পূর্ণতা পর্ব-৩৪+৩৫

0
525

পূর্ণতা ❤️
#Writer_তানজিলা_তাবাচ্ছুম❤️

৩৪ & ৩৫

গাড়িতে বসে পুরো রাস্তা তারা চুপ করে ছিল। মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ ও করেনি। তারার মনে প্রচণ্ড ভয় কাজ করছে। দেখতে দেখতে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তারা আলোক এসে পড়লো। তারা গাড়ি থেকে নামতে চাইছে না। আলোক তাকে বের করে আনলো। বাড়ির গেটের সামনে তারা দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকার সাহস পাচ্ছে না। তারার শরীর থরথর করে কাঁপছে। জানে না সামনে তার ভাগ্যে কি হবে। আলোক দরজায় নক করতেই তারার মা নীলিমা হাসি মুখে দরজা খুললেন। আলোক সালাম দিল তারপর হাতে থাকা প্যাকেট গুলো এগিয়ে দিলেন। যতই হোক শশুর বাড়িতে তো আর খালি হাতে আসা যায় না। নীলিমা হাসি মুখে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,

‘ এইসবের কি দরকার ছিল বাবা!’

আলোক প্রতুত্তরে সামান্য হাসলো।

‘বাবা ভিতরে আসো।’

তারা তার মাকে দেখে থরথর করে কাঁপছে। তারা ওখানেই ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। তারাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলোক বলল,

‘ আসো।’

নীলিমা পিছন ঘুরে আদুরে গলায় বলল,

‘ মামনি আসো।’

বলে তারার কাছে গেল। তারপর বলল,

‘ বাসায় কেউ নেই। নিকাব টা খুল মা।’

বলে তারার নিকাবটা খুলল। তারপর তারার দু’গাল ধরে বলল,

‘ ইশ কতো দিন আমার মেয়েটাকে দেখি না। কেমন আসিস মা।’

তারা একটু চমকে উঠে। সামনে থাকা মহিলাটাকে কেমন অচেনা লাগছে। আদৌ কি তার সেই মা? তারা কোনো উত্তর দেয় না। তারপর তারা আলোক ভিতরে ঢুকে। আলোক তারার বাবাকে সালাম দিলেন। তারার বাবা বলে উঠলেন,

‘ আরে আমার মামনি মা-টা এসে গেছে।’

বলে তারাকে জরিয়ে ধরলো। তারা বিস্মিত হয়ে যায়। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তারপর তাদের বসতে বলে নানান রকমের নাস্তা পানি এনে দেন। তারা এতক্ষনে বুঝতে পেরেছে হঠাৎ তার মা-বাবার এমন আচরন কেনো! কারন আলোক তার সাথে আছে। আর বড়লোক জামাই এর সামনে ওনারা খুব ভালো সাজছেন। অনেকক্ষণ যাবত আলোকের সাথে কথা বলছেন তারার বাবা মা। তারা চুপ করে গুটি মেরে বসে আছে। আলোক গেলেই হয়তো এনারা নিজেদের আসল রূপ দেখাবেন। দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। আজ বাড়িতে অনেক কিছু রান্না হয়েছে। নতুন জামাইয়ের আপায়ন করছে। আলোক কে কোমল কন্ঠে খাওয়ার জন্য ডাকলো নীলিমা। আলোক তারা কে খুঁজছে। তারা বাহিরে গেছে। শৈশবের স্থান। এতদিন পর এসেছে তাই বাহিরে গেছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়িতে আসলো তারা। এসে খাওয়ার টেবিলে গেল পানি খেতে। নিজের তৃপ্তি পরিমান পানি খেয়ে চেয়ার টেনে বসলো। কিছুক্ষণ পর আবার পানি গ্লাসটা হাতে নিল।

‘ আগেই খেতে বসেছিস?’

পাশ থেকে কারো ঝংকার কন্ঠের আওয়াজ শুনে গ্লাসটা রেখে দাঁড়িয়ে যায় তারা। তাকিয়ে দেখে তার মা। নিলিমা সামনে এগোলো।

‘ আগেই খেয়ে বসেছিস খাইনী?’

