পুষ্প কন্যার প্রেম পাবক পর্ব-০১

0
339

#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব১
#রাউফুন

ঝুমুরের বড় বোন লুকিয়ে বিয়ে করে রেখেছিলো। এটা হঠাৎ তার বাবা, চাচারা জানতে পেরেছেন। ঝুমুরের সামনেই এলোপাথাড়ি ভাবে তার বড় আপা কে মা’র’ছে। ঝুমুর আর সহ্য করতে পারলো না। সে ছুটে গিয়ে তার চাচাকে তার তুলতুলে নরম হাতে ধা’ক্কা দিয়ে, খামচি দিয়ে সরিয়ে দিলো। এদিকে বড় আপা একটাও টু শব্দ করেনি৷ ঝুমুরের সহ্য হয়না তার বড় আপার গায়ে কেউ-ই একটা আ’চ’ড় দিলে। আম্মা চেয়েও আটকাতে পারেনি ছোট চাচাকে। বড় আপা তো কোনো ভুল করেনি যে ছেলেকে সে ভালোবেসেছে তাকেই বিয়ে করেছে৷ বড় আপা তো বলেছিলো যে সে অন্য কাউকে পছন্দ করে তাই অন্যত্র বিয়ে করবে না। আপা যাকে পছন্দ করে সে ছেলেটা গরীব ঘরের আর এটাই আব্বা আর চাচাদের সমস্যা। ঝুমুরের সাহস দেখে তার ছোট চাচা ফুসে উঠে বললেন,

‘ভাইজান, আপনার ছোট মেয়ের কিন্তু খুব সাহস বাড়ছে। দেখছেন আমারে কেমন খামচি দিছে এই মাইয়া। ওঁরে সইরা যাইতে কন, আদর করি বইলা কিন্তু ছাড় দিবো না। ওঁরে বড়দের মাঝ খানে আসা বের করে দিবো৷’

‘থাম আসলাম, তুই আমার মাইয়ার গায়ে হাত দিস কেনো? ওঁ তোর মাইয়া না আমার মাইয়া? যা করছে করুক তাই বইলা ওর বাপ মা থাকতে তুই গায়ে হাত দিবি? আমার সাদাসিধা মাইয়াটারে ওই বেজ”ম্মার বাচ্চাটা ভুলাই ভালাই বিয়া করছে সম্পত্তির লোভে৷ ওই কু**র বাচ্চারে ধইরা আন। আজকেই ওরে বটতলায় গাছের লগে উলটা কইরা ঝুলামু!’

‘ভাইজান ওই মা**দ নাই বাড়িতে। আমগোর ভয়ে কই জানি লুকাইছে। ওঁরে খালি একবার হাতের কাছে পাই কল্লা টা ধর থেইক্কা আলাদা কইরা দিমু।’

ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঝুমুর দাঁড়িয়ে আছে। ওঁর বড় বোন ঋতু অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পরলো এসব শুনে৷ ঝুমুর আল্লাহ গো বলে চেঁচিয়ে উঠলো। ঝুমুরের মা সুফিয়া বেগম মেয়েকে আহাজারি করতে করতে ঘরে নিয়ে গেলেন। স্বামী, দেবরের ভয়াবহতার কথা ভেবে তাদের মুখের উপর কথা বলতে পারে না সুফিয়া।

একদিন কে’টে গেলো। পরিবেশ ঠান্ডা রেখেছে চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ এর বাড়ির সবাই। কোনো রকম কানাঘুঁষা করলেও তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। গ্রামের কাক পক্ষির মুখের যদি এই কথা শোনা যায় তবে একেকজন এর অবস্থা বেগতিক করে দিবে ঝুমুরের বাবা, চাচা।

ঝুমুর বড় বোনের মাথায় পানি ঢালছে। তাদের গ্রামের কেউ-ই প্রেম করে বিয়ে করতে পারে না৷ তার বাবা গ্রামের চেয়ারম্যান! সেই হিসেবে সবাই সমীহ করে চলে তার বাবা-চাচাকে। তবে তাকে অদ্ভুত ভাবে বেশিই আদর করে সবাই। সে বাড়ির ছোট সদস্য হলেও তার এই বাড়িতে একটা আলাদা দাম আছে। সবাই তাকে মূল্যায়ন করে। তার বাবা আবদুল আজিজ সব সময় বলেন, ‘ঝুমুর আম্মা, তুমি হইলা আমার আম্মা। আমার আম্মার চেহেরাটা পাইছো তুমি। তাই তো তুমি আমার মাইয়া হওনের পরেও পোলার মতোন ভালোবাসি। আমার আম্মারে তো আমি অমর্যাদা করবার পারি না।’

