নীড়ভাঙ্গা ভালবাসা পর্ব-২১ এবং শেষ পর্ব

0
552

#অন্তিম_পর্ব
#নীড়ভাঙ্গা_ভালবাসা
#লেখকঃমুহাম্মদ_রাফি

সবাই দুপুরে ঘুমানোর ফাঁকে ফারাহ্কে ধরে রুমে শুইয়ে দিলাম। তারপর বিকালের দিকে নীড়ের মামা মামি আসলে আমি নীড়কে তাদের সাথে কথা বলতে বললাম৷ কিন্তু ও বললো,

– আমি এই দুইটাকে অনেকবার বলছি আমি মামা মামির সাথে কথা বলবো কিন্তু ওরা আমার কথা শোনেনি। এখন এতদূর আগায় গেছে সবাই, আমি পারবো না বিয়েটা ভাঙতে। যা করার তোমার ভাইকে করতে বলো, আমি তোমাদের সাতেও নেই পাচেও নেই।

আমি পড়লাম মহা ফাপড়ে। শেষমেষ তানকে বুদ্ধি দিলাম যে এই কাজটা করতে পারলেই তুই ফারাহ্কে পাবি নাহয় ওর আশা ছেড়ে দে। ভাই তখন আমার কথামতোই কাজ করতে রাজি হলো। ড্রইংয়ে যখন সবাই বসে গল্প করছিলো তখন আমি নাফিকে কোলে নিয়ে নীড়ের মামা মামিকে সালাম দিলাম। তারা আমার সাথে টুকটাক লথা বলার পর আমি তানকে দেখিয়ে বললাম, আমার ছোট ভাই৷ তারা ওর টুকটাক খোজখবর নিলো। নীড়ের মামার খুব বড় আর্কিটেকচারাল ফার্ম আছে। তান আর্কিটেকচারে পড়ে শুনে উনি সাথে সাথে ওকে ইন্টার্ন হিসেবে এপোয়েন্ট করতে চাইলে তান সাথে সাথে ওনার পা জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে বললো,
– আমার ইন্টার্নশিপ চাই না আঙ্কেল। আমার শুধু আপনার থেকে একটা জিনিস চাই। প্লিজ না করবেন না৷
– কি চাও?
– আগে কথা দিন আমি যা চাইবো দিবেন?
– আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই দেবো।
– আপনার মেয়ের সাথে আমার অনেকদিনের সম্পর্ক, কিন্তু আমি এখনও পড়াশুনা শেষ করতে পারিনি বলে তাকে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করতে বলেছিলাম। কিন্তু আঙ্কেল আমি ওকে প্রচন্ড ভালবাসি। বেবেছিলাম ও সুকে থাকলেই আমি ভালো থাকবো। কিনৃতু ওকে ছাড়া আমার জীবনটা ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। কোনোকিছুর বিনিময়ে ওকে হারাতে পারবো না আমি। আপনি যা বলবেন আমি সব মেনে নেবো। আমি হয়তো ওকে আপনার মতো ঐশ্বর্যের মাঝে রাখতে পারবো না কিন্তু আপনাকে কথা দিচ্ছি ওকে আমি রানীর মতো রাখবো৷ আপনি প্লিজ আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিন।
– আমার মেয়ের যদি তোমাকে বিয়ে করার ইচ্ছা থাকতো তাহলে ও আজ এঙ্গেজমেন্ট করতে রাজি হতো না বাবা।
– আঙ্কেল ও আমাকে ছাড়া বিয়ে করবে না বলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে আছে। যাতে কোনো উপায়েই আজ এঙ্গেজমেন্টটা না হয়।
তানের সাথে আমি আর নীড়ও সায় দেওয়াতে অনেক বাকবিতন্ডার পর ফারাহর অজ্ঞান অবস্থা দেখে মামা মত দিলেন। কিন্তু বললেন এইসব হারাম সম্পর্ক তিনি মেনে নেবেন না৷ আমার বাবা মা কে ডেকে আজই বিয়ে পড়িয়ে দিতে হবে। অগ্যতা বাবা মাকে ডেকে আমরা পুরো ঘটনা জানালে বাবা তো তানের হাড়গোড় ভাঙ্গার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। আমরা সবাই বাবাকে থামিয়ে বিয়ের ব্যাপারে রাজি করলাম। একফাকে আব্বু তার বন্ধুকে ফোন করে ফারাহর ঐ বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিলো।

