পূর্ণিমাতিথি পর্ব-৫৭+৫৮

0
550

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৫৭

চোখ খোলার পর নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলাম। চোখ খোলার পর থেকে শুধু মনে পড়ছে তখনকার এক্সিডেন্টের কথা।প্রথমে রুদ্র গাড়ি সাইড করার চেষ্টা করলেও পরে শুধু আমার হাতটা চেপে ধরে ছিলেন। দুই পাশ থেকেই গাড়ি আসছিল। চোখের সামনে নিজেদের মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিলাম। ট্রাকটা আমাদের গাড়ি ধাক্কা দেওয়ার আগ মুহূর্তে আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে রুদ্রর হাত খামছে ধরেছিলাম। পরে কয়েক মুহূর্ত কেটেছিল শুধু অসহ্য যন্ত্রণায়। তারপর আর কিছু মনে নাই।

বেবির কথা মাথায় আসতেই আমি তড়িৎগতিতে ওঠে বসলাম। পেটে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলাম। পেটে হাত দিতেই আমি চমকে ওঠলাম। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। নিস্তব্ধ পরিবেশে শুধু কেবিনের দরজার খোলার আওয়াজ হলো। গুটি কয়েক মানুষ কেবিনের ভিতর প্রবেশ করলো। তাদের দেখার কোনো ইচ্ছে আমার হলো না। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের পেটের দিকে। তখনি কিছু কথা আমার কর্ণগোচর হলো,

আহারে মেয়েটার বয়সই বা কী হলো? একসাথে এতো শক নিতে পারবে। এক্সিডেন্টে নিজের সন্তান হারালো। স্বামীটারও এখনো ঙ্গান ফিরে নাই। আদৌ বাঁচবে নাকি তা কোনো আশা ডক্টর দেখছে না। এখন যদি স্বামীটাও
মারা যায়।

আহারে মেয়েটা এই অল্প বয়সেই এতো কিছু হারালো।

বার বার আমার কানে একটা কথায় প্রতিধ্বনি হচ্ছে। এক্সিডেন্টে নিজের সন্তান হারালো। স্বামীটারও এখনো ঙ্গান ফিরে নাই। আমার সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠলো। হুট করে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।

না না আমার রুদ্রর কিছু হতে পারে না। উনি আমাকে ছেড়ে যেতে পারেন না।

বেড থেকে নামতে গেলেই ত্রয়ী আর আম্মু আমাকে ধরে ফেললো। ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করতে লাগলাম। অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছি। ত্রয়ী আর আম্মুর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছি না। হুট করেই আমি হিংস্র হয়ে ওঠলাম। দিক বেদিক শূন্য হয়ে ত্রয়ী হাতে কামড় বসিয়ে দিলাম। ব্যথা পেয়ে ত্রয়ী আমাকে ছেড়ে দিল। আম্মুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম।

মাখায় অসহ্য যন্ত্রণা, পেটে সূক্ষ্ম ব্যথা নিয়েই ছুটলাম। কেবিনের দরজা খুলতেই বহুল কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতে পেলাম। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ। আমি উনার বুকে ঝাপিয়ে পড়লাম। উনি ঠাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেলেন কয়েক পা। উনার পিঠ ঠেকলো দেয়ালে উনি মৃদু আর্তনাদ করে ওঠলেন। কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই। আমি উনার পিঠ খামছে ধরে বললাম,

রুদ্র আমাদের বাচ্চা…….আমাদের বাচ্চা আর নেই।

আমি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলাম। উনার চোখের পানি দিয়ে আমার কাঁদ ভিজে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে ঙ্গান হারিয়ে উনার বুকে লুটিয়ে পড়ি।

_________________

তুমি আমার কাছ থেকে আমার রুদ্রকে কেড়ে নিয়েছ আমি তোমার কাছ থেকে তোমার বাচ্চাকে কেড়ে নিলাম।

অরি আপু এমন করবেন না। আমার বাচ্চাটাকে আমাকে ফিরিয়ে দিন না। দেখুন ও কীভাবে কাঁদছে? ওর এখন আমাকে ওর মাকে প্রয়োজন।

আমি ওকে কোনোদিন তোমার কাছে দিব না। ওর তোমার কোনো প্রয়োজন নেই। ওর জন্য আমি একাই যথেষ্ট। এই বাচ্চাটা শুধু আমার।

আমার শত আকুতি মিনতি উনি শুনলেন না। আস্তে আস্তে উনি পিছিয়ে যাচ্ছেন। এক সময় অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন।

আমি চিৎকার করে ডাকলাম কিন্তু অরি আপু শুনলো না। আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে গেলো।

এই রিয়া কী হয়েছে? তুমি এমন করছো কেনো?

