নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব-৬+৭

0
457

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৬

পুলিশের সামনে আনজুমা থতমত খেয়ে ভর্য়াত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যে ভয়ের চটে চার-পাঁচ গ্লাস পানি খেয়ে ফেলেছে। আরভীক রাগমিশ্রিত গলায় বলে,

‘মারাত্মক মনখুনি মহিলা তুমি। উফ যে জোরে মারছো বোধ হয় পরলোক গমন করছে সে।’

‘না না আমি ওতটা জোরেও বারি দেয়নি যতটা আপনারা আন্দাজ করছেন।’

‘মিথ্যে কি জম্মগত ভাবে শিখেছো! দেখছো না অঞ্জয় এখনো অজ্ঞান। অফিসার আমি বলছি মেয়েটা এক নাম্বারের গু*ন্ডি।’

ব্যস কথাটি যথেষ্ঠ ছিল আনজুমার ভেতরকার ক্রোধ জাগিয়ে তুলার জন্যে। ঠোঁট ফুলিয়ে চেঁচিয়ে বলে,

‘খামোশ আপনি কেন আদিখ্যেতা দেখাচ্ছেন হে! শোকরিয়া আদায় করেন। যে আপনার মাথায় বারিটা পড়েনি। বিশ্বাস করেন অফিসার, যদি এ অঞ্জয় নাকি টঞ্জয়ের জায়গায় এ লোকটা থাকতো না। নিশ্চিত একশত বারি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিতাম।’

ফাহাদ হতবাক দৃষ্টিতে আরভীক এর দিকে তাকায়। বেচারার মুখও ভোঁতা বনে গেছে। ফাহাদের ভয় লাগছে। যদি মেয়েটা তার উপরও রেগে বোম হয়ে যায়। আরভীক গলা ঝেড়ে বলে,

‘হাহ আরভীক ফাওয়াজ এর গায়ে…।’

তার বলতে দেরি কিন্তু তার গালে ফ্রাইপেনের বারি দিতে সময় নষ্ট করেনি আনজুমা। ঠাস করে তার গালেও বারি দিয়ে দেয়। আরভীক হতভম্ব চোখে কি হলো বুঝার জন্য সময় নিল। আসলেই কি সে তার গালে বারি খেয়েছে নাকি তার মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। ফাহাদ না দেখার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। যদি তারও ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যায়। আরভীক গালে হাত দেয়। অনুভব করে ব্যথা করছে তার গাল। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। ফ্রাইপেনটা সজোরে ছিনিয়ে নিল আনজুমার হাত থেকে।

আনজুমা আরভীক এর দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকায়। মনে মনে ভীতিগ্রস্থ হলো। পুলিশের সামনে আবার সে নিজেই না বারি খায়! যদি খায় ইজ্জতের দফারফা হয়ে যাবে। আরভীক ফ্রাইপেনটার দিকে অগ্নিশর্মা চোখে দেখে আনজুমার দিকে ভস্ম করার মত তাকায়। তার দিকে তিক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকেই জানালার কাছে গেল। আনজুমা দেখছে কিন্তু বুঝতে পারছে না আরভীক কি করতে চাইছে !
আরভীক শয়তানি হাসি দিয়ে জানালার বাহিরে নর্দমার দিকে ছুড়ে মারে ফ্রাইপেনটা। নর্দমায় পড়ে কচফচ শব্দ হলো। আনজুমা, ফাহাদ ও ছোট আশফি হা হয়ে যায়। ফাহাদ আন্দাজ করেছিল তার বন্ধুকে আঘাত করার পরিণামে ফ্রাইপেনের শাস্তি হলো নর্দমায় ডুবে যাওয়া। মনে মনে ফ্রাইপেনের মাগফিরাত কামনা করে সে। যেন যেখানেই তলিয়ে যায় না কেনো ঘুরেফেরে বাজারে বিক্রি হোক! কথাগুলো ভেবে তপ্ত শ্বাস ফেলে। আকস্মিক চিৎকারে ড্যাবড্যাব করে তাকায়।
আনজুমা আর্তনাদের গলায় জানালার কাছে এসে নর্দমার দিকে চোখ বুলাতে থাকে। প্রিয় ফ্রাইপেন চোখে পড়ে কিনা দেখতে থাকে। না কোথাও দেখা যাচ্ছে না, সব আবর্জনার স্তূপ দেখা যাচ্ছে। ঠোঁট কাঁপিয়ে কান্নার চেহারা করে নেই। আরভীক এর দিকে সূচাঁলো দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। গলায় যতটা জোড় পায় ততটা জোড় দিয়ে বলে,

‘বললদদ আমার ফ্রাইপেনকে ছুড়ে মারার সাহস কে দিলো আপনাকে।’

‘কে আবার তোমার প্রিয় ফ্রাইপেনই দিয়েছে। কেননা আমার গালে যে একবার চক খোঁসবে। তার জায়গা হবে নর্দমার কিট হুহ।’

আনজুমা আরভীক এর গলা চেপে ধরে। কিন্তু এতে বিন্দুমাত্র গলায় ব্যথা অনুভব করে না সে। বরং তার মনে হলো কোনো মশা রক্ত চুষার চেষ্টা করছে। ফাহাদ অবস্থা বেগতিক হতে দেখে আনজুমার হাত ছাড়িয়ে নেই। অথচ হিংস্র বাঘিনী আনজুমা পুনরায় আরভীক এর গলা চেপে ধরতে চাইলো। যা সম্ভব হলো না ফাহাদের জন্য। আনজুমার ক্রোধিত চেহারা দেখে আনমনে হেসে দেয় আরভীক।
ফাহাদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দেয়। এতে থতমত খেয়ে যায় সে। চোখের ইশারায় ‘কি’ বোঝায়। কিন্তু ঘাড়ত্যাড়া আরভীক জবাব না, কাজের উপর আগ্রহ দেখায়। ফলে সে এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজাসুজি আনজুমার গালে চুমু একেঁ দেয়। থেমে যায় আনজুমার শরীর। ফাহাদ নিজেও হা হয়ে যায়। হলো কি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ঢোক গিলল। তড়িঘড়ি কেটে পড়ে তাদের সামনে থেকে। অন্যথায় আনজুমা নিজেও শিহরিত,বিমূঢ়। আশফি হওয়া ঘটনাগুলো দেখে খালি হেসে যাচ্ছে। সে অবুঝ তাই ভ্রু নাঁচিয়ে হাসছে আর তালি দিচ্ছে। আরভীক বাকাঁ হেসে আনজুমার কান বরাবর এলো। ফিসফিসিয়ে বলে,

