পরিবর্তন পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
324

# পরিবর্তন : শেষ পর্ব #

হুশ ফিরলো ফাল্গুনীর — চোখ মেলে তাকিয়ে প্রথমে কিছুই মনে পড়লো না তারপরই বিদ‍্যুতের শক লাগার মত সমস্ত শরীর তার কেঁপে উঠলো — নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে….. বাটার দোকানের সামনের ফুটপাতে সে বসে আছে, যেমনটা সেই বৃদ্ধা প্রখর রোদে বসে বা কখনো শুয়ে থাকতো।
তার পরনে জরাজীর্ণ ময়লা কাপড়, উস্কখুস্ক চুল, জরার ছাপ হাতে – মুখে…. কোথায় সেই মসৃণ তেলতেলে দামী লোশন মাখা নরম শরীর, তার বদলে কুঁচকানো শুকনো খরখরে চামড়া, কতদিনের গোসল না করা শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসছে….. না না একি!! এই অবিশ্বাস্য রূপান্তর কেমন করে হলো!!! কেন কেন?
সে তো নিজের বিলাসবহুল ঘরে সুস্বাদু খাবার খেয়ে আরাম করে সুখ স্বপ্নে বিভোর ছিলো…. তাহলে!!!!
এই হতদরিদ্র বিগতযৌবনা মহিলাটি ফাল্গুনী, রাজরানী ফাল্গুনী?…. হাউমাউ করে কেঁদে উঠে চিৎকার করে বলতে লাগলো ফাল্গুনী — আমি না, আমি না,এটা আমি না…. আমার কত সম্পদ, কত অফুরন্ত আরাম বিলাস, আমি এই রাস্তায় বসে থাকবো কেন? ভুল হচ্ছে, নিদারুণ ভুল, এই কাছেই আমার প্রাসাদের মত বাড়ি, আমি কেন ফকির কাঙ্গাল হতে যাবো?
আশ্চর্য বিষয় হলো…. তার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হলো না, অব‍্যক্ত গোঙানীর মত শুধু দুর্বোধ‍্য শব্দ হতে লাগলো…. চলমান লোকজন দেখলো ভিখারীটি বসে দুই হাত পেতে কাঁদছে, কেউ দয়া করে পাঁচ দশ টাকা ফেলে দিলো ওর হাতে, একজন দিলো পঞ্চাশ টাকার একটা নোট, সম্ভবত যাকাতের টাকা… নইলে এত টাকা কেউ ভিক্ষা দেয় নাকি!
ফাল্গুনী কেঁদেই চললো — ভর দুপুরের গনগনে রোদে নির্জীবের মত বসেই থাকলো, কাঁদার শক্তি নেই আর —- কে যেন পলিথিনে মোড়ানো কিছু খাবার আর ছোট এক বোতল ঠান্ডা পানি ওর সামনে রেখে দিলো।
নিয়তিকে এড়ানোর ক্ষমতা ভিখারী ফাল্গুনীর নেই
এক এক করে মনে পড়তে লাগলো এই সব অসহায় বঞ্চিতদের প্রতি তার বিবেকহীন আচরণ, অবজ্ঞা, ঘৃণা। বুকের মধ্যে কষ্টের অনুভূতি তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে লাগলো যে এরাও মানুষ, এদেরও ভালো ভাবে বাঁচার অধিকার আছে…. এরা সব সেই স্রষ্টার সৃষ্টি — যিনি তৈরী করেছেন ফাল্গুনীকেও…. কোন স্পর্ধায় এদেরকে সে ছোট করে দেখেছিলো….. অবাক বিষয় হলো এই যে, দেহ বদলে গেলেও ফাল্গুনীর চিন্তা ধারা মন মানসিকতা ওরই রয়ে গেছে তাই ওদের কষ্টের, অবহেলিত জীবনের যন্ত্রণা ফাল্গুনী স্পষ্ট নিজের মধ্যে উপলদ্ধি করতে পারলো এবং এই অনুভূতি তার অন্তরে মিশে অবর্ণনীয় বেদনায় সর্ব শরীর আচ্ছন্ন করে ফেললো।
ক্ষুধার্ত ফাল্গুনী এক সময় অজান্তেই হাত বাড়ালো পলিথিনে মোড়ানো খাবারের দিকে, তার আগে পানিটা পান করলো অসীম আগ্রহ নিয়ে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে ছিলো…. হরেকরকম জুস, ফিল্টার করা সুদৃশ্য ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পান করে যে অভ‍্যস্ত, দামী কাঁচের থালা বাসন ছাড়া যে খায়নি —- ভুলে গেলো সে ফাল্গুনী, আজ রাস্তায় বিছানো পলিথিনে রাখা সামান্য খাবার ও অখ‍্যাত বোতলের পানি খুব তৃপ্তি করে খেলো…. মনে হলো জীবনেও সে এত সুস্বাদু খাদ্য পানীয় খায়নি। দরিদ্র নিঃস্ব এই ভিখারীর সাথে ধনী অহংকারী ফাল্গুনী মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
খেয়ে মুখ তুলতেই দেখতে পেলো সে ময়না হাসিমুখে আর একজন বুয়ার সাথে কথা বলতে বলতে আসছে…. পরিষ্কার শুনতে পেলো ফাল্গুনী, ময়না বলছে — ম‍্যাডাম আমারে বেতন যাকাত তো দিছেই, আরো পাঁচশো ট‍্যাকা বেশী দিছে, দ‍্যাশ থেইকা সবাই আইছে, ঈদের দিন পুলাউ, মুরগির মাংস রান্ধুম।
— কাপড় কিনিস নাই তাগো লাইগ‍্যা?
এবার একটু মলিন হলো ময়নার চেহারা — না, ক‍্যামনে, হগলের জন্য পারি নাই, ছোট ভাই বোনডারে দিছি।
— ক‍্যান তর স্বোয়ামীও তো কামায়।
—- হ কিন্তু রিশকার মহাজনরে জমা দেওন লাগে, রোজার সুময় যা একটু কামাইবার পারে, দুইজনের কামাই মিল্ল‍্যাইতো চলতাছি।
এরপরই ফাল্গুনীর দিকে চোখ গেলো ময়নার, সাথে সাথে করুণ হয়ে গেলো দৃষ্টি , মমতা ভরা কন্ঠে এগিয়ে এসে… না ফাল্গুনী নয়…. দরিদ্র এক ভিখারীকে বললো — খালা, খাইছো কিছু? এই লও ট‍্যাকা, খাওন কিন‍্যা খাও, না কইরো না, কিছু ট‍্যাকা পাইছি, লও…..
এই বলে পঞ্চাশ টাকা যত্ন করে ফাল্গুনীর হাতে গুঁজে দিয়ে বলতে বলতে গেলো….. আহারে এই মানুষটারে দ‍্যাখলে এমুন মায়া লাগে, কেউ নাই খালার, এই ফুটপাতেই পইড়া থাহে, কোন দোকানের মইধ‍্যে বুজি রাইতে গুমায়, কি করুম, কিছু তো করবার পারি না……
ভিখারী ফাল্গুনী স্তম্ভিত হয়ে গেলো, তারই বাসার কাজের বুয়া, মাত্র পাঁচশো টাকা বেশী পেয়েছে দেখে কত খুশী, অবলীলায় পঞ্চাশ টাকা ফকিরকে দিয়ে দিলো….. মেয়েটা বলে গেলো তার কিছু করার নেই কিন্তু ফাল্গুনীর তো অনেক কিছু করার সার্মথ‍্য আল্লাহ্ দিয়েছিলেন —- সে তাহলে কি করলো? কেন করলো না?
আবার ব‍্যথার অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো — এত বড় মন ঐ ছোট লোক বস্তির বাসিন্দা মূর্খ কাজের বুয়ার?….. আর তারা? শিক্ষিত, ভদ্রলোক, উচ্চ শ্রেণীর মানুষ, কত গর্ব , কত অহংকার তাদের…. রাস্তার ফকির, গরীবদের যারা মানুষ ভাবে না, দয়া করুণাও মন থেকে আসে না — এক ফোঁটা পানিও গলে না আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে —- ব‍্যতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু সেই ব‍্যতিক্রমীদের মধ্যে তো সে পড়ে না। কি চরম শিক্ষা পেলো ফাল্গুনী আজ মেয়েটির কাছে থেকে….