রুদ্রর ডাক শুনে আমি তাড়াতাড়ি ওঠে বসলাম। হুট করে আমার মনে পড়লো বাচ্চার কথা।

রুদ্র আমার বাচ্চা কোথায়? আমার বাচ্চাকে এনে দিন। আমার বাচ্চাকে নিয়ে অরি আপু চলে যাচ্ছে। আপনি অরি আপুকে আটকান।

আচমকা রুদ্র আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমাকে শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলেন,

কেনো পাগলামু করছো? আমাদের বাচ্চা আর নেই। প্লিজ শান্ত হও। তুমি এমন করলে আমি কীভাবে থাকবো? একজনকে হারিয়েছি
তুমি এমন করলে আমি কীভাবে বাঁচবো?

রুদ্রর অন্য কথাগুলো কর্ণপাত নাহলেও একজনকে হারিয়েছি কথাটা মস্তিষ্কে তীরের মতো বিধলো। একজনকে হারিয়েছি উনি অরি আপুকে হারিয়ে ফেলেছেন সেটার কথা বুঝাতে চাইছেন। আমার সাথে উনি অরি আপুর তুলনা করছেন। আমার বিদ্বেষী মন এটা মানতো পারলো না। আমি ভয়ঙ্কর একটা কাজ করে বসলাম। ধাক্কা দিয়ে রুদ্রকে আমি নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলাম। পাশেই ফল কাটার চাকু ছিল। চাকুটা নিয়ে ডান হাতের শিরা বরাবর টান দিলাম। আরেকটা টান দেওয়ার আগেই রুদ্র আমার হাত থেকে চাকুটা কেড়ে নিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে নার্সদের ডাকতে শুরু করলেন। আমি নিস্তেজ গলায় বললাম,

যার জীবনে আমার মূল্য নেই তার জীবনে আমি থাকতে চাই না। আপনার জীবনেও আমার মুল্য আর সবার মতোই। আমি থাকব না আপনার কাছে। আমি আপনার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাব। আমি আমার সন্তানের কাছে চলে যাব।

এক সময় আমার শরীর অবশ হয়ে এলো। নিস্তেজ হয়ে উনার বুকে ঢলে পড়লাম।

________________

কেটে গেছে একটা মাস। ত্রিশটা দিন। সবকিছুই আগের মতো স্বাভাবিক নিয়মে চললেও স্বাভাবিক হতে পারিনি আমি। শারীরিক ভাবে সুস্থ হলেও মানসিক ভাবে পুরোপুরি সুস্থ এখনো হয়ে ওঠেনি। এই এক মাসে বহু বার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছি। একবারও রুদ্রর জন্য সফল হতে পারিনি। আমাকে অনেক ডক্টর দেখিয়েছেন। এখন আগের মতো সুইসাইডের চেষ্টা না করলেও স্বাভাবিক হতে পারিনি।

ঠিক মতো কলেজে যাওয়া হয় না। সারাদিন নিজেকে রুম বন্দি করে রাখি। কারো সাথেই কথা বলি না। রুদ্র কিছু জিঙ্গেস করলে হু হা ছাড়া আর কোনো উত্তর দেই না। আমার চিন্তায় চিন্তায় আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রুদ্র আমার সাথে কথা বলতে চায় খুব করে চায়। কিন্তু আমি কাউকে এখন সহ্য করতে পারি না। ঠিক করে খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না।
খেতে গেলে মনে হয় কেউ বলছে আম্মু তুমি আমাকে না খাইয়ে নিজে খেয়ে ফেলছো। ঘুমুতে গেলে মনে হয় কেউ বলছে আম্মু তুমি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে না।

