নীড়ভাঙ্গা ভালবাসা পর্ব-১৭+১৮

0
408

#পর্ব_১৭
#নীড়ভাঙ্গা_ভালবাসা
#লেখকঃমুহাম্মদ_রাফি

তান যাওয়ার পর বাবা মা এসে অনেক বকাবকি করলেন এতো অসাবধান হওয়ার জন্য। তাদের কথাশুনে বুজলাম তান মনে হয় অ্যাক্সিডেন্টের কারণটা তাদের জানায়নি। তারা বললেন, আমার উপর তাদের আর কোনো রাগ নেই আমি যেন এখন শুধু তাদের নাতির দিকে মনোযোগ দেই। তাদের সাথে কথা বলতে বলতে আমি কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম জানিনা। মাঝরাতে ঘুম ভাঙতে দেখি চয়ারে হেলান দিয়ে নীড় ঘুমিয়ে পড়েছে৷ একদিনেই বেচারার মুখটা শুকিয়ে গেছে, চুল উস্কোখুস্কো হয়ে গেছে। সারাদিন হয়তো পেটেও কিছু পড়েনি ওর।

বাসায় যেয়ে ওর সাথে কথা বলেই সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিতে হবে। আম্মু যদি সত্যিই ঐরুমেই ছিলো তাহলে আমি যখন রুমে গেছিলাম তখনই সে কেনো ওয়াসরুমে গেলো? আর কই জ্ঞান হারানোর আগেও তো তাকে আমি দেখতে পেলাম না! সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নীড়ের থেকে শুনতে হবে। যদি আমার এই অবস্থার পিছনে ভদ্রমহিলার কোনো হাত থাকে তো এবার তার কোনো নিস্তার নেই। এই বদল বেটারই দোষ। মা বলতেই অজ্ঞান। এতটুকু জ্ঞান নেই, যে মা তার বউকে দুচোখে দেখতে পারতো না সে বৌমার খুশীর জন্য মন থেকে সারপ্রাইজ প্লান করবে! সবকিছু মেটা মাথা দিয়েই ভাবতে হবে? কুটিল বুদ্ধিতে যে মহিলারাই সেরা সেটা এ বেটা কবে বুঝবে?

সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন নীড়ের কোনো খোজ পেলাম না৷ হুইলচেয়ার থেকে নেমে গাড়িতে ওঠার সময় দেখি সে ড্রাইভ করবে। আমি নীড়ের পাশে প্যাসেন্জার সিটে বসার জন্য পা বাড়াতে মা আমাকে নিয়ে পিছনের সিটে বসিয়ে দিলো। আর তান বসলো নীড়ের পাশে। সারাপথ নীড় কোনো কথা বললো না। আমি বার বার মিরর ভিউতে তাকে দেখতে থাকলাম কিন্তু সে একবারও আমার দিকে তাকালো না।

গাড়ী থেকে নেমে সে আমাকে কোলে করেই বেডরুমে বসিয়ে রেখে অফিসে চলে গেলো। তারপর আম্মু স্যুপ বানিয়ে দিয়ে গেলো। এটুকু ভালো লাগলো যে আম্মু মায়ের সাথে শত্রুতা করছে না। মা আমাকে স্যুপ খাওয়াতে খাওয়াতে বাচ্চার খেয়াল কিভাবে রাখবো, নিজের যত্ন কিভাবে করবো এইসব শেখাতে লাগলো। কিন্তু নীড় সারাদিনে একবারও না ফোন করলো, না বাসায় এসে আমার খোঁজ নিলো। মা ডেলিভারির আগপর্যন্ত এবাসায়ই থাকবে তাই আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম। সন্ধ্যায় নীড় অফিস থেকে ফিরে চেঞ্জ করেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

