পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0
245

#পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
#পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

একটু আগের বিয়ে বাড়িটা এখন মৃত বাড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে। চারদিকে শোরগোল, কান্নার শব্দ। কেমন হৃদয় কাঁপানো আহাজারি! টকটকে লাল রঙের বেনারসিতে আবৃত তৃণার শরীরটা এখন উঠনোর মাঝখানে রাখা। তাকে ঘিরে মানুষের মেলা। কত আফসোসের দীর্ঘশ্বাস! কিছুক্ষণের বিবর্তনে একটা জলজ্যান্ত পুতুলের ন্যায় মেয়েটার কেমন নিস্তব্ধতা! কেমন নির্জীবতা!

দর্শিনী কেবল তাকিয়ে আছে তৃণার মুখের দিকে। গত কাল রাতেও মেয়েটা কতই না আকুতি করেছিল ভালোবাসা রক্ষার্থে, অথচ আজ সে মেয়েটা স্থির! হাজার হাজার গল্পের ঝুড়ি নিয়ে পরে থাকা মেয়েটা আজ কথা বলছে না।

তৃণার বাবা আজ কাঁদছে, খুব করে কাঁদছে। নিজের অবাস্তবিক জেদের জন্য পুতুলের ন্যায় মেয়েটা কেমন ঝরে গেলো! সে টেরও পেলো না সে কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারে? কেমন বাবা হলো সে? এত নিষ্ঠুর বাবা হয়!

নিপা কাঁপা কাঁপা পায়ে দর্শিনীর দিকে এগিয়ে আসে। তার শরীর আজ অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। আরও কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটতে পারে, সেই ভয়ে তার অন্তর আত্মা কাঁপছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়েছে। চারপাশটা তার কাছে মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে। যেখানে আরও কারো লাশ হওয়া বাকি।

দর্শিনী খেয়াল করলো ছোট বৌদির কাঁপুনি। আগলে নিলো মানুষটাকে। এতটা কাঁপছে কেনো মানুষটা!

নিপার ততক্ষণে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আসছে। কোনোমতে চোখ-মুখ উল্টে বললো,
“দৃষ্টান্ত টাও বোধহয় এমন নির্জীব পড়ে আছে, প্রিয়। ছেলেটাও বোধহয় নেই।”

আর কিছু উচ্চারণ করতে পারলো না নিপা। পুরো শরীরের ভর ছেড়ে দিলো দর্শিনীর উপর। হঠাৎ এমন কথায় হতভম্ব দর্শিনী। ছোট বৌদির আশংকা টা খুব যে ভুল হবে না সেটাও তার মন জানে।

নিপাকে নিয়ে আরও হৈচৈ পড়লো। দর্শিনী মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে গিয়ে দৃষ্টান্তের কথা বলতেই আরেকবার অনাকাঙ্খিত ভয়ে কেঁপে উঠলো মৃত্যুঞ্জয়। ছুট লাগালো বন্ধুর খোঁজে। দর্শিনী কেবল তৃণার লাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি সুন্দর মেয়েটাকে লাগছে! এত মিষ্টি কেন! মৃত্যু বুঝি মানুষকে সুন্দর করে তুলে!

_

ভোরের কোমল আকাশ। মেঘ জমেছে খুব গম্ভীর করে। থম মেরে থাকা প্রকৃতির সাথে মানুষের অনুভূতি গুলোর কেমন বিপর্যস্ত অবস্থা! আহাজারির ভয়াবহতার পর সবটাই এখন নিশ্চুপ। শ্মশানে দাউ দাউ করে পুড়ছে দুটো লাশ। যাদের গতকালকেও মানুষ বলা হতো আজ তাদের পরিচিতি কেবল লাশ! গতকালকের ধূসর রঙের জামদানীটা এখনো দর্শিনীর শরীরে আছে তবে বেশ এলোমেলো।

এতক্ষণ মানুষজনে ভরপুর থাকলেও এখন কেউ নেই। সবাই চলে গেছে নিজ গন্তব্যে। দর্শিনীই কেবল যেতে পারে নি। কেন পারে নি সে জানে না। তবে এখান থেকে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই তার হয় নি। সেদিন ছেলে-মেয়ে গুলোর অমন হৃদয় ভার করা বিচ্ছেদ দেখতে পেরেছে আর আজ একসাথে হওয়াটা দেখবে না! এই যে, বেঁচে থেকে একসাথে জীবন পার করতে পারবে না বলেই তো মৃত্যুর পথে হাতছানি দিলো, এমন মধুর মিলন সচক্ষে না দেখলে হবে!

দর্শিনী নিজের হাতের মাঝে থাকা দুটি চিরকুটের দিকে তাকালো। একটি তৃণার, অপরটি দৃষ্টান্তের। দু’জনই দু’জনের অপূর্ণতায় থাকবে না বলে বিদায় নিয়েছে অথচ মানুষ জাতি চাইলেই এ প্রাণ গুলোর ইচ্ছের পূর্ণতা দিতে পারতো।

দর্শিনী হতাশার শ্বাস ফেললো। নিপার ধারণাটাই ঠিক ছিলো। দৃষ্টান্তের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সে পৃথিবীর বুক থেকে ছুটি নিয়েছে চিরতরে। তৃণার তো অভিযোগ ছিলো, তাকে কেউ ভালোবাসেনি অথচ দৃষ্টান্ত কোনো অভিযোগ না রেখেই বিদায়ের ঘন্টা বাজিয়েছে। তৃণার আগেই পৃথিবী ছেড়েছে প্রেমিক পুরুষ। দৃষ্টান্তের মৃত্যুতে তত আহাজারি পড়ে নি। ছেলেটার তো কেউ ছিলো না, কে করবে আহাজারি! মৃত্যুঞ্জয়ের মা একটু কেঁদেছে, এই অবশ্য ঢের। ছেলেটা বেঁচে থাকতেও একা ছিলো, মৃত্যুর পরও যে কেউ তার নেই সেটা যেন আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো।

ফ্যানের সাথে নির্জীব হয়ে কেমন ঝু*লে আছে! কোনো অভিযোগ নেই, অভিমান নেই ছিলো কেবল একরাশ বিষন্নতা।

দর্শিনী দু’চোখ ভরে কেবল দেখে গেলো এই মানুষ গুলোকে। কি শান্তিতেই না দু’জন চির নিদ্রায় নিদ্রায়মাণ! কোনো অশান্তি নেই, অপূর্ণতা নেই। অথচ এই দৃষ্টান্তের পুরো জীবনটাই অপ্রাপ্তির এক নিষ্ঠুর দীর্ঘশ্বাস।

হরমোহন ছেলের দাহ্যের কাজে কোনোরকম ত্রুটি রাখে নি। তার একমাত্র ছেলেকে খুব ধুমধামের সাথে দাহ্য করেছে। এক রাতের মাঝে চন্দন কাঠ সংগ্রহ করেছে। ম্যালা টাকা খরচ করেই দাহ্য কাজ সম্পন্ন করেছে। অথচ ছেলেটার জীবনে সবচেয়ে বড় ত্রুটিটাই ছিলো সে। মৃৃত্যুর পর চন্দন কাঠে শুইয়ে লাভ কি? যদি বেঁচে থাকতে সুখের নিদ্রা না হয়!

