই আমাকে মিথ্যের জ্বালে ফাঁসিয়ে মেরে ফেলেছিলি! তবে আজ আমার পথের কিছু আগাছা পরিষ্কার করে নতুন করে আবার বেঁচে উঠবো।

নিবিড় নিজের চোয়াল শক্ত করে বললো,
—আমাদের এখানে কেন আনা হয়েছে?

—একটু আপ্যায়ন করে বাসায় পাঠিয়ে দিবো।

—আই উইশ, আমি টাকার আগে যদি তোমাকে খেয়াল করতাম, তাহলে আজ তনিমার মতো তুমিও আমার আরেকজন হতে।

তনিমা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
—নিবিড় তুমি এসব কী বলছো?

আমি তনিমার দিকে তাকিয়ে বললাম,
—কী বলছে, এখনো বুঝোনি? ও তোমাকে আজীবন শুধু ব্যবহারই করেছে, এখনো করছে। আর নিবিড়, তোকে বলছি! আমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর জন্য এখন চাইলে তোর চোখ উপড়ে দিতে পারি, জিহ্বাও কেটে দিতে পারি। কিন্তু তোর মতো পশুদের টাচ করে এ হাত অপবিত্র করতে চাই না।

আমি মহিলাটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
—এই যে, ডক্টর সাহেবা! বেশ ভালো টাকা পেয়েছিলেন, তাই না? একটা মিথ্যে এতো দামী ছিল তখন, হাহ!

মহিলাটা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—আমার ভুল হয়ে গেছে। আমায় ছেড়ে দাও। আমি এরকম আর কখনো করবো না।

আমি চোখ মুখ শক্ত করে চিৎকার করে বললাম,
—ছেড়ে দিবো? তোদের তিনজনের জন্য আমি পাঁচটা বছর গুমরে গুমরে মরেছি। যখন আমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম, তখন আমার স্বামীকে পাশে পাই নি। আমার সন্তান প্রায় পাঁচ বছর বাবার স্নেহ আর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিল। আমার পরিবার, জয়ের পরিবার থেকে শান্তি কেড়ে নেওয়ার পর বলছিস,তোর এমনি এমনি ছেড়ে দিবো! এসবের বিনিময়ে তো তোদের একটা শাস্তিই প্রাপ্য! আর সেটা হলো মৃত্যু।

বর্তমান,,,
মিরাজ এক্সাইটেড হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—লাশগুলো কী করেছিস? আমায় একবার দেখাতি কীভাবে মেরেছিস?

—হোহ, তোকে দেখাবো? তারচেয়ে ভালো তুই তোর স্যুটটা খুলে আমায় দে।

—সবসময়ই আমার জিনিস নিয়ে টানাটানি করিস তুই। বিয়ের পর আমার বউ নিয়েও টানাহেঁচড়া করবি মনে হচ্ছে।

আমি আর কিছু না ওর স্যুটটা খুলে নিয়ে নিজে পরতে পরতে বললাম,
—এই জ্যাকেটটা নর্দমায় ফেলে দিস। এসব পশুদের রক্তে আমার জাস্ট ঘেন্না হয়।

হঠাৎ মেইন ডোর দিয়ে রাদিফ, অর্ণব, রুহি আর অনিতা ঢুকলো। ওদের দেখার সাথে সাথে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম, চোখে পানি ছলছল করছে এতোদিন পর ওদেরকে দেখে। এরা কোনোদিন আমায় ভাইবোনের অভাব বুঝতে দেয়নি।

অর্ণব বলে উঠলো,
—আহিল ভাই, আমাদের কী সারপ্রাইজের কথা বলে ডেকে আ,,,,,,
আমার দিকে চোখ যেতেই অর্ণবের মুখটা হা হয়ে গেল। চারজনেই আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

রাদিফ অর্ণবের কানে ফিসফিস করে বললো,
—আমি যা দেখতাসি, তুইও কি তাই দেখতাছোস?

অর্ণব চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,
—আমার মনে হয়, এইটা ভুত।

রাদিফ চিৎকার দিয়ে বললো,
—ওমা,, ভু,,,,,,,,,ত।
বলেই উল্টো দৌড় দিবে এমনসময় আহিল বললো,

—আরে, এটা তোমাদের বন্ধু ই। ও এতোদিন বেচে ছিল। এখন আমাদের মাঝে আবার ফিরে এসেছে।

রাদিফ আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকালো। অর্ণব বললো,
—কাঁদতেছে!!!!

রাদিফ ধাক্কা দিয়ে বললো,
—তাইলে চল শুরু করি আমরা।

—এখন????

—-তাইলে কখন??

রাদিফ আর অর্ণব গান গাইতে গাইতে আমায় নিয়ে নাচতে লাগলো,
—মন খালি খালি তুই তুই করে, তুই তুই করে ;
এবুকে চোরাবালি চুই চুই করে, ছুঁই ছুঁই করে, তুই তুই করে ;
এখন আর কী করার?
হয়ে যা তুইও ফেরার!
প্রেমে চল হাবুডুবু হাবুডুবু খাই, দুজনে চল ডুবে ডুবে ভালোবেসে যাই।
প্রেমে চল হাবুডুবু হাবুডুবু খাই, দুজনে চল ডুবে ডুবে ভালোবেসে যাই।

ওদের গান শুনে আমরা হাসতে হাসতে শেষ । আমি কোনো রকমে হাসি থামিয়ে বললাম,
—স্টপ ইট, গাইস। আমার পেট ফেটে যাচ্ছে। তোরা আর শোধরালি না।

-চলবে