পূর্ণিমাতিথি পর্ব-২৫+২৬

0
751

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-২৫

মাথার ওপর কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে ওঠলাম। সজাগ হয়ে নিজের মাথায় কারো হাতের উপস্থিতি অনুভব করতে ব্যর্থ হলাম। আশেপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখলাম কেউ নেই। উনি তো বাসায় নেই। আজকে উনার হসপিটালে নাইট সিফটে ডিউটি। নিজের মনের ভুল ভেবে আবার শুয়ে পড়ি। বাকি রাত আর দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। রেজাল্ট নিয়ে ভীষণ টেনশন হচ্ছে। আগামীকালের রেজাল্টের ওপর নির্ভর করবে আমার স্বপ্ন পুরণ হবে কী না।

_________________

ভোর রাতের দিকে রুদ্র বাসায় আসলো। আমি উনার সাথে কথা বললাম না। উনি উনার মতো ফ্রেশ হয়ে নিলেন। আমার মনটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। আজান দিতেই আমি ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নিলাম। উনি মসজিদে চলে গেলেন। নামাজ পড়লে পড়লে অশান্ত মনও শান্ত হয়ে যায়। অন্য রকম এক প্রশান্তি অনুভব হয়।

_____________

উনি মসজিদ থেকে এসেই শুয়ে পড়লেন। আমি নামাজ শেষে না শুয়ে ছাদে চলে এলাম। নামাজ পড়ার পর মনের অস্থিরতা অনেকটাই কেটে গেছে। সকালের নির্মল হাওয়া, শান্ত পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করে দিচ্ছে। একদিকে ভালো লাগা কাজ করছে আরেক দিকে টেনশন হচ্ছে। রেজাল্ট কি হবে এটার চিন্তাই মাথা ফেটে যাচ্ছে। যদি এ+ না আসে তাহলে আমার স্বপ্ন আর পুরণ হবে না।
ছাদে একটা দোলনা আছে। অবশ্য এই বাসার ছাদটা আমিই সাজিয়েছিলাম আমার মনের মতো করে। এই ছাদের প্রত্যেকটা গাছ আমার হাতে লাগানো। ফুলের পাশাপাশি ফলের গাছও রয়েছে। ফুল গাছের সংখ্যায় বেশি।

ছাদের রেলিংয়ের ওপর বসে পড়লাম। ফোনে টুং টাং শব্দ করে মেসেজ আসছে। মেসেজ দেখতে একদমি ইচ্ছে করছে না আর আমি জানি ত্রয়ী মেসেজ দিচ্ছে। এই মেয়েটা প্রত্যেকটা রেজাল্টের সময়ই এমন করে। ফোন দিয়ে মেসেজ করে আমাকে পাগল বানিয়ে দেয়। যতক্ষণ না রেজাল্ট দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত এমনি করবে।

_______________

৯ টার দিকে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসলাম। ড্রয়িংরুমে চাঁদের হাঁট বসেছে। আব্বু, আম্মু, ভাইয়া, রিদি আপু, নিয়াম ভাইয়া, নিধি আসছে। কিন্তু সবাইকে দেখে আমি মোটেও অবাক হলাম না। আমি জানতাম সবাই আসবে। যদি না আসতো তাহলে ভীষণ অবাক হতাম। কারণ এই মানুষগুলো আমার জীবনের এমন কোনো বিশেষ মুহূর্ত নেই যখন তারা আমার পাশে ছিল না।

ভাইয়া বেশ আয়েশ ভঙ্গিতে সোফায় বসে মিষ্টি খাচ্ছে। আমাকে দেখেই ভাইয়া বলে ওঠলো।

ঐ তো রিয়া চলে এসেছে আর কাউকে যেতে হবে না। রিয়ু এতো টেনশন করিস না। আয় এদিকে মিষ্টি খা। আমি জানি তুই ফেইল করবি।

আমি ভাইয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাই। তারপর আম্মুর দিকে তাকিয়ে ইনোসেন্ট মুখ করে বলি, আম্মু দেখো ভাইয়া কী বলছে?

