#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪৪|
বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদিদ। তার থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়ানো তার মা। আদিদ নিরব চোখে তাকিয়ে আছে সেই কবরের দিকে। সে কখনো ভাবেনি এবার ফিরে এসে আর বাবাকে দেখবে না। ভেবেছিল, সামনে না গেলেও দূর থেকে একবার মা বাবাকে দেখে যাবে। কে জানতো, সে দেখার আগেই তার বাবাকে এই মাটির নিচে রেখে দেওয়া হবে। কে জানতো, আর চাইলেও বাবাকে দেখা হয়ে উঠবে না তার। এতকিছু হয়ে গেল, বাবা অসুস্থ হয়ে মা’রা গেল অথচ সে কিছু জানল না। কেমন ছেলে সে, আর কেমন ডাক্তারই বা সে, যদি না নিজের বাবার চিকিৎসাটাই করতে পারলো। আদিদ চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। মেনে নিতে পারছে না সে, কোনোভাবেই পারছে না। এই ঘৃণা আর ক্ষোভ তার কাছ থেকে তার বাবাকে কেড়ে নিয়েছে। এখন কাকে ঘৃণা করবে সে? কার প্রতি এত ক্ষোভ নিয়ে বসে থাকবে?
আদিদ চোখ মেলে তাকায়। তারপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে মায়ের কাছে ফিরে যায়। তার মা কাঁদছেন। এত এত কষ্ট আর হয়তো তিনি সহ্য করতে পারছেন না। আদিদ তার মা’কে গিয়ে বললো,
‘মা, তৈরি হয়ে নাও। আমি তোমাকে নিয়ে এখনই শহরে ফিরে যাবো।’
রুবি হোসেন ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন,
‘এই মানুষটাকে এখানে একা ফেলে আমি কী করে চলে যাবো। সারাটা জীবন আমার পাপের সঙ্গী ছিলেন। শেষ সময়ে এসে রাতদিন কেঁদে কেটে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। অনেকবার চেয়েছিলেন তোমার সাথে যোগাযোগ করতে, কিন্তু সাহস হয়ে উঠেনি। আর যেদিন মা’রা গিয়েছিলেন সেদিনও তোমার জন্য খুব কেঁদেছিলেন। আমি এই মানুষটাকে কীভাবে ভুলবো? উনি তো ভালো ছিলেন, আমি উনাকে খারাপ বানিয়েছি। আমার জন্য উনি কষ্ট করেছেন। আমাকে উনি কোনোদিনও মাফ করবেন না। কোনোদিনও না..’
এই বলে তিনি আরো জোরে জোরে কেঁদে উঠলেন। আদিদ তার মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কষ্ট তো তারও হচ্ছে, ভীষণ কষ্ট। বুক ফেটে যাওয়ার মতো কষ্ট। কিন্তু এখন আর সে আগের মতো কাঁদতে পারে না। চোখ দিয়ে এখন আর পানি আসে না তার।
রুবি হোসেন অনেকক্ষণ ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন । তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক মুখ মুছে বললেন,
‘চলো বাবা, তোমাকে কিছু খেতে দেই। বিকেল হয়ে গেছে, এখনও কিছু খাওনি তুমি। চলো।’
ছেলেকে নিয়ে তিনি ভেতরে গেলেন। ছোট্ট একটা টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা করলেন, ছেলের বসার জন্য। তারপর তিনি খাবার নিয়ে এলেন। এক প্লেট ভাত, এক বাটি ডাল আর অন্য একটা বাটিতে কিসের একটা তরকারি। খাবারগুলো দেখে আদিদ অবাক হলো। তার মা এখন এসব খায়! হায়! ভাগ্য মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে আসে।
আদিদ খুব মজা করে খাবারটা শেষ করে। অনেকদিন পর এতটা তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে সে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আদিদ তার মা’কে বললো,
‘তুমিও খেয়ে নাও মা। আর খেয়ে তৈরি হয়ে নাও, আমরা শহরে ফিরছি।’
রুবি হোসেন বলে উঠলেন,
‘আমি তোমার বাবাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না, আদিদ।’
আদিদ জোর গলায় বললো,
‘যেতে হবে তোমাকে। এখন থেকে আমার সাথেই শহরের বাড়িতে থাকবে তুমি। প্রয়োজন পড়লে কিছুদিন পরপর এসে আমরা বাবাকে দেখে যাবো। তাও তোমাকে এখানে একা রেখে আমি কোথাও যাবো না।’
আদিদের কাছে হার মেনে রুবি হোসেনকে রাজি হতে হলো। তিনি ফিরে গেলেন তার শহরের বাড়িতে।
আবার সেই বাড়িতে ঢুকে কেঁদে উঠলেন। কত স্মৃতি উনার এই বাড়ি জুড়ে। উনি ভুলতে পারবেন না কখনো। আজ নিজেকে অসহায় লাগছে, মনে হচ্ছে নিজের হাতের সুন্দর সম্পর্কগুলো ধ্বংস করেছেন। আর তার শাস্তিই হয়তো সৃষ্টিকর্তা তাকে এইভাবে দিচ্ছেন।
অনেকদিন বাড়ি বন্ধ থাকায় অনেক ময়লা আবর্জনার স্তুপ পড়েছে বাড়িতে। আদিদ খবর দিয়ে বাইরে থেকে লোক আনাল, এসব পরিষ্কার করতে। সাথে তার বাড়ির পুরোনো কাজের লোকদেরও খবর দিল, আবার আসার জন্য।
.
