নেশাক্ত তোর শহর পর্ব-০৪

0
704

#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০৪

অজানা মানুষের স্পর্শে শরীরের শিরায় শিরা গভীর ঝাঁকুনি অনুভব করলো তৃষ্ণা। ইতিমধ্যে প্রতিবেশীদের কথায়, কষ্ট অনুভব করে শরীরটা অনেকটাই কেঁপে উঠেছে । সেই অস্বাভাবিক কম্পনের সাথে আয়াতের দেওয়া স্পর্শে কম্পিত হলো সে । কাঁপা কাঁপা হাতে আয়াতের এগিয়ে দেওয়া কুঁচি গুলো নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিল । কোনো দিকে না তাকিয়ে কোনো উপায়ে কোমরে গুঁজে পূর্ণরায় উপরে আসার জন্য পা বাড়ালো।
হাত ধরে থামিয়ে দিল আয়াত । কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল..

— “আজকের পর থেকে সাবধানে এবং সামলে শাড়ি পড়বে । যদি সমস্যা হয়, বেল্ট ইউস করবে । আর যদি অতিরিক্ত সমস্যা হয়, তাহলে শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পড়বে । ভুলেও যাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে ।এবার যাও..

মাথা নিচু করে আয়াতের কথায় সায় দিলো তৃষ্ণা। ধরে রাখা হাত ছাড়িয়ে নিল। নত ভঙ্গিতে বড় বড় পা ফেলে উপরে চলে গেল। তৃষ্ণাকে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে তৃক্ষ্ম চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলল…

— “কি জানো বলেছিলেন একটু আগে !! ও হে মনে পড়েছে .
কোন মেয়ে বিয়ের আগে শাড়ি পড়ে বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি করে, একটু বলবেন ? আচ্ছা আপনি কি বিয়ের আগে শাড়ি পড়তেন? আচ্ছা বাদ দিন । তৃষ্ণার মতো মেয়েকে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিতেন না । সত্যি টা কি জানেন আন্টি, আপনার মতো শাশুড়িরা তৃষ্ণার মতো মেয়েকে ডিজার্ভ করে না । বাবা মায়ের আদরে কোনো সন্তান বাঁদর হয়না ।
যে মেয়ে নিজেকে সামলাতে পারে না , সে কিভাবে আমাকে সামলাবে ।আমার মা যাতে আমার ওয়াইফকে মেরে জব্দ করে ফেলে । আন্টি আমার ওয়াইফ কোনো অলংকার নয় যে তাকে জব্দ করে নিতে হবে ।তাকে মারবো নাকি আদর করবো সেটা ব্যক্তিগত আমার এবং একান্ত ” আয়াত রিদুয়ান” এর ব্যাপার ।বাইরের কারো ইন্টা-ফেয়ার আমি এলাও করবো না ।মাইন্ড ইট”।

একদমে কথাগুলো বলে থামলো আয়াত। রাগে ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে সংযত করছে ।

— “তৃষ্ণার খাবারটা রুমে দিয়ে যাস”।

কথাটা বলে লেবু নামক কাজের মেয়েটাকে ইশারা করলো আয়াত। লেবুর সম্মতি পেলে মিনিট খানেক সময় নিল না আয়াত। হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল ।আয়াত যেতেই উঠে দাঁড়ালো তারা । প্রচ্ছন্ন কন্ঠে বললেন..

— “সাদর আমন্ত্রণে বাড়িতে ডেকে এভাবে অপমান না করলেও পারতি মনু “।

হাতের উল্টো পিঠ দেখিয়ে থামিয়ে দিল মনিকা। স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন..

— “আমি তোদের অপমান করতে ডাকি নি, আমার পুত্রবধূকে দোয়া করতে ডেকেছিলাম । কিন্তু তোরা কি করলি, উল্টো আমাদের আনন্দময় পরিবেশটাকে নষ্ট করে দিলি।
আমাকে শাসনের জ্ঞান দিয়েছিলি না। তাহলে তোর বউমা তোর ছেলে ,কেন তোর সাথে থাকে না ? তাকে অন্তত একটু শাসন করার দরকার ছিলো । এবার আসতে পারিস” ।