কিন্তু এখন ফাল্গুনী কি করবে? কোন মায়া বলে, কোন যাদুকরের ইশারায় — অলৌকিক ভাবে এই ভিখারীর সাথে বদলে গেলো, পুনরায় ফাল্গুনী কি করে ফিরে পাবে নিজেকে? এই অভূতপূর্ব নিরুপায় অসহায় কি সে ছিলো কখনো!!!
স্তব্ধ হয়ে বসেই রইলো সে তারপর তাকালো হাতের মুঠোয় থাকা টাকা গুলোর দিকে, এদিক ওদিক চাইতেই দু’তিনজন ফকিরকে দেখতে পেয়ে ইশারায় ডেকে সব টাকা ওদের দিয়ে দিলো এবং সবিস্ময়ে অনুভব করলো… টাকাগুলো দিয়ে সে মনের মধ্যে এক অভূতপূর্ব তৃপ্তি, প্রশান্তি, আনন্দ পাচ্ছে।
একটুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে মনস্থির করলো, খানিক সরে পাশের দোকানের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে এক মনে বলতে লাগলো ফাল্গুনী…. হে আমার প্রভু, আমি সংকটাপন্ন আর আপনি সকল দয়াবানের শ্রেষ্ঠ দয়াল, আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত, আপনি ক্ষমাশীল , ক্ষমা করতে পছন্দও করেন , এই পাপী অজ্ঞ বান্দাকে আপনি ক্ষমা করে দিন, না বুঝে আমি যা করেছি… দয়ালু মহান আল্লাহ্… তার জন্য আপনার কাছে মাফ চাইছি…. কতক্ষণ এভাবে ফাল্গুনী অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে আকুলভাবে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছিলো, জানে না, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তার কথাগুলো বেরিয়ে মিলিয়ে গেলো অসীমে….. হঠাৎ তীব্র একটা ঝাঁকুনিতে তার শরীর কেঁপে উঠতেই চোখ মেলে তাকালো…. সবিস্ময়ে দেখলো সে নিজের বিছানাতেই পড়ে আছে — চারপাশের সেই অবিশ্বাস্য কষ্টকর, অপ্রত্যাশিত পরিবেশ গায়েব, সেও আর মলিন দরিদ্র ভিখারী হয়ে নেই, গরবিনী ফাল্গুনী বসে আছে, প্রাচুর্যময় বিলাসবহুল ঘরেই।