‘টিট ফর ট্যাট। তুমি গালে মেরেছো বারি, আমি তোমারই গালে একেঁছি চুমু। হিসাব বারাবার প্রিটিগার্ল।’

শিষ বাজিয়ে আনজুমার পাশ কাটিয়ে সোফার কাছে গেল। এখন অঞ্জয়ের হুঁশ ফেরানো উচিৎ। বেশিক্ষণ হয়ে গেল আনজুমার ফ্লাটে এসেছে তারা। কেউ যদি দেখে তখন মেয়েটার উপর কুৎসিত কথা রটাবে। পরিণামে অনুশোচনায় ভোগতে হবে তার। অঞ্জয়ের গালে বার দুয়েক থাপ্পড়,চটকানি দিল। না হুঁশ ফিরছে না। বিরক্তিতে আরভীক মুখ থেকে ‘চ’ উচ্চারণ করে। আনজুমার দিকে সূক্ষ্ম কপালের ভাঁজ টেনে বলে,

‘মুখ ভবিষ্যতেও দেখতে পারবে, আপাত পানি এনে দিলে খুশি হবো জনাবা।’

ঘাবড়ে গেল আনজুমা। তড়িঘড়ি কিচেনে গেল পানি আনতে। কিন্তু জগে একফুটো পানি নেই। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে জগ হাতে নিয়ে সোফার রুমে এলো। আরভীককে উদ্দেশ্য করে আমতা আমতা করে বলে,

‘আ আমি পানি আনছি কিছুক্ষণের মধ্যে।’

কিছু বলেনি আরভীক। শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল তার কথায়। আশফি নিশ্চুপে তার আরভীক আঙ্কেলের আনা চকলেট বক্স থেকে একটি চকলেট বের করে চাবানো শুরু করে। বাচ্চা মানুষ বড়দের মাঝে থেকে তার কি লাভ! সে বিন্দাস চকলেট চাবানোয় মনযোগ দেয়। আনজুমা বের হবার পরই হুঁশ ফেরে অঞ্জয়ের। এতে আরভীক কি ভেবে যেন অঞ্জয়ের মাথায় পাতিল নিয়ে মৃদু বারি দেয়। বেচারা অঞ্জয় পুনরায় আঘাত পেয়ে নুয়ে পড়তে পড়তে মাতাল কণ্ঠে বলে,

‘মরণ মুই আইছি তোর কাছে।’

কথাটি শুনে আরভীক শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করে দেয়।

‘হয়নি রে। কথাটি হবে মরণ আমি আসছি তোর কাছে। কিন্তু তুই যাবি না। তোকে শুধু ভ্রমণ করতে পাঠাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরিয়ে আনব। ডোন্ট ওয়ারি মাই ব্রো।’

অঞ্জয়কে জাগতে দেওয়া যাবে না বলে ভেবে রেখেছে আরভীক। কেননা আনজুমা জব্দ হয়েছে প্রায়। তাকে পিএয়ের পদে যোগ দিতে রাজি করানোই হলো তার মূল উদ্দেশ্য। যদি রাজি না হয় তাহলে সেও জানে কেমনে আঙুল বাকাঁ করতে হয়। সোজা আঙুলে কখনো ঘি উঠে না। শয়তানি হাসি দিয়ে মনে মনে বলে,

‘আমার বাপের অফার রিজেক্ট করো হা! তোমার মুখ থেকে যদি রিজেক্টকে এগ্রিমেন্টে না নেই তাহলে আমার নামও আরভীক ফাওয়াজ না।’

আনজুমার আসতে সময় লাগায় আরভীক কিছুক্ষণ আগের ভাবনায় ডুব দিল।

১২.
কিছুক্ষণ আগে….

আনজুমা বিসমিল্লাহ্ বলে ব্যক্তির মাথায় যে বারিটা মারল। এতে ব্যক্তিটা অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। দুঃসাধ্য কাজ করতে পেরে খুশিতে লাফিয়ে উঠে আনজুমা। জীবনে প্রথমবার সাহসিকতার জোড় দেখিয়েছে। ফ্রাইপেনের বারি দিয়ে সে নিজেকে রাপুনজেলের সঙ্গে তুলনা করছে। রাপুনজেলও ফ্রাইপেন দিয়ে আঘাত করে মানুষের হুঁশ উড়িয়ে দিতো। সেও পেরেছে। খুশির চটে সে ফ্রাইপেনটা রেখে যেই না মানুষটাকে মুখ বরাবর করে। তখনি চমকে ‘ইন্নালিল্লাহ্’ বলে লাফিয়ে উঠে। অজ্ঞানরত ব্যক্তি অন্য কেউ নয় বরংফাটাবাঁশ আরভীক ফাওয়াজ এর পিএ। অঞ্জয় তার পূর্ব চেনা। কেননা সে তাকে দেখে ছিল আরভীক এর সঙ্গে চলাফেরা করতে। বিধেয় বুঝতে পেরেছে বাসার মধ্যে আরভীক এসেছে। এ মুর্হুতে অঞ্জয়কে না দেখে আঘাত করার কারণে আফসোস করছে সে। কি করবে বুঝতে পারছে না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসেছে।
তখনি দরজা কটকট করে খুলে ভেতরে প্রবেশ করে আরভীক। ভেতরে নিরবতা দেখে সে প্রথমত আনজুমার দিকে তাকায়। তাকে বিধ্বস্ত, হতবাক দেখে আশ্চর্য হলো সে। কেননা আজ মেয়েটি তাকে দেখেও চিল্লাচ্ছে না। ব্যাপারটা তার হজম হলো না। ফলে আনজুমার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে মেঝের দিকে তাকায়। মেঝেতে অঞ্জয়কে লুটিয়ে থাকতে দেখে চমকে গেল। আশফি আরভীককে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে বলে,