.
রাণী পুরোটা দিন খুব অস্থিরতায় কাটাল। আদিদ এসেছে সেই খবর আরো অনেক আগেই পেয়েছে সে। কিন্তু পদ্ম’কে যে সে এটা বলবে সেই সাহসটুকুও পাচ্ছে না। পদ্ম সেদিনের পর থেকে খুব রেগে আছে। রাণীর সাথেও ভালো ভাবে কথা বলে না। অযথাই তার সাথে রাগ দেখায়। রাণী বুঝতে পারে পদ্ম ঐ ছেলের রাগ তার উপর মিটাচ্ছে, তাই সেও আর কিছু বলে না। কিন্তু আদিদ আসার খবর টা সে কোনোভাবেই পেটে রাখতে পারছে না। আর অন্যদিকে ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। বারবার পদ্ম’র রুমে উঁকি মেরে চলে আসছে। পদ্ম দু’দিন ধরে পাঠশালাতেও যাচ্ছে না। বাসায় সারাদিন তার ব্লকের কাজ করছে। অনিকও তাকে আর কল দেয়নি। পদ্ম ঠিক করেছে সে আর পাঠশালায় যাবে না। কিন্তু ঐ বাচ্চাগুলোর কথা মনে পড়লে কষ্ট লাগে তার। আবার ঐ অনিকের কথা মনে পড়লে রাগে তার গা রি রি করে উঠে। সে এতিম বলে, সবাই কি ভালোবেসে তাকে দয়া দেখায়? প্রয়োজন নেই, এই ভালোবাসা নামক দয়া তার লাগবে না। কারো কাছ থেকে লাগবে না, আদিদের কাছ থেকেও না।
সারাদিন ছটফট করতে করতে সন্ধ্যার পর রাণী লুকিয়ে অভিকে কল দেয়। তারপর সে ফিসফিসিয়ে অভিকে বলে,
‘অভি ভাই, আমাকে ডাক্তার সাহেবের সাথে একবার দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও না।’
অভি তাকে ধমক দিয়ে বসে,
‘তোর বাঁদরামো কি এখনো যায়নি, রাণী। আদিদ আসার কথা শুনে আবার শুরু করেছিস।’
‘আরে ভাই, তুমি বুঝতে পারছো না। আমার ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করতেই হবে। খুব জরুরি। প্লীজ, একটা ব্যবস্থা করে দাও।’
অভি রাণীর কথা বিশ্বাস করলো না। সে ভাবল রাণী হয়তো আবার আদিদ কে বিরক্ত করতে চায়ছে। তাই সে তাকে শাসিয়ে বললো,
‘দাঁড়া, আমি এক্ষুণি কল করে পদ্ম কে বলছি। পদ্ম’র হাতের কান মলা না খেলে তুই মানুষ হবি না।’
রাণী ভয় পেয়ে যায়। বলে,
‘না না, আপুকে বলো না প্লীজ। আচ্ছা আমি দেখা করবো না কিন্তু তাও আপুকে কিছু বলোনা।’
রাণী কলটা কেটে মন খারাপ করে বসলো। সে বুঝতে পারছে না আদিদের সাথে যোগাযোগ কী করে করবে। এতদিন তো আদিদ আসার অপেক্ষাতেই সে বসে ছিল। আদিদ আসবে আর সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পদ্ম আর আদিদের মিল করবে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, আদিদের সাথে যোগাযোগই করতে পারবে না সে। রাণী মন খারাপ করে বসে থাকে, আর ভাবতে থাকে কীভাবে কী করা যায়।
পরদিন সকালে মা’কে নিয়ে আদিদ তার হসপিটালে আসে। মায়ের অনেকগুলো টেস্ট করাবে সে। এসেই অন্যসব ডক্টরদের সাথে মায়ের টেস্টের ব্যাপারে কথা বলে সে। রুবি হোসেন সেসময় আস্তে আস্তে হেঁটে একটা কেবিনের সামনে যান। এই কেবিনেই পদ্ম’কে তিনি প্রথম দেখেন। এই একটা মেয়ে তাকে পুরো বদলে দিয়েছে, এই একটা মেয়ে তার জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়ে, এই একটা মেয়েই তাকে আবার মানুষ হতে শিখিয়েছে। রুবি হোসেনের মনে তখন প্রশ্ন জাগে, “আচ্ছা, মেয়েটা কোথায়?” তিনি একবার তার সাথে দেখা করতে চান। তার কাছে ক্ষমা চাইতে চান। একবার জড়িয়ে ধরতে চান মেয়েটাকে। কিন্তু কোথায় সে?