বুঝলাম না, আমি অসুস্থ আর সে আমার সাথে কেনো ভাব নিচ্ছে! যাহ্ বেটা তোর সাথে কোনো কথা নেই। রাতে তুই একবার আমাকে, আর পুচকোকে টাচ্ করে দেখিস তোকে মজা কিভাবে দেখাই। সব বুঝি দিনের বেলা ড্যাম কেয়ার ভাব দেখায় সে বোঝাতে চায় যে আসল কন্ট্রোল তার হাতে। রাতে আসিস কেয়ার দেখাতে। মা আমাকে খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে গেলো। খাবার খাওয়ার সাথে সাথে প্রচন্ড ক্লান্ত থাকায় আমিও ঘুমিয়ে গেলাম।

মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখি আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরা হাতদুটো আজ মিসিং৷ এতো কিসের রাগ! রাগ তো আমার হওয়া উচিত না! ভুলভাল সারপ্রাইজের চক্করে আজ আমার পুচকের কতো কষ্ট! হাতড়ে হাতড়ে দেখি পাশে একজন মহিলা শোয়া। ব্যাপার কি শেষমেষ শাশুড়ীর সাথে ঘুমাতে হবে নাকি?
– কিরে মাঝরাতে হাতড়া হাতড়ি করছিস কেনো?
– তুমি এই ঘরে কেনো?
– আমি ছাড়া কে থাকবে তোর সাথে?
– যার ঘর সে কই মা?
– তার যেখানে থাকা দরকার আছে। তুই ঘুমা। না ঘুমালে আমার নাতির সমস্যা আরও বাড়বে।
– তারে এইরুমে পাঠায় দিয়ে তুমি যাও গেস্টরুমে ঘুমাও। ওর নিজের রুম ছাড়া ঘুম হয়না অন্যকোথাও।
– রাতের বেলা ঢং করবি না৷ এতো যদি বরের খেয়াল থাকতো তাহলে আগে বাচ্চাটার খেয়াল রাখতিস। কাল ছেলেটার কি অবস্থা হয়েছিলো জানিস! মাইর একটাও তোর পিঠের বাইরে পড়তো না যদি পোয়াতি না হইতিস। দুইজন মিলে বাচ্চার কোনো খেয়াল রাখতে পারো না, আবার বাপ মা হবে! বাচ্চা হওয়ার আগপর্যন্ত নীড় তোর সাথে ঘুমাবে না। তুই আমার সাথেই ঘুমাবি। কাল জামাইয়ের কাছে শুনবো তার ঘুম ভালো হয়েছে কিনা! যদি ঐ রুমে ঘুম না হয় তুই আমার সাথে গেস্টরুমে ঘুমাবি আর ও এখানেই ঘুমাবে৷
২টাই সমান বেহায়া। একতো লুকায় বিয়ে করে সংসার করে পোয়াতি হয়েছো, তাও যদি দুজনের কারো আক্কেল থাকতো বাচ্চার সুস্থতার তাও মেনে নিতাম। কোনো বাছবিচার মানবা না, তা সমস্যা তো হবেই।
– আম্মা, আমি তোমার মেয়ে তুমি ভুলে যাচ্ছো! কিসব উল্টাপাল্টা কথা কও! তুমি যা ভাবতেছো তেমন কিছুই হয়নি।
– শোন চুল শুধু শুধু পাকেনি আমার। বাপ হবে এটুকু ত্যাগ তাকে করতেই হবে!
– তুমি তোমার জামাইকেও এইসব বলছো? লজ্জা করেনি তোমার?
– তাকে বলতে পারিনি বলেই তোকে বলতেছি। সে তো ছেলে ভালো। আমি আর তোর শাশুড়ী বলার সাথে সাথেই তানের সাথে ঘুমাতে চলে গেলো। তোর মতো বেহায়া না।
– মা হয়ে মেয়েকে নিয়ে কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলতেছো শুনলে আমার শশুরবাড়ির লোকজনকে কীভাবে মুখ দেখাবো বলো? তোমার মুখে কি কিছুই আটকায় না?
– না বাচ্চা হওয়ার আগে একদম দূরে দূরে থাকবি জামাইয়ের থেকে।
– তুমি প্লিজ চুপ করো। ঘুমাও আর আমাকেও ঘুমাতে দাও৷