________________________
বালিশে মুখ গুজে কুপিয়ে কুপিয়ে কেঁদে চলেছে তৃষ্ণা। এতো গুলো বাজে কথা শুনিয়েছে তাকে , সবটা মুখ বুঁজে সহ্য করে নিত সে । কেন তার মৃত বাবা মাকে নিয়ে সামান্য একটা ব্যাপারে কটু কথা শুনি দিল । যা সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।
দরজায় হেলান দিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে আয়াত । যে মেয়েটার থেকে বিন্দু পরিমাণ দূরে অবস্থান করলে নিজেকে পাগলের নিম্ন মানুষ হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করে ।সেই প্রিয় মানুষটিকে এভাবে কাঁদতে দেখে ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে যাচ্ছে সে। ভেতরে প্রবেশ করে রুমের এক কোণ থেকে অন্য কোণে পায়চারী করে কাঠ কাঠ গলায় বলল..

— “আয়াত রিদুয়ানের ওয়াইফ হবে কঠিন মনের। সামান্য একটু কথায় বাচ্চাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদা, ডোন্ট লাইট মি “।

মাথা তুলে তাকালো তৃষ্ণা। দুটো রক্তবর্ণ চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন চোখের আগুনে ঝলসে ফেলবে তাকে। ক্ষনে ক্ষনে কপালের রগ দুটো তীব্র ভাবে আতঙ্কতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আয়াতের অবস্থা যাচাই- বাছাই করে পূর্বের ন্যায় বালিশে মুখ গুজে নিল। টান টান হয়ে নিজের সকল শক্তিটুকু বেডের উপর ছেড়ে দিল।
তৃষ্ণার পায়ের দিকে অবলোকন করে এগিয়ে গেল সে। পায়ের ব্যান্ডজটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। নিজের উপর উষ্মা হলো সে। মেয়েটা পায়ের ব্যাথায় ব্যাথিত হচ্ছে আর সে হাজারটা রুদ্র বচন শুনিয়ে দিল ।
মোটা ব্যান্ডেজ করা পায়ে কিছুক্ষণ মশৃণভাবে হাত ছুঁয়ে দিল । অতঃপর ধীরে ধীরে রঞ্জিত ব্যান্ডজগুলো সময় নিয়ে অতি সাবধানে খুলে ফেলল ।
ব্যান্ডেজের শেষ প্রান্তটা ধরে টান দিতেই ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো তৃষ্ণা । দৃঢ় বান্ধনে আবদ্ধ করে নিল বেডশিট। মনে হলো কেউ পায়ের ব্যাথার্থ স্থানটা ছিঁড়ে নিয়ে গেল। চিৎকার দিতে গিয়েও দিল না। কথায় কথায় গায়ে হাত দেওয়া পছন্দ নয় তার।
আয়াত শোণিত ব্যান্ডেজ দিয়ে ধীরে ধীরে তৃষ্ণার পায়ে জমাট বাঁধা রক্ত গুলো মুছে দিল। পূর্বের মতো ব্যান্ডেজ করল না। তৃষ্ণার দুইবাহুতে হাত রাখল , অতঃপর তৃষ্ণার হাত নিজের কাঁধে রেখে ধীরগতি ভাবে শোয়া থেকে উঠে বসালো। অপরাধী কন্ঠে বলল..

— “আই এম সরি তৃষ্ণা। আমি বুঝতে পারিনি ।বুঝলে কখনো ওভাবে বলতাম না। তোমার যত সমস্যা হবে আমাকে বলবে। আমি কি বাইরের লোক না-কি, তোমার হাসবেন্ড তো “!

আয়াতের শান্ত কন্ঠে ভেতরে ভেতরে এক প্রকার ঝড় বয়ে গেল তৃষ্ণার। একটু আগে যে ছেলে চোখ গরম করে তাকে শাসিয়ে ছিল এখন সেই ছেলে অপরাধী কন্ঠে ক্ষমা চাইছে। আয়াতের এমন ভঙ্গিমা রিজভীর সাথে অনেকটা মিল আছে। নিজেকে নতুনভাবে কারো মায়ায় ঝরাতে ভয় হচ্ছে তার। কিন্তু অবুঝ মন তার কথায় সায় দিচ্ছে না। আচ্ছা সে আদোও কি আয়াতের স্ত্রী হওয়ার যোগ্য।নিজের হাতটা কাঁধ থেকে নামিয়ে অস্ফুট কন্ঠে বলল..