বাবার এরুপ কথায় প্রাণ ভরে যায় ঝুমুরের৷ কিন্তু কালকে তার বোনের সাথে করা অন্যায়ের পর থেকে সে বাবাকে ভালো চোখে দেখতে পারছে না। ধন সম্পদ,প্রতিপত্তি, প্রভাবশালী হওয়ায় কি এমন নিষ্ঠুর হ’য়েছে? তবে কি গ্রামের মানুষজনের মুখে মাঝে মধ্যে বলা কথা গুলো সত্যি? তার বাবা সত্যিই অসৎ মানুষ। ঝুমুর তার আপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎই তার হাত একটা ঝটকায় সরিয়ে দিলো ঋতু। গোঙ্গানি ক্রমশ বাড়ছিলো তার৷

‘এই আপা কি হইলো তোমার? শরীর কি বেশি খারাপ লাগতাছে?’

‘তুই সর! হাত দিস না গায়ে। আমার শরীর জ্বইলা যাইতাছে!’

‘আপা এমন কইরো না। আমি পানি দিয়া দিতাছি দিতে দেও।’

ঝুমুর তার আপার বাঁধা মানলো না। বড় আপার জ্বরে জীর্নশীর্ন হয়ে পরে থাকা ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ঝুমুরের কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে।

আবদুল আজিজ ছোট মেয়েকে ডাকলেন। ঝুমুর বসে বসে বোনের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিলো। বাবার ডাকে উঠে গেলো।

‘আম্মা, ও আম্মা, আপার কাছে আহো!’

সুফিয়া কাজ করছিলেন, কাজ ফেলে বড় মেয়ের মাথার কাছে এলেন। দু দিনেই মেয়েটার শরীর যেনো বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। চোখের জল তো বাঁধ মানে না। ঋতু মাকে দেখলো। শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ফাঁক
করে অল্প বিস্তর হাসলো। বললো,

‘আম্মা, আব্বা আমারে ঝুমের মতোন ক্যান ভালোবাসে না? আমি তো আব্বার বড় মাইয়া! তাইলে এমন অবিচার ক্যান আম্মা? ছোট থেইক্কাই দেইখা আইতাছি। আমি আমার ছোট বোনেরে হিংসা করছি না আম্মা, কিন্তু আমার প্রতি অবহেলাডা কি সমীচীন আম্মা?’

‘তোরেও তোর আব্বা ম্যালা ভালোবাসে৷ তুই জানোস, তোর জন্মের আগে আমার আরও তিনডা বাচ্চা হইয়া ম’ই’রা গেছে। এরপর তোর বাপে খুব ভাইঙ্গা পরছিলো। তুই যহন হইলি আমারে ঘর থেইকা বাইর হইতোও দিতো না। যদি তোর কিছু হইয়া যায়। কত্তো কোলের উপরে নিয়া গোসল করাই দিসে৷ খাওয়াই দিসে। এসব না তুই দেহোস নাই আমি দেখছি।’

‘তাইলে বোন হওনের পর বুঝি আমার ভালোবাসায় ভাগ পরলো!’

‘তুই যা করছস এরপরে আর ভালোবাসা বাঁইচা নাই। যা ভালোবাসা আছিলো তাও শেষ! তোর লাইগা আমারেও মানুষডা কত কতা শুনাইতাছে। ক্যান করলি এইডা? সবাই যে আমার দোষ দিতাছে, আমি তোরে প্রশ্রয় দিসি লাইগাই তুই এতো দূর পর্যন্ত যাইতে পারছস! তোরে ঠিক মতোন মানুষ করবার পারি নাই। আরও কত কতা!’