আদিদ তার মায়ের পেছনে এসে বললো,
‘মা, তুমি এখানে কী করছো?’
রুবি হোসেন ঘুরে ছেলের দিকে তাকালেন। মৃদু সুরে বললেন,
‘পদ্ম কোথায় আছে আদিদ, তুমি কী জানো?’
আদিদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
‘উনাকে তোমার কী প্রয়োজন?’
রুবি হোসেন জবাবে বললেন,
‘আমি ওর কাছ থেকে ক্ষমা চাইবো।’
আদিদ দম ফেলে বললো,
‘ঠিক আছে, অভির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমরা উনার সাথে দেখা করবো।’
‘আজই আমি ওর সাথে দেখা করবো।’
আদিদ ব্রু কুঁচকে বললো,
‘আজ?’
‘হ্যাঁ, আজকেই।’
‘ঠিক আছে, তোমার টেস্টগুলো আগে শেষ হোক। তারপর নাহয় পদ্ম’র সাথে দেখা করা যাবে। এখন চলো আমার সাথে।’
চলবে…
#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪৫|
অভির কাছ থেকে আদিদ পদ্ম’র ঠিকানা নিল। তারপর বিকেলের দিকে মা’কে নিয়ে আদিদ সেই ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যেতে লাগল প্রায় আধ ঘন্টা।
কলোনির দুই নম্বর গলির সামনে এসে আদিদ গাড়ি থামাল। মা’কে বসতে বলে সে গাড়ি থেকে নামল। আশেপাশের কয়েকটা বাড়ির নেইমপ্লেট দেখল সে। অভির দেওয়া নামের সাথে তো কোনো নামই মিলছে না। সে আরো কিছুটা সামনে গেল। একটা সবজিওয়ালা দেখল, যে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছিল। কলোনিগুলোর এই এক সুবিধা, এখানে রাতদিন চব্বিশ ঘন্টায়’ই কোনো না কোনো ভ্যানওয়ালা থাকবেই। আর এইসব ভ্যান ওয়ালার কদরও এখানে অনেক। নয়তো এই বিকেলে কেউ কি সবজি কিনতে বের হয়?
আদিদ বাসা খুঁজে পাচ্ছিল না বলে ভ্যানওয়ালার কাছে গেল। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি কি রহিমা মঞ্জিল টা চিনেন?’
সবজিওয়ালা চিনল না। কিন্তু তার থেকে যে সবজি কিনছিল সেই মেয়েটার মনে হলো নামটা তার খুব পরিচিত।
সবজিওয়ালা চিনতে পারেনি বলে আদিদ ফিরে যাচ্ছিল। তখনই মেয়েটির মনে পড়ে, আরে! তারা যে বাড়িতে থাকে সেটার নামই তো রহিমা মঞ্জিল। সে পেছন ফিরে আদিদ কে ডেকে উঠে,
‘শুনুন।’
আদিদ চমকে পেছন ফিরে তাকায়। আর তার দৃষ্টি মেয়েটির উপর পড়তেই সে নির্বাক হয়ে যায়। মেয়েটিও বাকরুদ্ধ। সে কী সত্যিই দেখছে সামনে মানুষটাকে, নাকি এটাও তার কল্পনা? আদিদ বিস্ময় কাটিয়ে ক্ষীণ সুরে বলে,
‘পদ্ম!’
পদ্ম’র বুকের ভেতরে ঢিপ ঢিপ শব্দ করছে। চোখের পল্লব ফেলতে ভুলে গেছে যেন। মস্তিষ্কের স্নায়ু কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে কেবল ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। এমনটা কেন হলো? কেন সে আদিদ কে দেখল? আদিদ কেন এখানে এলো? কেন তাদের আবার দেখা হলো? খুব কি দরকার ছিল এসবের?
পদ্ম’র নিস্তব্ধতা দেখে আদিদ তার দিকে দু কদম এগিয়ে গেল। সরব গলায় বললো,
‘আমাকে চিনতে পারছেন না, পদ্ম? আমি আদিদ।’
পদ্ম ঢোক গিলল। বললো,
‘আপনাকে ভুলিনি আমি।’
থামল সে। খুব বেশি জড়তা কাজ করছে তার মাঝে। সে চোখ বুজে নিশ্বাস নিয়ে বললো,
‘ভালো আছেন?’