আবীর যখন অফিস থেকে ফিরে এলো তখনো ফাল্গুনী নিশ্চল ভাবে বসেই আছে….. না না ভুল — এ সেই ফাল্গুনী নয়…. পরশমনির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পরিবর্তিত এক অন্য ফাল্গুনী।
ওকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক আবীর প্রশ্ন করলো….. কি হয়েছে!! তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন, শরীর খারাপ?
অবসন্ন নিস্তেজ স্বরে ফাল্গুনী বললো… আমি ঠিক আছি, তোমার সাথে কিছু কথা আছে,
এমন ভাবে কখনো ফাল্গুনী কথা বলে না, আরো অবাক হয়ে আবীর বললো…. হ‍্যাঁ বলো,
— না, এখন নয় কাল বলবো।
অদ্ভুত ঘটনায় শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে তার, ধকল সামলাতে সময় দরকার, কোনমতে শুয়ে পড়লো, আবার নিজেকে ফিরে পেয়ে পরম করুণাময়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় সমস্ত দেহ মন অবশ হয়ে রইলো।
পরদিন ময়না আসতেই ওকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বেডরুমে নিয়ে এসে, এক হাজার টাকার একটা নোটের বান্ডিল হাতে দিয়ে হাসিমুখে বললো ফাল্গুনী — এই নাও, এখানে বিশ হাজার টাকা আছে, এই দিয়ে তোমার পরিবারের জন্য যা মন চায় কেনো, আমি চাই ভালো ভাবে তোমরা ঈদ পালন করবে।
ময়না বেচারী হকচকিয়ে যেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো, তার দৃঢ় বিশ্বাস হলো, এরপর পুলিশে খবর দিয়ে বলবে এই টাকা ময়না চুরি করেছে, বাড়তি টাকা চাওয়ার শাস্তি দেবে…. কাঁদতে কাঁদতেই ময়না বললো… ম‍্যাডাম, আমি আর কখনো ট‍্যাকা চাইমু না আমারে মাফ করেন।
— ম‍্যাডাম নয়, আজ থেকে আমাকে খালা বলে ডাকবে, ভয় পেও না, আমার কিছু হয়নি, শুধু ভুলে গিয়েছিলাম যে আমিও তোমাদের মতই সাধারণ একজন মানুষ।
…………………………..
আবীরের সাথে আলোচনা করে ফাল্গুনী একটা বৃদ্ধাশ্রম করার পরিকল্পনা করলো…. যেখানে সেই বৃদ্ধার মত সব অসহায় বঞ্চিতরা থাকবে…. বিনা খরচে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা ইত্যাদি সবই পাবে
সেই বৃদ্ধাশ্রমের নাম হবে…. আনন্দ ভুবন।
বদলে যাওয়া এই ফাল্গুনীকে দেখে সবচেয়ে আশ্চর্য ও মর্মাহত হলো বার্বুচি…. তার চাকরী শেষ, এখন থেকে ম‍্যাডাম —- না না খালাই বাসার সব রান্না করবেন, সাহায্য করার জন্য ময়না ও অন্য বুয়ারা তো রইলোই।

আজকে ফাল্গুনী হালিম রাঁধবে ইফতারে, খাসি নয়, ছোট একটা মুরগীর মাংস দিয়ে। গুনগুন করে গান গাইছে আর চুলার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে ফাল্গুনী হালিমের মাংসটা ঠিক মত নরম হয়েছে কিনা —–
একটু দুরে দাঁড়িয়ে অপার বিস্ময় নিয়ে ময়নারা তাদের এই নতুন মনিবকে দেখছে…. তাদের খালা, যার জন্য এবারের ঈদ সবার অনাবিল আনন্দ ও নির্মল খুশী হয়ে এসেছে।।
………………………………

( অদৃশ্য সর্বশক্তিমানের ইচ্ছায় অহংকারী এক মানুষের বাস্তব কঠিন সত্য উপলদ্ধি করে পরিবর্তন হয়েছে, এই পরিবর্তন ও মানবিকতা কামনা করি.. ধন্যবাদ। )
# সমাপ্ত #
নাজনীন রাহমান *****