নেশাক্ত তোর শহর পর্ব-০৯

0
609

#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৯

— “ঠিক আছে ঘুমিয়ে পড়বো। আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে। আসলে এতো দিনে কাজের চাপে মাথাটা পুরো ধরে আছে। যদি অফিসের কাজ করতাম তাহলে চা খেলেই কমে যেত”।

আয়াতের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করলো না তৃষ্ণা। কোল থেকে ল্যাপটপ টা সেন্টার টেবিলের উপর রাখল। গুছিয়ে রাখা বালিশটা নিজের কোলের উপর রাখলো। আয়াতের মাথাটা টেনে নিজের কোলের উপর রাখা বালিশটার উপর রাখল। চুলের ভাঁজের হাত রেখে সুন্দর ভাবে চুলগুলো টেনে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
তৃষ্ণার হাত ছাড়িয়ে উঠে বসলো আয়াত। কোলের উপর থেকে বালিশটা সরিয়ে পূর্ণরায় তৃষ্ণার কোলে মাথা রাখল। তৃষ্ণার হাতজোড়া নিজের চুলের ভাঁজে রেখে চোখ জোড়া গ্ৰথন করে বলল..

— “তোমার শরীরে উষ্ণভাব টা বালিশের কারণে পুরোপুরি আমার কাছে আসছে না। তাই আসার ব্যবস্থ করলাম”।

বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করলো দুজনের মাঝে। নিরবতা কাটিয়ে আয়াত মুখ খুললো..

— “তৃষ্ণা তোমার কি তোমাদের বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। বিয়ের পর তোএকবারও যাও নি”।

— “আগে ইচ্ছে করত না বাট এখন করে। পুরোনো সেই দিন গুলোকে বড্ড মিস করি”।

— “তাহলে চলো কালকে যাই। আমারও বন্ধ আছে। তাছাড়া তুমি যদি চাও তাহলে বেশ কিছুদিন থাকতেও পারো”।

“আর আপনি” বিরবির করে উচ্চারণ করলো তৃষ্ণা। ভ্রু কুঁচকে বলল..

— “তুমি তো জানো, কাজের চাপে বাবা দেশে ফিরতে পারছে না। আমাদের বিয়েতেও আসতে পারেনি। তাই আমি ভেবেছি, কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে গিয়ে থাকবো, বাবাকে হেল্প করবো। তুমি চাইলে পুরোটা সময় সেখানে থাকতে পারো”।

চুপ হয়ে গেল তৃষ্ণা। অজানা মন খারাপ এসে তৃষ্ণার মনে ভর করলো। বুকের মাঝে আয়াতের শূন্যতা অনুভব করলো সে।

_____________________
বেশ কিছুক্ষণ আগে তাহসানের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে আয়াত তৃষ্ণা। আসার সময় পুরো বাজার তুলে এনেছে। তৃষ্ণার বারণ আয়াত শুনেনি। তার একটাই কথা,” প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি,, ফাঁকা হাতে কিছুতেই যেতে পারবো না। প্রয়োজনে পুরাতন হলে কিছুই নেবো না”। তাই কিছু বলার অবকাশ পাইনি তৃষ্ণা।
সেখানে এসে চমকে গেছে দুজনে। আগে থেকেই সেখানে রিজভী আর তিশা উপস্থিত ছিল। তবুও স্বাভাবিক বিহেব করেছে। তার ভাবনার আয়াতকে ঘিরে অন্যকোনো পুরুষের অস্তিত্ব সেখানে নেই।

সোফায় বসে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তৃষ্ণা। সাথে পেটে ক্ষুধার জ্বালা যোগ হয়েছে। ভাবীর কড়া নির্দেশ ছেলেরা না আসা পর্যন্ত খাওয়া যাবে না।
তাহসান, আয়াত, রিজভী জুম্মার নামাজ আদায় করতে মসজিদে গেছে।

