পুতুল বউ পর্ব-০৭

0
321

#পুতুল_বউ
#Afxana_Junayed
#পর্ব_৭

চেয়ারম্যান বাড়ির বড় দোয়াড়ে মানুষের আনাগোনা,,তপ্ত রোদের মধ্যে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।দোয়াড়ে মোট আটটি চেয়ার পাতানো হয়েছে।চেয়ারম্যান সাহেব একটা চেয়ারে বসে আছেন,তার পাশেই মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা গার্ড।সামনে অনেক মানুষ আছে,কত কত মহিলারা মুখে কাপড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,সবাই আগ্রহ নিয়ে আছে চেয়ারম্যান সাহেব কি উক্তি দেন।পাশেই তিনটে চেয়ারে তিনজন লোক বসে আছে,যাদেকে কেন্দ্র করেই আজকের এই বিচার বসবে।

পুতুলের বাবা চোখ উঁচিয়ে একবার সবার দিকে চোখ ঘুড়িয়ে নিলেন।তারপর হালকা কেশে সামনে বসে থাকা তিন জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-হুম তো বলো তোমাদের কি সমস্যা!

সামনের চেয়ার থেকে একটা মহিলা পাশেই বসা তার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-চাচা এইযে এই জা’নো’য়া’র’টা আমার জীবনটা নষ্ট করেছে তো করেছেই এখন আবার আমার বোনের দিকে নজর দিয়েছে,,

পাশ থেকে ওই লোকটা হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,

-না চাচা আমি আশাকে বিয়ে করেছি,আমাদের মধ্যে কোনো অবৈধ সম্পর্ক নেই,যেখানে আমি বলছি তাদের দু বোনের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমি নিতে পারবো সেখানে ওর কথা বলার কোনো প্রশ্নই আসেনা।আর আশাও আমাকে খুব ভালোবাসে।

দুজনের কথা শুনে,পুতুলের বাবা মাটির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

-যদি তুমি আশাকেই ভালোবেসে থাকো তাহলে তার বড় বোন সম্পাকে কেনো বিয়ে করলে?

-চাচা আমার আব্বা আম্মা আমাকে সম্পার সাথে বিয়ে দিয়েছিলো,তখন আমি আশাকে চিনতামনা।আমাদের বিয়ের পর আশা প্রায় সময় আমাদের বাসায় থাকতো।তখন আস্তে আস্তে আমাদের ভাব ভালোবাসা হয়।তারপর আমরা বিয়ে করি,

শেষের কথাটুকু মাথানিচু করে বলে,সম্পা কিছু বলার জন্য উদ্যোগ হতেই চেয়ারম্যান হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে আশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,,

-তুমি তো জানতে যে সে তোমার বড় বোনের বর,তাও কিভাবে তুমি এই সম্পর্কে আগালে?কি করে তোমার বোনের সংসার নষ্ট করলে?

প্রতিউত্তরে আশা কিছু বলে না,মাথা নিচু করেই হাত ডলতে থাকে।ওভাবেই অনেক্ক্ষণ কথা বার্তা বলার পর তাদের বিচার শেষ হয়।

সবাই আস্তে আস্তে চলে যেতে থাকে,পুতুলের বাবাও বাড়িতে যাওয়ার জন্য চেয়ার থেকে উঠতে যাবে তখন আতোয়ার মোল্লা নিজের চেয়ার থেকে উঠে তার পাশে গিয়ে বসে,মাথার ছাতাটা বন্ধ করে হাতে নিয়ে দাঁত বের করে একটা হাসি দেয়।পুতুকের বাবা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।আতোয়ার মোল্লা মুখে সেই হাসি বজায় রেখে বলে,,