হরমোহন ছেলের মৃত্যুর পরের কাজ গুলোতে যতটা কর্মঠ ছিলেন, তৃণার বাবা ঠিক ততটাই নেতিয়ে ছিলেন। অবশেষে ভদ্রলোক কি মনে করে যেন মুখ খুললে। এই প্রথম, এই প্রথম সে মেয়ের আনন্দের কথা ভাবলেন। হরমোহনের কাছে হাত জোর করে আকুতি মাখা কণ্ঠে বললেন,
“আমার মেয়েটারে আপনার ছেলের পাশে জায়গা দিবেন, দাদা? একটু শান্তির সাথে পুড়ুক সে। দিবেন জায়গা?”

হরমোহন এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। শ্মশানে পাশাপাশি দু’জনকে রাখা হলো। এই মধ্য রাতের দিকেই গ্রামের আশপাশে থেকে মানুষ ছুটে এলো। প্রেমের এক অসাধারণ ইতিহাস দেখে নিলো নিজের দু’চোখ ভরে। সবার মুখে মুখে ছড়ালো, ভালোবাসা কতটা সুন্দর! অথচ এই ছেলেমেয়ে গুলোই যখন ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিবাদ করেছে তখন মানুষ ভালোবাসার মুখে কত গুলো মিছে কালি লেপে কলঙ্কিত করেছে সেই বন্ধন। হায়রে মানুষ! হারানোর পর বোধহয় সবই সুন্দর মনে হয়।

আহাজারি, আহাজারিতে ভারী হলো প্রকৃতি। আগুন জ্বললো দুটি দেহে, হা হুতাশ করলো মানুষ। তারপর ভীর কমলো, আহাজারি কমলো কেবল কমলো না আগুনের ছাট। হয়তো একটু পর থিতিয়ে আসবে সেই আগুনও, সাথে স্মৃতির পাতায় ঝাপসা হবে প্রেমের এই করুণ পরিণতিটাও। তারপর আবারও ছেলে-মেয়ে প্রেমে জড়াবে, বাবা-মায়ের মিছে জেদ জাগবে তারপর অকালো ঝরবে আরও প্রাণ। এভাবেই নিত্য নতুন ভাবেই পুরোনো ঘটনা চলতেই থাকবে। প্রকৃতির কি নিয়ম!

আগুন থেকে উঠা ধোঁয়া গুলো আকাশ ছুঁয়ে দিচ্ছে। দর্শিনী তার পাশে থাকা শুকনো ভেঙে পড়া একটা গাছের ডালে বসলো। দৃষ্টান্তের চিঠিটা মেলে ধরলো চোখের সামনে। এই চিঠিটা দর্শিনী কাউকে দেখায় নি। খুব গোপনে সরিয়ে নিয়েছে। তার কেন যেন মনে হয়েছে, এই চিঠির যোগ্য ব্যাক্তি সেখানে নেই। সে নিজেও হয়তো যোগ্য না, তবুও সে খুললো, দৃষ্টান্তের হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি গুলো ছুঁয়ে দেখার জন্য চোখ রাখলো চিঠির শব্দ কণিকায়। নীল রঙের কলম দিয়ে লিখা,

“দু-চোখ আমার অন্ধ হোক,
বন্ধুর পাশে অন্যলোক–

কে জানতো জীবনটা গানের লাইন হয়ে রবে! বন্ধুর পাশে অন্যলোক দেখার মতন ভাগ্য নিয়ে আসবো, সোটাও বা কে জানতো? এই বিশাল পৃথিবীতে একা থাকার যে কি ভিষণ কষ্ট, কাকে জানাবে সে কথা? আমার যে কোথাও কেউ নেই। ছেলেদের কাঁদতে নেই বলে অনুভূতি প্রকাশ করাও বারণ আমাদের, কাকে জানাবো ভেতর আমার জ্বলে যাচ্ছে! খুব ছোট বেলায় যখন মাকে হারাই, সৎ মায়ের প্রথম চ*ড় খেয়েই বুঝেছিলাম জীবন এত সহজ না। কে জানতো জীবন যে এতটা কঠিন? আমার জীবনে প্রথম নারী আমার মা, যাকে হারিয়েছে সেই ছোট বেলায়, যখন হারানোর অর্থ জানতাম না। মা হারানোর পর বাবাকেও কেমন অপরিচিত মনে হলো। এই পরিত্যক্ত জীবনটা নিয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন দ্বিতীয় বারের মতন হারিয়েছি জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে। কতই না পাগলামি করেছি সেই ভালোবাসা আঁকড়ে রাখার জন্য! কারণ ততদিনে হারানোর অর্থ আমার খুব ভালো করে জানা হয়ে গিয়েছিলো। আটকাতে পারি নি তাকে। র*ক্তাক্ত হয়ে ফিরেছিলাম। কত রাত ঘুমাই নি, অগোচরে ভিজিয়ে ছিলাম বালিশ, কেউ জানবে না সে খবর। আমার উদ্দেশ্য বিহীন জীবনে হুট করেই দখল করলো আমার তৃণাবতী। আরেকবার, আরেকবার ভালোবাসা দহনে ঝাঁপ দিলাম। ভেবেছিলাম এবার আর পুড়বো না। কিন্তু আমি ভুল। বিশাল এই অপ্রাপ্তির জীবনে আমার যে প্রাপ্তি মিলবে না সেটা প্রায় ভুলতেই বসে ছিলাম। আরেকবার তাই হৃদয়ের ক্ষতটা জাগিয়ে দিয়ে বিদায় দিলাম আমার জীবনের শেষ ভালোবাসাকে। হ্যাঁ, তৃণাবতীই আমার শেষ ভালোবাসা। যাকে হারানোর আগেই আমি হারাবার ভয়ে থাকতাম। যাকে হারাবো না বলে নিজের বাবার পা ধরেছি। আকুতি করেছি প্রেমিকার বাবার পা ধরেও। অতঃপর শূন্য থালা নিয়ে ফিরে গেছি আমার শূন্যতা ভরা আঙিনায়। গোটা পৃথিবী আমায় কলঙ্কিত প্রেমিক বলবে। যে প্রেমিক আটকে রাখতে জানেনা ভালোবাসা। এই কলঙ্ক নিয়ে আদৌও বেঁচে থাকা যায়? তৃণাবতী শুনছো, তোমায় আমি ভীষণ ভালোবাসি। এই যে দেখো, নিজের জীবনের চেয়ে বেশি। প্রেমিকের অশ্রু নিয়ে প্রেমিকা ভালো থাকতে পারে না। তাই তো চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো তৃণাবতী। তৃণাবতী ছাড়া যে আমাকে কেউ ভালোবাসে নি।”

চিঠি শেষ। দৃষ্টান্তের অনুভূতি গুলো কেমন খড়খড়ে! যার আঁচ কেউ পায় নি কখনো। দর্শিনী হুট করেই কেঁদে উঠলো। দৃষ্টান্তের জন্য তার কান্না আসছে। আকাশ-পাতাল এক করে কান্না যাকে বলে। ছেলেটার হাহাকার কেউ দেখে নি। কতটা যন্ত্রণা পুষে একজন মানুষ ভালো থাকে? ভালোবাসা এমন কেন? তরতাজা দু’টি প্রাণ কেমন ছিনিয়ে নিলো। এত নিষ্ঠুর কেন ভালোবাসা!