আদিদ মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘হ্যাঁ, ভালো আছি। আপনার কী খবর? শোনলাম আপনি আর রাণী নাকি আলাদা বাসায় থাকেন?’
‘জ্বি।’
আদিদ একটু থেমে বললো,
‘আমরা আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছি।’
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও পদ্ম ভদ্রতার খাতিরে বললো,
‘ঐ যে আমার বাসা। অভি ভাইয়াকে নিয়ে আমার বাসায় চলুন।’
‘অভি তো আসেনি।’
পদ্ম কিছুটা ভাবুক কন্ঠে বললো,
‘তাহলে আমরা বললেন যে?’
আদিদ কিছুক্ষণ চুপ থাকল। মায়ের কথা শুনলে পদ্ম’র রিয়েক্ট কেমন হবে সেটাই ভাবছে সে। অন্যদিকে আদিদকে চুপ থাকতে দেখে এক মিনিটের জন্য পদ্ম’র মনে হলো, আদিদ বিয়ে করে ফেলেনি তো? এখন হয়তো বউকে নিয়ে সে এখানে এসেছে। কথাটা ভাবতেই কেন যেন পদ্ম’র শরীর আষাঢ় হয়ে আসছিল। সে অস্থির হয়ে বললো,
‘কে এসেছে আপনার সাথে?’
আদিদ তার দিকে তাকাল। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,
‘মা।’
পদ্ম তাকিয়ে রইল। আদিদ বললো,
‘মা, আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছেন পদ্ম।’
পদ্ম কোনো জবাব দিল না। মনের অশান্তি টা আরো বেড়ে গেল তার। পদ্ম কে চুপ থাকতে দেখে আদিদ এবার বললো,
‘বাবা মা’রা গিয়েছেন, পদ্ম। আর মা তার কর্মের ফল ভোগ করছেন। মা খুব কষ্টে আছেন। উনি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে চান। আর মা’র এই অনুরোধ আমি ফেলতে পারিনি বলে মা’কে নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি। আশা করছি, আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।’
পদ্ম মাথা নুইয়ে আস্তে করে বলে,
‘উনাকে নিয়ে আমার বাসায় চলুন।’
আদিদ কিছুটা স্বস্তি পেল। বললো,
‘আপনি দাঁড়ান, আমি মা’কে নিয়ে আসছি।’
আদিদ তার গাড়ির দিকে গেল রুবি হোসেনকে আনার জন্য। পদ্ম দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মানুষটা আগের মতোই রয়ে গেছে। এত বছর পরে এসেও সে আদিদের কাছে এখনো আগের মতোই গুরুত্বহীন। পদ্ম’র আজ খুব আফসোস হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেন সে সেদিন আদিদের কাছে নিজের আবেগ প্রকাশ করেছিল? কেন সে নিজেকে শক্ত রাখতে পারেনি? কেনই বা আজও সে একইভাবে আদিদের জন্য কষ্ট পাচ্ছে, কেন..?
আদিদ মা’কে নিয়ে পদ্ম’র মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। রুবি হোসেনকে দেখে পদ্ম যেন চিনতেই পারেনা। কী থেকে কী হয়ে গিয়েছে। কোথায় গেল সেই সৌন্দর্য? মুখের চামড়া আজ ঝুলে গিয়েছে। চুলে পাঁক ধরেছে তার। এই কয়েক বছরের ব্যবধানে কী আমূল পরিবর্তন একটা মানুষের। পদ্ম রুবি হোসেনের চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারে, উনি কতটা কষ্ট আছেন। স্বামী কে হারিয়েছেন, ছেলের কাছ থেকেও এতদিন এতটা দূরে ছিলেন, কম মানসিক যন্ত্রণা পোহাননি উনি। কিন্তু এটাই হয়তো উনার পাপের ফল ছিল।
রুবি হোসেনের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
‘আমাকে ক্ষমা করবে পদ্ম?’
পদ্ম সঙ্গে সঙ্গে বললো,
‘ডাক্তারবাবু উনাকে নিয়ে আমার সাথে চলুন।’
“ডাক্তারবাবু” অনেকদিন পর এই শব্দ টা শুনে আদিদের মনের ভেতরে কেমন যেন একটা শান্তি লাগল। কিন্তু পদ্ম তার নিজের কথা শুনে বিরক্ত হলো। ডাক্তারবাবু বলাটা কি খুব জরুরি ছিল। সে বিরক্ত কন্ঠে আবার বললো,
‘আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।’
আর দুটো বাড়ির সামনেই পদ্ম’র বাসা। পুরোনো একটা বিল্ডিং। রঙ উঠে শ্যাওলা পড়ে আছে। একতলা বিল্ডিং এর পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট। একপাশে বাড়িওয়ালা আর অন্যপাশে পদ্ম’রা থাকে। পদ্ম দরজায় কলিং বেল দিলে রাণী এসে দরজা খুলে। রাণী প্রথমে স্বাভাবিক থাকলেও হঠাৎ পদ্ম’র পেছনে থাকা মানুষটাকে দেখে সে যেন আর স্বাভাবিক থাকতে পারলো না। চেঁচিয়ে উঠল,
‘ডাক্তার সাহেব আপনিইইইইই!’
