পূর্ণতা পর্ব-২৮

0
451

#পূর্ণতা❤️
#Writer_তানজিলা_তাবাচ্ছুম ❤️

২৮.

মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে কি থেকে কি হয়ে গেল! ‘সময়’ নামক এই জিনিসটা কেমন অদ্ভুত। আলোক কিছুক্ষন আগে রাগের বশে বলেছিল ‘মুক্তি দাও আমাকে’। এখন সে চিরদিন মুক্তি পেলো চাঁদের থেকে! কিন্তু সে কি এই মুক্তি চেয়েছিল? যেই মানুষ তার মুখ দেখে প্রতিদিন তার ঘুম ভাঙ্গত ,যেই মানুষটিকে ঘুম পাড়িয়ে সে শান্তিতে ঘুমাত! এখন কিভাবে থাকবে তাকে ছাড়া? যাকে না দেখলে চোখ জোড়া অতৃপ্তি হয়ে থাকে। যাকে হাসি না দেখলে মনে অশান্তি লাগে। কিভাবে থাকবে তাকে ছাড়া? আলোক চাঁদকে এতোই শক্ত করে ধরে আছে যেন ছেড়ে দিলে সে হারিয়ে যাবে। ইরা টলমলে চোখে তাকিয়ে অস্পষ্ট কন্ঠ বলল,

‘ ও_ ওর _ ওর হয়তো শা_শ্বাস_ শ্বাস না নিতে নিতে পেরে__ মা___মার____

আর বলতে পারছে না ইরা। হু হু করে কেঁদে দিলো। আশা পুরো চুপসে গেছে। চাঁদ এতদিন যেন তার নিজের মেয়ে হয়ে ছিল। কখনোই আশা চাঁদকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে দেখে নি, দেখেছে নিজের মেয়ে হিসেবে। সেই মেয়েটা আর নেই ভেবেই তার খুব কষ্ট হচ্ছে। আরো বেশী কষ্ট হচ্ছে আলোকের কথা ভেবে। এরপরে আলোকের জীবন কোন দিকে যাবে? চাঁদ তো আলোকের জানপাখি ছিল। আলোক তো তাকে অনেক অনেক অনেক ভালোবাসত। কিন্তু এখন কি হবে আলোকের? আলোক যেন পুরো শকড হয়ে চাঁদ কে জরিয়ে বসে আছে। ‘মারা গেছে’ কথাটা শুনে আলোকের নড়াচড়া , কান্না সব বন্ধ হয়ে গেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে জীবন্ত লাশ। ইরার কান্না দেখে নিরব এগিয়ে আলোক কে ঝাকালো,

‘ আল_আলোক_ আলোক!’

আলোকের কোনো সাড়া শব্দ নেই। নিরব আলোককে জোরে একটা মারলো তারপর বলল,

‘ আলোক! কান্ট্রোল ইউর সেলফ।’

আলোকের কানে যেনো কথাটা পৌঁছালো না। সে হতভম্ব হয়ে বলল,

‘ হা?’

নিরব নিজের কান্না চেপে রেখে বলল,

‘ আলোক সামলা নিজেকে?’

আলোককের ব্যবহার কেমন অদ্ভুত হয়ে গেল। যেন কিছুই হয়নি। আলোক চাঁদকে এমন ভাবে ডাকতে লাগলো যেনো চাঁদ ঘুমিয়েছে।

‘ সাইনিং মুন? এই মুন। উঠো।’

নিরব কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ আলোক! চাঁদ মারা গেছে।’

আলোক বড়বড় চোখ করে নিরবের দিকে তাকালো। তার চোখ জোড়া কেমন ছলছলে হয়ে আসলো। সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে তার গালে হাত স্লাইড করলো তারপর কপালে একটা কিস করে বলল,

‘ চাঁদ পাখি ঘুমাও তুমি। শান্তির ঘুম ঘুমাও। এই দুনিয়া, দুনিয়ার মানুষ সবাই তোমাকে খুব কষ্ট দেয় তাইনা? আজ থেকে তাদের সবার থেকে তুমি মুক্তি পেলে। শান্তির ঘুম ঘুমাও তুমি।’

বলে চাঁদের চোখ জোড়ায় কিস করলো তারপর আবার বলল,

‘ আমি তখন বলেছিলাম কান্না না করতে কারন এটা আমার সহ্য সীমার বাহিরে। তাই তুমি আমাকে কাদিয়েই চলে গেলে এখন ?