কান্নার এক পর্যায়ে দর্শিনীর হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। অবাক চোখে তাকাতেই মায়ার নামটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। এত ভোরে মেয়েটা কল দিয়েছে কেনো! তড়িঘড়ি করে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মায়ার উৎফুল্ল কণ্ঠ ভেসে এলো,
“সই, ভালো আছো?”

দর্শিনী অবাক হলো। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এত সকালে যে! কিছু হয়েছে?”

“আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হচ্ছে। আশীর্বাদ করো, সই। কিডনির ডোনার পাওয়া গিয়েছে।”

দর্শিনী হা হয়ে রইলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“আজ তোমার অপারেশন? ডোনার কে জোগাড় করলো?”

“হৈমন্ত ভাই।”

মায়ার অকপটে স্বীকারোক্তিতে থমকালো দর্শিনী। কিছুক্ষণ মৌন থেকে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। মনে করো, তুমি ফিরে আসলে, কারো গোটা পৃথিবী জয় করা হবে।”

অপর পাশের ব্যস্ততা কানে আসতেই ফোন কাটলো দর্শিনী। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। দর্শিনী খেয়াল করলো সে বাদে এখানে আরেকজন উপস্থিত। নিপা বৌদি! যে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত অগ্নি শিখার দিকে। বিড়বিড় করে বলছে,
“আমি তোমায় রোজ নিয়ম করে ভালোবাসি, দৃষ্টান্ত।”

দর্শিনী হাসলো। ভালোবাসার সংজ্ঞা ঠিক কেমন হওয়া উচিত আসলেই তার জানা নেই। কেউ ভালোবাসা না পেয়ে মরছে, কেউ ভালোবাসার জন্য পৃথিবী থেকে পাপ লুকাচ্ছে আবার কেউ যুগের পর যুগ আস্ত ভালোবাসা পুষে রেখে আরেকজনের সংসার করছে। ভালোবাসার এত বৈচিত্র্যতা! তবুও ভালোবাসা সুন্দর।

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ আটচল্লিশ

কিছু তিক্ত অনুভূতি, রিক্ততা নিয়ে সপ্তাহ পেরুলো। মানুষ ব্যস্ত হয়ে গেলো নিজ নিজ বাস্তবতায়, ভুলে গেলো শোক। কেবল একজন সেই শোক নিজের অন্তঃস্থলে জিইয়ে রেখেছে। রোজ নিয়ম করে সে, সেই শোকে নিমজ্জিত হয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়। বাঁচিয়ে রাখে শোক নিজের আর্তনাদে।

ধরণীর বুকে এখন সময়টা প্রায় বিষন্ন বিকেল। দর্শিনী স্কুলের চাকরিটাতে জয়েন করেছে। আজ তিনদিন যাবত স্কুলে যাচ্ছে। সারাটা দিন সেখানেই পার হচ্ছে। আজও যথারীতি স্কুল শেষ হতেই সে বাড়ির দিকে পথ ধরলো। খুব ধীরে ধীরে পা চালালো। আর তো কয়েকটা দিন, তারপর তার সমস্ত অপ্রাপ্তিকে পূর্ণতা দিতে তার কোল জুড়ে নতুনের আবির্ভাব ঘটবে। এরপর আর দীর্ঘশ্বাসের পাল্লা তত ভারী হবে না। ভাবতে ভাবতেই মুচকি হাসলো দর্শিনী। তারও একটা নিজের কেউ হবে, যাকে আঁকড়ে ধরে নির্দ্বিধায় পাড় করা যাবে বাকি জীবন টা। হুট করেই দর্শিনীর মাথায় মায়ার ভাবনা খেলে গেলো। সেদিন মেয়েটার অপারেশন হওয়ার কথা ছিলো, এরপর তো আর কোনো খোঁজই নেওয়া হলো না মেয়েটার! ভীষণ বোকামি করে ফেলেছে ভেবে আফসোসের শ্বাস ফেললো দর্শিনী। ব্যাগ থেকে নিজের মুঠোফোন টা বের করলো। ডায়াল করলো কাঙ্খিত নাম্বারটি। দুই একবার রিং হতেই অপর পাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হলো। দর্শিনী উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো, মায়া?”

প্রশ্নের বিপরীতে অপর পাশ থেকে গমগমে পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“দিদি,আমি হৈমন্ত। ভালো আছেন?”

আকষ্মিক হৈমন্তের কণ্ঠে থতমত খেয়ে গেলো দর্শিনী। মনের কোণায় জেগে উঠলো অনাকাঙ্খিত ভয়। মায়ার ফোন তো সবসময় মায়াই রিসিভ করে, তবে আজ কেনো নয়! মেয়েটার কি তাহলে কোনো বিপদ হলো! ভয়ে দর্শিনীর শরীর থেকে যেন উষ্ণ ভাব বের হচ্ছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম উঁকি দিলো গলদেশে। কোনো মতে নিজেকে ধাতস্থ করে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বললো,
“আমি ভালো আছি। মায়া কোথায়? সুস্থ আছে তো মেয়েটা? ওর অপারেশন কেমন হলো? সাকসেসফুলি হয়েছে তো?”

“হ্যাঁ, মায়ার অপারেশন ঠিকঠাক ভাবে হয়েছিলো। এখন ও সুস্থ। ঘুমাচ্ছে।”

হৈমন্তের উত্তরে শীতল হলো দর্শিনীর মস্তিষ্ক। স্বস্তির শ্বাস ফেলতেই হুট করে বিহুর কথা মনে পড়লো। কেমন আছে ওরা? মেয়েটা তো একটাবারও খোঁজ নিলো না! হৈমন্তের কাছে জিজ্ঞেস করবে কি করবে না ভাবতে ভাবতেই হৈমন্তের কথা ভেসে এলো,
“দিদি,আপনাকে একটা কথা বলার আছে।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলো না।”

দর্শিনীর সাথে সাথে জবাব দেওয়ার পর অপর পাশে পিনপতন নীরবতা। হয়তো ছেলেটা গুছিয়ে নিচ্ছে যা বলবে সেটা। দর্শিনীও সময় দিলো তাকে। মিনিট দুয়েক পেরুতেই হৈমন্ত বললো,
“আমি মায়াকে নিয়ে এ দেশ ছেড়ে চলে যাবো।”

সামান্য একটা বাক্য, কিন্তু দর্শিনীর কাছে ভীষণ অদ্ভুত শুনালো। বিষ্মিত কণ্ঠে সে বললো,
“কোথায় যাবে! আর কেনই বা চলে যাবে!”