আল্লাহ এরা সবাই মিলে কি নিজেদের দোষ ঢাকতে এই বোঝাইছে আমার বাসায়! আমার শ্বশুরও কি তাই জানে? আমি কিভাবে মুখ দেখাবো সবাইকে? সায়শা যদি আসে আমাকে তো নোংরা কথা বলে ভাসিয়ে দেবে। এমনিতেও আমার মায়ের মতো মুখ পাতলা ওর। আমার মা যদি নীড়ের সামনে মুখ খোলে এমন করে, নীড় বেচারার কি হাল হবে! আল্লাহ মা আমাকে যা বলছে বলুক আর কারও সামনে যেন এইসব না বলে!

ঐরাত কোনোভাবে মায়ের সাথে কাটালাম। তারপরের রাত আমার শাশুড়ী ঘুমালো আমার সাথে। নীড় শুধু অফিসে যাওয়ার সময় রেডি হতে আসে আর ফিরে ফ্রেশ হয়ে চেন্জ করে আবার বের হয়ে যায় রুম থেকে। আমার মা ই তাকে আমার কাছে ঘেষতে দেয় না। আর তার হাবেভাবেও বুঝতেছিনা সে আমার কাছে আসতে চায় কিনা! কথা বলতে চায় কিনা! ফারাহ্ একদিন আমার কাছে এসে খুব কান্নাকাটি করলো। নিজেকে বারবার দোষ দিতে থাকলো আমার অবস্থার জন্য। ও আমাকে বললো বড় হয়ে কখনো নীড়ের দিকে ভাই ছাড়া অন্যকোনো নজরে ও তাকায়নি। আর ওর রিলেশনও আছে ৩ বছরের। কিন্তু ছেলের এখনও লেখাপড়া শেষ হয়নি বলে ওরা বিয়ে করতে পারছে না। যাইহোক সবার সাথেই মোটামুটি মনোমালিন্য দূর হয়ে গেলো শুধু আসলজন ছাড়া। যদিও শাশুড়িকেও এখনও ভরসা করতে পারিনা, তার সবকাজেই আমার সন্দেহ লাগে৷

নীড় আমাকে আমার সারপ্রাইজটা দেখানোর আর কোনো চেষ্টা করেনি। আমিও আগ বাড়ায় যায়নি নার্সারি দেখতে। তানও এ কদিন আমাদের বাসা থেকেই ক্লাস করে। তান আর ফারাহ্ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আমি জানতাম না। দুজন একসাথেই ভার্সিটি যায় আর একসাথেই আসে। দুটোকে মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। কিন্তু আমি সবসময় ভুলভাল বুঝি কাজেই এবার ওদের সম্পর্কে কিছুই ভাবলাম না৷ ১০ দিন কেটে গেলো এভাবে৷ নীড়কে ছাড়া কোনোভাবেই আর থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। খুব কষ্ট হয়। সারাদিন পুচকোটা খুব লাফালাফি করে। ব্যাথা হয়ে যায় পেটে৷ ও কি ওর আব্বুকে মিস করে ওর আম্মুর মতো!