‘ কখন ঘুম ভাঙ্গবে তোমার চাঁদ? চাঁদ পাখি। এই চাঁদ! উঠো না।’

বলে জোরে ডাকতে লাগলো। আলোক কে একজন পাগলের মত লাগছে। কেমন অদ্ভুত কথা, আচরন করছে সে। রায়হান এতক্ষণ সব দেখছিল। চাঁদের সাথে ব্যস্ততার কারণে তেমন কথা হয়নি। কিন্তু তবুও কেমন একটা মায়া কাজ করতো মেয়েটার প্রতি। এতদিন ধরে একসাথে ছিল আজ থেকে আর থাকবে না, ভাবতেই কেমন লাগছে তার। সে নিরবে চোখের জল ফেলছে। তার আলোকের কথা ভেবে খুব কষ্ট লাগছে রায়হানের। নিজের প্রিয় ভালোবাসার মানুষ যখন ছেড়ে চিরদিনের মত চলে যায়, তখন এই পুরো পৃথিবীটা কেমন বিষাক্ত লাগে। সেই মুহূর্তে ইচ্ছে করে ‘যদি আমিও তার সাথে মরে যেতাম’ । আলোকের মা মরার পরে রায়হান এইসব উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই সে জানে এই মুহূর্তে আলোকের অবস্থা ঠিক কেমন! আলোক বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

‘ আমি ওকে মেরে ফেললাম! হ্যা আমি ওকে মেরেছি! আমার কারণে ও আজ কতটা কষ্ট নিয়ে চিরদিনের মতো চলে গেলো।’

নিরব আলোকের কাছাকাছি থাকায় সবটা শুনতে পেয়েছে। সে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

‘ আলোক কি সব বলছিস তুই! সামলা নিজেকে।’

আলোক ‘থ’ মেরে বসে আছে। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কি থেকে কি হলো! আলোকের বিশ্বাস হচ্ছে না! এইতো মাত্র ১০ মিনিট আগে মেয়েটা তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তার হাতে চুমু দিয়ে ছিল। সেই মেয়ে এখন নেই! আলোকের মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আলোক ধারণা করছে তখন অনেক জোরে চাঁদ দরজায় শব্দ করেছিল। হয়তো তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আলোক তাতে পাত্তা না দিয়ে কানে হেড ফোন গুজয়। মানুষ এক মিনিট অক্সিজেন ছাড়া কেমন ছটফট করে, কতো কষ্ট পায়। সেখানে তার চাঁদপাখি কতো কষ্ট পেয়ে শেষ পর্যন্ত মারা গেলো! ভেবেই আলোকের গলা শুকিয়ে আসছে। আলোক মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করছে। যদি সে এত অভিমান না করত তাহলে হয়তো তার চাঁদ পাখি থাকতো। ওকে সারাজীবন সুখে রাখতে চেয়েছিল আলোক। কিন্তু সেই মানুষটাকেই সে কতো কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলল! আলোকের এইসব ভাবতে নিজের উপর খুব ঘৃনা লাগছে। ধীরে ধীরে এশারের আজানের শব্দ আসছে। শেষমেশ সবাই ডিসিশন নিলো এশার নামাজের পরে চাঁদকে দাফন করা হবে। কিছুক্ষন আগেই আলোক শুনছিল ‘কতো জানাজার নামায’ নামে গজল। এখন তার প্রিয় চাঁদের জানাজাই তাকে পড়তে হবে। আজ থেকে চাঁদ কে আর কখনো দেখতে পাবে না, পারবে না ছুঁতে, পারবে না তার সাথে আর মন ভরে কথা বলতে ভেবেই আলোকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আজ থেকে চাঁদ থাকবে অন্ধকার কবরে। নামায পড়ার শক্তি টুকু আলোক পাচ্ছে না তবুও কাপাকাপি শরীর নিয়ে নামাজের জন্য দাঁড়ালো।‌নামাজ শেষে তাদের বাড়ি থেকে প্রায় কয়েক কিলোমিটার দূরের কবর স্থানে চাঁদ কে দাফনের জন্য নিয়ে গেলো। পুরো রাস্তায় আলোক চাঁদ কে জড়িয়ে জাপটে ধরেছিল। আর চাঁদের কানে বার বার বলছিল ‘উঠতে’ , ‘ফিরে আসতে’। মরে গেলে সে তো আর কখনোই ফিরে আসবে না। এইজন্য প্রতিটি মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত ই নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করা উচিত। কারো মৃত্যুর ই নির্ধারিত সময় নেই। সময় হয়ে এলো দাফনের। চাঁদ কে দাফন করা হবে। সাদা কাফনে মোড়া চাঁদের লাশ টি। আলোক শেষবারের মতো একবার চাঁদের মুখ টা দেখলো। কান্না জড়িত কন্ঠে কেঁদে কেঁদে ধীর কন্ঠে বললো,

