পরিণয় পর্ব-০৯

0
1643

#পরিণয়
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৯

কারণ পল্লবী খেয়াল করল আনায়নার কপালে ব্যান্ডেজ করা। আনায়নার মুখটা শুকিয়ে আছে। বুঝায় যাচ্ছে তেমন যত্ন পায়নি মেয়েটা। পল্লবী আনায়নার অবস্থা দেখে দৌঁড়ে গিয়ে আনায়নাকে কোলে নিয়ে পল্লবী তার শ্বাশুড়িকে বলল

– আমার মেয়ের কপালে ব্যান্ডেজ কেন? তার মানে গতকালকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেছিল? এতটুকু বাচ্চাটাকে এত কষ্ট দিতে অন্তর কাঁপেনি? আমার মেয়েকে আমি কোথাও দেবো না। আমার কলিজাটাকে আমার কাছেই রেখে দেবো।

পল্লবীর শ্বাশুড়ি পরক্ষণেই হুংকার দিয়ে বলল

– তোমার মেয়েকে দেখার জন্য শুধু আধাঘন্টা সময় দেওয়া হয়েছে। এরপর আমার নাতিনী আমার কাছে নিয়ে যাব। ছেলে মেয়ে বড় করতে গেলে একটু আধটু ব্যথা পায়। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তোমার মাকে জিজ্ঞেস করো তুমি ছোট বেলায় কোনো ব্যথা ছাড়া বড় হয়ে গেছ কিনা।

– ব্যথা পায় সেটা আমিও জানি। তবে যত্নের অভাবে আর অবহেলায় ব্যথা পেলে আমি কখনও মেনে নিব না। আনায়না ব্যথা পেয়েছে আপনার সাবধানতার অভাবে। এটুকু মেয়েকে কী কেউ একা রুমে ঘুম পাড়িয়ে রেখে যায়? আজকে তো এর থেকে বড় কাহিনিও হতে পারত। আনায়না যদি কোনো সুইচে হাত দিয়ে বসত তখন কী হত? আমার মেয়েটাকে দয়াকরে একটু সাবধানে রাখবেন। আল্লাহ চাই তো আমি আমার মেয়েকে আমার কোলে আবার ফিরিয়ে আনব।

বলেই পল্লবী আনায়নাকে বুকে জড়িয়ে আদর করতে লাগল।আনায়না পল্লবীর স্পর্শ পেয়ে একদম পল্লবীর বুকে মিশে রয়েছে। একেই হয়তো বলে নাড়ির টান। কিছুক্ষণ পর পল্লবীর শ্বাশুড়ি আনায়নাকে পল্লবীর কোল থেকে টেনে নিয়ে বলল

– আধা ঘন্টা হয়ে গেছে। আমার নাতিনীকে দাও এবার আমার কাছে।

বলেই টানতে টানতে পল্লবীর কোল থেকে আনায়নাকে নিয়ে গেল। আনায়নাও মায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগল আর পল্লবী অজোরে নিজের চোখের জল ফেলতে লাগল। ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় আজকে মা আর মেয়ে দুদিকে। আনায়নার কান্না উপেক্ষা করে পল্লবীর শ্বাশুড়ি আনায়নাকে নিয়ে চলে গেল। আর পল্লবী কাঁদতে কাঁদতে দাঁড়ানো থেকে মেঝেতেই বসে পড়ল।এডভোকেট জান্নাত জেসি পল্লবীর পিঠে হাত দিয়ে বলল

– কাঁদবেন না দয়াকরে। নিজেকে শক্ত করুন। আর আমি চেষ্টা করব এক মাসের মধ্যে আপনার আনায়নাকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিতে। যত কষ্টই হোক আমার। আর যা করা লাগে করব। আপনি নিজেকে শক্ত করে বাসায় যান।

এডভোকেট জান্নাত জেসির কথা শোনে পল্লবী মেঝে থেকে চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল। এডভোকেট জান্নাত জেসিকে জড়িয়ে ধরে বলল

– আপনার এ ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না।

এডভোকেট জান্নাত জেসি পল্লবীর পিঠে হাত রেখে বলল

– আমি একজন মা। আমি একটা মায়ের কষ্ট বুঝি। আপনার নিজেকে শক্ত রাখা উচিত কারণ সকল বাঁধা পার হতে হলে নিজেকে শক্ত করতে হবে।

পল্লবী চোখের পানিটা মুছে এডভোকেট জান্নাত জেসির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় আসলো। বাসায় এসে বসে বসে আনায়নার কথা ভাবতে লাগল। আনায়নার মুখটা পল্লবীর চোখে ভেসে আসছে আর পল্লবীর বুকটা ফেটে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি পড়তে লাগল। এমন সময় পল্লবীর মনে হলো কেউ একজন তার পিঠে হাত দিয়েছে। পল্লবী পেছন ফিরতেই খেয়াল করল নিরা পল্লবীর পাশে বসে আছে। পল্লবী কিছুটা অবাক হলো নিরাকে এ সময় এভাবে দেখে। পল্লবী লক্ষ্য করল নিরার মুখটা বেশ বিষন্ন হয়ে আছে। পল্লবী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল

– ভাবী আপনি এখানে এসময়?