“দিদি, আমার পরিবারের সবাই এ দেশ ছেড়ে অনেক আগেই চলে গেছে। মায়ার পরিবারের কেউ নেই। ওর দিদি মারা যাওয়ার পর পরই ওর মা মারা গেছে আর ওর বাবা ওর জন্মের আগেই মারা গেছেন। এই শহরে মায়া একা হয়ে যাবে বলেই আমি থেকে গেছি। আর এতদিন সে প্রতিশোধের নে*শায় ছিলো। আজ এ শহরে তার কিছুই অবশিষ্ট নেই যার টানে সে থাকবে। তাই, আমি ওকে নিয়ে চলে যাবো। সুন্দর একটা জীবন দিবো ওরে।”

হৈমন্তের কথা থামলো। বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস। দর্শিনীও গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঠিকই তো, মায়ার বয়সই বা কত? এতটুকু বয়সে মেয়েটা জীবনের যে নিষ্ঠুর বাস্তবতা সইয়েছে তা-ই বা কম কিসে? গোটা একটা জীবন ই মেয়েটার পরে আছে।

দর্শিনী ধীর কণ্ঠে শুধালো,
“বিহু আর মৈত্র ভাইয়ার কী হবে তাহলে? ওদের জানিয়েছো? ওদের জন্য তো তাহলে কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।”

দর্শিনীর কথা শুনে বেশ অবাক হলো হৈমন্ত। বিষ্মিত হয়েই সে বললো,
“বিহঙ্গিনী দিদি আর মৈত্রদা তো গত পরশুই শহর ছেড়েছেন। মৈত্রদাকে নিয়ে খুব দূরে কোথাও চলে যাবে সে। এই শহরে তার কেউ নেই, কি জন্য পড়ে থাকবে এখানে। সে জন্য ই তো চলে গেলো। আপনাকে বলে নি?”

হৈমন্তের কথায় অবাকের মাত্রা ছাড়ালো দর্শিনী। কণ্ঠের কথা কণ্ঠেই আটকে রইলো। বিহু শহর ছেড়ে চলে গেছে? কোথায় গেলো? দর্শিনীকেও জানালো না!

দর্শিনীকে নির্বাক থাকতে দেখে হৈমন্ত আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“বলে নি আপনাকে, তাই না?”

দর্শিনী অস্ফুটস্বরে জবাব দিলো,
“নাহ্!”

“হয়তো সেও অতীত পিছে ফেলে নতুন ভাবে জীবন কাটাতে চাচ্ছে। অতীতটা তো তার কাছে কেবল ঘৃণিত তাই না? দিদি, আপনাকে আরেকটা কথা বলার ছিলো।”

দর্শিনী যেন বিহুর ঘটনাটা মানতেই পারলো না। কেমন ঘোরে চলে গেলো সে। আনমনেই বললো,
“হ্যাঁ, বলো।”

হৈমন্ত আবারও নিরব রইলো। সময় নিয়ে বললো,
“এখান থেকে যেহেতু মায়াকে নিয়ে চলেই যাবো তাই এখানে মায়ার সব সম্পর্ক আমি শেষ করে দিয়ে যেতে চাই। আপনার সাথে আর মায়া যেন যোগাযোগ না করে বা আপনিও যেন না করেন সেটাই চাইবো।”

হৈমন্তের কথায় ধ্যান ভাঙলো দর্শিনীর। ঘোর কেটে গেলো হুড়মুড় করে। হৈমন্ত কি বুঝাতে চেয়েছে তার বুঝতে বাকি রইলো না। এমন কঠিন মুহূর্তেও দর্শিনীর হাসি এলো। খিলখিল করে হেসে বললো,
“মায়ার সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক নেই যেটা তোমাকে শেষ করতে হবে। তবে তথাকথিত ভাবে, সমাজের মতে মায়া আমার সতীন। আর বর্তমানে সতীন সম্পর্কটাও নেই, তাহলে কোন সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলছো? যতটুকু আছে সম্পর্ক সেটা আত্মার, সে সম্পর্ক তো ছিন্ন করা যায়না। তবে হ্যাঁ আমি আর কখনোই মায়ার সাথে যোগাযোগ করবো না, অতীতকে পিছে ফেলে আমিও চলতে চাই। মায়া আমার অতীতের কালো অধ্যায়, সেটা নিয়ে আমিও হাঁটবো না। তবে ঐ শহরে মায়ার একটা সংসার আছে, ছিন্ন করার হলে সেটা ছিন্ন করো।”

দর্শিনীর হাসি হাসি কথার মাঝেও যে ঠাট্টার একটা করুণ সুর রয়েছে তা বুঝতে বাকি রইলো না হৈমন্ত। নিজেই লজ্জিত বোধ করলো এমন কথা বলার জন্য। নিজের অনুভূতি সামলে নিয়ে স্থির কণ্ঠে বললো,
“মায়ার এই সংসারের কোনো মূল্য নেই। স্ত্রী থাকা স্বত্তেও আরেকটা বিয়ের আইন সনাতনী ধর্মালম্বীদের আইনে নেই। সেই মতে এই বিয়েটা নিছকই ছেলেখেলা। আমি মায়ার সব পিছুটান পিছে ফেলেই যাবো।”

“আমি তবে আশীর্বাদ করলাম। চির জীবন এমন করে তুমি ভালোবেসে যাও।”

কথা শেষ করেই কলটা কেটে দিলো দর্শিনী। তপ্ত শ্বাসে ভারী হলো তার চারপাশ। মায়া মেয়েটাকে না চাইতেও সে কত কথাই বলেছে, অথচ মেয়েটার দোষ নেই। হয়তো মনের গোপনে মায়ার জন্য সে অভিশাপও পুষে ছিলো কিন্তু আজ আর কোনো অভিশাপ নেই। মেয়েটাকে আর দেখতে পাবে না ভেবেই বুক ভার হচ্ছে। মায়ার প্রতি অদৃষ্ট মায়া জন্মেছিলো হয়তো। সম্পর্ক গুলো কেমন ঘেটে ঘ হয়ে গেলো। এক কালের আত্মার সই বিহুকেও হারিয়ে ফেললো কেমন করে! হারিয়ে গেলো কত মানুষ, কত সুন্দর সন্ধ্যা! এখন তো কেবল মন ভার করা বিষাদ আর বিষন্নতা। জীবনের এই রঙ্গমঞ্চে কতই না পর আপন হয়, আপন থেকে হুট করে তারা অদৃশ্যে মিলিয়ে যায়। শুধু থেকে যায় স্মৃতিদের কলরব।

প্রকৃতি ধীরে ধীরে আঁধারে নিমজ্জিত হচ্ছে। দর্শিরীর হুট করেই মনে হলো তৃণা আর দৃষ্টান্তকে একটু দেখে যাওয়া যাক। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। হাঁটতে হাঁটতে শ্মশানের সামনে এসে পা থামালো দর্শিনী। চোখ দুটো তার বিষ্ময়ে বড় হলো। শ্মশানে আগরবাতি, মোমবাতি দেখাচ্ছে ছোট বৌদি। পড়নে তার লাল টুকটুকে সুতির কাপড়। পায়ে দেখি আলতাও দিয়েছে! নূপুরের রিমঝিম শব্দ কেমন গা কাঁপিয়ে দিলো!