‘ আল্লাহ্ তোমাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুক। যাতে মৃত্যুর পর তুমি শান্তি পাও। আমি তো পারলাম না শান্তিতে রাখতে। উল্টো কষ্ট দিয়ে মেরে ফেললাম। তোমার এই অপদস্ত স্বামী কে ক্ষমা করে দিও চাঁদ পাখি, আমার সাইনিং মুন। এখন এই নাম গুলো কাকে ডাকবো আমি? আমার সামান্য অভিমানের এত বড় শাস্তি দিলে?’

আর বেশি কিছু বললো না আলোক। তারপর চাঁদের কপালে,চোখের গালে শেষ বারের মত ভালোবাসার পরশ ছুঁইয়ে দিলো তারপর শেষ বারের মতন জরিয়ে ধরল আলোক। চাঁদ কে দাফন শেষে আলোক সেখানেই বসে আছে। তার যেনো এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না। পারলে এখানেই থাকতে রাজি সে। আলোক কে নিরব বললো,

‘ আলোক! চল।’

আলোক কোনো রেসপন্স করলো না।

‘ আলোক। এই আলোক।’

আলোক আনমনা হয়ে বললো,

‘ কি করে ওকে একা এই অন্ধকারের মধ্যে রেখে যাই? ও তো অন্ধকারে খুব ভয় পায়। ওকে বলেছিলাম সবসময় ওর পাশে থাকবো। সেখানে কি করে ওকে একা ফেলে যাবো?’

নিরব নিজের কান্না চেপে রেখে বললো,

‘ আলোক ও বেচেঁ নেই। মরে গেছে। ওকে এখান থেকে আর ফিরে আনা যাবে না।’

‘ আমি! আমিই ওকে মেরে ফেলেছি। অনেক___! অনেক কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলেছি আমি।’

‘ আলোক কিসব বলছিস তুই। মৃত্যু কি কারো হাতে থাকে নাকি বল? কেনো নিজেকে দোষারোপ করছিস?

আলোক কিছু বললো না। শুধু নিস্তব্ধে কেঁদে যাচ্ছে। নিরব সবাইকে যেতে বললো। আলোকের সাথে এখানে সে আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আলোক যাবে ততক্ষণ সে এখানেই থাকবে। সবাই চলে গেলো।

__________

আজ পুরো বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ! কোথাও কোনো টু শব্দ নেই। যে যার ঘরে। আলোক নিজের ঘরে নিজেকে বন্ধ করে রেখেছে। আলোকের কানে খালি একটা কথাই বাজছে যে, সে চাঁদ কে কষ্ট দিয়ে মেরেছে। চাঁদের মৃত্যুর কারণ আলোক নিজেকে ভাবছে।

#চলবে….

* রি-চেক হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]
#তানজিলা_তাবাচ্ছুম