‘মাম্মা বারি দিছে, মাম্মা বারি দিছে।’

ব্যস শুরু হলো আরভীক এর মেলোড্রামা। দাঁত কেলিয়ে আনজুমার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ছেহ্ ছেহ্ মনখুনি মহিলা। এতটা জোরে বারি দিলা। বুঝতে পারছি আমার ভাই তোমার ওয়াশরুম কি ব্যবহার করছে। সেজন্য মেরে ফেলতে চাইছো। সে তোমার ওয়াশরুম খেয়ে ফেলতে ছিল না। যে বারি মেরে তটকা বানিয়েছো। শুধু একনাম্বার কাজই ছাড়তে গেছিল।’

ঘোরের মধ্যে ছিল আনজুমা। তার উপর আরভীক এর ন্যাকা কথা শুনে সে চোখ বুজে দৃঢ় শ্বাস নিল। তার দিকে তাকিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কণ্ঠে বলে,

‘তো আপনার ভাই মুতার আর জায়গা পাইলো না। আমারই বাথরুম ইউজ করতে হলো। মুতে দুর্গন্ধ করে ফেলছে। ইশ! কি দুর্গন্ধ। মনে হচ্ছে কমোডে পানিও মারিনী।’

আরভীক এর মুখ হা হয়ে গেল। মেয়ের কথার কি শ্রী! তার কথা শুনে সে নিজেই নিজের কথা গুলিয়ে ফেলছে। তবুও হার মানেনি। আনজুমার দিকে আঙুল তুলে বলে,

‘ইডিয়েট গার্ল এখনি পুলিশ এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। দেখব তখন তোমার পটরপটর কোথায় যায়।’

‘যান যান পুলিশ এলেও আমার কিছু করতে পারবে না হাহ্।’

ভাব নিয়ে কথাটি বলে উঠে আনজুমা। দুহাত বুকের উপর গুজে ভ্রু বাঁকিয়ে হাসে সে। আরভীক সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘কেন ভয় লাগে না বুঝি! কপালে যে শনি ঘুরছে তা জানো না মেবি।’

‘একদম না আজ আমার কপালে মঙ্গল গ্রহ ঘুরছে। শনি তো আপনার কপালে আছে। এখনি যদি আপনার লাপাঙ্গা মুতখোড় সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে না যান। তাহলে আপনার উপর পানি ঢেলে দেব।’

পানি ঢালার ভয় দেখিয়ে আরভীককে ব্যর্থ জব্দ করার চেষ্টা করে আনজুমা। ইতিমধ্যে ফাহাদ একজন মহিলা কনস্টেবল নিয়ে চলে এসেছে। তাকে আসার জন্যে আহবান জানিয়ে ছিল আরভীক। মেসেজ করে ঠিকানা দিয়ে ছিল। এতে ফাহাদ কোনো ধরনের প্রশ্ন করেনি। বরং বন্ধুর ডাকে চলে এলো। এবার আনজুমা সত্যিতে ঘাবড়ে গেল। সে ভাবেনি আরভীক সত্যিই পুলিশ ডাকবে। ডেকেছে তো ডেকেছে এবার যদি বারি মারার দায়ে ফাঁসি হয় তাহলে ছাড়াবে কে তাকে। তিক্ষ্ণতার দৃষ্টিতে আরভীক এর দিকে তাকায়। আরভীক আনজুমার দৃষ্টি উপেক্ষা করে ফাহাদকে বলে,

‘অফিসার এ মেয়েটা আমার পিএয়ে কে বারি মেরে ভোঁতা বানিয়ে দিয়েছে। এখনো জ্ঞান ফিরেনি তার। দেখছেন আমার পিএয়ে হতে না পেরে আমার প্রাক্তন পিএয়ের জান কবজ নিয়ে ফেলতে চাইছে।’

নিজের নামে মিথ্যে অপবাদ শুনে আনজুমা নির্বোধ হয়ে গেল। আরভীক এর সামনে গিয়ে কলার টেনে ধরে বলে,

‘ঐ বলদ মুখের বুলিতে মিথ্যে কথা ভালোই ফুটাস। আমি কবে তোর পিএ হতে চেয়েছি হে!’

‘ওমা সেকি তালবাহানা করছে দেখছেন অফিসার। আজকাল কার মেয়েগুলো লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে।’

ফাহাদ নিশ্চিত আরভীক জাল বুনে ফন্দিতে ফেলার চেষ্টা করছে আনজুমাকে। সে আনজুমাকে চিনলেও আনজুমা তাকে চিনতে পারেনি। কেননা সে মাস্ক পরে মুখ ডেকে এসেছে। যেহেতু আরভীক মেসেজে বলেই দিয়েছিল যে আনজুমার বাসায় আসতে হবে। সেহেতু তার থেকে গুপ্তচরের বেশে পুলিশ হয়ে আসতে হলো। আনজুমা দ্বিরুক্তি করতে গেলে ফাহাদ মাঝখানে থামিয়ে দেয়। আরভীকে চেনেও না চেনার ভান করে কথা জিজ্ঞেস করে।

‘স্যার আপনি এখন মেয়েটিকে কি শাস্তি দিতে চান!’