আম্মু ভাইয়ার বাহুতে থাপ্পড় দিয়ে বলে, তুই আর ভালো হবি না? দেখছিস মেয়েটা টেনশন করছে। তার মাঝে তুই মেয়েটার পিছনে লাগছিস। আরেকবার কিছু বললে তোর খবর আছে।

এতো টেনশন করার কী আছে? ও জানে না ও কেমন পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা খারাপ দিয়েছে বলেই এতো টেনশন করছে। আমার পরীক্ষার রেজাল্টের সময় আমি কতো চিল মুডে ঘুরতাম।

রিদি আপু মাঝখান থেকে বলে ওঠে, কেমন যে চিল মুডে ঘুরে বেড়াতি আমাদের জানা আছে। পরীক্ষার রেজাল্টের আগের দিন থেকে রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতি। যতক্ষণ পর্যন্ত রেজাল্ট না দিতো ততক্ষণ দরজা বন্ধ করে বসে থাকতি। খালামনি যদি বলতো শাওন তুই এ+ পেয়েছিস তাহলেই তুই দরজা খুলতি। জেএসসি পরীক্ষার সময় কী কান্ডটা নায় ঘটিয়েছিলি। এখনো মনে পড়লে আমার হাসি পায়। রেজাল্টের দুই দিন আগে থেকে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে রুমে দরজা বন্ধ করে বসেছিলি। রেজাল্টের দিন সোজা গিয়ে পুকুরে নেমে পড়লি। তখন কী ভয়াবহ ঠান্ডা ছিল। কেউ বলেও তোকে আটকাতে পারেনি। জানিস রিয়া কেনো পানিতে নেমে ছিল। টেনশনে নাকি তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। মাথা ঠান্ডা করার জন্য আর টেনশন কমানোর জন্য সে পুকুরে নেমে গেছে। রেজাল্ট শুনেই অঙ্গান হয়ে গিয়েছিল। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া না করা শীতের মাঝে পানিতে ভিজার কারণে অঙ্গান হয়ে গিয়েছিল। রেজাল্ট নিয়ে আনন্দ করা রেখে সবাই শাওনকে নিয়ে হসপিটালে ছুটে।

রিদি আপুর কথা শেষ হতেই সবাই এক পতন হেসে নেয়। ভাইয়া মুখ কাঁচুমাচু করে বসে আছে। এতক্ষণ পরে নিয়াম ভাইয়া মুখ খুললেন,

রুদ্র কোথায়? আমরা এতো দূর থেকে চলে এলাম। রুদ্রর কোনো খবরই নাই। তার বউয়ের রেজাল্ট দিবে তারই পাত্তা নেই।

রিদি আপু নিয়াম ভাইয়াকে রাগ দেখিয়ে বলে, আমার ভাই তোমাদের মতো চাকরি করে না। তোমাদের মতো সারাদিন শুয়ে বসে টাকা পায় না। ওকে পরিশ্রম করতে হয়।

তুমি আমাকে অপমান করছো। তুমি আমাকে টো টো কম্পানির ম্যানাজার বলছো। আমিও কম পরিশ্রম করি না ওকে।

পরিশ্রম করোই তো শুধু শুধু বসে বসে অর্ডার করো। এটা করো, ওটা করো।

_______________

রেজাল্ট দিবে সাড়ে ১১টা নাগাদ। জানি রেজাল্ট হাতে পেতে পেতে ১২ টাই বেজে যাবে। উনি ঠিক সাড়ে ১১ টাই নিচে নামলেন। ১২ টা বাজতেই উনি আর ভাইয়া রেজাল্ট দেখতে বসে পড়লেন। টেনশনে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আমি একা ধারে পায়চারী করছি। অল্প কিছুক্ষণ পরেই ভাইয়া মুখ কালো করে আমার দিকে তাকায়। ভাইয়ার মুখ দেখে আমার বুকের ভিতর ধক করে ওঠে। আম্মু ভাইয়াকে জিঙ্গেস করে,

রেজাল্ট কী হয়ছে?

রিয়া ফেইল করছে।

কথাটা শুনেই আমি দু পা পিছিয়ে গেলাম। আমার চোখ জলে টই টুম্বুর হয়ে গেছে। আমি দৌড়ে রুমে চলে এলাম। পিছন থেকে ভাইয়া অনেক ডেকেছিল কিন্তু আমি শুনিনি। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। রাস্তা বের হলে সবাই বলবে রিয়া ফেইল করছে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না। আমি নিজের স্বপ্ন আব্বুর স্বপ্ন কারোর স্বপ্নই পুরণ করতে পারলাম না।

আমি রুমে এসে দরজা বন্ধ করতে নিলেই রুদ্র এসে বাধা দেয়। রুদ্র আমাকে ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে। উনি নিজেই দরজা বন্ধ করে দেন। আমার দুই গালে হাত রেখে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন,