আজ রাতে মা ঘুমাবে, যা করার আজকেই করতে হবে৷
মাঝরাতে ঘুম ভেংগে গেলে আমি শব্দ করে কাঁদতে থাকলাম। তাতে মায়েরও ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে খুব ভড়কে গেলো। বারবার বলতে থাকলো ভালো মানুষ ঘুমাইলি এখন মাঝরাতে কি হলো? আমি চুপচাপ কাঁদতেই থাকলাম। মায়ের কোনোকথায় কান দিলাম না৷ সে কি করবে বুঝতে না পেরে নীড়কে ডেকে নিয়ে আসলো। বেচারা মনে হয় সবেমাত্র ঘুমিয়েছিলো, ঘুমের টাল ভাঙেনি এখনও। এসে আমাকে কাঁদতে দেখে সে হন্তদন্ত হয়ে গেলো। আমাকে আলতো করে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে?
– পুচকো খুব লাফালাফি করছে আজ সারাদিন। ব্যাথা করছে খুব।
সে সাথে সাথে আবার ছুট লাগাতে গেলে, আমি হাত টেনে ধরলাম,
– কই যাও?
– ফোনটা নিয়ে আসি, গাইনোকলজিস্টকে একটা ফোন করতে হবে।
আমি দাঁতের উপর দাঁত চেপে বললাম,
– কেনো বউয়ের পাশে কিছুসময় বসতে খারাপ লাগছে?
বেচারা মায়ের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
– না মানে, তোমার শরীরটা ভালো না।
মা কিছু না বলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলো৷ আমি বললাম,
– দরজা লাগিয়ে চুপচাপ আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকো৷ আজ কতগুলো রাত আমার ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনা জানো!
– কেনো ঘুমাতে পারছো না? কোনো অসুবিধা হচ্ছে?
– হচ্ছে, তোমার বাচ্চা তোমার আদর ছাড়া ঘুমাতে পারছে না৷
একথায় সে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
– সবাই মানা করেছে একসাথে ঘুমাতে৷
– তাতো করবেই, সবাই যা ভাবার সেটা ভেবে নিয়েছে। কেউ তো আর জানেনা আমার স্বামীকে মাঝরাতে আরেকটা মেয়ের সাথে দেখে আজ আমার এই অবস্থা! আর আমি নিশ্চয়ই আমার মাকে সেকথা জানাবো না! জানালে তারা আমাকে এখানে রাখবে ভেবেছো?
– আচ্ছা আমি তাহলে যাই মা কে পাঠিয়ে দেই।
বুঝলাম সেইরাতের কথা বলাতে ওর মন খারাপ হয়েছে। তাই আবার বললাম,
– কিছুই হতো না যদি তোমার ঘিলুতে মেয়েদের মতো কুটিল বুদ্ধি থাকতো। আম্মু বাথরুমে গেলে তুমি দরজা খুললে বলেই এমন হলো। তোমার নিজের গাধামি নিয়ে কোনো অনুশোচনা আছে?
– অবশ্যই আছে কিন্তু আমি ভাবছি আমাকে দেখলেই তুমি আবার উত্তেজিত হয়ে যাবা তাই একয়দিন আর তোমাকে রাগায়নি।
– গুড। কিন্তু তোমাকে না দেখে তোমার বাচ্চা আমার জীবন হারাম করে দিচ্ছে।
– কেনো?
– জানিনা, হয়তো সেও তোমাকে মিস করছে! পেটে তুমি সারারাত তেল মালিশ করবা, আর তোমার বাচ্চাকে ঠান্ডা করবা। এটাই তোমার শাস্তি।
– আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
– আমাকে ছাড়া শালার সাথে শুয়েও যে তুমি শান্তিতে ঘুমাইছো এটার জন্য ডাবল সাজা হবে তোমার। যাও আজ রাত ঘুমাতে দিলাম। কাল থেকে তোমার সাজা শুরু। চুপচাপ লাইট অফ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ো।

চলবে???

#পর্ব_১৮
#নীড়ভাঙ্গা_ভালবাসা
#লেখকঃমুহাম্মদ_রাফি

– নীড় এখানে ঘুমাবে না। যাও বাবা, তুমি তানের সাথে ঘুমাও। তোমার সকালে অফিস আছে। এই মেয়ে তোমাকে ঘুমাতে দেবে না৷ সারাজীবন আমাকে জ্বালিয়েছে, এখন তোমাকে জ্বালাচ্ছে। আমি দেখছি ওর কি হয়েছে।