দর্শিনী তাকিয়ে রইলো সে দিকে কেবল। নিপা মোমবাতি টা হাত থেকে নামিয়ে বসে পড়লো। কতক্ষণ মাটির মাঝে হাত বুলালো। ক্ষণে ক্ষণে মেয়েটার শরীরও কেঁপে উঠলো। মেয়েটা কি কাঁদছে! গুনগুনিয়ে কবিতা তো রটছে। কাঁপা কাঁপা ভেজা কণ্ঠে মনের সকল বিষাদ উজাড় করে দিয়ে বললো,
“কাফনের কাপড় গায়ে, মোর প্রেম নিলো বিদায়
প্রেমিক মোর বিচ্ছেদ বিরহে পড়িয়া রইলো হায়,
ওহে প্রেম কি অনল তোমার!
মৃ*ত্যু দেও দু’হাতে
তবুও কোনো মানুষ তোমায় নিয়ে
এমন উন্মাদনায় মাতে?”

_

ইদানীং গ্রামে কারেন্ট থাকে না। রাত হলেই দুনিয়া আঁধার করে বিদায় নেয় এই কৃত্রিম আলো। এইতো, এখনো বিদ্যুৎ নেই। মানুষ হাতপাখা নিয়ে যার যার উঠোনে বসে আছে। দর্শিনীর বাড়ির সবাইও উঠোনে বসা। ধৃষ্ট পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে ছুটোছুটি করছে। নিধি বার কয়েক ধমক দিয়ে চুপ করে আছে। সুমন অবশ্য এখনো বাজারে। প্রদীপ উঠোনের মাচার উপর শুয়ে আছে। নিপা বারান্দার উপর জলচৌকিতে বসে আছে। দর্শিনী নিজের বাবার সাথে উঠোনে মাদুর পেতে বসেছে। সরলা রান্নাঘরে টুকটাক কাজ সেরে নিচ্ছে। ওদের অবশ্য হারিকেন ঘরেই জ্বলছে। বাহিরে বেশ জোৎস্নার আলো আছে বিধায় হারিকেন বাহিরে আনা হয় নি।

ইদানীং প্রতাপ সাহা বেশ চুপচাপ থাকে। কি যেন মনে মনে ভাবে কেবল। দর্শিনী নিজের বাবাকে বেশ কয়েকদিন খেয়াল করছে। লোকটা কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। হুট করে এমন বদলের কারণ কি! আজ যেহেতু বাবা-মেয়ে একসাথে বসেছে তাই সুযোগ বুঝেই দর্শিনী প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“বাবা, তুমি কী কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”

প্রতাপ সাহা এখনো ধ্যানে মগ্ন ছিলো। মেয়ের কথায় ধ্যানে বিঘ্ন ঘটলো। কতক্ষণ মেয়ের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বললো,
“না মা, আমার আবার কিসের চিন্তা! ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে গেলে, বাবা-মায়ের চিন্তা ফুরোয়।”

দর্শিনী হাসলো। বাবার ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো,
“তাহলে তুমি এমন চুপচাপ থাকো কেনো বাবা?”

প্রতাপ সাহা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সবার দিকে তাকিয়ে গলা পরিষ্কার করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হুট করেই বলে উঠে,
“আমার জায়গা জমি আমি তোমাদের মাঝে ভাগ করে দিতে চাই। জায়গাজমির অর্ধেক ভাগ আমার দুই ছেলে পাবে আর অর্ধেকটা আমি আমার মেয়ের ঘরের নাতিকে উপহার হিসেবে দিতে চাই।”

এই নিস্তব্ধ পরিবেশে প্রতাপ সাহার কথা যেন বেশ গম্ভীর শুনালো। হুট করে এমন একটা প্রস্তাব যেন কেউই আশা করে নি। যেই না দর্শিনী কিছু বলতে যাবে, তখনই হুড়মুড় করে তাদের বাড়ির উঠোনো মৃত্যুঞ্জয় হাজির হয়। কেমন উসকোখুসকো লাগছে লোকটাকে!

মৃত্যুঞ্জয় বাড়িতে ঢুকেই সবার দিকে একবার তাকালো। প্রতাপ সাহা অবাক কণ্ঠে বললো,
“শহরে না গিয়েছিলে? কখন আসলে বাবা?”
“এইতো একটু আগে।”

দর্শিনী মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটাকে কেমন উদ্ভট লাগছে। কিছু কি হলো!

দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে হুট করেই মৃত্যুঞ্জয় বললো,
“আগামীকাল বিকেলে আমার ফ্লাইট, দর্শিনী।”

দর্শিনী এমন একটা কথা যেন এখনই আশা করে নি। হুট করে মৃত্যুঞ্জয় এ খবরটাই দিতে এলো! দর্শিনীর হাসি এলো, তাচ্ছিল্যের হাসি। প্রথম প্রথম সে সবার কাছে প্রিয়-দর্শিনী থাকে, কিন্তু যখন তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় হয় মানুষের, তখন প্রিয় দর্শিনী থেকে কেবল দর্শিনী হয়ে যায়। কি অদ্ভুত! ছেড়েই যদি যেতে হয় তবে জীবনে আসার কি দরকার!

দখিণা বাতাসে বাতাবি লেবুর ঘ্রাণ ভেসে আসে রাতের বৈরী বাতাসে। টিনের চালে এক নাগাড়ে ডাকতে থাকা কানাকুয়ো। অকল্যাণের সুর। তবে কী আরেকটা বিচ্ছেদের গল্প লিখলো এই রজনী?

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ উনপঞ্চাশ

আজ রাতটা একটু বেশিই নীরব, পানসে,বিষন্নতায় পরিপূর্ণ। প্রকৃতিতে শরীর শীতল করা বাতাস থাকলেও মনে বিষাদের উষ্ণতা বিরাজমান। দূর হতে ভাটিয়ালি গান ভেসে আসছে। নন্দন জেঠু হয়তো গান ধরেছে। কি মধুর সুর তার! গলায় কি টান! বিষাদটা মাখো মাখো করার জন্য একদম সঠিক সুর,
“মাঝি বাইয়া যাও রে,
অকূলো দড়িয়ার মাঝে, আমার ভাঙা নাও রে মাঝি, বাইয়া যাও রে…”

দর্শিনী চোখ বন্ধ করে মনযোগ দিয়ে শুনছে। এমন মনোমুগ্ধকর কণ্ঠ না শুনে পারা যায়? যায় না তো। নন্দন জেঠু একজন ভবঘুরে মানুষ। ঘর,সংসার বলতে কিছুই নেই। ছোটবেলায় নাকি সে কোন মেয়েরে ম্যালা ভালোবাসতো, অতঃপর মেয়েটার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই ভবঘুরে হন নন্দন জেঠু। তার গল্প গ্রামের প্রতিটা কোণ জানে। ভালোবাসার কি নির্দশন! কি সৌন্দর্যতা!