মোটামুটি বিয়ের সব রেডি করতে করতে রাত ১০ টার মতো বেজে গেলো, ততোক্ষণে ফারাহর জ্ঞান ফিরলো। মেয়েটা তালগোল পাকিয়ে ফেললো সবকিছু শুনে। তান যে ওকে পাওয়ার জন্য ওর আব্বু পা ধরতে পারে জেনে মেয়েটার কান্না তো আর থামেইনা৷ ও বারবার বলতে থাকলো, আজ রাগের বশে যদি এম্গেজমেন্টটা করে ফেলতো তাহলে কি হতো ওর ভালবাসার? শেষমেষ বিয়ে হতে হতে মাঝরাত হয়ে গেলো। কনেকে এখনই বাসায় তোলা সম্ভব না, তান আর ফারাহর সেমিস্টার শেষেই ওকে উঠিয়ে নেওয়া হবে৷

পরদিন সকালবেলা নীড় অফিস চলে গেলে, আমি রান্নাঘর গুছিয়ে নাফিকে কোলে নিয়ে আম্মুর রুমে গেলাম৷ আম্মু আমাকে দেখে কিছুটা অবাক হলো কারণ আমি সচরাচর আম্মুদের রুমে আসিনা। নাফিকে বিছানায় শুইয়ে রেখে আমি আম্মুর পায়ের কাছে বসতেই আম্মুর বিস্ময় চরম সীমায় পৌঁছালো। আমি বললাম,
– আম্মু, এখন কি আপনার খেলাটা বন্ধ করলে হয়না? আর কত! আপনি কি ক্লান্ত হচ্ছেন না? এখন তো আপনার নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে আপনার খেলাটা বন্ধ করা উচিত।
– কি বলতে চাও তুমি?
– আপনি আমি দুজনেই জানি আমি কোন ব্যাপারে কথা বলছি।এখন তো সব কিছুর শেষ হওয়া দরকার আম্মু৷ আমি সবাইকে নিয়ে শান্তিতে সংসারটা করতে চাই বলেই আপনার ছেলেকে কিছুই জানাইনি আপনার কীর্তি। ভেবে দেখুন তো, আপনার ছেলে যদি জানতে পারে যে আপনি চালাকি করেই সেদিন বাথরুমে গেছিলেন যাতে আমি নীড়কে ভুল বুঝে ওকে ছেড়ে চলে যাই তাহলে কি হবে? আপনার কি মনে হয় তার নিজের মায়ের জন্য যখন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী হসপিটালাইজড হয়েছিলো, তার অনাগত বাচ্চার প্রাণসংশয় পর্যন্ত হয়েছিলো এটা জানার পর একমুহূর্ত কি আপনার ছেলে এই বাসায় থাকবে আমাদের নিয়ে!
আমি মানছি আপনি নাফির ক্ষতি চাননি, আমি যে ওতো অসুস্থ হয়ে যাবো আপনি বুঝতে পারেননি। কারণ আমার ছেলের জন্য আপনার ভালবাসা মিথ্যা না। আমি দেখেছি আপনি নাফিকে কতো ভালবাসেন। আমি নিজেও মা হয়েছি তো তাই আপনাকে নীড়ের থেকে আলাদা করতে চাইনি বলেই সবকিছু জানার পরও ওকে কিছু জানায়নি৷ কিন্তু আপনি আবার তানকে ফারাহর থেকে দূর করার জন্যই ফারাহর বিয়ের জন্য তৎপর হয়েছিলেন সেটাও তো আমি জানি। আমি আমার ভাইকে প্রচন্ড ভালবাসি তাই ওর কষ্টে যেনো আমি কষ্ট পাই তাই আপনার এই প্লান ছিলো,আমি জানি। কিন্তু আমি ভালো না থাকলে কি আপনার ছেলে, নাতি ভালো থাকবে? ভেবে দেখুন না আম্মু!