হঠাৎ মায়ের আওয়াজ পেয়ে দুজনেই অবাক হয়ে গেলাম। আমি চোখমোটা করে নীড়ের দিকে তাকালাম। ফাজিলটা দরজা না লাগায় এতক্ষণ দাড়িয়ে ছিলো! নীড় কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর আস্তে করে বলে উঠলো,
– না মা, আমি থাকি আজ রাতে! ওর শরীরটা খারাপ করেছে বলছে।
– তুমি কি ডাক্তার!
– না মানে ও মেন্টাল সাপোর্ট পাবে।
– দরকার নেই আমি দেবো ওর যতরকম সাপোর্ট দরকার। তোমার আম্মাও আসছে৷ দুজনে একসাথে তোমার বউয়ের খেয়াল রাখবো। তুমি টেনশন না করে ঘুমাও।

বেচারা আর কিছু বলার সুযোগ না পেয়ে কাঁচুমাচু করতে করতে চলে গেলো।
– আমার মেয়ে হয়ে তুই এতো বেহায়া কি করে হলি? আমি প্রথমে বুঝিনি পরে বুঝছি ছেলেটাকে খাটানোর ফন্দিসব। ছেলেটা সারাদিন অফিস করে বাসায় আসে। আমরা এতো মানুষ সেবা করছি তাতে হচ্ছে না তোমার!
– আম্মা তুমি হচ্ছো আমার সব থেকে বড় শত্রু। তোমার সাথে আমার আর কোনো কথা নেই যাও।

মাকে আমি রেগে গেলে সবসময় আম্মা ডাকি৷আমি সবার সামনেই খুব শান্তশিষ্ট কিন্তু মাকে অনেক জ্বালাই ছোটোবেলা থেকে। আমার রাগ, জেদ সবই মার কাছে। তাই মা আমার কোনো কিছুই সিরিয়াসলি নেয়না।

মা আমার একপাশে আর শাশুড়ী আরেকপাশে, দুইজনের মাঝখানে আমি চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে শুয়ে পড়লাম। মেজাজটা এতো খারাপ হলো! কিন্তু কিছু করার নেই, আমার পুচকোর জন্য সবার এতো কেয়ার দেখে মনের মধ্যে একটা শান্তিও লাগলো। সবার কাছে ভালোবাসাটা অন্তত পাবে আমার পুচকো৷
দিনকাল এভাবেই চলতে লাগলো। আমার তো হাটাচলা করা নিষেধ তাই ফাজিলটা যেই বুঝছে যে আমি রাগ করে নেই তারপর থেকে অল্প অল্প সময় কাটায় আমার সাথে মাকে লুকায়। বুঝিনা কিসের এতো লজ্জা তার নিজের বউয়ের কাছে তার লুকায় কেনো আসা লগবে! আমার মাতো আমাকে চুপ করায় রাখতে পারে কিন্তু সে যদি প্রেসার দেয় তাহলে কি আমার মা তাকে কিছু বলতে পারে! দুইমহিলার ভালবাসার অত্যাচারে আমি হাপিয়ে উঠতে থাকলাম।

বেশকিছুদিন এভাবে কেটে গেলো। একদিন সবাইমিলে আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে গেলো আমার দাদা শ্বশুরের মৃত্যুবার্ষিক উপলক্ষ্যে৷ সন্ধ্যায় ফিরে আসবে৷ মা যেতে চাচ্ছিলো না কিন্তু আমার শ্বশুর শাশুড়ী বার বার বলাতে আর না করতে পারলো না। আমার ওষুধপত্র সব নীড়কে বোঝায় দিয়ে গেলো। শুধু ও আর আমি বাসায় আছি৷ নীড়ের হোম অফিস করতে হবে তাই ও ডাইনিংয়ে বসে অফিস করছে৷ রহিমা (কাজের মেয়েটা) আমার কাছেই বসে ছিলো। বেচারির সারাদিন অনেক কাজ করা লাগে বলে আমি তাকে আজ রেস্ট নিতে বললাম। তোমার ভাইয়া আছে ও দেখবে।