নিরা পল্লবীর কথা শোনে চোখের কোণে হালকা পানি এনে বলল

– ঐদিন তোমার কষ্ট না বুঝলেও আজকে তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি বোন। সন্তান না পাওয়ার যন্ত্রণা যে কতটা গভীর আজকে অনুভব করতে পারছি। আনায়নাকে নিয়ে ঐদিন তোমাকে এসব বলা ঠিক হয়নি। আনায়নাকে আনার ব্যবস্থা করো যা করা লাগে আমি করব।

পল্লবী নিরার কথা শোনে আরও বিস্মিত হলো। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে নিরার দিকে তাকিয়ে বলল

– কেন কী হয়েছে ভাবী? এসব বলতেছেন কেন হুট করে?

নিরার চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা বৃষ্টি ফোঁটার মতো পড়তে লাগল। হালকা গলায় বলল

– আজকে ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। লাস্ট কয়েক মাস যাবত বাচ্চা নেওয়ার অনেক চেষ্টা করলাম।আজকে ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তার বলল আমার যে সমস্যা তাতে আমার কোনোদিনও বাচ্চা হবে না। কথাটা শোনার পর একটা শূন্যতা অনুভব করেছি। বাসায় এসে খুব মন খারাপ লাগল। তখন মায়ের কাছে জানলাম তুমি আনায়নাকে দেখতে গেছ। তখন তোমার কষ্টটা আমি অনুভব করতে পেরেছি। আমি না বুঝে এমন করেছি আমাকে ক্ষমা করে দিও।

বলেই নিরা কাঁদতে লাগল। পল্লবী নিরার কান্না দেখে নিরাকে ধরে বলল

– বাচ্চা আল্লাহর দান।কষ্ট পাবেন না।যা হয় ভালোর জন্য।

নিরা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল

– শোনেছি তুমি নাকি আবার কনসিভ করেছ। কথাটা কী ঠিক?

– হ্যাঁ।

– শোনো আজ থেকে তোমার সব কাজ আমি করব।তুমি একদম রেস্টে থাকবে। তোমার সন্তান আমার সন্তানের মতোই। আর আনায়নাকে আনার জন্য যা করা লাগে করব। চাকুরি আর খুঁজতে হবে না।আমি সব দেখাশোনা করব। তোমার দুই সন্তানের দায়িত্ব আমি নেব।

পল্লবী হালকা একটা দম ছেড়ে বলল

– আমার সন্তানকে আপনি আদর করেন কোলে নেন তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আমার সন্তানের খরচ আমিই চালাব। আমি কারও কাছ থেকে কিছু নিব না।আমার সন্তান আমার টাকায় বাঁচবে। কারও দয়ায় না। ভাবী আপনি কষ্ট পাবেন না। আমার অবস্থানে থাকলে বুঝতেন আমি কেন এসব বলছি।

নিরা পল্লবীর কথা শোনে হালকা হেসে বলল

– তোমার যা ভালো মনে হয় করো। তুমি চাকুরি করবে আমি তোমার সন্তানকে বাসায় দেখাশোনা করব চিন্তা করো না। আর আস্তে ধীরে চাকুরি খুঁজো।

বলেই নিরা রুম থেকে বের হয়ে গেল। পল্লবী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবতে লাগল আল্লাহ কত তাড়াতাড়ি নিরাকে বুঝিয়ে দিয়েছে তার ভুলটা।হয়তো সাহিল ও একদিন বুঝবে। যারা ওর সাথে অন্যায় করেছে সবাই বুঝবে। এটা ভেবেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। তারপর আবার চাকুরির ইন্টারভিউ এর জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল।

একের পর এক চাকুরির দরখাস্ত দিতে লাগল আর একের পর এক ইন্টারভিউ দিতে লাগল। প্রতিটা জায়গায় তাকে ডিভোর্সের জন্য কথার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রতিটা জায়গায় বিভিন্ন ভাবে তাকে অপমান করা হচ্ছে। টানা একমাস চাকুরির জন্য ঘুরতে ঘুরতে পল্লবী পাগলপ্রায়। এ দেশে চাকুরির বাজার যে কতটা ভয়ানক পল্লবীর বুঝতে বাকি রইল না। পল্লবী এবার নিরাশ হয়ে গেল। একদিকে আনায়না অন্যদিকে অনাগত সন্তান। সে সাথে এতকিছুর পর কারও দয়ায় বাঁচতে ইচ্ছা করছে না পল্লবীর। এদিকে একটা চাকুরিও জুটছে না। কী করবে কিছুই যেন তার মাথায় আসছে না। সবকিছু তার এলোমেলো লাগছে।
নিরাশ হয়ে অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। সে ভাবল –