‘ বিয়ে হয়েছে তোর। স্বামীকে ছেড়েই খেতে বসেছিস নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার।’

কথাগুলো শুনে তারার চোখ ছলছলে করতে লাগলো। আসলে তার মায়ের চিন্তা ভাবনা এমন। ছোট থেকেই দেখে আসছে তার মা তার বাবা খাওয়ার পড়ে খায়। দেখতে দেখতে আলোক চলে আসে। তারা নিজের চোখের কর্নিশের অশ্রুটুকু মুছে নেয়। আলোকের দিকে অসহায় দৃষ্টিপাত দেয়। আলোক কে তো রাতে সব বলেছিল তবুও আলোক কেনো নিয়ে এলো?মর্মবিদ্ধ হরিণী ব্যাধের দিকে যেভাবে তাকায়, নীরবে বলতে থাকে ‘সব জেনেও আমাকে কেনো নিয়ে আসলে আলোক?’। সামনে তাকাতেই তারার আঁখিপল্লব হতে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুজল। আলোক কে নীলিমা খাবার বেড়ে দিচ্ছে সাথে নীলিমা কথাও বলছে তাই আলোকের দৃষ্টিপাত তারার থেকে সরে যায়। তারা আর থাকল না সেখান থেকে কয়েক পা এগিয়ে আসতেই আলোক কোমল কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসলো,

‘ তারা? কোথায় যাচ্ছো?’

তারা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিলো। আলোক হাতে লোকমা নিয়ে খেতে যাবে এমন সময় তারাকে ডেকে উঠে। তারা হাসিমুখে বলে,

‘ ঘ্_ঘরে_ঘরে যাচ্ছি।’

‘ খেয়েছো?’

তারা মাথা তার মায়ের দিকে তাকায় তারপর কথা নাড়িয়ে ‘না’ বলে। পরক্ষণে আলোক জোড় কণ্ঠে বলে,

‘ আসো বসো। না খেয়ে যাচ্ছো কোথায়?’

তারা আটকা কন্ঠে বলে,

‘ আম্_আমি পর্_পরে খাবো। তু_তুমি খাও।’

তারার মা তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো। কারণ তারা আলোলকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছে। আলোক কড়া কণ্ঠে বললো,

‘ পড়ে একাই কেনো খাবা? আমার সাথে খাও। আসো।’

তারা তার মায়ের দিকে তাকালো।

‘ আসো।’

তারা হাতে হাত রেখে ভাবতে লাগছে কি করবে।

‘ তারা?’

‘হু..’

‘ আসো।’

তারা আর কিছু না বলে ধীর পায়ে এগোলো। তারপর চেয়ার টেনে বসলো। প্লেট নিয়ে খেয়ে যাবে এমন সময় আলোক বললো,

‘ তুমি আমার এখান থেকে খাও। আমি এখনো খাইনি। তাছাড়া এতগুলো খেতে পারবো না।’

বলে তারার সামনে খাবারের লোকমা তুলে দিলো। স্ত্রী কে আগে খাইয়ে নিজে খাওয়া সুন্নাত। আলোক ধরে আছে কিন্তু তারা খায়নি। তারা আলোকের দিকে তাকাতেই আলোক ইশারায় খেতে বললো তারপর তারা হা করে খেল। তারা মা ভিতরে চলে যেতেই তারা বললো,

‘ তুমিও খাও। নাকি আমার এটো বলে খাবে না?’

তারার কথায় আলোক হেসে নিজেও খেল। এভাবেই আস্তে আস্তে ওরা দুজন খাইয়া শেষ করলো।

___________________

এশার নামাজ পড়ে আলোক চলে যাবে। তারা নিজের ঘরে পায়চারি দিচ্ছে। ভয়ে, টেনশনে কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না। এতক্ষণ আলোক আছে বলে সব ঠিক কিন্তু চলে গেলে কি হবে? তারার এইসব ভেবে মাথা ব্যাথা করছে। কিছুক্ষন পর তারা নিজের বাবার কর্কশ কণ্ঠের আওয়াজ পেল। তাকে জোড়ে জোরে ডাকছে। তারার বের হওয়ার সাহস নেই। তাহলে কি আলোক তাকে রেখে গেলো? বলার সত্ত্বেও আলোক এমন করলো? কিন্তু কেনো? তারার ভেবে কান্না পাচ্ছে। তারা আস্তে আস্তে দরজা খুলে বের করতেই তার বাবা তাকে টেনে সামনে আনলো। তারপর রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

‘ তুই নাকি আলোকের সাথে থাকতে চাস না।’

তারা জোরে জোড়ে শ্বাস ফেলে। এখন তারা বাবাকে কিভাবে সবকিছু বলবে? তবুও তারা বলার প্রয়াস চালায়।

‘ বা_বাবা_আম_

‘ হ্যাঁ বা না এ উত্তর দে। বলেছিস কিনা!’