বাতাসের তালে মাঝে মাঝে গানের সুরের স্রোত কেটে যাচ্ছে, তবুও নির্জন রজনী হওয়ায় তত অস্বচ্ছ শোনা যাচ্ছে না। দর্শিনীর মনে হলো বর্তমানে জেঠুর গাওয়া গানটা যেন তার জীবনকেই নির্দেশ করছে। গানের লাইন গুলো যেন একেক জনের জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই যে, যা-ই হোক, জীবন নামের বিধ্বস্ত তরী নিয়েই এই এই বিশাল বেঁচে থাকার সমুদ্র পাড়ি জমাতে হবে। হঠাৎ ঝড়ে তরী নড়বড়ে হবে, রৌদ্র তপ্ত দুপুর তরীর উপর পড়লে শরীর জ্বলে যাওয়ার উপক্রম হবে, তবুও জীবন তরী বাইতেই হবে। এ ছাড়া যেন পথ নেই, উপায় নেই।

দর্শিনীর ভাবনার ছেদ পড়লো বাহুতে একটা শক্তপোক্ত হাতের আভাস পেতেই। এত রাতে তো কেউ জেগে থাকার কথা না, তাহলে কে বাহুতে হাত রাখলো! চমকে গেলো দর্শিনী, ঘাড়টা একটু ডান দিকে নিতেই বাবার হাস্যজ্জ্বোল মুখ নজরে এলো। বাবার মিষ্টি হাসির বিনিময়ে হাসি ফিরিয়ে দেয় দর্শিনীও। প্রতাপ সাহা মেয়ের পাশে এসে বসে। মধ্য রজনী, মাথার উপর ঝকঝকে চাঁদ, বাবা-মেয়ে একসাথে মাচার উপর বসে আছে, এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে বোধহয় আর একটাও নেই।

নন্দন জেঠুর গানের সুর বদলালো, কথা বদলালো। নতুন গান ধরেছে,
“আমার সারা দেহ খেও গো মাটি,
চোখ দুটি মোর খেও না,
আমি ম*রে গেলেও তারে দেখার স্বাধ,
মিটবে না গো, মিটবে না।
তারে এক জনমে ভালোবেসে, ভরবে না মন ভরবে না।”

বাবা-মেয়ের নিস্তব্ধতার মাঝে গানের সুর গুলো যেন ঝংকার তুলেছে। প্রতাপ সাহা কতক্ষণ নিরব থেকে মেয়ের পানে তাকায়, বাচ্চাদের মতন ডাক দেয়,
“মা।”

দর্শিনী হঠাৎ এহেন ডাকে চমকে যায়। মনে হলো তারই সন্তান তাকে ডাকছে। কি অদ্ভুত! ছোট্ট বেলায় যারা সন্তানের বাবা-মা থাকে, সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে সেই বাবা-মায়ের অভিভাবক হয়ে উঠে সন্তান। বাবা-মা নিজেদের সন্তানের মাঝে নিজেদের বাবা-মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়।

দর্শিনী বাবার এমন আদুরে ডাকে মিষ্টি হাসে। নরম কণ্ঠে শুধালো,
“কী, বাবা?”

প্রতাপ সাহা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, ভাব এমন যে বুকের সবটুকু স্নেহ সে ঢেলে দিবে মেয়ের তরে। বার কয়েক আদুরে হাত বুলিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
“মা, মৃত্যুঞ্জয় তো চলে যাবে, তোমার কী কিছু বলার নেই?”

হঠাৎ মৃত্যুঞ্জয়ের কথা উঠতেই বুক ভার হলো দর্শিনীর। হুট করেই মন খারাপের মেঘ গুলো আহাজারি করে উঠলো বক্ষ মাঝে। তার শূণ্য শূণ্য লাগলো চারপাশ। এমন টা কেনো হচ্ছে! এমন হওয়ার কথা তো ছিলো না। রাত দশটার দিকে হুড়মুড় করে এসে মৃত্যুঞ্জয় তার চলে যাওয়ার বাণী দর্শিনীকে শুনিয়েই আবার চলে গেলো নিজ পথে। সে বেছে বেছে দর্শিনীকেই কেনো চলে যাওয়ার বার্তা শুনালো? তবে কী সে চায় দর্শিনী তাকে আটকে রাখুক, আগলে রাখুক নিজের সাথে! হয়তো চায়। তাইতো আকার ইঙ্গিতে প্রকাশ করলো সেটা।

মেয়েকে ভাবনার রাজ্যে ডুব মেরে যেতে দেখে হাসলেন প্রতাপ সাহা। মেয়ের পানে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালালো। তার কাজে সে সক্ষমও হলো। দর্শিনীর ধ্যান ভাঙলো। ক্ষানিক থতমতও খেলো। প্রতাপ সাহা মেয়ের থতমত ভাব কাটাতেই বললেন,
“ওরা তো ভোরের দিকেই বের হয়ে যাবে, বিদায় জানাতে যাবে না? আবার কিন্তু বছর ঘুরলে মৃত্যুঞ্জয় আসবে। ভাবতে পারছো, বছরখানেক দেখা হবে না তোমাদের? মানতে পারছো এ সত্য!”

দর্শিনী হাসলো। বাবা যে তার ভিতরের অনুভূতি বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে তা বুঝতে বাকি রইলো না দর্শিনীর। বাবার কাঁধে মাথা রেখে আকাশ পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। তপ্ত এক শ্বাস ফেলে বললো,
“জীবনে সত্যিটা মানতে পেরেছি বলেই আজও টিকে আছি, বাবা। আমার আবার তেমন কষ্ট হয় না সত্যি মানতে। আর, যার চলে যাওয়ার কথা সে তো চলে যাবেই, বাবা। সবাই কি আর থাকে জীবনে!”

প্রতাপ সাহা জানেন, তার মেয়ের বাস্তবিক জ্ঞান এতটাই প্রখোর যে আঁচড় কাটবে যে কারো হৃদয়ে। কিন্তু মেয়েটা বরাবরই কল্পনার জগতে ভাসতে ভালোবাসতো। আজ আর তার মিছে শৌখিনতা নেই। জীবনের প্রতি উপচে পড়া উচ্ছ্বাসও নেই। বেঁচে থাকতে হবে বলেই হয়তো বেঁচে আছে।

দীর্ঘশ্বাসের পাল্লা ভারী হলো। হু হু করে রাতের বিষন্নতা বাড়লো। গুমোট রূপ ধারণ করলো প্রকৃতি। তবুও প্রতাপ সাহা মিইয়ে গেলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে ম্লান কণ্ঠে বললেন,
“মা, মাঝে মাঝে নিজের ভালোর জন্য ও কিছু মানুষকে আটকে রাখতে হয়। নিজের জীবনের প্রতি নিজের এমন নিষ্ঠুরতা যে সাজে না। আর মানুষ কখনো একা বাঁচতে পারে না। দুঃখ পাবো এ ভয়ে যদি কাউকে আঁকড়ে না ধরো তবে দিনশেষে তোমার প্রিয় একাকীত্বই হবে তোমার মৃ*ত্যুর কারণ। জীবন তো সুখ-দুঃখের রঙ্গমঞ্চ। সুখটাকে যদি উপভোগ করতে পারো তবে দুঃখে তোমার কেন এত অনীহা? আর দুঃখেই বা কেন এত নিমজ্জিত হবে যে সুখকে আঁকড়ে ধরবে না? দুটোকেই নিয়ে পথ চলতে হবে। আর হ্যাঁ অবশ্যই দিনশেষে সবারই নিজের একটা মানুষ লাগে।”

“প্রিয়দর্শিনী থেকে দর্শিনী বানানো মানুষ গুলোকে আদৌও নিজের ভাবা যায়, বাবা?”

