#পরিণয়
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৩
ওপাশ থেকে মুচকি হেসে সাদেক সাহেব বলল,
– আপনাকে আমি চাকুরিটা দেবো তবে ঐ পোস্টে না। কারণ আপনার শারীরিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমার মনে হলো আপনার জন্য ঐ পোস্ট টা গ্রহণযোগ্য হবে না। আর মাতৃকালীন সময়ে ছুটি দেওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই ঐ ছুটিটা পুরোটা আপনাকে দেবো। তাই বর্তমান পোস্টে চাকুরি দেবো না তবে অন্য একটা পোস্ট খালি আছে যেখানে আপনি অনায়াসে ডেস্কে বসে কাজ করতে পারবেন। আপনার কাজ আমার ফাইলগুলো চেক করা।এজন্য আমার একজন বিশ্বস্ত কাউকে দরকার ছিল । আমার কাছে মনে হয়েছে বিশ্বাসের জায়গায় আপনি যেহেতু ঠকেছেন সুতরাং আর কাউকে ঠকাবেন না। কারণ ঠকানোর কষ্ট সেটা যে ঠকে সে ভালো উপলব্ধি করতে পারে। আমার মতে যারা ঠকে তারা ঠকাতে পারে না। এজন্য আমি ভেবে চিন্তায় আপনাকে ঐ পোস্টে চাকুরি দিয়েছি। এখন শর্ত এটাই যে আপনাকে চাকুরি করতে হলে ঐ পোস্টেই চাকুরি করতে হবে। এখন এ শর্ত মেনে নেবেন কী না সেটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যপার।
পল্লবী সাদেক সাহেবের কথা শুনে নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশ্বাসের জায়গাটা যেন আরও শক্ত হলো। অনুভূতির জায়গাটাও সতেজ হলো। চোখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে অশ্রু ফোঁটা পড়ছে। তবে এ অশ্রু ফোঁটা টা পড়ছে অসীম আনন্দ প্রকাশের তাড়নায়।পল্লবীর গলাটা ক্রমশ আনন্দে ভার হয়ে যেতে লাগল।কী বলবে বা কীভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে এটা যেন তার মাথায় কাজ করছে না। নিজেকে সামলাতে চাইলেও যেন ব্যর্থ হচ্ছে। মিনেট দুয়েক একদম স্থির হয়ে পড়েছিল। সাদেক সাহেব পল্লবীর নীরবতা দেখে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। ভাবতে লাগল এমন প্রস্তাব দেওয়াতে পল্লবী কী বিষয়টা নেতিবাচক হিসেবে নিয়ে ফেলেছে? সাদেক সাহেবের বোধগম্য হচ্ছে না পল্লবী নীরব কেন? পল্লবীর নীরবতা দেখে উনি হালকা গলায় বলল
– আপনি কী আমার শর্তে রাজি না? চুপ হয়ে থাকলে তো আমি কিছুই বুঝতে পারব না।আপনাকে তো একটা উত্তর দিতে হবে।
পল্লবী নিজেকে সামলে নিয়ে সাদেক সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে বলল
– আমি রাজি। আপনার এত উত্তম প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। অনেকদিন পর মনে হচ্ছে কোনো ভালো সংবাদ আর আশার আলো পেয়েছি তাই খুশিতে স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম।আপনাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার নেই।
– ওহ আচ্ছা তাই বলুন।আপনার নীরবতা দেখে আমি একটু বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। তা কবে থেকে জয়েন করবেন বলুন।
পল্লবী হালকা হেসে বলল
– কাল থেকেই স্যার।
– আচ্ছা ঠিক আছে। Best wishes for you.
– ধন্যবাদ স্যার।
– ওয়েলকাম।
বলেই কলটা কাটলেন সাদেক সাহেব।কলটা কেটে আনমনা হয়ে গেলেন। কেমন জানি অদ্ভূত অনুভূতি জাগছে তার মনে। একটা অস্থির অস্থির ভাব হচ্ছে তার। আবার অস্থিরতাটাকে কোনো শীতল ছোয়া গ্রাস করে সেটা শীতল করে দিচ্ছে। এমন কেন হচ্ছে সেটা সাদেক সাহেবের অজানা। রকিং চেয়ারে শুয়ে দোল খাচ্ছে। চোখ বন্ধ করতেই পল্লবীর মুখ অবয়বটা বারবার ভেসে আসছে। পল্লবীর মুখ অবয়বটা দেখে পরক্ষণেই চোখ খুলে ফেলছে। চোখ বন্ধ খোলার অদ্ভূত খেয়াল মেতে উঠেছে সাদেক সাহেব।
এদিকে পল্লবীর খুশিতে চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।এ মুহুর্তে নিরা আনায়নাকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকে পল্লবীকে কাঁদতে দেখে বলল
– কী ব্যাপার পল্লবী কাঁদতেছ কেন? নতুন করে কী কিছু হয়েছে? নাকি তোমার শরীর খারাপ? হুট করে কাঁদতেছ কেন?