এখন তারা কি বলবে! সে তো চেয়েছিল কিন্তু কোন অবস্থা , পরিস্থিতিতে চেয়েছে সেটা কিভাবে বলবে? আর তার বাবা তো শুনবেন ও না।

‘ বাব্_

তারার বাবা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

‘ আমি বলেছি হ্যাঁ বা না এ উত্তর দিতে।

বলে এক হাত দিয়ে তারার বাহু শক্ত করে ধরলেন। ব্যাথায় তারা কুকড়ে উঠলো আর বলে দিল,

‘ হ_ হ্যাঁ আমি বলেছি।’

তারার বাবা তার বাহু ছেড়ে চেঁচিয়ে বললো,

‘ তোর খুব সাহস বেড়েছে তাইনা? আজ দেখছি।’

বলে থাপ্পর মারার জন্য হাত উঠলেন। তারা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ গেলে থাপ্পর তার গালে পড়লো না। তারা পিটপিট করে তাকালো। আলোক কে দেখতেই মনে এক প্রশান্তি লাগলো। তারার ইচ্ছে করছে আলোক জড়িয়ে ধরে বলতে তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে।

‘ ক্ষমা করবেন আপনার এভাবে হাত ধরার জন্য।’

তারার বাবা নিজের হাত নামিয়ে আচমকা হাসতে শুরু করলো। তারপর ধাতস্থ করে বললেন হাসি মুখে বলার চেষ্টা করলেন,

‘ তুম_তুমি_ তুমি যাওনি?’

আলোক মৃদু হেসে বললো,

‘ না নামাজে গেছিলাম।’

তারার বাবা আটকা কন্ঠে বললেন,

‘ তুমি তো আজই যাবে বলেছিলে?’

‘ হ্যাঁ। এখন যাবো।'[ তারার দিকে তাকিয়ে]

তারা ছলছলে নয়নে তাকিয়ে আছে।

‘ তারাকে নিয়ে।’

কোথায় শুনে তারা বড়বড় চোখ করে তাকাল। স্বস্তির শ্বাস ফেলল। আলোক তারাকে ডাকলো। তারা তার কাছে গেলো। আলোক যাওয়ার আগে বললো,

‘ আপনি আমার বয়সের বড়ো হবেন। আমার বাবার বয়সে। জানি না আপনাকে বলা ঠিক হবে কিনা তবুও বলছি।’

‘ নিজের মেয়েকে ভালোবাসুন। এভাবে তার উপর অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম করা বন্ধ করুন। এগুলো আপনার জাহান্নামের যাওয়ার কারণ হবে।’

তারা মনে তাচ্ছিল্য হচ্ছে। আলোক কাকে কি বলছে। যে লোক নামাজ ই ঠিক মত পড়ে না তার এইসবের আবার ভয় থাকবে!

‘ আর হ্যাঁ তারা আপনার মেয়ে হলেও এখন ও স্ত্রী! আমার অধিকারে। আপনার থেকে ওর উপর আমার বেশি অধিকার। তাই ওর গায়ে হাত তোলার আগে ভাববেন। জানি ছোট থেকে আপনারা ওকে বড়ো করে তুলেছেন। কিন্তু মাথায় রাখবেন আপনার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আর সে অন্যের বাড়ির মেয়ে। তাই অকারণে মারার আগে ভাববেন। আমার কোনো আচরণে কিংবা কথায় কষ্ট লাগলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ভালো থাকবেন ইন শা আল্লাহ্। চলি। আসসালমুআলাইকুম।’

শেষোক্ত কথায় আলোক তারার হাত ধরে হাঁটা শুরু করে। তারা পিছনে তাকিয়ে তার মা বাবার দিকে ছলছলে দৃষ্টিতে তাকায়। বেশির ভাগ মেয়েই তার বাপের বাড়ি আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে! অনেক দিন থাকতে চায়। কিন্তু সে! তার ভাগ্যটা কেমন ব্যাতিক্রম!