রাণী রীতিমতো লাফাচ্ছে। পদ্ম রেগে বললো,
‘কী শুরু করেছিস, উনাদের ভেতরে যেতে দে।’
রাণী খুশিতে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে দৌঁড়ে ভেতরে গেল। বিছানা টেনে টুনে ঠিক করলো। সোফা নেই ওদের তাই বিছানাতেই বসতে হবে। পদ্ম তাদের নিয়ে ভেতরে ঢুকল। তার হাতের সবজির ব্যাগ টা এক পাশে রেখে তাদের বললো,
‘আপনারা বসুন, আমি আসছি।’
পদ্ম রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি বসালো।
পদ্ম চলে গিয়েছে, এই সুযোগে রাণী অস্থির কন্ঠে আদিদ কে বলতে লাগল,
‘আপনি কেমন আছেন ডাক্তার সাহেব? আমাকে নিশ্চয়ই আপনি ভুলে গিয়েছেন? আমি কিন্তু আপনাকে ভুলিনি। আপুকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি আপনার কথা কতো বলি। আপনাকে যে আমি কত মিস করেছি তা বলার বাইরে। আচ্ছা, আপনার পাশে উনি কে? আপনার আম্মু?’
রুবি হোসেন তখন হেসে বললেন,
‘কী করে বুঝলে?’
রাণী দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘আপনাদের চেহারা মিলে।’
রুবি হোসেন খুশি হয়ে বললেন,
‘তাই! আচ্ছা মা, একটু পদ্মকে ডাকবে। আমি একটু ওর সাথে কথা বলবো।’
রাণী ছুটে রান্নাঘরে গেল। রাগী গলায় বললো,
‘তুমি এখানে কী করছো, আপু? তোমার শ্বাশুড়ি মা এসেছেন, যাও উনার সাথে গিয়ে কথা বলো।’
পদ্ম চোখ গরম করে রাণীর দিকে তাকাল। রাণী তখন বোকা বোকা হাসি দিয়ে বললো,
‘না মানে, উনি ডাকছেন তোমাকে।’
‘তুই চা’ টা দেখ। আমি যাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে, তুমি যাও।’
পদ্ম সেই রুমে এলো। রুবি হোসেন তখন ছোট্ট একটা ঢোক গিললেন। কীভাবে কী শুরু করবেন কিছুই তিনি বুঝতে পারছেন না। আদিদ মায়ের দিকে তাকাল। তার মা অস্বস্তিতে কিছু বলতে পারছে না সেটা সে বুঝতে পারলো। সে মায়ের হাতে হাত রেখে বললো,
‘মা, কী হলো?’
রুবি হোসেন শুকনো মুখে হেসে বললেন,
‘কিছু না।’
তারপর তিনি পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বললেন,
‘আমাকে ক্ষমা করবে মা? আমি আর এই পাপের ভার কাঁধে নিয়ে চলতে পারছি না। নিজের পাপের জন্য নিজের স্বামীকে হারিয়েছি, ছেলের কাছ থেকে দূরে থেকেছি। এখন আর পারছি না, মা। খুব কষ্ট হয় এখন। শরীর, মন সব এখন দুর্বল হয়ে গিয়েছে, কোনরকমে বেঁচে আছি বলতে পারো। এখন আমার শেষ ইচ্ছে এইটুকুই যে, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। হাত জোড় করে অনুরোধ করছি, প্লীজ মা।’
পদ্ম উনার কাছে এগিয়ে এলো। উনার পায়ের সামনে বসলো। তারপর ধরা গলায় বললো,
‘যখন আপনার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়, তখন আমি ভেবেছিলাম আমি আরেকটা মা পেয়েছি। কোনোদিনও ভাবেনি আপনি আমার সাথে এমন করবেন। একটা ভয়ংকর সময় আমি পার করে এসেছি। এখনো সেই মুহুর্তগুলোর কথা ভাবলে আমার বুক কাঁপে। কষ্ট হয়। কিন্তু আমি পাষাণ হতে পারিনা। কেউ আমার সামনে দু ফোটা চোখের জল ফেললে আমি গলে যাই। তাই আজও পারলাম না। আপনার প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগ নেই। নিজের ভুলের শাস্তি স্বরূপ অনেক কিছু হারিয়েছেন। এখন বাকি সময়টা ছেলেকে নিয়ে খুব ভালো থাকুন, এই দোয়াই করি।’
রুবি হোসেন মাথা নিচু করে পদ্ম’র মাথার উপর চুমু খেলেন। তারপর তিনি মাথা তুলে বলেন,
‘তোমার কাছে আর একটা জিনিস চাইবো মা, দিবে আমায়?’