দুহাতে পেট চেপে রান্না ঘরের ভেতরে চলে গেল তৃষ্ণা। শান্তা শাওয়ার নিতে গেছে। নিঃশব্দে বাটির ঢাকনা সরিয়ে লোভাতুর দৃষ্টিতে ইলিশ মাছের ঝোলের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রতিটি পিচের ভেতরে ডিমের ভর্তি। ঝোল ছাড়িয়ে ডিম ভর্তি ইলিশ মাছের থেকে ডিমটুকু বের করে মুখে পুড়ে নিল।‌ অতি দ্রুত চিবিয়ে এক ঢোক পানি খেয়ে শান্তির শ্বাস ছাড়লো। এবার যদি তার ভাবী জানতে চাই কে মাছ খেয়েছে। তাহলে সোজা উত্তর দেবে। “ঐ বাড়ির ছুঁছুম বিড়াল খেয়েছে।
এইসব ভেবে নিজেই শব্দ করে হেঁসে উঠলো।

— “তুমি এখানে কি করছ”?

ভরকে গেল তৃষ্ণা। প্রতিবারের মতো আজও ফেঁসে গেল সে। শব্দহীন হাতে ঢাকনাটা বাটির উপর রেখে পেছনে ফিরে মেকি হাসি দিল।
এগিয়ে এলো আয়াত। পেছন থেকে তৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরে গম্ভীর কন্ঠে বলল..

— “তুমি চুরি করছ তৃষ্ণা। তোমার থেকে এটা আমি এক্সপেক্ট করি নি”।

নিজের ভেতরের সাহস সঞ্চয় করে থেমে থেমে উত্তর দিল..

— “আমি যে চুরি করেছি তার কি প্রমান আছে হ্যা? আজকাল লোকেরা সাক্ষী প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করে না”।

তৃষ্ণাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল..

— “আই সি। সাক্ষী হচ্ছি আমি নিজে আর প্রমান হচ্ছে তোমার মুখের কোণে লেগে থাকা ডিমের গুঁড়ো”।

ঠোঁট উল্টে আয়াতের দিকে তাকিয়ে মুখ মুছতে নিলে, হাত ধরে থামিয়ে দিল আয়াত। উপায় না পেয়ে করুন সুরে বলল..

— “প্লীজ মুছতে দিন, সবাই দেখলে কি ভাববে। প্রয়োজনে আমি আপনাকেও ঘুষ দেবো”।

— “কি ঘুষ”।

অপেক্ষা করলো না তৃষ্ণা। অন্য একটা মাছের ডিম বের করে আয়াতের দিকে এগিয়ে দিলো। আকস্মিক ঘটা তৃষ্ণার এমন ঘুষের জন্য আয়াত প্রস্তুত ছিলো না। তাতে তৃষ্ণার কিছু যায় আসেনা। একহাতে আয়াতের গাল চেপে পুরো ডিম মুখে পুড়ে দিয়ে হাত ধুয়ে নিল।
.
সবাই তৃপ্তি করে খেতে বসেছে। তৃষ্ণা আর শান্তা সবাইকে পরিবেশন করে দিচ্ছে। শান্তার জোরাজুরিতে তৃষ্ণাও খেতে বসেছে। তাহসান বোনের প্লেটে খাবার সাজিয়ে ইলিশ মাছ দিতে গেলেই চোখ ছানাবড়া। একটা ইলিশ মাছেরও ডিম নেই। তৃষ্ণা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ইনোসেন্স ফেস করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল..

— “ভাইয়া বিয়ের পর প্রথমবার এলাম। আর তুমি কিপ্টামো করে ডিম ছাড়া ইলিশ মাছ এনেছ? আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি চাও নি আমি এই বাড়িতে আসি। যাও আমি আর আসবো না। এবার খুশি তো”।

তৃষ্ণার উদ্ভর কথাবার্তা শুনে আয়াতের চোখ কপালে। একটু আগে রান্না ঘরে বসে সব ডিম সাভার করে দিয়ে এখন ইনোসেন্স ভাব নিচ্ছে।
তাহসান ক্ষুব্ধ চোখে শান্তার দিকে তাকালো। আজ তৃষ্ণারা আসবে বলে, বাজার থেকে বড় বড় ডিম ওয়ালা মাছগুলো কিনে এনেছে।
— “ডিমগুলো কোথায় শান্তা”।

নরম কন্ঠে ভয় পেয়ে গেল শান্তা। সে তো ডিমগুলো সরায় নি তাহলে গেল কোথায়। শান্তা মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আয়াত বলল..