বোকা মেয়ে শাওন ভাইয়া তো তোমার সাথে ফাজলামো করছিল। সবটা না শুনেই আগেই দৌড়ে চলে আসছো। তুমি ফেইল করো নাই। তুমি এ+ পেয়োছ।

কথাটা মস্তিষ্কে পৌছাতেই আমি উনার বুকে ঝাপিয়ে পড়লাম। উনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। উনি পরম মমতায় আমাকে উনার বুকে আগলে নিলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,

এখন কাঁদছো কেনো? এখন তো তোমার হাসার সময়। এই কান্না থামাও। সবাই ভাববে আমি তোমাকে মেরেছি তাই তুমি কান্না করছো। এখনি কিন্তু তোমার হিটলার বাপ আমার মাথা ফাটাতে আসবে।

আমি তো আনন্দে কাঁদছি। আমার স্বপ্নের পুরণের আরেকটা ধাপ পার করে ফেললাম। আমার স্বপ্নের খুব কাছে আমি চলে আসছি। এবার আমার স্বপ্ন পুরণ হবে তাই না?

হুম। তোমার নিজের ওপর বিশ্বাস নেই। কিন্তু আমার তোমার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল। আমি জানতাম তুমি সবার আশানুরূপ ফলাফল করবে।

______________

কিছুক্ষণ আগেই ইলান ভাইয়াদের বাসায় আসছি। আমার রেজাল্টের খবর শুনে রুনা আপু আর ইলান ভাইয়ার আম্মু ভীষণ খুশি হয়েছে। আন্টি তো আমাকে নিজের গলার চেইন খুলে পড়িয়ে দিয়েছেন। রুনা আপু আমার হাতে একটা বড় গিফট বক্স ধরিয়ে দিয়েছে। এটা নাকি ইলান ভাইয়া আমার জন্য কিনেছিল। আমার রেজাল্টের দিন দিবে বলে। রুনা আপু কাঁদছে। আমার চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

হুট করেই কলিংবেল বেজে ওঠলো। সবাইকে বলে আমি দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দরজার সামনে ইলান ভাইয়াকে দেখে থমকে গেলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না ইলান ভাইয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে……….

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-২৬

হুট করেই কলিংবেল বেজে ওঠলো। সবাইকে বলে আমি দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দরজার সামনে ইলান ভাইয়াকে দেখে থমকে গেলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না ইলান ভাইয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি ইলান ভাইয়ার দিকে। মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। ইলান ভাইয়া অনেকটা বিধস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ গালের পাশে তিনটা সিলি। আমাকে দরজার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুদ্র আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,

তুমি এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেনো? কে এসেছে?

রুদ্র দরজার সামনে ইলান ভাইয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্থির হয়ে গেলো। স্তব্ধ নয়ে অনিমেষ তাকিয়ে আছে ইলান ভাইয়ার দিকে। রুদ্র ইলান ভাইয়ার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিলো। উনার হাতটা অসম্ভব রকম কাঁপছে। ইলান ভাইয়াকে ছুঁতে গিয়েও ছুতে পারছে না।
উনার হাতটা থরথর করে কাঁপছে। ইলান ভাইয়া খপ করে রুদ্রর হাতটা ধরে ফেললেন।

আমি ইলান। তোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে ভিতরে আসতে দিবি না।

ইলান ভাইয়ার গলা শুনে ইতিমধ্যে রুনা আপু আর আন্টিও ছুটে এসেছে। দুজনেরই আঁখি অশ্রুতে টলমল করছে। শরীর দুর্বল থাকায় ইলান ভাইয়া পড়ে যেতে নেয়। পড়ে যাওয়ার আগেই রুদ্র ইলান ভাইয়াকে খপ করে ধরে ফেলে। ইলান ভাইয়া সবার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসে। ইলান ভাইয়ার মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ঠিক করে দাঁড়াতে পারছেন না কিন্তু উনার মুখে মুচকি হাসি লেগেই আছে। চোখ দুটো ছলছল করছে। হয়তো এতোদিন পর নিজের পরিবারের মানুষগুলোকে দেখে কেমন রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারছে না।