পদ্ম জিজ্ঞেস করলো,
‘কী?’
রুবি হোসেন দ্বিধা ভরা কন্ঠে বললেন,
‘আমার সাথে আমার বাড়িতে থাকবে?’
মায়ের এমন প্রস্তাবে আদিদও অবাক হলো। পদ্ম উঠে দাঁড়াল। দ্বিমত পোষণ করে বললো,
‘এটা আর কোনোভাবেই সম্ভব না।’
রুবি হোসেন তখন বললেন,
‘তোমাকে আমি এমনি এমনি নিব না। পরিপূর্ণ সম্মান দিয়েই ঐ বাড়িতে নিয়ে যাবো।’
পদ্ম ব্রু কুঁচকে বললো,
‘মানে?’
রুবি হোসেন একবার আদিদের দিকে তাকালেন। আদিদ ও কপালে ভাঁজ ফেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘আমার ছেলের বউ করে তোমাকে আমি ঐ বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই, পদ্ম।’
চলবে…
#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪৬|
পদ্ম তীব্র কন্ঠে বললো,
‘এটা কখনোই সম্ভব না।’
আদিদ অবাক হয়ে তাকাল পদ্ম’র দিকে। সে তো ভেবেছিল, পদ্ম বিনা বাক্যে রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু পদ্ম মুখের উপর বারণ করে দিল!
রুবি হোসেন অসহায় কন্ঠে বললেন,
‘কেন সম্ভব না, মা? আমি জানি, আমার উপর হয়তো তুমি আর বিশ্বাস রাখতে পারছো না, কিন্তু আদিদ, ওর উপর তো তোমার বিশ্বাস আছে তাই না?’
‘আমি বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা বলছি না। আমি..আ..আসলে আমার পক্ষে সম্ভব না।’
‘কী সম্ভব না?’
রাণী চায়ের স্ট্রে টা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললো। পদ্ম কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে আছে। আদিদের ও চোখ মুখ কুঁচকানো। রাণী বুঝতে পারছে না এখানে কী হয়েছে। তাই সে রুবি হোসেনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আন্টি, কী হয়েছে বলুন তো? সবার মুখ এমন বাংলার পাঁচ হয়ে আছে কেন?’
রুবি হোসেন তখন ফিচেল গলায় বললেন,
‘আমি আদিদের সাথে পদ্ম’র বিয়ের কথা ভাবছিলাম। কিন্তু পদ্ম তাতে রাজি হচ্ছে না।’
কথাটা রাণীর বোধগম্য হওয়া মাত্রই সে চেঁচিয়ে উঠল,
‘কী! ডাক্তার সাহেব আর আপুর বিয়ে? এই আপু, তুমি রাজি না এই বিয়েতে?’
পদ্ম কাট কাট গলায় বললো,
‘না।’
রাণী সঙ্গে সঙ্গে রেগে গেল। পদ্ম’র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
‘আপু, তোমার কি মাথা ঠিক আছে? তুমি তোমার ডাক্তারবাবু কে বিয়ে করতে চাও না? কেন?’
পদ্ম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
‘এমনি।’
রাণী আরো বেশি রেগে গেল,
‘কিসের এমনি? তুমি না ডাক্তার সাহেব কে ভালোবাসো? জানেন আন্টি, যেদিন ডাক্তার সাহেব চলে যাচ্ছিলেন সেদিন আপু খুব কেঁদেছিল, খুব। আপু বলেছিল সেদিন, আপু তার ডাক্তারবাবু কে ভালোবাসে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত, আপু তার ডাক্তারবাবুর স্মৃতি আকড়ে ধরেই বেঁচে আছে। আপু ডাক্তার সাহেব কে ভালোবাসে, অনেক বেশি ভালোবাসে। এত ভালোবাসার পরও তুমি কেন এই বিয়েতে রাজি হচ্ছো না আপু?’
পদ্ম ঠাস করে রাণীর গালে চ’ড় মেরে বসলো। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। রাণী গালে হাত দিয়ে বিস্মিত চোখে পদ্ম’র দিকে তাকাল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
‘তুমি আমাকে মারলে আপু?’