তারপর গাড়িতে উঠতেই আলোক স্টার্ট দেয়। কিছুটা এগতেই তারা বলে উঠে,

‘ আমার বোরকা,নিকা__

আলোক স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘ আমরা তো গাড়িতে যাচ্ছি। আর এখন রাত কোথাও নামবও না। আশেপাশে আমি ব্যতীত দেখার মতন কেউ নেই তাই সমস্যা নেই।’

‘ কিন্তু ওটা রেখে আসলে আমি পরে পড়বো কি?’

‘ সমস্যা নেই। নতুন কিনে দিবো।’

তারা আর কোনো শব্দ করলো না। এই মুহূর্তে তার মন খারাপ। নিরবতা কেটে তারা আলোক কে বললো,

‘ আচ্ছা? আমি যে তোমার সাথে থাকতে চাইতাম না এগুলো কি আপনি ওনাদের বলেছিলেন?

আলোক হতভম্ব হয়ে তারার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে ‘না’ বললো।’

তারার প্রতত্তরে কিছু বলল না। তারা ভাবছে তাহলে তার বাবা মাকে কে জানালো? আশা কি হতে পারে? কিন্তু আশা তো তারালোকের ব্যাপারে এইসব জানে না। তাহলে তো সম্ভবনা নেই! তাহলে ওনারা জানলো কিভাবে। তারা এইসব ভাবতে ভাবতে মাথাটাকে হেলান দিলো জানালার ধারে।কিছুটা পথ গিয়ে আলোক শুধু এক’দুবার তারাকে ডাকলো। কিন্তু তারার সাড়া দিলো না হয়তো ঘুমিয়ে গেছে।

_________________

সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে তারালোকের সম্পর্ক টা কেমন তিক্ত হয়ে গেছে। তারা কয়েকদিন যাবত অসুস্থ তবে আলোকের উপর ক্ষুণ্ন হয়ে আছে। তারা সবসময় চেষ্টা করে নিজেকে আলোকের কাছাকাছি রাখার কিন্তু আলোক তাকে তুমুল ব্যস্ত রাখে সারাদিন শুয়ে আর রেস্ট করার জন্য। তারার ইদানিং কেনো জানি মনে হয় আলোক শুধু দায়িত্বের খাতিরে তারার সাথে থাকছে। কারণ আলোক অত্যন্ত ভালো, সৎ, ঈমানদার মানুষ। তাই হয়তো নিজের মনের বিপক্ষে গিয়ে তারার সাথে থাকছে। আলোক হয়তো নিজের সব দিক দিয়ে বেস্ট ট্রাই করছে কিন্তু তবুও হয়তো মনের দিক দিয়ে পারছে না। আর তারা আলোকের অতীতে শুনেছিল, আলোক চাঁদকে এতটাই ভালোবাসতো যে বাচ্চার খাতিরে সে দ্বিতীয় বিয়ে করে নি। আর বলেও ছিল সে কখনোই চাঁদের মত কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। হয়তো আলোক তারাকেও ভালোবাসতে পারে নি। তারার এমনটা ধারণা! তারা অসুস্থ এই বাহানায় হয়তো আলোক নিজের থেকে তাকে দূরে রাখছে এমনটা তারার মনে হয়।
তবে এর জন্য তারা নিজের উপর ভিষণ ক্ষুব্ধ! কারণ তারার মনে হয় সে জোরপূর্বক আলোকের উপর চেপে বসেছে। তারা এখন কেমন হয়ে গেছে। আগের মত চঞ্চলতা, হাসিখুশি নেই। সেই আগের মতন সেই দুঃখিনী হয়ে গেছে। কথাই বলেনা আর! কেমন চুপচাপ আর মনমরা হয়ে গিয়েছে।

আলোক ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে চুপচাপ। তার মা-বাবা আসার কথা ছিল অনেক আগেই। কিন্তু হঠাৎ করে আশার আপন কেউ অ্যাকসিডেন্ট করায় আসতে করে নি।

‘ আলোক?’

আলোক চটজলদি পিছন তাকায়। তারা কেমন মনমরা হয়ে তাকিয়ে আছে। আলোক শান্ত গলায় বলে,

‘ তারা? তুমি?’