“তুমি এতটাও অবুঝ না মা, যে মৃত্যুঞ্জয়ের অনুভূতি বুঝবে না বা অভিমান, আবদার বুঝবে না। মানুষের অনুভূতিকে মূল্য দিতে হয় সময় থাকতে । ফুরিয়ে গেলে হাহাকার বাড়বে, তাছাড়া আর কিছুই না৷”

বাবা বিচক্ষণ মানুষ। আর মৃত্যুঞ্জয়ের উন্মুক্ত অনুভূতি সবারই চোখে পড়েছে। বাবাও যে সেই সবার দলে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। দর্শিনী বাবার ডান হাতের উপর নিজের দু-হাত রাখলো। বিনীত স্বরে বললো,
“সবার অনুভূতি তো ফুরায় না, বাবা। এই যে প্রতি রাতে গান গাওয়া নন্দন জেঠুর তো কখনো অনুভূতি ফুরালো না। বিশ বছরের কিশোর নন্দন জেঠু প্রেমে পড়েছিলো, আজ তার বয়স পঁয়ষট্টির এপাড়-ওপাড়, কই এক বিন্দু তো প্রেম কমেনি। বরং দিনে দিনে তা বাড়ছে দ্বিগুণ আকারে। এখনও নন্দন জেঠু ললিতা মাসির সাথে কথা বলে। চুলে পাঁক ধরা ললিতা মাসির সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে পাশে আছে। কই, তাদের অনুভূতির তো নড়চড় হয় নি। মানুষটা সঠিক হলে অনুভূতিরা তো বদলায় না, বাবা। আমি সঠিক হলে মৃত্যুঞ্জয়ের অনুভূতিও বদলাবে না আশা রাখা যায়। মৃত্যুঞ্জয় চলে যাচ্ছে মানে এই না যে সে ফিরে আসবে না। সব চলে যাওয়া মানে তো বিচ্ছেদ না, বাবা। আমিও দেখি আমি ললিতা মাসির মতন শেষ বয়সের বন্ধু পাই কিনা? কিছু দূরত্ব ভালো যদি সে দূরত্ব মানুষকে কাছে আনে।”

“তবে তা-ই হোক। তোমার গোপন পরীক্ষায় যেন সর্বোচ্চ নাম্বার নিয়ে উত্তীর্ণ হয় মৃত্যুঞ্জয়, আমি সেই প্রার্থনাই করবো।”

প্রতাপ সাহার কথা থামে। প্রকৃতির নিরবতা আরও বাড়ে। অনেক রাত পর্যন্ত বাবা-মেয়ে বসে থাকে একসাথে। দূর হতে কখনো নন্দন জেঠুর গান ভেসে আসে কখনো বা হু হু কান্না। জেঠুর কান্নার সাথে তাল মিলিয়ে কিঞ্চিৎ শোক দর্শিনীও পালন করে। দু’ফোটা অশ্রু ঝরে। কার জন্য যেন বিশাল শূণ্যতা অনুভব হয় হৃদয় কোণে। কখনো দৃষ্টান্তের সাথে কাটানো শৈশব মনে পড়ে, কখনো বা ছোট্ট তৃণার মেলায় করা আবদারের কথা মনে পড়ে, কখনো বড়বৌদির স্নেহ মনে পড়ে, কখনো নিপা বৌদির গোপন বিরহের কথা মনে পড়ে, কখনো বা পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় নারী মোহনার কথা মনে পড়ে। মানুষটা ভালো আছে তো! জীবনের স্মৃতির পাতায় অনেক মানুষের মুখই ভেসে উঠে কেবল ভেসে আসে না বিপ্রতীপের প্রতিচ্ছবি, তবে কী লোকটাকে সে ভুলে গেলো! কি অদ্ভুত! অথচ তাদের প্রেমের বিয়ে ছিলো। এত তাড়াতাড়ি ভুললো কীভাবে সে মানুষটাকে! দর্শিনীর নিজেরই ভীষণ অবাক লাগে নিজের এমন বদলে।

সবাইকে মনে করে দীর্ঘশ্বাসের পাল্লায় যখন চোখ বন্ধ করে, তখন চোখের পাতায় ভেসে উঠে ভিনদেশী মানবটা। যত্ন নেওয়ার মুহূর্ত গুলো। কি অদ্ভুত, তাদের মধ্যে তো কোনো সম্পর্ক নেই, তবে মনে পড়লো কেন মানুষটাকে?

ভোরের পাখিদের শোরগোল শোনা গেলো, সাথে কিঞ্চিৎ ঠান্ডা বাতাসের ঝিলিক। চোখে রোদ পরতেই ঘুম ভেঙে যায় দর্শিনীর। রোদের উত্তপ্তটা দেখলেই বোঝা যায় বেলা বোধহয় বেশ হয়েছে। আড়মোড়া ভাঙতেই দর্শিনীর মনে পড়লো আজ মৃত্যুঞ্জয়দের চলে যাওয়ার কথা। মৃত্যুঞ্জয়ের কথা মনে পড়তেই মন খারাপের বিজ্ঞাপনে উত্তাল-পাতাল হলো হৃদয় মন্দির। ঘড়ির কাটায় দৃষ্টি দিতেই দেখে সাতটা বাজছে। আজ শুক্রবার, ছুটির দিন বিধায় ব্যস্ততা নেই আর তাছাড়া কাল রাতে অনেক দেরি করে ঘুমাতে এসেছে বলে আজ ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে তবে তত দেরিও না।

বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াতেই তার নরম কোমল পা দুটোকে ছুঁয়ে দিলো কোমল রোদ। মনটা কিছুটা শান্ত হলো তার। মৃত্যুঞ্জয়রা চলে গেছে না এখনো আছে এটা ভাবতে ভাবতে পাঁচ মিনিট কাটিয়ে দিলো ক্ষীণ ভাবনায়। শরীর ঝাড়া দিয়ে অলসতা কাটিয়ে ফেললো। বাবা বলেছিলো শেষবার মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে, দেখতে যাওয়া কি উচিৎ কাজ হবে! সে তাহলে মৃত্যুঞ্জয়ের পিছুটান হয়ে রবে না! কারো পিছুটান হওয়া উচিৎ আদৌও!