রুদ্র আর রুনা আপু ইলান ভাইয়াকে ধরে ধরে ভিতরে নিয়ে যায়। আমিও দরজা লাগিয়ে উনাদের পিছন পিছন আসি। ইলান ভাইয়াকে নিয়ে সোজা রুমে যান। ইলান ভাইয়াকে আধ শোয়া করে বিছানায় বসাতেই রুনা আপু আর আন্টি ঝাঁপিয়ে পড়ে ইলান ভাইয়ার বুকে। হু হু করে দুজন কেঁদে দেয়। ইলান ভাইয়া দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। এতো সহজে কী কান্না থামে? এতোদিনের জমে থাকা চোখের অশ্রু আজকে উপচে পড়ছে। রুনা আপু কান্না জড়িত কন্ঠে বলে,

এতোদিন তুমি কোথায় ছিলে? এই কয়েকটা দিন আমার আর মার কীভাবে কেটেছে তুমি জানো? তোমার হাতে পায়ে এতো আঘাত কেনো? কী হয়েছিল তোমার?

তোমরা কান্না বন্ধ করো প্লিজ। আমি তো ফিরে এসে। দেখো আমি একদম ঠিক আছি। হাত পায়ে একটু ছুট লেগেছে শুধু।

ইলান ভাইয়া অনেক কিছু বলে দুজনকে শান্ত করে। রুনা আপু বাচ্চাদের মতো বিহেইভ করছে। কতোদিন পর নিজের ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেলো। ইলান ভাইয়া রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে,

আমি আসাতে কী তুই খুশি হসনি? আমার থেকে এতো দূরে কেনো দাঁড়িয়ে আছিস?

রুদ্র গিয়ে ইলান ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে।

তুই নিজেও জানিস না তোকে ছাড়া আমার এতোগুলো দিন কীভাবে কেটেছে। প্রতিমুহূর্তে তোর স্মৃতি আমাকে তাড়া করেছে। যেদিন থেকে তোর সাথে আমার পরিচয় তারপর থেকে একটা দিনও আমি তোকে ছাড়া আমি থাকিনি। তোর মৃত্যুর খবর শুনে আমাদের কী অবস্থা হয়েছিল ভাবতে পারছিস?

মানে? আমার মৃত্যুর মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

রুদ্র ইলান ভাইয়াকে সব কিছু খুলে বলে।

ঐ দিন তোর সাথে যখন আমি ফোনে কথা বলছিলাম ঠিক তখনি একটা গাড়ি আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। আমার হাত থেকে ফোনটা ছিটকে পড়ে যায় আর আমি মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে যাই। চোখ জোড়া বন্ধ হওয়ার আগে দেখতে পাই কয়েক জোড়া পা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তারপর যখন চোখ খুলি নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করি। কতদিন পর ঙ্গান ফিরেছিল সেটা বলতে পারব না। কিন্তু বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখতে পারিনি। যাস্ট এক পলক হসপিটালটা দেখতে পাই। পরের বার যখন চোখ মেলে তাকাই তখন নিজেকে গুদাম ঘরের মতো একটা জায়গায় আবিষ্কার করি। আমাকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল। চারপাশে ছিল ভাঙা জিনিস পত্র। বাইরে থেকে আসা আগন্তুকদের কন্ঠে শুনে বুঝতে পেরেছিলাম তারা বেশ কয়েকজন মিলে আমাকে পাহাড়ে দিচ্ছে আর আমাকে হসপিটাল থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসা হয়েছে। দিনে এক থেকে দুই বার খাবার দিতো। খাবারের দিতে আসলেই অল্প কিছুক্ষণের জন্য হা-পা খুলে দিতো। আজকে সুযোগ বুঝে সেখান থেকে পালিয়ে আসি।

তুই জানিস তোকে কে ওখানে আটকে রেখেছিল বা তাকে দেখেছিলি?

না। কে আমাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল বা কার কথায় আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল কিছুই আমি জানি না।

আমি একটু আসছি। তুমি এখানেই থেকো, এখান থেকে কোথাও যাবে না। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব। একদম পাকনামি করে একা যাওয়ার চেষ্টা করবে না। আমি ডক্টরকে ফোন করে দিবো। ডক্টর এসে ইলানকে দেখে যাবে।

উনি আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে চলে গেলেন। ইলান ভাইয়া নড়েচড়ে বসে বলে,

আজকে কয় তারিখ? আমি ঠিক আন্দাজ করতে পারছি না আজকে কয় তারিখ। আমি কয়দিন অঙ্গান ছিলাম সেটাও জানি না।

আমি ফট করে বলে ওঠি, তেরো তারিখ।

তার মানে আজকে তোমার রেজাল্ট দিয়েছে। কংগ্রেস।

আমার রেজাল্ট না শুনেই আপনি আমাকে কংগ্রেস করছেন?