‘শাস্তি’ শব্দটা শুনে ঢোক গিলে আনজুমা। কেননা এই গর্দভ ছেলেটার কাছ থেকে শাস্তি নেওয়া মানে হলো সমুদ্রে গা ভাসিয়ে দেওয়া। মনে মনে আল্লাহর কাছে চাইছে যেন এ যাত্রায় বেঁচে যাক। কিন্তু সূচাঁলো দুষ্টুমিপূর্ণ হাসি যখন আরভীক এর ঠোঁটের কোণে বিরাজমান দেখে। তখন বুঝতে পারে সে মাইঙ্কার চিপায় ফেঁসেছে, প্রখরভাবে ফেঁসেছে। মাথা নুয়ে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

‘বলুন আমি রাজি।’

কথাটি শুনে আরভীক ফাহাদকে চোখ টিপ দেয়। কারণ শেষমেষ মেয়েটাকে সে জব্দ করতে পেরেছে।

ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটে আনজুমার কণ্ঠ শুনে। সে পানি ভর্তি জগ নিয়ে এসেছে। আরভীক পানি ছিটিয়ে দেয় অঞ্জয়ের মুখে। নিভু নিভু চোখ খুলে মাথা চেপে ধরে বসে। মাথায় মৃদু যন্ত্রণার চটে চোখ তুলে তাকায় আর্দশ ব্যক্তিদ্বয়ের দিকে। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে,

‘আ আমি কোথায়,কে আপনারা, চিনি না আপনাদের। আমি বরং যায়।’

তাদের কথা না শুনে দৌড়ে বেরিয়ে গেল অঞ্জয়। আনজুমা নিরবে মুখ হা করে তাকিয়ে রইল। অঞ্জয় স্মৃতিশক্তি হারিয়েছে নাকি জ্বিন ঢুকেছে তার উপর বুঝতে পারল না। আরভীক অঞ্জয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দুঃখি গলায় বলে,

‘উফ তোমার বারির ঠেলায় আমার পিএয়ের মেমোরি লস্ট হয়ে গেল। কাল যদি তোমাকে অফিসে না দেখছি। বিশ্বাস করো গলা টিপে মেরে ফ্রাইপেন দিয়ে তোমাকে ভেজে খাবো।’

অবুঝের চোখে তাকায় আনজুমা। ফ্রাইপেন হারিয়ে ফেলেছে ফাঁটাবাঁশের কারণেই। তো নতুন ফ্রাইপেন কোথার থেকে আসবে। তা ভেবে প্রশ্ন করে

‘আমার ফ্রাইপেনকে নর্দমায় ফেলছেন। সে আবার কোথার থেকে আসবে।’

‘বাজার থেকে কিনে পাঠিয়ে দেব। নতুন ফ্রাইপেনের উপর ঝাড়ফুক দিয়ে দোয়া পাঠ করে রান্না করিও। পুরাতন ফ্রাইপেন তো নর্দমায় গেছে। তার জন্যে মাগফিরাত কামনা করবে ওকে।’

কথা শেষ করে আনজুমার সামনে থেকে কেটে পড়ে আরভীক। বেচারী ক্রোধে জ্বলছে তাও চুপ রইল। ইচ্ছে করছে এখনি আরভীক এর মাথা বরাবর ফ্রাইপেন এর বারি মারতে। কিন্তু তার আদরের ফ্রাইপেনকে খুন করেও খুনি বাইরে টইটই মারতে চলে গেল। মনে মনে ফ্রাইপেনকে ভেবে বলে,

‘ফ্রাইপেন তুই চিন্তা করিস না। যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস। তোকে দিয়ে আর মাছ-মাংস ভাজা হলো না। তোর সতীন এনে দিলেও তোকে কিন্তু ভুলব না। কারণ তুই আমার রান্নার প্রিয় ফ্রাইপেন বলে কথা।’

চলবে……

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৭

আনজুমার প্রিয় ফ্রাইপেনকে মে’রে ফে’লার দায়ে সরাসরি আরভীক এর পিএ হওয়ার প্রস্তাব নাকচ করে। যার ফলে আরভীক এর ফুরফুরে দিনটা হয়ে গেল ক্রোধে জর্জরিত।
অঞ্জয় হু হা কিছু বলছে না। শুধু কেবিনে এসে তার বসকে আনজুমা ম্যাডামের জবাব শুনিয়েছে। কিন্তু তার নজরে বসের বাহ্যিক শান্তশিষ্ঠতা লক্ষ হচ্ছে। অন্তরালের কথা জানে না সে। আরভীক হাতের ইশারায় যেতে বলে তাকে। শ্বাসকে দমিয়ে মূর্তির বেশ ধরে কথাগুলো বলে ফেলে ছিল অঞ্জয়। যখন বস চলে যেতে বলল। তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে দমফাটা শ্বাস ফেলে। বার-দুয়েক ঢোকও গিলে ফেলে। যেন যমের মুখ থেকে ফিরে এসেছে। সে গতকালের হওয়া ঘটনাটা বুঝতে পেরেছে। তবে স্যার ও ম্যাডামের মধ্যে কি চলছিল তা অজানা তার। গতকালকের ঘটনা মনে হতেই মাথার মধ্যে চিনচিন ব্যথা অনুভব করে। মাথায় হাত দিয়ে ঠোঁট চেঁপে ন্যাকা কান্নার মত মুখ করে অঞ্জয়। আনমনে নিজেকে শান্ত্বনা দেয়।

‘মাথা তুই বেঁচে আছিস তো। কখনো আবার ড্যামেজ হস না। হওয়ার আগে বলিস। যাতে শেষমুর্হুতে একটা গার্লফ্রেন্ড জোগাড় করে রাখতে পারি। ভ্যাঁ ভ্যাঁ…ও আম্মা কই গো তুমি তোমার পোলাডারে কার কাছে রাইখা গেলা। যমেও এতটা খাটাই না। যতটা আরভীক স্যার আমার উপর খাটাই।’