-চেয়ারম্যান সাহেব আমি আপনেরে অনেকদিন ধইরা খুজতাছি কিন্তু আপনি বাড়ি থাহেন না,ব্যস্ত মানুষ তো তাই।আচ্ছা যাই হোক দেহেন আমি জানি ওই ইয়াসিন তার ফটকা পোলা ইমনের লোগে আপনের সোনার টুকরা মেয়ার বিয়া দিতে চায়,,এহন হেরা তো ভালো না তাই আপনেরা না কইরা দিছেন।তয় যাই হোক এহন আসল কোথায় আসি,আমার ছোট পোলারে চিনেন না?ওইযে আনোয়ার!কিছু মনে না করলে আমার ছোট পোলার আর আপনার মাইয়ার হাত এক কইরা দিতে চাই চেয়ারম্যান সাহেব।আপনি টেনসন কইরেন না,মাইয়া আপনার রানীর হালে থাকপো।সব কাম আমার ওই বড় পোলার বউই করবো।

হাত নারিয়ে নারিয়ে কথা গুলো বলল আতোয়ার মোল্লা।পুতুলের বাবা তার সবটুকু কথা মন দিয়ে শুনলেন,তিনি জানতেন এই কথাটা বলার জন্যই এতোদিন ধরে উসখুস করছিলেন আতোয়ার মোল্লা ।পুতুলের বাবা হালকা মুচকি হেসে বলা শুরু করলেন,

-দেখেন আতোয়ার মোল্লা,আমি জানি আপনারা খুব ভালো মানুষ!আপনার ছোট ছেলেকেও আমি চিনি সেও খুব ভালো,তবে আসল কথা হচ্ছে কি আমার মেয়ে এখনো ছোট! সবে মাত্র স্কুলে পড়ে।আর আমি চাইনা এতো ছোট বয়সে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে,আর আপনার ছেলে আর আমার মেয়ের বয়সেরও পার্থক্য অনেক।আপাতত এই বিষয় নিয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না,আশা করি বুঝতে পেরেছেন।এইবার আমি আসি।

কথাটা বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে বাড়ির ভেতর চলে আসেন তিনি।চেয়ারে বসা আতোয়ার মোল্লাও বুঝতে পারলো কিছুতেই তার মেয়েকে এখানে বিয়ে দিবে না,কিন্তু সে তো হাফ ছাড়ার ব্যক্তি নন!যে করেই হোক এই মেয়েকে তার বাড়ির বউ করে আনবেন এবং এ বাড়ি অর্ধেরক সম্পত্তির তাদের নামে হবে।

___________
বাইরে প্রচন্ড রোদ দিয়ে মানুষকে ক্লান্ত করলেও এতো গাছগাছালির মধ্যে যেনো সূর্য মামা হেরে গেছে এই ঘরে সূর্যের তাপ দেওয়ায়,এই ছায়া দিয়েই ঢেকে আছে বাড়ির অর্ধেকটা
জানলার সামনেই বসে আছে পুতুল!বড় বড় গাছের জন্য আকাশের এই গরম সূর্যর তাপটা তার ঘরে পৌছাতে পারছে না।হাতে তার সেই চিরকুটটা,স্পষ্ট হাতের লেখায়া লেখা তিনটি লাইন বার বার পড়ছে সে,যেখানে ছোট ছোট করে খুব সুন্দর করে লেখা

“কালো গোলাপ পেয়ে এতো খুশি হয়ো না,এটা আমার গাছের না।
এই গাছের ফুল নেওয়ার অধিকার কোনো সাধারণ মানুষের নেই।
একদিক পবিত্র ফুলের কাছে আমি এই পুরো গাছটাই তুলে দিবো।”

পুতুল চিরকুটের সারমর্মটা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও কিছুটা বুঝতে পেরেছে।’এখানে পবিত্র ফুল মানে কি উনি ওনার অর্ধাঙ্গিনীকে বুজিয়েছে?হতেও পারে,কিন্তু কি এমন জিনিস আছে এই গাছে যে যাকে তাকে দেওয়া যাবে না?আর উনি কি আমাকে সরাসরি অপমান করলো!থাক লাগবে ওনার গাছের ফুল আমার।দিক উনি উনার পবিত্র ফুলকে,আমার কি?আর কখনো ওনার সামনে যাবো না আমি।কোনোদিনো ওই ফুলের দিকে নজর তো দূর ভাববোও না।