— “আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন, নিজেকে আপনার জন্য প্রস্তুত করতে চাইছি। যোগ্য হতে চাইছি আমি’।

কাতর মুখটা হাসৌজ্জ্বল মুখে রুপান্তরিত হতে সময় লাগলো না আয়াতের। বাহু থেকে হাতটা না সরিয়ে সামান্য ঝুঁকে দুহাতের গভীর বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল তৃষ্ণাকে।
বিব্রত বোধ করলো তৃষ্ণা। হুটহাট জড়িয়ে ধরা , পায়ে হাত দেওয়াতে ক্ষনে ক্ষনে তাকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। সেই ব্যাপারটা কি আয়াত নামক মানুষটা বুঝতে পারে না। আয়াতের চুলের বাজে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল..

— “কি করছেন? ছাড়ুন। যখন তখন যে কেউ এসে পড়তে পারে”।

ছাড়লো না আয়াত। বরংচ শক্তিশালী শরীরের সমস্ত ভড় তৃষ্ণার উপর ছেড়ে দিল ।পড়ে যেতে নিলে বেডের উপর হাতের করতলে ভড় করে নিজেকে সামলে নিল সে।

— “ছোট ভাইজান আপনার খাবা..! বিশ্বাস করেন ভাইজান আমি কিচ্ছু দেহি নাই “। (উল্টো ঘুরে লেবু)

দুজনকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে উল্টো ঘুরে গেল লেবু। আয়াতের কথায় খাবার দিতে এসে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ভাবতে পারে নি।
তৃষ্ণাকে ছেড়ে এক লাফে সরে গেল আয়াত। আয়াত সরে যেতেই শাড়ি ঠিক করলো তৃষ্ণা।
দেয়ালের হেলান দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল..

— “আমাদের প্রাইভেট সময় নষ্ট করে এসেছে, কিছু দেখিনি।
এসেই যখন গেছিস , তাহলে বাইরে দাঁড়িয়ে ডং না করে ভেতরে আয়। তাছাড়া এখানে তেমন কিছুই হয়নি। হলে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকবে”।

চপল পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো লেবু। শব্দময়ে খাবারের প্লেটটা টেবিলের উপর রাখল। আড় চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে সময় নিয়ে ভেংচি কাটলো।মাথার দুপাশে ঝুঁলে থাকা লম্বা বেণুনী দুটো দুহাতে ঘুড়িয়ে ভাব নিয়ে বলল..

— “আমার বয়ে গেছে। তোমাদের প্রাইভেট সময়ে আসতে । খাবার দিতে বলেছিলে তাই এলাম”।

বেণুনী দুটো নাচাতে নাচাতে প্রস্থান করলো লেবু নামক কাজের মেয়েটি। লেবু যেতেই চোখ বড় করে আয়াতের দিকে তাকালো তৃষ্ণা। তৃষ্ণার মুখের রাগী আভা দেখে চুপসে গেল আয়াত। ঠোঁট প্রশস্ত করে মলিন হয়ে বলল…

— “চিন্তা করছো কেন? পিয়াসু পাখি। আরো আদর হবে ,আগে খেয়ে নাও”।

আগ্নেয়গিরির মতো ফুটতে লাগল তৃষ্ণা। টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসটা খপ করে হাতের মাঝে বন্দী করলো। পানিটুকু আয়াতের দিকে ছুঁয়ে মারলো। তারপরেও শান্ত হলো না সে, পূর্ণরায় গ্লাসে পানিতে পূর্ন করে নিল।
দুহাতে মুখ আড়াল করতে গিয়েও পারল না আয়াত। তার আগেই তৃষ্ণার ছোড়া পানিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল। এখানে থাকলে ভূমিকম্পন থেকে শুরু করে সাইক্লোন পর্যন্ত হতে পারে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আয়াতের।চোখ বন্ধ করে এক দৌড়ে রুমের বাইরে চলে গেল সে।
আয়াত বেরিয়ে যেতেই ভর্তি গ্লাসটা এক ঢোকে খালি করে নিল তৃষ্ণা। একটু আগের দৃশ্য গুলো ক্রমাগত চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আদোও এমন অদ্ভুত অনুভুতির কোনো নাম আছে কি-না জানা নেই তার। বুঝতে পারছে, আয়াত নামক মানুষটার সাথে ক্রমশ দৃঢ় প্রত্যয় জরিয়ে পড়ছে সে।।

(চলবে)