মনের সাথে প্যাঁচ প্যাঁচে কথা বলার মাঝে ফোন শব্দ করে বেজে উঠে তার। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে স্ক্রিনে ‘বস’ লিখা। হাত কেঁপে উঠল। ফোন হাত থেকে পড়ার আগেই চট করে ধরে ফেলে। দম আঁটকে তড়িঘড়ি ফোন কানে ধরে ‘ইয়েস বস’ বলে। আরভীক শান্ত ভঙ্গিতে টেবিলের উপর কাগজে গাড়ির ডিজাইন আকাঁবুকি করতে থেকে বলে,

‘মেয়েদের মত না কেঁদে কাজে মন দিলে পেমেন্ট ডাবল পাবি। যদি সারাদিন কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে মেয়ে সাজতে মন চাই তাহলে বলে দেস। তোর কেবিন খালি করে দেব।’

চোখ বড় হয়ে গেল অঞ্জয়ের। সঙ্গে সঙ্গে দম ছেড়ে বলে,

‘নো নো স্যার। আমি কাজে মন দিচ্ছি।’

অঞ্জয়কে আর পায় কে দৌড়ে তার নিজের কেবিনে চলে গেল। কাগজের মধ্যে একটানে সারি টেনে সটান হয়ে দাঁড়ায় আরভীক। কম্পিউটারের দিকে একপলক তাকিয়ে পুনরায় রেখা-সারি টানায় মগ্ন হলো।

১৩.
আরাজ সাহেব উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কিচেনের মধ্যে। সেখানে সেফ’স রান্না করছে। রান্নার রেসিপি হিসেবে কাঁকড়া,স্যালাদ,মশলাবিহীন তরকারি দেখে গা গুলিয়ে এলো তার। দুঃখী মনে সোফার রুমে এসে ধপ করে বসে পড়ে। কপাল চাপড়ে বলতে লাগল।

‘কপাল গুণে ছেলে পাইছি। বিয়েশাদি নিজেও করবে না আমাকেও বউমার হাতের সুস্বাদু খাবার খেতে দেবে না।’

‘স্যার ডাকছিলেন।’

অন্য পুরুষের কণ্ঠ পেয়ে বিরক্ত চোখে তাকায় আরাজ সাহেব। সামনে লিয়াকত হলুদেটে দাঁত দেখিয়ে হাসি দিল। যা দেখে অত্যধিক বিরক্ত হলো আরাজ সাহেব। তিনিও তার সফেদ দাঁত দেখিয়ে হাসি দিল। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘না ডাকিনী, কোন দুঃখে ডাকব তোকে।’

‘কেন স্যার বড় স্যারের বিয়ে না হওয়ার দুঃখেই তো ডাকবেন।’

‘কেন তুই কি ঘটক ! আমার ছেলের জন্যে মেয়ের লাইন লাগাবি।’

‘হে হে হে স্যার বড় সাহেব জোয়ান পোলা। মেয়ে খোঁজা কোনো ব্যাপারই না।’

কথাটি শুনে তিনি ভাবান্তর চেহারা নিয়ে লিয়াকতের দিকে তাকায়। তার চেহারায় রহস্য লুকিয়ে আছে নাকি স্বাভাবিক বুঝার চেষ্টা করে। লিয়াকত মনে মনে হেসে আরাজ সাহেবকে আশ্বস্ত কণ্ঠে বলে,

‘স্যার এক মেয়ে আছে আমার নজরে। খুবই সুশ্রী,সুন্দর চরিত্রের মেয়ে। ফ্যামিলি ফরেইনার। দেশে এসেছে বিগত তিনবছর হয়ছে। তার বাবা ঢাকায় কাপড়ের ব্যবসা করে। ঢেরখানেক জমিজমাও আছে।’

প্রতি কথা মনযোগ দিয়ে শুনলেও শেষ কথার কারণে তিক্ততায় মন বিষিয়ে উঠে আরাজ সাহেবের। তিনি রক্তিম দৃষ্টি নিয়ে লিয়াকতের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘জমিজমার লোভ আমাদের নেই। তা জানিস নিশ্চয় !’

শুদ্ধ মানুষের সামনে ভুল কথা বলে ফেলায় নিজেকে শত’খানে’ক গা’লি দেয় লিয়াকত। স্বহাস্যে দাঁত দেখিয়ে বলে,

‘স্যার কথা শুনেন না। কথার অর্থ বের করে কেন খামোখা জল খেসবেন।’

‘লিয়াকতত..।’

গলার স্বর তেজ করে বলে উঠে আরাজ সাহেব। লিয়াকত এর বলা কথাটি মোটেও পছন্দ হলো না তার। তবে মেয়েটির কথা শুনে কোন না কোন যোগসূত্র তৈরি করার মনভাবনা এটেঁ রেখেছে মনে। তিক্ত ক্রোধ চেপে রেখে রুমের দিকে হাঁটা ধরে। যাওয়ার আগে লিয়াকতের উদ্দেশ্য জবাব ছু’ড়ে দেয়।

‘কথা বুঝে কথা বলবি। মেয়ের ফ্যামিলির সঙ্গে সময় ঠিক কর। ছেলেকে নিয়ে যেন মনস্থীর করে যেতে পারি।’