ভাবনায় মত্ত হয়েই হাত-মুখ ধুয়ে এলো। ততক্ষণে সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে তার দৃষ্টি পড়লো টেবিলের উপর। তার পছন্দের নোবেল টেবিলের উপর চকচক করছে। সে তো কেনে নি এটা! তাহলে! বাবা আনলো?

আর অপেক্ষা না করেই নোবেল টা ছুঁয়ে দেখলো দর্শিনী। নাড়াচাড়া করতে গিয়ে নোবেলটা থেকে হলুদ একটা চিরকুট পড়লো। দর্শিনী অবাক হলো, বাবা তো চিরকুট দিবে না। আর এ নোবেল গ্রামের লাইব্রেরীতেও নেই। তবে!

চিরকুটের ভাজ খুলতেই নীল কালির উজ্জ্বল অক্ষর গুলো ভেসে উঠলো। যেখানে লিখা,
“আমি মুখ থুবড়ে পড়ার আগেই চোখ লুকিয়ে পালাচ্ছি, প্রিয়দর্শিনী। আর যাই হোক, আপনার চোখের তাচ্ছিল্য আমাকে ভালো থাকতে দিবে না যে! কখনো চক্ষুলজ্জা লুকাতে পারলে ফিরে আসবো। থাকবেন তো আমার অপেক্ষায়?

মৃত্যুঞ্জয়”

বইখানা তবে মৃত্যুঞ্জয় দিয়েছে! আর এই চিরকুটের মাধ্যমে সে কি বুঝাতে চাইলো! তবে কি সেদিন দর্শিনীর বলা কথাটা সে শুনতে পেয়েছিলো। তার মুখ থুবড়ে পড়া বাকি, এটা শুনেছিলো সে! তবুও এত হাস্যোজ্জ্বল কীভাবে ছিলো মানুষটা?

খারাপ লাগায় ছেয়ে গেলে দর্শিনীর মন বাগিচা। শেষবার অন্তত মানুষটাকে ভুল বুঝে চলে যেতে দেওয়া যাবে না। মানুষটা খারাপ লাগা নিয়ে থাকবে এটা আদৌও মানা যায় না।

দর্শিনী দ্রুতই উঠোনে নামলো। তাকে উঠোনে নামতে দেখে সরলা রান্নাঘর থেকে হাঁক ছেড়ে চিন্তিত স্বরে বললো,
“প্রিয়, তোর বাবাকে দেখেছিস? কাল রাত থেকে মানুষটাকে দেখছি না। কোথায় গেলো সে!”

মায়ের কথায় অবাক হলো দর্শিনী। বাবা তো অনেক রাত অব্দি তার সাথেই ছিলো। তারপর সে ঘরে চলে যায়, বাবা তখনও বসে ছিলেন উঠোনে। এরপর কী তাহলে আর বাবা ঘরে যান নি? কোথায় গেলো মানুষটা? সারারাত কোথায় রইলো?

অথৈজলে পড়লো দর্শিনী। কার খোঁজে আগে যাবে, বাবা না মৃত্যুঞ্জয়! আর মৃত্যুঞ্জয় এতক্ষণ অব্দি আছে? না চলে গেছে? হাজার খানেক প্রশ্ন নিয়ে পা বাড়ালো পথের ধারে।

গ্রামের পথে ব্যস্ত পদচারণ মানুষের। দর্শিনী হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা পথ পাড়ি জমালো। উদ্দেশ্য মৃত্যুঞ্জয়দের বাড়ি। মৃত্যুঞ্জয়দের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তার সামনে শা শা করে ছুটে গেল কতগুলো গাড়ি। গাড়ির গতি তত বাড়ন্ত না থাকায় সাদা চকচকে শার্ট পড়া মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে অসুবিধা হলো না তার। লোকটার চোখ টলমল করছে! কাঁদছে কি সে! দর্শিনীর বিরহেও কোনো মানুষ কাঁদে!

দর্শিনীর গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো, “থেকে যান ভিনদেশী সাহেব।” কিন্তু তা আর বলা হলো না। চোখের পলকে খুব দূরে চলে গেলো গাড়ি গুলো। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো গন্তব্যে। যতটা দূরে গেলে আর ছোঁয়া যায়না, ঠিক ততটা দূরে।

খুব গোপনে দর্শিনীর চোখ থেকেও দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। কেউ দেখার আগেই গালের সাথে খুব যত্নে মিশিয়ে ফেললো এই অশ্রুবিন্দু। কিছু অনুভূতি গোপনে থাক।

দর্শিনীর চারপাশে নেমে এলো শূণ্যতা। সকালটা ভীষণ একলা মনে হলো। চিরচেনা সেই পুকুর পাড়ের নিবিড় সিঁড়িটাই বসে থেকেই নিস্তব্ধ সকালটা পাড় করলো। দুপুরটা কেমন হৃদয় ছাড় খার করে গেলো। পুরো গ্রাম যেন মৃত্যুঞ্জয় বিহীন একা ঠেকলো দর্শিনীর কাছে। চারপাশে যেন ধূ ধূ মরুভূমি। হাসলো দর্শিনী। যে মানুষটা তার বিরহে কেঁদেছে, সে মানুষটাকে হাত ছাড়া করা জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামি বোধ হলো। কিন্তু কিছু বোকামি শোধরাবার সুযোগ থাকে না।

শ্যাওলা সবুজ পুকুর পাড়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বিবশ হয়ে দর্শিনী বললো,
“ভিনদেশী সাহেব, আমার বিরহে আপনি কেঁদেছেন, আপনার বিরহে আমার মনের রাজ্যে উদযাপিত হবে আজ থেকে ভীষণ শোক। একজন নারীর জন্য কোনো পুরুষ কান্না করলে সে নারী ভাগ্যবতী। আজ থেকে নাহয় এত ভাগ্যবতী হয়েছি বলে রোজ আপনার জন্য আমি কাঁদবো। কেউ জানবে না, আমিও শেষ বয়সের জন্য একটা বন্ধু পেয়েছি। আপনি এলেই আমার অপেক্ষারা চির নির্বাসনে যাবে।”

পুকুরের জল টলমল করে উঠলো। একটা গোটা বিষন্ন দিন জানলো, মানুষেরও মানুষ হারায়।

সারাটা দিন এক ধ্যানে কাটিয়ে সন্ধ্যা নামতেই দর্শিনী পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মনে হলো বাবাকে তো সে খুঁজলো না। তবে এতক্ষণে হয়তো বাবা চলেও এসেছে। ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছে এসে পা থেমে গেলো তার। বাড়ি থেকে এত হৈচৈ ভেসে আসছে কেনো! একটা সাদা গাড়িও তো দেখা যাচ্ছে। মৃত্যুঞ্জয় তো এমন একটা গাড়িতেই ছিলো। তবে কী মৃত্যুঞ্জয় যায় নি!

#চলবে