সন্ধ্যার দিকে পুতুল রান্না ঘরে কেক বানাচ্ছিলো,ইচ্ছে ছিলো ভাইয়া ভাবির বিবাহ বার্ষিকীতে ছোট খাটো একটা অনুষ্ঠান করার।কিন্তু হঠাৎ ভাইয়ার এই অবস্থার কারনে,সব ইচ্ছে ভেস্তে যায়।আপাতত ভাইয়া একটু ঠিক আছে তাই,ভাবির হাজার মানার পরেও রান্না ঘরে এসে কেক বানাচ্ছে সে,পাশেই মা বিরিয়ানি রান্না করছে।ভাবিকে আজকে আর রান্না ঘরে আসতে দেওয়া হয় নি।স্নিগ্ধা একটু পর পর এসে দেখে যাচ্ছে কে কি করছে।কেকের পেস্ট তৈরি করে ওভেনে রেখে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বের হয় পুতুল।ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখে বাবা আস্তে আস্তে করে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে মুখে কেমন মলিনতার ছায়া,কিছুক্ষণ আগেই বাহিরে গিয়েছিলো একটু হাটাহাটি করতে,তখন তো বেশ ফুরফুরে মেজাজ ছিলো এখন আবার কি হলো?হয়তো এতক্ষণ হাটাহাটি করে খুব ক্লান্ত।

পুতুলের বাবা সোফায় বসতে বসতে পুতুলকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-মা এক গ্লাস পানি দে তো,

পুতুল কিছু না বলে পেছন ঘুরে দৌড়ে পানি আনতে যায়,এক সেকেন্ড অতিবাহিত হতেই আবার দৌড়ে বাবার কাছে এসে বলে,

-বাবা শরবত এনে দিবো, দুপুরে ভাইয়ার জন্য বানিয়েছিলাম।

-দে,,

পুতুল আবার দৌড়ে গিয়ে গ্লাসে শরবত এনে বাবাকে দেয়।পুতুলের বাবা এক নিশ্বাসে সবটুকু শরবত খেয়ে পুতুলের হাতে গ্লাসটা দেয়।পুতুল গ্লাসটা হাতে নিয়ে বাবাকে বলে,

-কি হয়েছে বাবা তোমার মুখটা এরকম ভার হয়ে আছে কেনো?

পুতুলের বাবা একবার চোখ তুলে তার মেয়ের দিকে তাকায়।’আর কেও বুঝুক আর না বুঝুক তার মনের খবর ঠিকি তার মেয়ে ধরে ফেলতে পারে,কিন্তু এখন তাকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না’,তাই কথা কাটানোর জন্য বলে,

-নারে মা কিছু হয় নি এমনি খুব ক্লান্ত লাগছিলো এখন ঠিক হয়ে গিয়েছে,,তোর মা কই?

-আম্মু তো রান্না করছে ডেকে দিবো?

-না থাক লাগবে না,আমি বরং ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেই।

-আচ্ছা!

রাতে তারা সবাই মিলে কেক কাটে,খুব আনন্দ করে।সবাই খাবার খেয়ে যার যার মতো শুতে যাবে,তখব পুতুলের বাবা সবাইকে একটু থেকে যেতে বলে,,সবাই গোল হয়ে সোফায় বসে,স্নিগ্ধা ঘুমিয়ে পড়েছে,তাই তাকে ঘরে রেখে আসে শ্রেয়া।প্রণয় বলে,

-কি হয়েছে বাবা সবাইকে এমন জরুরি তলব দিয়ে ডেকে আনলে কেনো?কিছু কি হয়েছে?