তারা এগিয়ে এসে রেলিং ধরলো। আলোক তারার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল,

‘ তারা? তোমার কিছু লাগবে? এভাবে উঠে আসলে কেনো? কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে বলো।’

তারা চট করে বলে ফেলে,

‘ আপনাকে লাগবে।’

আলোক তারার কথা শুনে একটু চমকে। তবে আলোক এরি মধ্যে লক্ষ্য করেছে তারা যখন খুব কষ্ট কিংবা তার মন খারাপ থাকে তখন তাকে ‘আপনি’ করে সম্বোধন করে। কিন্তু তারার কারণে মন খারাপ আলোক ঠিক বুঝে উঠতে পারল না সাথে তারার কথার মানে তাও।

‘ আমাকে লাগবে? আমি তো আছিই।’

তারা কেমন তুচ্ছ হাসলো। তারপর সামনে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বললো,

‘ নিজের মনের উপর জোড় দিয়ে কেন আমার সাথে থাকছেন?’

আলোক বুঝে উঠতে পারলো না।

‘ মানে? নিজের মনের উপর জোর! কিসব বলছো তারা?’

তারা স্থির হয়ে আলোকের দিকে দৃষ্টিপাত দিল। তারপর শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ আপনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। আপনার মত মানুষ হয়তো খুব কম আছে আলোক। এতকিছু করার পরেও ধৈর্য্য সহকারে আমাকে রেখেছেন। তাছাড়াও একজন মানুষ, একজন ছেলে, একজন হাসব্যান্ড হিসেবে আপনি আদর্শ! আমার পরিপেক্ষিতে আপনি আদর্শ একজন মানুষ। আমি জানি না আমি যেগুলো আজ বলছি আর বলবো সেগুলো সঠিক কিনা তবুও না বলে থাকতে পারছি না।’

তারা রেলিং ছেড়ে আলোকের সাথে সামনাসামনি হয়ে দাঁড়ালো। তারার চোখের কার্নিশে নোনা পানি জমেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক কষ্ট নিয়ে কথা বলছে।

‘ আপনি হয়তো আমাকে ভালোবাসেন না। শুধু দায়িত্বের খাতিরে আমাকে রেখেছেন! আমার দেখাশুনা, খেয়াল রাখছেন। কিন্তু এর মধ্যে আমি ভালোবাসার গন্ধ পাইনা আলোক। আমার মনে হয় আমি আপনাকে জোরপূর্বক আমার সাথে বেধে রাখছি। আপনার অনিচ্ছায় আপনার সাথে থাকছি। আর বিচারা আপনি নিরুপায় হয়ে থাকছেন। কারণ আপনি হয়তো ভাবছেন আপনি ছাড়া আমার তো কেউ নেই! আমার নিজের বাবা মা তো অন্যরকম! তাই হয়তো আপনি কোনো স্টেপ নিতে পারছেন না। কিন্তু প্লিজ! আপনি নির্দ্বিধায় বলুন। আমার চিন্তা করবেন না যে, আপনি আমি আলাদা গেলে আমি কোথায় যাবো! আমার কি হবে!’

বলে তারা একটু হাসলো। কিন্তু আঁখিপল্লবে তার অশ্রু। তারপর তারা রসিকতা নিয়ে বললো,

‘ যে মোহরানা দিয়েছেন সেটা দিয়ে চলতে পারব ইন শা আল্লাহ্।’

তারপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

‘ আপনি আমার সাথে থাকতে না চাইলে আমি জোড়জবরদস্তি করে আপনার সাথে থাকবো না। আমি আপনার কাছে এক্ষনি উত্তর চাচ্ছি না। আপনি আজ পুরো রাত ভাবুক কিন্তু নিজের মনের উপর জোর দিয়ে কিছু বলবেন না প্লিজ।’

তারপর তারা চোখ বন্ধ করে দিতে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে অনেক কষ্ট সহকারে বলার চেষ্টা করলো,

‘ আপনি যদি ভালো না বাসেন তবে কালকে সকালেই আমরা lawer এর কাছে যাবো। আপনি প্লিজ নিজের মনের উপর জোড় দিয়ে কিছু বলবেন না।’

বলে তারা চলে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আলোক বলার মত কিছু পাচ্ছে মা। তার বাকশক্তি লোপ পেয়েছে।

আলোক কি বলবে ভেবে তার ভয় লাগছে। যদি সত্যি তার কথা মতই আলোক তাকে সত্যি ভালো না বাসে। কিন্তু তারা তো আলোক কে ভালোবাসে। অনেক ভালোবাসে। মুখে তো খুব সহজেই বলে দিলো কিন্তু আদৌ কি সে পারবে আলোকবিহীন থাকতে? আলোক তো তার নামের মতই তারার জীবনে যেনো আলো নিয়ে আসছিল। কিন্তু প্রথমত তারা বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছে।