আমার তো সারাদিন শুয়ে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই তাই শুয়ে থাকলাম। শুধু ওয়াসরুম ছাড়া হাটাহাটিও করিনা। ওয়াসরুমে যেতেই হঠাৎ পেটে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো। নীচ দিয়ে তরল কিছু পড়তেই যা বোঝার বুঝে গেলাম কারণ সারাদিন শুয়ে শুয়ে দুনিয়ার সব চাইল্ডবার্থের বই আমার মোটামুটি পড়া শেষ। আস্তে আস্তে বের হয়ে ড্রইংয়ে যেয়ে দেখি সাহেব আমার খুব মনোযোগ দিয়ে অফিস করছে৷ পিঠে হাত রাখতেই ও আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি ইশারা দিয়ে বোঝালাম খুব জরুরী বিষয় লিভ নাও। সে লিভ নিয়ে আমার সামনাসামনি দাড়ালে বললাম,
– যাও একটা ব্যাগে আমার একটা শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট আর পুচকোর রুম থেকে ওর কিছু কাপড় চোপড়, ডায়াপার, টাওয়েল ভরে নিয়ে আসো৷
– কেনো?
– হাসপাতালে যেতে হবে৷ ওয়াটার ব্রেক করেছে। রহিমাকেও ডেকে নিয়ে আসো।
বেচারা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে থাকলো যেনো আমি অন্যকোনো ভাষায় কথা বলছি!
– Hurry up, বাবু। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
বলার সাথে সাথেই এদিকে ওদিকে পাগলের মতো ছুটাছুটি করতে লাগলো৷ একবার সোফায়, একবার দরজায়, একবার টেবিলে বাড়ি খেতে খেতে সে সবকিছু গোছাতে লাগলো। দরজায় এমন জোরে বাড়ি খেলো যে সাথে সাথে কপালের কিছু অংশ ফুলে উঠলো। বেচারা কিভাবে বাপের দায়িত্ব পালন করবে ভাবতেই ওর জন্য আমার কষ্ট হতে লাগলো।ব্যাথাও আস্তে আস্তে বাড়ছে বিধায় খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু নীড়ের লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে না দ্রুত যেতে পারবো৷ কোনোরকমে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করতে লাগলাম। অনন্তকাল পরে আমার স্বামী সবকিছু নিয়ে এসে আমার সামনে দাড়ালো। রহিমাও একইসময়ে এসে আমাকে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
– তুমি কি শর্টস পরেই হসপিটালে যাবে?
– মানে?
– নিচের দিকে তাকিয়ে দেখো।
স্যুট কোর্ট টাই পরে সাহেব সেজে শর্টস পরে ভদ্রলোক হোম অফিস করছেন। ব্যাপারটা ধরতে পেরে ও দ্রুত টিশার্ট আর জিন্স পরতে পরতে বেরোলো। রহিমার কাছে সব ব্যাগ দিয়ে, ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে আমাকে কোলে তুলে নিলো। গাড়িতে আমাকে কোলের উপর বসিয়েই ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বললে আমি বললাম,
– তোমার প্যান্ট নোংরা হয়ে যাবে। আমাকে একটা টাওয়েল বিছায় বসাও।
– তোমার মনে হয় এই সময় আমার প্যান্ট নোংরা হওয়া নিয়ে কোনো মাথাব্যথা আছে? তুমি একটু অপেক্ষা করো আমরা খুব দ্রুত পৌঁছে যাবো।
সারাপথ আমি ব্যাথায় গোঙাতে থাকলাম আর সে আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু দিতে থাকলো আর হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। সত্যি বলতে ও আমাকে টাচ করলেও আমার এখন বিরক্ত লাগছে কিন্তু বেচারা আমার কষ্ট কমানোর জন্য ড্রাইভার আর রহিমার সামনেই লজ্জার মাথা খেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে বলেই আমি কিছু বললাম না।