লিয়াকত যেন খুশিতে গদগদিয়ে উঠে। তিনি আশ্বস্ত করে আরাজ সাহেব কে যে, ‘সে ফোন করে সময়,জায়গা জানিয়ে দেবে।’
আরাজ সাহেব দ্বিরুক্তি না করে নিজের রুমে চলে যায়। সেফ’স এতক্ষণ নিরব শ্রোতা বনে ছিল। পরিবেশও নিরবতায় চেয়ে গেলে তারাও নিরবে কাজে মন দেয়। লিয়াকত
ফাওয়াজ বাড়ির বাহিরে এসে হাঁটা থামিয়ে দেয়। পিছু ঘুরে বাড়ির চৌপাশ নজর বুলিয়ে নেয়। চোখজোড়ায় লোভাতুর দৃষ্টিকোণ স্পষ্ট। লোভী মনের সুপ্ত মনবল বলে এক প্রবাদ আছে। সেটাই তিনি প্রয়োগ করেছে। সুপ্ত মন দিয়ে জয় করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ছিল আজ। যেটা সফল হয়েছে বিনা দ্বিধায়। কোমরে হাত রেখে ফাওয়াজ বাড়ির ত্রিসীমানায় দাঁড়িয়ে রাজার মত বেশভূষা ধরে। ডান পা দিয়ে মাটি স্পর্শ করে। পা দিয়ে জোরে ধুলা ছিটিয়ে দিল। যেন সে তিরস্কার জানিয়েছে ফাওয়াজ বাড়ির উপর। মুখে শয়তানি তেজ ফুটিয়ে বলে,

‘ছেলের জন্য বউ আনা তো শুধু বাহানা। বউমা না যেন স্বর্গের সর্বনাশীনি এনে দেব। এই লিয়াকত মোবাশেরের কসম তোকে আরাজ ফাওয়াজ।’

কুৎসিত হাসি দিতে থেকে চলে যায় তিনি।
অন্যদিকে রকিং চেয়ারে হেলতে থেকে আরাজ সাহেব লিয়াকতের মতিগতি সম্পর্কে ভাবে। চেহারায় তার মতই বৃদ্ধের ছাপ ফুটে উঠেছে, চুলে পাক ধরেছে, হাত-পাও শুকিয়ে শক্তপোক্ত। এককথায় তাদের দুজনের বয়স কাছাকাছি। তার যদি একচল্লিশের কৌঠায় পড়ে। তবে লিয়াকত হবে চল্লিশের কৌঠায়।
ঘনিষ্ঠতা খুবই সূক্ষ্ম তাদের মাঝে। এককালীন শত্রু ছিল বটে। যা সময়ের বিবর্তনে মিটিয়ে নেয় লিয়াকত নিজ সাপেক্ষে। শত্রুতার রেশ ছিল বড় ছেলেকে নিয়েই। যাকে হারিয়ে নিঃস্ব আরাজ সাহেব। বড় ছেলেকে হারালেও ছোট ছেলেকে বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। একমাত্র আরভীকের দিকে তাকিয়ে তিনি বেঁচে আছে। না হলে কবেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ফেলতো। স্ত্রীকে যেদিন হারিয়ে ছিল সেদিন প্রতিক্ষা করে ছিল সেই এক নারী যে চিরঞ্জীব তার বুকে বিরাজ করবে। তিনি রেখেছে তার কথা স্ত্রীর মত পরম অধিকারভুক্ত নারীকে ছাড়া অন্য নারীর সান্নিধ্যে ধরা দেয়নি। ছেলেকে বড় করে, মানুষ করে এখন বার্ধক্যের সময়ের প্রহর গুণছে। ছেলের বিয়ে দেওয়ার খুব শখ তার। বউমা,নাতী/নাতনির সঙ্গে দিনরাত গল্পগুজবে কাটাতে চাওয়ার স্বপ্ন বুনে রেখেছে। তবুও ছেলে সাফল্যতার দ্বারপ্রান্তে হওয়ায় বিয়ের জন্য জোর করেনি। তারই স্বপ্ন ছিল বড় ছেলে যেন কানাডায় কারস পাবলিস্ট করে।
পাবলিস্ট হলেই দেশ-বিদেশের খবরাখবরে প্রকাশ পেত।
‘কারস নিউ প্রডিউসার দ্যা বেস্ট ডিলার অফ আজীব ফাওয়াজ।’
যা স্বপ্নই রয়ে গেল। বড় ছেলে যা পারেনি তা ছোট ছেলে পূরণ করতে চাইছে। বড় ছেলের কথা ভেবে নিরবে, একাকি দুঃখে অশ্রু ঝরায়।
আকস্মিক রুমের বাহির থেকে চেঁচামেচি করার শব্দে চটজলদি চোখ মুছে ফেলে তিনি। কেননা আরভীক অত্যধিক খুশি হলেই এমন চেঁচামেচি করে। অন্যথায় রোবটের মত চলাফেরা করে।
বিছানায় গা হেলিয়ে দিয়ে ঘুমানোর ভান ধরে। আরভীক ব্যাগপত্র সোফায় ছু’ড়ে মেরে হাতজোড়া নেড়ে উল্লাসের মত খুশি প্রকাশ করছে। দিনদুপুরে বড় সাহেবের পাগলামী দেখে সেফ’স,মেইড’স অবাক। বড় সাহেবের উল্লাস তাদের চোখে খুব একটা পড়েনি। আজ দেখে তারাও মনে মনে দোয়া করে বড় সাহেবের জন্য। অঞ্জয় মিষ্টি নিয়ে বাসার ভেতর প্রবেশ করে। আরভীক ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে দেয়। মিষ্টি দুটো হাতে নিয়ে অঞ্জয়ের মুখে পুরে দেয়। বেচারার দুগাল মিষ্টির ওজনে ভারী হয়ে গেছে। আরভীক মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে সোজা হাটাঁ ধরে তার বাবার রুমের দিকে। অঞ্জয় মিষ্টি চাবানো,গলাধকরণ ছাড়াই ঢোক গিলে। মন্থরগতিতে চাবানোর চেষ্টা করে। প্রথম চেষ্টাতে তার দাঁত কিড়মিড় করে উঠে। মনে মনে মিষ্টিওয়ালাকে গা’লি দিয়ে বলে,

‘শুকন শা’লা’ ডিপ ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে দিছে। উফ স্যারও, না ভেবে গালে ঢুকিয়ে দিল। হজম তো দূর, চাবাতেই বমি পাচ্ছে।’