________________

ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁই ছুঁই! আলোকের দৃষ্টিপাত তারার কোমল মুখশ্রীতে। দীর্ঘক্ষণ দৃষ্টিপাতের পর আলোক তপ্তশ্বাস ফেলে! আসলেই কি সে তারাকে ভালবাসে না? তারার উপর কি সত্যি সে দায়িত্ব পালন করছে? আলোক তার হাত বুকের বা’পাশে রাখল। তারপর চোখ বন্ধ করলো আসলেই কি তাই? বোঝার জন্য! তারপর চোখ খুললো। কই তার তো এমন মনে হচ্ছে না তাহলে তারার কেনো এমন মনে হলো? আলোক তারার দিকে আবার তাকালো । এতক্ষণ ওপাশ ঘুরে ছিল তারা এখন এদিকে তাকিয়েছে ঘুমে। আলোক স্নিগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কান্নার ছাপা ছাপা মুখে লেগে গেছে। কেমন বিষন্নতার ছাপ ফুটে উঠেছে। আলোকের কাছে তারাকে কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগে। কারণ তারার স্বভাব,আচার আচরণ, কথাবার্তা আলোকের কাছে ইমম্যাচিউরেট মনে হয়। পরিশেষে আলোক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সামনে তাকিয়ে রেলিং ধরে তারপর খোলা আকাশের দিকে তাকায়। শুক্লাদ্বাদশীর রাত। আকাশে চাঁদ উঠেছে সাথে অসংখ্য তারা। মনে হচ্ছে যেন এই গভীর রাতে চাঁদ, তারা পুরো শহর কে পাহারা দিচ্ছে। আলোক স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ চাঁদ তারার মাঝে আটকা পড়েছি।’

রাত্রির এ মেঘাছন্ন ডাকা তারার আলো
অন্ধকার চারিপাশে,
রাতের লাজুকতায় সে রয়েছে
অবিন্যস্ত ক্যানভাসে!
_______তানজিলা

কিন্তু ‘সে’ টা ঠিক কে তা আলোক বুঝে উঠতে পারছে না। কি করবে তাও জানে না। পরিশেষে আলোক ভাবলো তার কর্মেই তারার মনে এইসব ভাবনা আশ্রয় পেয়েছে। অনেক্ষন ভাবার পর আলোক ঘরে ঢুকে তারার সামনে ফ্লোরে হাঁটু ভেঙ্গে বসে তার মাথায় হাত বুলালো। তারপর কপালে একটা আলতো করে কিস করে ওয়াশরুমে গেল।

চোখ বন্ধ করে হাসি মুখে পাশের বালিশটাকে জরিয়ে ধরলো তারা। এই মুহূর্তে তার খুব খুশি লাগছে। আলোক তার কপালে কিস করলো তার মানে আলোক তাকে ভালোবাসে। জি মুহূর্তে তারার ইচ্ছে করছে বিছানার উপর দাঁড়িয়ে নাচছে কিন্তু আফসোস তা করতে পারবে না।তারা এখনো চোখ খুলে নি। চোখ হতে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে পড়তে সে চোখ খুলল আর মুখে বিড়বিড় করে বলল, ‘ আই লাভ ইউ আলোক। আই লাভ ইউ সো মাচ।’ তারপর তারা খুশিতে আহ্লাদী হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

________________

সকালে আলোকের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে তারার। কিন্তু উঠে যে আলোক এমন কিছু বলবে তা তারার ভাবতে পারে নি। আজ ফজরেও উঠতে পারে নি তারা সাথে নামাজ ও পড়তে পারে নি। কিন্তু আলোকের বলা কথায় যেনো তার ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। তাহলে কালকে রাতে তারার ধারণা ভুল! মানে আলোক সত্যি তাকে__! ভেবেই তারার খুব কান্না পাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে তারা আলোকের দেখা পায়নি। কিছুক্ষন পর আলোক কোথা থেকে এসেই তারাকে গম্ভীর কণ্ঠে বলেছে রেডি হতে। তারা কাল রাতে আলোক কে বলেছিল যদি আলোক তাকে ভালো না বাসে তবে ওরা সকালেই lawer এর কাছে যাবে। তাহলে সত্যি কি আলোক ভালোবাসেনি? এরপর কতদূর পৌঁছাবে তারালোকের সম্পর্ক?

#চলবে….
#Tanju