হাসপাতালে পৌঁছে আমাকে ডক্টর চাইল্ড কেয়ার ইউনিটে ঢুকিয়ে নিলো। প্রায় ৩/৪ ঘন্টার মতো নীড় আমাকে ধরে হাটাতে থাকলো। আমি শুধু কাঁদতে থাকলাম ওকে জড়িয়ে ধরে৷
– আর সহ্য হচ্ছে না বাবু।
– আর একটু সহ্য করো। ডাক্তার বললো এখনো টাইম হয়নি। আর সামান্য একটু কষ্ট করো প্লিজ৷
এর মাঝেই বাসার সবাই হন্তদন্ত হয়ে আমার কেবিনে ঢুকলো। মা আর আম্মু আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আর নীড়কে বাইরে পাঠিয়ে দিলো। তারপর কখন ডাক্তার আসলো আর কখন আমাকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে গেলো আমি জানিনা কারণ ব্যাথায় আমি ততক্ষণে নাজেহাল হয়ে গেছি। প্রথম যখন নিজের বাচ্চার কান্না শুনলাম তখনই আমার শেষ জ্ঞান ছিলো। বাচ্চার কান্না শুনতে শুনতে আমি আমার জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।

কতক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলো জানিনা। চোখ মেলে দেখলাম আমি নরমাল বেডে শুয়ে আছি। আমার পাশে মা, তান আর বাবা বসে আছে। বাবা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
– আমাকে এমন চাঁদের টুকরো নাতি উপহার দেওয়ার জন্য তোমার করা সব অন্যায় মাফ করে দিলাম যাও, মাম্পি। তোমার আর নীড়ের উপর আমার আর কোনো রাগ নেই।
– সত্যি বাবা! তুমি বিয়ের কথা জানাজানি হওয়ার পর একবারও আমার সাথে ঠিক করে কথা বলোনি। Thank you, বাবা। By the way, আমার ছেলে হয়েছে?
– হ্যা রে মাম্পি। কি যে সুন্দর হয়েছে তোর ছেলে! তোর বাবা তো কোলে নিয়েই কান্না করে দিলো।

মা পাশ থেকে বলতে বলতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো।
– আমার ছেলে কই মা?
– তোর শাশুড়ী আর শ্বশুর ওকে কারো কাছেই দিচ্ছে না। দুইজন কোলে নিয়ে বসে আছে। জানিস নার্স বললো, তুই তো এখনও ব্রেস্ট ফিড করাতে পারবি না তাই অন্য মায়েদের থেকে বাচ্চাকে খাইয়ে আনতে হবে। কিন্তু তোর শাশুড়ী নার্সের কাছেও দিচ্ছে না। নিজে কোলে করে নিয়ে তারপর বাচ্চাকে খাইয়ে নিয়ে এসেছে। মহিলা খুব বদ আছে আমার কাছেও দিচ্ছে না আমার নাতিকে।