পল্লবী চোখের জল মুছে হালকা হেসে বলল
– ভাবী এটা তো স্বস্তির কান্না। আমার একটা চাকুরি হয়েছে ঐ গার্মেন্টসে। উচ্চ পদে চাকুরি তার উপর বেতন ভালো। অনেকটা কষ্টের মধ্যে একটু স্বস্তি পেলাম। তাই সেই খুশিতে কাঁদছি।
নিরা পল্লবীর মুখে কথাটা শুনেই হা হয়ে নুরজাহান বেগমকে ডাকতে ডাকতে বলল
– মা শুনে যান।
নিরার এমন ডাক শুনে নুরজাহান বেগম দৌঁড়ে আসলো।ভাবল কী না কী হয়েছে। এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
– কী ব্যপার নিরা এভাবে ডাকছো কেন? কী হয়েছে?
নিরা প্রশস্ত একটা হাসি দিয়ে আনায়নাকে বুকের সাথে মিশিয়ে বলল
– পল্লবীর ঐ গার্মেন্টসে উচ্চ পদে চাকুরি হয়েছে আর বেতনও অনেক ভালো।
নুরজাহান বেগম নিরার মুখে কথাটা শুনে খুশিতে কান্না করে দিয়ে পল্লবীর পাশে বসে পল্লবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
– আস্তে আস্তে তোর জীবনের অন্ধকার এভাবে ঘুচে যাবে। দেখবি তুই অনেক ভালো একটা অবস্থানে চলে যাবি।
পল্লবী নুরজাহান বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল
– মা দোআ করো।
– সে কী তোকে বলতে হবে রে মা।
এর মধ্যেই কলিং বেল এর আওয়াজ আসলো। নিরা আনায়নাকে কোলে নিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখল আতিক এসেছে। আতিক কে দেখেই নিরা হাসির রেখা টেনে বলল
– পল্লবীর নতুন একটা চাকুরি হয়েছে।
নিরার মুখে এমন কথা শুনে আতিক তাড়াহুড়ো করে পল্লবীর রুমের দিকে এগুতে লাগল আর বলতে লাগল
– কী রে পল্লবী নিরা যা বলেছে তা কী সত্যি নাকি?
পল্লবী আতিকের গলা শুনে শোবার রুম থেকে বের হয়ে আতিকের কাছে এসে বলল
– হ্যাঁ ভাইয়া ভাবী যা বলেছে ঠিক বলেছে।
– আল্লাহ তোর ভালো করুক। পেটের বাচ্চাটার যত্ন নিস। ভালো মন্দ খাওয়া দাওয়া করিস।
সবার কাছে এত ভালোবাসা পেয়ে পল্লবীর চোখে জল ছলছল করছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মাথা নেড়ে ছলছল চোখ নিয়ে রুমের দিকে গেল। এদিকে নুরজহান বেগম আতিক কে জিজ্ঞেস করল
– যা হাত মুখ ধুয়ে আয়। খেতে বসবি।
তারপর নিরার দিকে তাকিয়ে বলল
– আনায়না তো ঘুমিয়ে গেছে ওকে শুইয়ে দাও। তুমিও কিছু খেয়ে নাও। সারাদিন তো আনায়নাকে নিয়েই পড়ে থাকো।কয়েকদিন পর পল্লবীর আরেকটা হলে তো ওদের নিয়ে পড়ে থেকে খাওয়ার সময় ভুলে যাবে। শুধু ওদের নিয়ে থাকলেই তো হবে না তোমার। নিজেরও যত্ন নিতে হবে।আনায়নাকে শুইয়ে দিয়ে আতিক আর তুমি একসাথে খেতে বসো।
নিরা নুরজাহান বেগমের কথা শুনে আনায়নাকে পল্লবীর কাছে শুইয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হতে নিল এমন সময় পল্লবী নিরার হাতটা টেনে বলল
– ভাবী আপনার এ ভালোবাসার ঋণ আনায়না কখনও দিতে পারবে না। আমার পাশাপাশি যে আপনিও আনায়নার মা হয়ে গেছেন। আমার জীবনটা যে এভাবে পাল্টে যাবে আস্তে আস্তে বুঝি নি। ভালো মুহূর্তগুলো নাকি বেশিদিন থাকে না। তাই বেশি ভয় লাগে যখন ভালো থাকি। শুধু মনে হয় এ বুঝি কষ্টটা চলে আসছে।