— “আসলে কি হয়েছে ভাইয়া। আপনাদের পাশের বাড়ির ছুঁছুম বিড়াল টা মাছগুলো বেছে বেছে ডিমগুলো খেয়ে গেছে। আমি কতো করে বললাম, ডিমগুলো রেখে মাছগুলো খাঁ। ডিম আমার বউয়ের খুব পছন্দ কিন্তু শুনলোই না।
বলল, শাড়ি পড়া না থাকলে সবগুলোই খেতাম”।

সরাসরি তৃষ্ণাকে না বোঝালেও ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে সেই তৃষ্ণাকেই মিন করছে আয়াত। তাহসান আয়াতের কথার মানে বুঝতে না পেরে বলল..

— “বিড়াল আবার শাড়িও পড়ে”?

— “এটা যেই সেই শাড়ি না। একদম কালো শাড়ি”।

কালো শাড়ি শুনতেই সবাই আড়চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকালো। সামান্য সময় তৃষ্ণার কান্ড দেখে শব্দ করে হেঁসে উঠল সবাই। তৃষ্ণা আয়াতের দিকে তাকিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। নাক টানতে টানতে বলল..

— “এরজন্যই আমি আপনাকে ঘুষ খাইয়ে ছিলাম হ্যা। আপনি সবার সামনে আমাকে এভাবে! ভ্যাঁ ভ্যাঁ”।

তৃষ্ণা হাত নাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে হুট করে গরম তরকারির বাটিতে ধাক্কা লাগল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আয়াতের পাঞ্জাবির উপরে পড়ল। আকস্মিক ঘটা দূর্ঘটনায় জন্য সবাই হতবাক হয়ে গেল। চর্বিযুক্ত গরম তরকারি আয়াতের শার্টের সাথে আঠার মত লেগে আছে। আয়াত দ্রুত পাজ্ঞাবি শরীর থেকে খানিকটা দ্রুতে নিয়ে বুকে ফুঁ দিতে লাগলো।
তৃষ্ণা খাওয়া ছেড়ে আয়াতের দিকে এগিয়ে গেল। আয়াতের পাজ্ঞাবীতে হাত দিতেই “আহহ” করে চিৎকার করে উঠলো তৃষ্ণা। তৃষ্ণার চিৎকার শুনে আয়াত পাজ্ঞাবী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তৃষ্ণার হাতের দিকে দিল। তৃষ্ণা হাতে ফুঁ দিচ্ছে। একহাতে নিজের পাজ্ঞাবী অন্যহাতে তৃষ্ণা হাত ধরে বেসিনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। ট্যাপ ছেড়ে ধীরে ধীরে তৃষ্ণার হাত পরিস্কার করে নিল।

— “ভাবী একটু মলমটা রুমে দিয়ে যাবেন”।

বলে অপেক্ষা না করে তৃষ্ণার হাত ধরে উপরে চলে গেল। রুমে এসে এক টানে শরীর থেকে পাজ্ঞাবী খুলে ফেলল। চিবুকে প্রচুর পরিমাণে জ্বলছে তবুও কোনো আক্ষেপ নেই তার। তৃষ্ণার কষ্টের কাছে তার কোনো ব্যথা কিছুই নয়।
তৃষ্ণার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি ঝড়ছে। আয়াত তৃষ্ণার পাশে বসে করুন সুরে বলল..

— “খুব জ্বলছে। একটু দেখে শুনে কাজ করতে পারো না। হাত পুড়ে গেলে কি হতো।
একটু অপেক্ষা করো, ভাবী এক্ষুনি মেডিসিন নিয়ে আসবে”।

আয়াতের গলা জড়িয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলো তৃষ্ণা। অপরাধী কন্ঠে বলল..

— “আ’ম সরি। আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি। কিভাবে পড়ে গেল বুঝতে পারিনি। সামান্য হাতে লেগেই আমার এতো জ্বলছে। আর আপনার তো।
আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না”। (আয়াতের চিবুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে)

এক দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ির অর্ধ আঁচল ভিজিয়ে ফিরে এলো আয়াতের কাছে। অতি সাবধানে সময় নিয়ে আয়াতের চিবুকে লাল হয়ে যাওয়া অংশে ভিজিয়ে নিচ্ছে।

(চলবে)