বাবা একটা ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
– তুমি চুপ করবে! ওদের বংশের প্রথম বাচ্চা তাই একটু বেশি আদরের হবে এটাই স্বাভাবিক। মেয়ের শাশুড়ী সম্পর্কেও উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করেছো?
– আমাদের বংশের কয়নম্বর বাচ্চা এটা? আমাদের অধিকার নেই!
আমি না পেরে বললাম,
– মা তোমার শক্তির পরিচয় দাও বাইরে যেয়ে। তুমি শক্তিশালি না আমার শাশুড়ী শক্তিশালি তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। যদি তুমি আমার ছেলেকে আমার কাছে আগে নিয়ে আসতে পারো তাহলে আমার ছেলেকে তোমার কাছে রেখে মানুষ করবো।
– সত্যি বলছিস?
– মিথ্যা কেনো বলবো! তোমার কাছে থাকলে তো আমারই কোনো কষ্ট হবে না৷ আমি বেঁচে যাবো।
– আচ্ছা যাই তাহলে আমার নাতিকে নিয়ে আসি।
বাবা মাকে আটকাতে মায়ের পিছন পিছন গেলো। তানকে ডেকে বললাম,
– কিরে তোর ভাগ্নেকে নিয়ে তোর কোনো আনন্দ নেই যে।
– আমি আর ভাইয়া এখনও চান্সই পাইনি পুচকোকে দেখার। এই ৪ জনের কামড়াকামড়ি তে আমরা বিরক্ত।
– তোর ভাইয়া কি করছে?
– ছেলে হয়েছে শুনে ভাইয়ার সে কি কান্না জানিস! আমি ভাবলাম, ছেলে হওয়ার খুশীতে কান্না করতেছে। পরে সবার সামনে যখন বলে তার মেয়ে হওয়ার কথা ছেলে কিভাবে হলো! বাচ্চা পাল্টে ফেলেছে নার্সরা, ডাক্তারদের কাছে যেয়ে তর্কাতর্কি করতে থাকলো কিছুসময়।তোর শ্বশুর একটা ধমক দিয়ে চুপ করায় রাখছে। তারপর থেকেই সে চুপচাপ একা বসে আছে বাইরে।
– যা তোর ভাইয়াকে বল আমি ডাকছি।
কিছুসময় পর নীড় মুখটা ভার করে আমার পাশে এসে বসলে, আমি ওর হাতটা ধরে বললাম,
– খুব মন খারাপ তোমার?
– না।
– এমন মুখ ভার করে বলছো কেনো তাহলে! ছেলেকে দেখেছো?
– দূর থেকে দেখেছি।
– কোলে নাওনি?
– না পরে নিবো।
– পছন্দ হয়েছে?
– আমার ছেলে আমার কেনো পছন্দ হবে না!
– তািলে মুখভার করে আছো কেনো?
– এমনি।
– ওকে বাদ দাও৷ আমার গিফট কই?
– মেয়ে হলে গিফট দিতে চাইছিলাম৷
– ওহ্ আচ্ছা, আমি সুস্থ আছি, ছেলে সুস্থ আছে তাতে তোমার সুখ হচ্ছে না?
– তা কেনো হবে! আমি অনেক হ্যাপি৷
– একটু হেসে বলো!
এর মাঝে আমার শাশুড়ী বাচ্চা কোলে নিয়ে ভেতরে ঢুকলে, নীড়ের থেকেও দুঃখী একজনের দেখা পেলাম। আমার মায়ের মুখের দিকে আর তাকানোর মতো নেই। কষ্টে তার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আম্মু তার গলা থেকে চেন খুলে আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললো,
– পৃথিবীর সেরা সুখটা দেওয়ার জন্য তোমার ছোট্ট উপহার।

সূর্য আজ কোনদিক দিয়ে উঠেছে! শাশুড়ী বললো শ্বশুর নাকি আমার বাবাকে নিয়ে সারা হাসপাতাল মিষ্টি বিলি করতে গেছে। তারপর বাচ্চাকে আমার কোলে দিতেই নীড় আড়চোখে আমাদের দুজনকে দেখতে থাকলো। আব্বু আর বাবা এসে কিছুক্ষণ পর সবাইকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলো। আমি নড়ের হাত ধরে বললাম,
– তুমি কোলে নেবে না!
– পারিনা এতো ছোটো বাচ্চা কোলে নিতে।
– মানে ১০ মাস আমি বইলাম, এখনও আমিই বইবো?
রাগ করে কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার আঙুলে নতুন একটা আংটি পরানো। নীড়কে আংটি দেখাতে সে মাথা চুলকে বললো,
– তোমার গিফট আমি অনেক আগেই দিয়ে গেছি। তুমি অজ্ঞান ছিলে আমি কি করতে পারি!

পাগল একটা! এই ভালবাসার জন্যই সব ছেড়ে এসেছিলাম। এতদিন দুজন ছিলাম তবুও কতো সমস্যা আসলো, কে জানে ৩ জনের জীবনে আবার কতো সমস্যা আসবে?

চলবে?