পদ্ম তার সমস্ত রাগ এবার উগ্রে দিল। চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
‘কী শুরু করেছিস তোরা? আমাকে কেন বাঁচতে দিচ্ছিস না? আমার জীবন, আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে দে। অন্যের সামনে আমাকে ছোট করতে ভালোলাগে তাই না? আমি আর পারছি না। সেই শুরু থেকেই আমার সাথে সবাই এমন করছে। আমার মামা মামী টাকার লোভে আমাকে এই মানুষটার হাতে তুলে দিয়েছিল। তারপর এই মানুষটা আমার জীবনটাকে একেবারে শেষ করে দিয়েছিল। জানিস, আমি একটা অসহায় মেয়ে ছিলাম, যাকে সবাই যার যার প্রয়োজনে ব্যবহার করতো কেবল। কেউ কেউ দয়া দেখাতো। কিন্তু, কখনো কেউ ভালোবাসেনি। সবসময়ই সবাই কেবল দয়া দেখিয়েছে। আর সেই রকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও আমার মনে আবেগ এসেছিল.. এই ডাক্তারবাবুর প্রতি। বলেও ছিলাম উনাকে। কিন্তু, কোথায় উনি আর কোথায় আমি! ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের মধ্যকার পার্থক্য টা। কিন্তু, ডাক্তারবাবুর মনে ছিল, উনি গুরুত্ব দিলেন না আমায়..চলে গেলেন। তারপর আর কোনো খোঁজ নেননি। কিন্তু, আমি কি তার শোকে বেঁচে থাকতে ভুলে গিয়েছিলাম? ভুলিনি তো। এই যে বেঁচে আছি। সুন্দর ভাবে বেঁচে আছি। এখন আর আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। যখন আমার ভালোবাসার প্রয়োজন ছিল, তখন আমি সবার কাছ থেকে শুধু ধোঁকা পেয়েছি। আর এখন যখন আমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই, তখন উনি আবার আমার জীবনে কেন আসতে চাইছেন? আমি নিজেকে আর দুর্বল করতে পারবো না। উনাদের চলে যেতে বল….প্লিজ।’
পদ্ম আর ঐ রুমে দাঁড়াতে পারলো না। সে অন্য রুমে চলে গেল। পদ্ম চলে যাওয়ার পর রাণী তার গাল থেকে হাত সরালো। বিরক্ত হয়ে বললো,
‘ঢং দেখলে বাঁচি না। ওর কথা কিছু বিশ্বাস করবেন না তো, ডাক্তার সাহেব। ও সব মিথ্যা বলছে। ও এখনও আপনাকে আগের মতোই ভালোবাসে। আসলে মেয়ে মানুষ তো, তাই হয়তো অভিমান জমেছে। সেই অভিমান কিন্তু আপনাকেই ভাঙাতে হবে, ডাক্তার সাহেব।’
আদিদ অনেকক্ষণ পর এবার গলা ঝারল। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘রাণী, তুমি অনেক কিছুই জানো না। পদ্ম’র জীবন সহজ ছিল না। অল্প বয়সে তাকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। ওর সাথে আমার পরিচয়টা ক্ষণিকের। আমাদের সম্পর্ক টা ওরকম ছিল না যে, আমাদের মধ্যে কখনো মান অভিমান হবে। কোনোকিছুই তখন স্বাভাবিক ছিল না। একের পর এক অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটেই যাচ্ছিল। ও যেমন ভেঙে পড়েছিল, তেমন ভেঙে পড়েছিলাম আমিও। ঐ সময়টা আমাদের দু জনের জন্যই খুব কঠিন ছিল। তাও আজ আমরা দু জন নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি। পদ্ম আজ অনেক বড়ো হয়েছে, অনেক স্ট্রং হয়েছে। কিন্তু সেদিন যদি আমি না যেতাম তাহলে ও এতটা স্ট্রং হতে পারতো না। ও নিজের আবেগের কাছে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। আর সে সময় আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি মানসিক ভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। সুজা…(বলতে গিয়েও থেমে গেল, তারপর বললো) পদ্ম’র জীবনে এখন আর কাউকে প্রয়োজন নেই। ও হয়তো একাই ভালো থাকতে পারবে। ও যেমনটা চায়, তেমনটাই হোক। আর আমিও তাই চাই।’
রাণী মুখ কালো করে বললো,
‘কিন্তু ডাক্তার সাহেব, আপনি আপুর জীবনে না এলে অন্য কেউ চলে আসবে তো।’
‘পদ্ম যদি চান, অন্য কাউকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতেই পারেন, এটা উনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
রাণী বিরক্ত হয়ে বসলো। দূর সে তো কিছুই ঠিক করতে পারছে না। কিন্তু এভাবে চুপ করে তো বসেও থাকা যায় না। কিছু তো একটা করতেই হবে। মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে রাণী বুদ্ধি বের করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর সে বললো,
‘জানেন তো, অনিক নামের একটা ছেলে আপু কে প্রচন্ড ভালোবাসে। আর আপুও হয়তো ঐ ছেলেটাকে একটু একটু পছন্দ করে। তাই বোধ হয় ও এখন আর আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে না।’
দু ব্রু’র মাঝখানে অল্প খানিক ভাজ ফেলে আদিদ বললো,
‘অনিক কে?’