তার বলতে দেরি কিন্তু গলাধঃকরণ করতে না পারায়, দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ওয়ার্ক ওয়ার্ক করে বমি করে। গালে লেগে থাকা মিষ্টির ছিঁটেফোটা পানি দিয়ে কুলি করে ঝেড়ে ফেলে। গার্ড’স একে অপরের দিকে আহাম্মকের মত তাকায়। ব্যাপারটা তাদের কাছে প্রেগন্যান্সির লক্ষণ বলে বিবেচিত হলো। তারা সময় বিলম্ব না করে আরভীক কে নিউজ দিতে চলে যায়।
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
আরভীক বাবার রুমে এসে দেখে তিনি ঘুমে আচ্ছন্ন। ফলে সে তার বাবার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়নি। নিজের রুমে যাওয়ার পূর্বে মেইডকে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। তাদের ভাগ নিয়ে বাকিটুকু ফ্রিজে রাখতে বলে চলে যায় রুমে। শাওয়ার সেরে তোয়াল পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তখন সায়াজ ঘোর চিন্তা নিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকে ধপ করে বন্ধুর বিছানায় বসে পড়ে। আড়চোখে সায়াজকে দেখে ভাবলেশনহীন মাথা মুছায় মন দেয়। সায়াজ ভাবান্তর থেকে জিজ্ঞেস করে।

‘তুই আনজুমাকে দিয়ে কি করতে চাস বল তো!’

‘আনজুমা’ নামটি শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল আরভীক এর। কাজের ঠেলায় মেয়েটার কথা ভুলেই গিয়ে ছিল। কিন্তু সায়াজের কথায় পুনরায় কুবুদ্ধি চলে এলো। শয়তানি হাসি দিয়ে কৃতজ্ঞার চোখে তাকিয়ে সায়াজ কে বলে,

‘থ্যাংকস ডুড।’

সায়াজ বলদের মত মুখ করে ফেলে। বন্ধুর কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা পেল কিসের জন্য ! ভেবেই জিজ্ঞেস করে,

‘কেন।’

জবাবে শুধু দুষ্টু মুখ করে সায়াজকে চোখ টিপ দেয়। যা দেখে চোখ পিটপিটিয়ে থতমত খেল। মুখ বাঁকিয়ে আঙুল তুলে বলে,

‘হেই ডুড চোখ মারা কি তোর জম্মগত রোগ। মেয়েকে তো বাদই দিলাম ছেলেকেও তোর চোখ মা’রা’ লাগে। আরে ভাই ইজ্জতেরও খেয়াল রাখিস। চোখ মে’রে কামুক জাগাস কেন হা’লা ব’ল’দ!’

আরভীক সায়াজের কথা শুনে শার্ট,প্যান্ট পরে চোখে চশমা এটেঁ হ্যান্ডসাম ভাব নিল। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘মেয়ের কমতি পড়ছে তোর। এক চোখ মা’রায় তোর কাম জাগে। হা’লা লু’চ্চা একটা।’

‘দেখ ডুড আমি অতি ভদ্র ঘরের ছেলে।’

‘হেহেহে অতি ভদ্র ঘরের সাধু সন্ত্রাসী। কথাটা এমন হবে।’

সায়াজ ঠোঁট প্রসারিত করে ‘চ’ উচ্চারণ করে বালিশ ছুঁড়ে মা’রে আরভীককে। সেও ক্যাচ করে তারই মুখে ছু’ড়ে দেয়। যা ক্যাচ করতে অসফল হলো সায়াজ। মুখে বারি খেয়ে তোতা মুখ করে চলে যায় সে।
চলে যাওয়ার মূল কারণ একটাই আরভীককে যতই প্রশ্ন করা হোক না কেন উত্তর পাবে না। বরং কাজ করে লেটেস্ট নিউজ বানিয়ে শুনাবে। তাও নিউজ বন্ধুর কাছ থেকে শুনতে পায় না। অন্য মানুষ এসে জিজ্ঞেস করে। জিজ্ঞেস তো করেই। তবে জবাব তার কাছে থাকে না। উল্টো জিজ্ঞেস করা প্রশ্নে সে নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

১৪.
ফাহাদকে কল দেয় সায়াজ। ফাহাদ ক্রি’মিনা’লের ডিটেলস চেক করছিল। সায়াজের কল পেয়ে ফাইল রেখে দেয়। কানে ফোন ধরে বলে,

‘হেই ডুড ওয়াট’স আপ!’

‘তোর ওয়াট’স আপের মাইরে বাপ করে দেব।’

সায়াজের রাগী কণ্ঠ শুনে ফাহাদ আবুল বনে গেল। গলা ঝেড়ে বলে,

‘কেন!’

‘কেন আবার আরভীকের হলো কি! আজকাল আনজুমা নামের মাইয়ার পিছে ঘুরছে। মুই এতকাল জানিও না। কেমন ডুড সে! একবার বললোও না।’

‘হেহেহে ডুড তোর মত আমারও এক অবস্থা।’

সায়াজ অবাক হলো ফাহাদের কথা শুনে। চমকিত গলায় বলে,

‘মানে তুইও জানস না!’