‘আম্মা প্রেম-ভালোবাসা কি বইলা কইয়া আসবার জিনিস? হুট কইরাই চইলা আসে।’

সুফিয়া ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন মেয়ের গালে। মুখে আঁচল চেপে কেঁদে কেঁদে বললেন,’ নির্লোজ্জ মাইয়া, আমি তোর আম্মা ভুইলা গেছস? আমার কাছে এই গুলা কস, লজ্জা করে না? তোর মতোন ওমন কালসাপ, স্বার্থপর মাইয়া আমি পেটে ধরছি ভাবলেই গা ঘিন ঘিন করতাছে। তার চেয়ে ভালো হইতো জন্মের পরই নুন মুখে দিয়ে মা’ই’রা দিতাম। যে মাইয়া বাপ মায়ের সন্মান ধুলোই লুটাইয়া দেই তারে আবার কিসের ভালোবাসা,আদর-যতন করবো!’

সুফিয়া চলে যেতে নিলে ঋতু সুফিয়ার কাপড় টেনে ধরলো! অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে বললো, ‘আম্মা আইজ তুমি আমারে প্রথমবার মা’র’লা, তুমি আমারে মা’র’তে পারলা? এই খানডাই, এই বুকে লাগছে আম্মা! তোমারে মনের কতা কমু না তো কার কাছে কমু আম্মা? তুমিও পর করে দিলা আমারে?’

আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসেন সুফিয়া। ঋতু মাকে ওভাবে যেতে দেখেই বুঝে যায় কিছু একটা হয়েছে। তাই সে বোনের কাছে আসে।

‘বড় আপা কাঁনদো ক্যা? আম্মা কি কিছু কইছে?’

ঋতু হিচকি তুলে তুলে বললো, ‘আম্মাও আইজ আমারে মা’র’লো ঝুম! আম্মাও মা’র’লো।’

হুহু করে কাঁন্না করছে ঋতু। ঝুমুর জড়িয়ে ধরলো বোনকে। আপার কষ্ট যে তার কষ্ট। কলিজায় লাগে। এই বাড়িতে যদি সে কাউকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে থাকে সে আর কেউ না তার বড় আপা। তার বাবার চেয়েও সে বড় আপাকে বেশি ভালোবাসে।

‘কাঁইন্দো না আপা। সব ঠিক হইয়া যাইবো! আইচ্ছা দুলাভাইর নাম কি কও তো!’

‘সেকি রে! তুই জানোস না?’

‘ উঁহু!’

‘তুষার শেইখ!’

‘তুষার ভাইরে তো আমি দেখি নাই। তুষার ভাই কেমন দেখতে?’

‘খুব সুন্দর!’

‘ফর্সা?’

‘নাহ শ্যামলা!’

‘লম্বা কেমন গো?’

‘ইয়া লম্বা। তোর আপা তার বুকের উপর পইরা থাহে!’

‘পড়াশোনা করে?’

‘হ্যাঁ ম্যালা পড়াশোনা জানে। মাস্টার্স শেষ হইবো,শহর থেইকা খুব কষ্ট কইরা পড়াশোনা করছে!’

‘তুমি তুষার ভাইরে ম্যালা ভালোবাসো তাই না আপা?’

‘হো! আইচ্ছা ঝুম তুই কো-তো, ওরম একজন শিক্ষিত মানুষ যে, আমার মতোন এমন নিরেট মূর্খ মাইয়ারে বিয়া করছে এইডাই তো ম্যালাকিছু। তাও আব্বার ওমন গুমর ক্যান?’

‘জানি গো আপা। আর তুমি পড়াশোনায় কম হইলোও পরীর নাহাল সুন্দর। তুমারে দেইখাই তুষার ভাই টাস্কি খাইছে বুজছো? হের লাইগাই তোমারে বিয়া করছে!’

ঋতু লজ্জা পেলো। বোনকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আস্তে করে বললো,’আমি তো তার পরীই রে! কি জানি মানুষ টা এহন কেমন আছে! আমিই তো কইছি পলাই যাইতে এইহান থেইকা। আমারে ছাইড়া তো যাইতেই চাইছিলো না।’

‘চিন্তা কইরো না আপা! সব ঠিক হইয়া যাইবো। আব্বা এহন রাইগা আছে তাই এমন করতাছে। আব্বা কইলাম ওতোটাও খারাপ মানুষ না!’

‘জানি আমি, তয় আব্বারে কেরা উষ্কানি দিসে এইডাও জানি!’

তম্বন্ধে ঋতুর ছোট্ট বাটন ফোনের টুট-টুট-টুট করে শব্দ হলো।

#চলবে