‘আপু যে পাঠশালায় বাচ্চাদের পড়ায় ওখানকার স্যার। আপুকে সেদিন আমার সামনে প্রপোস করেছিল। আর আপু তো লজ্জায় পুরো লাল হয়ে যাচ্ছিল। আমার কী মনে হয় বলুন তো, আপু বোধ হয় ঐ অনিকের প্রপোস টা একসেপ্ট করে ফেলবে।’
আদিদ নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
‘করতেই পারে। এটা সম্পূর্ণ উনার ব্যাপার। আর অবশ্যই আপনার আপুকে বলে দিবেন, বিয়ের দাওয়াত টা যেন দেয়।(তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে) মা, চলো।’
মা’কে বলেই আদিদ বেড়িয়ে গেল। রাণী মনে মনে খুশি হলো। যতই উপর দিয়ে স্বাভাবিক থাকুক না কেন, ভেতর দিয়ে যে সে একটু হলেও জ্বলছে সেটা রাণী ঠিকই আন্দাজ করতে পারল।
রুবি হোসেন একরাশ হতাশা নিয়ে দরজার কাছে যান। রাণী তখন তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আন্টি, আপনি আমার উপর ভরসা রাখুন। আপনার ছেলের বউ পদ্মই হবে।’
রুবি হোসেন জবাবে আলতো হাসলেন। তারপর তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন।
বাড়িতে ফিরে গিয়ে আদিদ মায়ের সাথে খুব রাগ দেখাল। তার ইগোতে আজ খুব লেগেছে। পদ্ম ইচ্ছে করে এমন করেছে, সেদিনের শোধ তুলতে। পদ্ম’র যদি তাকে প্রয়োজন না হয়, তার তো আরো আগে পদ্ম কে প্রয়োজন নেই। কিন্তু পদ্ম এভাবে রিয়েক্ট করতে পারেনা। তারা চলে আসার সময়ও একটা বার এলো না। এত কিসের রাগ ওর? আদিদ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মা’কে বললো,
‘কিসের ভিত্তিতে সেখানে গিয়ে তুমি বিয়ের কথা তুলে দিয়েছ, মা? বললেই কি বিয়ে হয়ে যায় নাকি? তুমি জানো না আমার মনের অবস্থা? তুমি জানো না আমি সুজানা কে ভালোবাসি, যাকে তোমরা…’
রুবি হোসেন টলমল চোখে আদিদের দিকে তাকাতেই সে থেমে যায়। আর বলতে পারে না কিছু। এসব আর ভাবতে চায় না সে, তবুও ভুলতে পারছে না। সুজানাকে ভুলা সম্ভব না। আর তাকে ভুলতে না পারলে তার খু*নিদের ও সে ভুলতে পারবে না। আদিদ উঠে নিজের রুমে চলে যায়। রুবি হোসেন তখন বসে বসে কাঁদেন, আর মনে মনে ভাবেন, কেন যে সেদিন তারা সুজানাকে মেরেছিল। সেই তো তাদের কৃতকর্মের ফল আজ সবাই জানল। না হয় সুজানা সেটা আগেই জানিয়ে দিত সবাইকে। তাও তো আজ ছেলেটা সুজানাকে নিয়ে একটু ভালো থাকতে পারতো। তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। ছেলের এত কষ্ট সব তার জন্য। আর এর জন্য হয়তো উনার ছেলে উনাকে কখনোই ক্ষমা করবে না..
.
পদ্ম রুমে দোর দিয়ে বসে আছে। রাণী সেসবে পাত্তা দিচ্ছে না। সে তার বাটন মোবাইল টা দিয়ে অভি কে কল করলো। অভি কল রিসিভ করতেই রাণী খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
‘জানো অভি ভাই, আজ আমাদের বাসায় ডাক্তার সাহেব এসেছিলেন।’
অভি ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
‘নিশ্চয়ই খুব জ্বালিয়েছিস ওকে?’
‘আরে না, একদমই জ্বালাইনি। তবে এখানে এক অন্য ঘটনা ঘটেছে। জানো তো, এখানে ডাক্তার সাহেব আর পদ্ম আপুর বিয়ের কথা উঠেছিল।’
‘কী!’
অভি চেঁচিয়ে উঠল। তার কাছে কথাটা বিশ্বাস যোগ্য মনে হলো না। রাণী বাধ্য হয়ে অভিকে প্রথম থেকে সবকিছু বললো। আর সবকিছু শুনে অভি হতভম্ব। তার কাছে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। মানে ব্যাপার টা কেমন না, অনিক পদ্ম কে ভালোবাসে, পদ্ম ভালোবাসে আদিদ কে আর আদিদ আবার গিয়ে ভালোবাসে সুজানা কে…. আশ্চর্য তো!
চলবে..
আশ্চর্য না..?