পুতুলের বাবা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলা শুরু করে,,

-বিকেলে যখন আমি হাটতে বের হই তখন মাঝ রাস্তায় ইয়াসিন আর তার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিলো আমার।আমি কোনো কথা না বলে চলে আসতে যাচ্ছিলাম তখন ইয়াসিন আমার পথ আটকে ধরে বলে, ইমনের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে না দিলে আমাদের নিউ প্রজেক্টটা নষ্ট করে দিবে,তোকে তো ওই ইমনের চ্যালাপেলারাই মেরেছে,আরো অনেক ধরনের হুমকি দেয়,কিন্তু আমি এগুলো মাথায় না নিয়ে হেসে উড়িয়ে দেই,কিন্তু ওরা পুতুলের ক্ষতি করবে এটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।আমি মরে গেলেও ওই জা’নো’য়া’রের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিবো না।তাও আমি আমার মেয়ের জীবন নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছি না,সামনে ইলেকশন।সব দিক বুঝেই তারা আমাদের এই সময়ে এট্যাক্ট করেছে।এখন আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না,তাই ভেবেছি কয়দিনের জন্য পুতুলকে কোথাও পাঠিয়ে দিবো।

বাবার কথা গুলো শুনে প্রণয়ের মাথায় র’ক্ত চরে বসে,চোখ লাল হয়ে যায়।বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়,হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,

-ওই কু’ত্তা’র বা’চ্চা’দের মাংস যদি আমি রাস্তার কু’কু’রদে না খাইয়েছি তাহলে আমার নামো প্রণয় নয়।কি ভেবেছে তারা আমার বোনকে দিয়ে তারা পুতুল খে’লা খেলবে আর আমি তাদের ছেড়ে দিবো?আর কেনো বাবা ওদের জন্য আমি আমার বোনকে কেনো অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিব কেনো?

পুতুলের বাবা প্রণয়কে শান্ত করানোর জন্য বলে,

-দেখ বাবা সবার আগে আমার মেয়ে!পুতুলকে এখানে রেখে আমাদের কিছু করাই সম্ভব হবে না,যা করতে হবে ঠান্ডা মাথায় করতে হবে।আর পুতুলকে সেইফ যায়গায় রেখেই করতে হবে,নাহলে ওরা বার বার আমাদের দুর্বল যায়গায় আ’ঘা’ত করবে।

পুতুল এতক্ষণ সব শুনছিলো,’বাবা ভাইদের কথা শুনে সে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে।এতোদিন সে শুধু জানতো ইমন তাকে পছন্দ করে,কিন্তু তার পেছনে যে বাবাদের এতো থ্রেট দিয়েছে এতো ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে তা সে কল্পনায়ো ভাবতে পারে নি।তার জন্য তার পরিবার এতো বড় ঝুকিতে আছে আর সে কিনা চিল মুডে আছে।’একদম স্তব্ধ হয়ে যায় পুতুল।

প্রণয় আবার সোফায় বসে বাবাকে বলে,

-এখন কি করবে তুমি?পুতুলকে কে সেইফ রাখবে?

-এখন তো আর তাকে বিদেশ পাঠানো সম্ভব না,আমার মতে পুতুলের থাকার মতো একমাত্র সেইফ যায়গা হলো এমপিদের বাড়ি!তাদেএ বাড়ির সবাই খুব ভালো আর পুতুলকে আদর করে,আমার মনে হয় না ও বাড়িতে থাকলে পুতুলের কোনো বিপদ হতে পারে,,আমি ফায়াজকে সব খুলে বলেছি সেই আমাকে এই কথাটা বলেছে।

এতক্ষণ চুপ থাকলেও এমপিদের বাড়ির ক্থা শুনে এইবার মুখ খুলে পুতুল।

-কেনো বাবা জানা নেই চেনা নেই আমি কেনো একজনের বাড়িতে গিয়ে থাকবো?

-দেখ মা তুই যদি জানা শোনার দিকে যাস তাহলে ন্বিসন্দেহে ও বাড়ি তোর জন্য সেইফ।আর সব তোর তোর সেইফটি জন্যই করছি মা,আগে যদি জানতাম আমাদের একটা ভুল ডিসিশনের জন্য তোর এতো বোর ক্ষতি হবে তাহলে আমি কখনোই এই পদটা বেছে নিতাম না।

পুতুল আর কিছু বলে না,কেনো যেনো সব অচেনা লাগছে মুহুর্তেই তার বুকে ভয়ের ঢেউ খেলে যাচ্ছে,না জানি এই সুন্দরময় জীবনে কি ঝড় আসে।

চলবে..!