‘না রে ডুড। আরভীক কি করে সেটা শুধু সেই জানে,বুঝে। আমরা হলাম শ্রোতা,দর্শক। মাইনষের কাছ থেকে শুনি আর ঐ ডাকলে দর্শকের মত গিয়া দেখি।’

‘আরে ডুড আমার লগেও এমনডা করছে। গতকাল জমি দেখতে গেছিলাম। প্রজেক্ট স্টার্ট করব তাই। ওখানের ফরেইন মাইয়ারে পটাতে চাইছি। হে’তিই উল্টা আমারে আরভীকের রিলেশনের কথা জিগাই। এখন তুই বল ডুড! এ কেমন অবিচার!
সিঙ্গেল লাইফে আরভীকের লুকাইয়া প্রেমপিরিতের ঠেলা সহ্য হয় না। হা’লা নিজে করে তলে তলে, আমরা করলেই হাতি পাঁদা দোষ।’

ফাহাদ-সায়াজ একে অপরেই কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে হেসে দেয়। অথচ তারা অন্তর থেকে খুশি আরভীক এর মনচ্ছলতা দেখে।

_______

রাত নয়টা বেজে বিশ মিনিট পার হলো। আনজুমা বিতরের নামাজ পড়ে জায়নামাজ ভাঁজ করতে উঠে দাঁড়ায়। ছোট আশফি পিছন থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। নামাজে মা যতবার সিজদা করেছে। সে ততবার মায়ের গলা জড়িয়ে ঝুঁকেছে। তার কাছে আরামদায়ক মনে হলো বিষয়টা। আশফিকে পেছন থেকে হেঁচকা টান দিয়ে বুকের মাঝে শায়িত করে আনজুমা। ঠোঁটের আদরমাখা চুমু এঁকে দেয় আশফির ঠোঁটে। খিলখিলিয়ে হেসে দেয় সে। কোল থেকে বিছানায় নামিয়ে রাখে আশফিকে। তাকে খাওয়াতে হবে। তাই হিজাব খুলে ও জায়নামাজ ভাঁজ করে গলায় উড়না পরে নেয়। আশফিকে রেখে কিচেনে যায়। ভাতের সঙ্গে অমলেট দিয়ে তৃপ্তি করে খেতে পছন্দ করে আশফি। ঝালযুক্ত তরকারি খুব খাওয়ায় না তাকে। মাঝে মাঝে মাছ-মাংসের টুকরো দিয়ে মেখে খাওয়ায়। অমলেট করার জন্য ফ্রাইপেন খুঁজে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
কিন্তু না পেয়ে গতকালের হওয়া ঘটনাটি মনে করে। রাগের সঙ্গে দুঃখও পেল। পাতিলে অমলেট করার জন্য চুলোয় পাতিল বসায়। যেই না চুলোয় চালু করবে তার পূর্বেই কেউ তীব্রভাবে দরজায় কড়াঘাত করে। চমকে যায় আনজুমা। কিচেন থেকে সোফার রুমে এসে গায়ে আবাইয়া ও মাথায় হিজাব বেঁধে ফেলে। জোর গলায় ‘কে’ বলে। ‘কে’ বলাতে দরজায় কড়াঘাতের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। আনজুমা ভীতি মনে জানালা দিয়ে তাকায়। অন্ধকারে ফ্লাটের বাহিরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু কুকুরের ‘ঘেউঘেউ’ শব্দ রাস্তার মোড় থেকে ভেসে আসছে। সে ভাবছে দরজা খুলবে কি খুলবে না। তার ভাবনার পাঁচ-ছয়েক পরেই পুনরায় দরজায় আঘাত করে কেউ। জট করে দিগিদ্বিক না ভেবে দরজা খুলে দেয় আনজুমা। খুলেই ভয়ে ছিটিয়ে গেল। কেউ নেই ভয়ংকর শুনশান বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দ। ঢোক গিলে দরজা আঁটকাতে নিলে জুতোয় রাখা পাপোশে একটি কাগজ মোড়ানো বক্স দেখে। ভ্রু কুঁচকে এলো তার। চোখ দিয়ে সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিতে বাহিরের দিকে তাকায়। কাউকে না দেখে সন্তপর্ণে বক্সটি নিয়ে দরজা আঁটকে দেয়। কাগজটি খুলে দেখে নতুন ফ্রাইপেনের বক্স। চোয়াল শক্ত করে জোরালো শ্বাস ছাড়ে। মনে মনে কাঠিন্য ভাব তুলে পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলে,

‘মিস্টার ফাঁটাবাঁশ আমার মেয়ে ফ্রাইপেনকে মে’রে তোর ছেলে ফ্রাইপেনকে পাঠাস। কাল দেখ তোর অফিসে গিয়ে এ ফ্রাইপেন দিয়েই তোর মাথায় বারি মা’র’ব। এ ফ্রাইপেনকে তো আমি….।’

নতুন সদ্য কেনা চকচকে ছাই রঙের ফ্রাইপেনকে মোচড়ে হ্যান্ডেল বাকাঁ করে দিল। ছাই রঙের ফ্রাইপেনের মাথায় কালো কালি মেখে একদম রঙচটা করে ফেলে। হ্যান্ডেলের স্ক্রু খুলে ফ্রাইপেন এর মাথা আলাদা করে দেয়। নতুন ফ্রাইপেনের করুণ দশা করে পৈশাচিক হাসি দিল আনজুমা। তার কাছে মনে হলো সে ফ্রাইপেনকে নয়। বরং ঐ ফাঁটাবাঁশকেই মে’রে ল্যাংড়া বানিয়েছে।
জানালা দিয়ে আরভীক মেয়েটার রগরগে ভাব দেখে সে নিজেও ক্ষোভে জ্বলে উঠে। মনে মনে বলে,

‘মেয়ে তোমার বেশ দেমাগ। ফ্রাইপেনের মধ্যেও ছেলেমেয়ে ফারাক করো। বুদ্ধি হাটুতে গিয়ে ঠেকছে তোমার বুঝতে পারছি। বেশ উড়ছো তো। ভাবছো আমি বুঝি ভুলে গেছি তোমার বলা সেই রাতের অপমানগুলো। না মুন্নি, না। এটা ভাবলে তুমি একনাম্বারের কুচিখুকি। খেলা সমান তালেই আগাচ্ছে। নতুন জয়েনড হওয়া কোম্পানির বসের সামনে তো যাও। গেলেই মুখ খুলার মত খুলা হয়ে যাবে।’

পৈশাচিক হাসি দুজনের ঠোঁটেই লেগে আছে। এখন দেখার পালা কার পৈশাচিক আনন্দের রেশ কবে চমকে পরিণত হয়।

চলবে…..