আমি জানি তুমি ভালো রেজাল্ট করেছো। তুমি কখনো খারাপ রেজাল্ট করতেই পারো না। রুনা রিয়াকে আমার আনা গিফটটা দিয়েছো।

রুনা আপু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আমি আর আন্টি ইলান ভাইয়া আর রুনা আপুকে স্পেস দিয়ে চলে যাই। রুদ্র ডক্টরকে ফোন করে দিয়েছে আর কিছুক্ষণের মাঝেই ডক্টর চলে আসবে রুদ্র আমাকে মেসেজ করে দিয়েছে।

_______________

বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিলো পিছে
বসন্ত এসে গেছে……..

পাশের বাসা থেকে রিন রিনে সাউন্ডে গান ভেসে আসছে। পাশের বাসায় কখনোই উচ্চস্বরে গান বাজায় না। আজকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি। একদিকে ভেলেন্টাইন্স ডে আরেক দিকে পহেলা ফাল্গুন। আর আমি বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে বসে আছি। আগামীকাল পরীক্ষা আছে কোচিংয়ে। ভেলেন্টাইন্স ডে নিয়ে আমার কখনোই উচ্ছ্বাস ছিল না। আমার মতে ভালোবাসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিনের প্রয়োজন হয় না। ভালোবাসার মানুষটা ভালোবেসে পাশে থাকলে প্রত্যেকটা মুহূর্তই ভেলেন্টাইন্স ডে হয়ে ওঠে।

আমার যত উচ্ছ্বাস হচ্ছে পহেলা ফাল্গুন নিয়ে। পহেলা ফাল্গুন আর পহেলা বৈশাখের জন্য আমি প্রত্যেক বছরই অপেক্ষা করে থাকি। বান্ধবীদের সাথে শাড়ী পড়ে ঘুরে বেড়াই। রিকশা করে ঢাকা শহরের অলি গলি ঘুরে বেড়াই। হাসানের নতুন বছর নতুন গার্লফ্রেন্ড পাওয়ার ট্রিট। এবার হয়তো আর হাসানের কাছ থেকে ট্রিট পাওয়া হবে না। হাসান আমাদের থেকে দূরে সেই কমলা কান্দা অবস্থান করছে। আমার সব ফ্রেন্ডরা যে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চাইলেও সবাই একসাথে হওয়া সম্ভব না। যদিও সবাই আসে তবুও ডাক্তারবাবু আমাকে যেতে দিবেন না। উনি তো আমাকে বাসা থেকে এক পা একা হাঁটতে দিবেন না। আর উনি নিজেও আমাকে নিয়ে যাবেন না।

আমার স্বপ্ন ছিল বিয়ের পর প্রথম বসন্তে আমার হাজবেন্ডের হাতে হাত রেখে ঢাকা শহরের অলি গলি হেঁটে বেড়াবো। আমি বাসন্তী কালার শাড়ি পড়বো আর উনি বাসন্তী কালার পাঞ্জাবি। উনি আমার খোপায় বেলি ফুলের মালা জড়িয়ে দিবেন। কিন্তু ডাক্তারবাবু দ্বারা এসব জীবনেও সম্ভব না। উনি তো আস্ত একটা আনরোমান্টিক। রোমান্টিকের ‘র’ ও বুঝে না। এবার ফাল্গুন্টাইনটা হয়তো আমার বইয়ের সাথেই পালন করতে হবে। আহা এতো দুঃখ আমি কই রাখি?

আমি যখন দুঃখ বিলাস করতে ব্যস্ত তখনি রুদ্রের আগমন ঘটে। পড়া রেখে আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে রুদ্র আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে,

কী সমস্যা? পড়া রেখে মুখটা এমন করে রেখেছো কেনো?

জীবনের এতগুলো বসন্ত কেটে গেলো কিন্তু কেউ বসন্ত বিলাস করতে নিয়ে গেলো না। এতো দুঃখ আমি কোথায় রাখব সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।

একটা বালতি এনে দেই সেটাই ভরে রাখ। যদি বালতিতে না হয় তাহলে একটা ড্রাম এনে দেই সেটাই তোমার দুঃখগুলো ভরে রাখ।

চলবে……..