নিরা হালকা হেসে বলল
– তুমি তোমার কষ্টের প্রতিদান পাচ্ছ।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো অবশ্যই এ ভালো সময় কখনও ফুরাবে না। ঘুমিয়ে যাও কালকে তো নতুন চাকুরিতে জয়েন করবে।তোমার ঘুমের প্রয়োজন।
পল্লবী মুখে হাসির রেখা টেনে মথা নেড়ে শুইয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে উঠেই হালকা নাস্তা করে আনায়নাকে খাইয়ে দিয়ে তৈরী হতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এর মধ্যেই নিরা একটা নীল শাড়ি এনে বলল
– পল্লবী আমার এ শাড়িটা পড়ে যাও সুন্দর লাগবে।নতুন চাকুরি একটু সুন্দর করে গুছিয়ে যাও।
পল্লবী নিরার হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে নিরাকে বলল
– এত চকচকা শাড়ি পরব?
– কেন তাতে কী হয়েছে? তুমি কী বুড়ি হয়ে গেছ নাকি?
– বুড়ি হব কেন? তবুও।
– এত সংকোচ করতে হবে না। পরে যাও সুন্দর লাগবে।
নিরার জোরাজোরিতে পল্লবী আর না করতে পারল না। শাড়িটা পরে নিরা আর নুরজাহান বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো পল্লবী। রাস্তায় একটু হেঁটে সামনে যেতেই এক মহিলা বলে উঠল
– আরে পল্লবী না? কেমন আছো?
পল্লবী ডাকে সাড়া দিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল পাশের বাসার রাহিমা বেগম। পল্লবী রাহিমা বেহমের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল
– হ্যাঁ আন্টি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
রাহিমা বেগম মুখটা বাঁকিয়ে বলল
– আমি তো ভালোই আছি। তোমার না কয়েকদিন আগে ডিভোর্স হয়েছে।
পল্লবী হালকা গলায় বলল
– হ্যাঁ।
রাহিমা বেগম মুখটা হা করে এক গালে হাত দিয়ে বলে উঠল
– তবুও কীভাবে এত চকচকা শাড়ি পরে বের হয়েছ। বলি মনে এত সুখ তোমার। পেটে একটা নিয়ে ঘুরছ জামাই ছেড়ে দিয়েছে এখনও এত আনন্দ কোথায় পাও যে এত সাজগোজ করার।
পল্লবী রাহিমা বেগমের কথা শোনে হালকা হেসে বলল
– কেন আন্টি ডিভোর্সিদের জন্য কী আলাদা শাড়ি বানানো হয়েছে? আপনি জানলে একটু বলেন তো। আমি তো জানতাম না।
রাহিমা বেগম পল্লবীর কথা শুনে মুখটা বাঁকিয়ে বলল
– তোমাদের কিছু বলতে গেলেও তোমরা বাপু ফুস করে উঠো। তোমাদের সাথে কথা বলাটাই বৃথা।
– হ্যাঁ আন্টি শুধু শুধু সময় নষ্ট করতে হবে না। এবার যেতে পারেন।
রাহিমা বেগম কপালটা কুঁচকে সামনের দিকে এগুতে লাগল। পল্লবীও সামনের দিকে এগুতে লাগল। আর ভাবতে লাগল একটা মেয়েকে অসুস্থ বানাতে এ সমাজের এরকম মানুষেই যথেষ্ট। এসব মানুষের মতে একটা মেয়ের ডিভোর্স হলে সে মেয়েকে হয় কালো পোশাক পরে না হয় সাদা পোশাক পরে শোক পালন করতে হবে। কী অদ্ভুত চিন্তা ধারা এসব মানুষের মনে। এসব ভাবতে ভাবতেই গার্মেন্টসে পৌঁছাল পল্লবী।
পল্লবী গার্মেন্টসে ঢুকেই লক্ষ্য করল সাদেক সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। সাদেক সাহেব এবার পল্লবীর দিকে তাকাল। তারপর-