আম্মু প্লিজ আপনার পায়ে পড়ি আপনি আর আমার উপর রাগ রাখবেন না৷ চলুন না সুন্দরভাবে সংসারটা করি? আপনি আমার কাজের দোষ ধরবেন কোনো সমস্যা নেই আমি সারাজীবন আপনার মন পাওয়ার জন্য চেষ্টা করবো৷ কিন্তু যদি কোনোভাবেই আপনি আমাকে মেনে নিতে না পারেন আমি এখনই এইবাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। আর আপনার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো না। আমি আপনার ছেলেকে ভালবাসি বলেই আপনার সব অন্যায় জেনেও চুপ করে থাকি। কারণ সে আপনাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। আর আপনাকে ছাড়া, আব্বুকে ছাড়া শুধু আমাদের নিয়ে ও সুখী হবে না৷ আমি এখন যদি এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাই, আপনি না আটকান তাহলে আমার থেকে সব চেষ্টা আজ এই মুহূর্ত থেকে বন্ধ হয়ে যাবে।

আম্মু কিছু না বলাতে আমি উঠে নাফিকে কোলে নিতে গেলে আম্মু আমার হাত সরিয়ে দিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন,
– আমার নাতি আমার কাছেই থাকবে। তোমাদের যেখানে খুশী যাও।
– আপনি ওকে রাখতে পারবেন না আম্মু ও এখনো বুকের দুধ খায় আর আমি আমার ছেলেকে কখনো ছেড়ে কোথাও যাবো না।
-তুমি তোমার এই কয়মাসের বাচ্চাকে রেখে থাকতে পারবা না, তাহলে আমার ছেলেকে নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার কথা তুমি ভাবো কোন সাহসে?
– আমি ভাবতে চাইনা আম্মু, বিশ্বাস করুন। কিন্তু আপনি যদি সবসময় আমাদের সম্পর্ক ভাঙার চেষ্টা করতে থাকেন তাহলে আমি কিভাবে এই সংসার করবো? আমাকে মেয়ে মনে করতে হবে না আপনার শুধু ছেলের বউ হিসাবে শান্তিতে সংসারটা করতে দিলেই হবে। আমার আর কিছু চাইনা।
– ঠিক আছে যাও তোমাকে আমার ছেলের থেকে আলাদা করার কোনো চেষ্টা আমি আর করবো না কথা দিলাম কিন্তু তার থেকে বেশি কিছু আমার থেকে আশা করোনা তুমি।
– থ্যাংক ইউ আম্মু।

এরপর কেটে গেছে বহুদিন। আম্মু এখনও আমাকে ভালবাসেনা কিন্তু একটা অদ্ভুত মায়ায় পড়ে গেছে একসাথে থাকতে থাকতে। আমি বাপের বাড়ি গেলে সে নানা অজুহাতে আমাকে তলব করে। যদিও বলে যে সংসারের ভার তার উপর দিয়ে ঘুরে বেড়ানো সে সহ্য করবে না। কিন্তু আমি তার না বলা কথাতে বুঝি আমাকে সে মিস করে৷
নীড় এখনও আম্মু বলতে অজ্ঞান। কিন্তু স্ত্রীও যে জীবনের বড়একটা অংশ সেটা সে বুঝতে শিখেছে। ওর জীবনের একটাই আফসোস তার এখনও কোনো মেয়ে হয়নি৷ ৪ ছেলের বাপ হয়ে গেছে সে কিন্তু মেয়ের বাপ আর তার হওয়া হলো না৷ মাঝে মাঝে তার মলিনমুখটা দেখে কষ্ট লাগে কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানিতে আমরা ভালো আছি। নীড়ের বোনও এখন আস্তে আস্তে আম্মুর সাথে সম্পর্কটা নতুন করে শুরু করছে। মায়ের সাথে তিক্ত অভিজ্ঞতা তাকে পোড়ালেও সে চেষ্টা করছে স্বাভাবিক হতে।

জীবনের এই জার্নিটা আমার খুব সহজ ছিলো না৷ ভালবাসার মানুষটার হাতটা ধরা হয়তো অনেক সহজ কিন্তু সারা জীবন সেটা দরে একসাথে চলাটা অনেক কষ্টের। আমার ধৈর্য্য আমার ভালবাসা আর আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস আজ আমাকে আমার সুন্দর সংসারটা উপহার দিয়েছে। তাই পারলে সবাই ধৈর্য্য ধরুন। আর জীবনে নানা ঝড়ঝাপটা আসবে কিন্তু ভালবাসার মানুষটাকে পারলে ছেড়ে যাবেন না। কারো জন্য জীবন হয়তো থেমে থাকে না কিন্তু কাউকে হারানোর শূন্যতাটা কখনো পূরণ হয়না৷

#সমাপ্ত