___________________

রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে বেলকনিতে বসেছিলাম। কাধে কারো ছোঁয়ে পেয়ে পিছনে তাকালাম। রুদ্র আমার সামনে এসে বসলেন। আমার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরলেন। আমি চোখ তুলে উনার দিকে তাকালাম। আজ এক মাস পর আমি উনাকে খেয়াল করলাম। গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। আগের মতো চেহারায় লাবণ্যতা নেই। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে উনি আগের থেকে অনেকটা শুকিয়ে গেছেন। উনাকে এমন অগোছালো আমি আগে দেখিনি।

তুমি কেনো এমন করছো রিয়া? আমার সাথে একটা বার কথা বলো না। আজ একটা মাস হয়ে গেলো তুমি আমার সাথে কথা বলো না। তুমি বুঝো না তোমার কথা না শুনলে আমার কষ্ট হয়। বুকের ভিতর ভয়ংকর ব্যথা হয়। জানো আমি সুস্থ হয়েও অসুস্থ। তুমি নামক অসুখে আমি অসুস্থ। আমি আসক্ত গভীর ভাবে আসক্ত তুমি নামক রমনীতে। ড্রাগসে আসক্ত লোকেরা যখন ড্রাগ না পাই তখন যেভাবে ছটফট করে তেমন আমিও ছটফট করি। তোমার মুখ থেকে একটা শব্দ শোনার জন্য। এই একটা মাস আমি দু চোখের পাতা এক করতে পারি নাই। প্রতিটা রাত আমার কেটেছে নির্ঘুম।

আমি বেবি চাই।

এটা সম্ভব না। আমি তোমার লাইফ নিয়ে তিল পরিমাণ রিস্কও নিতে পারবো না। এখন বেবি নিলে তোমার লাইফ রিস্ক আছে। একটা বেবির জন্য আমি তোমাকে হারাতে পারবো না। এমন অনেক কাপল আছে যারা সন্তান ছাড়া দিব্বি বেঁচে। দুজন একসাথে সুখে আছে । তাহলে আমরা কেনো পারবো না? প্রয়োজন মনে হলে একটা বাচ্চা এডপ্ট করবো।

আমি উনার কথা কর্ণপাত করলাম না। একটু এগিয়ে গিয়ে উনার টি-শার্টের কলার খামছে ধরে দুজনের ওষ্ঠ্যদ্বয় এক করে দিলাম।

চলবে…………

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৫৮

কেটে গেছে কয়েক মাস। আমাদের প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হলো। সোফায় বসে নুডুলস খাচ্ছিলাম। ঠিক তখনি বেশ শব্দ করে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলেন রুদ্র। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের হাতে থাকা ফাইলটা আমার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। উনার কাজে আমি হতবাক। কিছুদিন ধরেই খেয়াল করছি উনি আমার সাথে অদ্ভুত বিহেইভ করছেন। ঠিক মতো কথা বলেন না। কেমন মন মরা হয়ে থাকেন।

উনার ছুঁড়ে দেওয়া ফাইলটা আমার পায়ের কাছে ফ্লোরে পড়েছে। ফাইলটা হাতে নেওয়া মাত্রই আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না যে এটা প্রেগনেন্সির রিপোর্ট। পজিটিভ লেখাটা দেখা মাত্রই আমার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠলো। আমি ফাইলটা হাতে নিয়ে ছুটলাম নিজেদের রুমের উদ্দেশ্যে।

আমি রুমে প্রবেশ করা মাত্রই উনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি উনাকে দেখা মাত্রই দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলাম। উনি সাথে সাথেই নিজেকে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। আমি অশ্রু সিক্ত নয়নে উনার দিকে তাকালাম। অতঃপর আহত গলায় বললাম,

আপনি এমন করছেন কেনো? আমি প্রেগনেন্ট এটা শুনে আপনি খুশি হননি?

আমি খুশি হয়েছি নাকি হয়নি সেটা জেনে তুমি কী করবে? তুমি তো ভীষণ খুশি হয়েছো। তাহলে নিজের খুশি নিয়েই থাক।

আপনি এভাবে কথা বলছেন কেনো?

আমার কথা শুনতে খারাপ লাগছে তোমার। আমাকে মেরে ফেলো তাহলে আর তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে না। এভাবে তিলে তিলে মারার থেকে একবারেই মেরে ফেলো না। আমি এতো টেনশন আর নিতে পারছি না। দশটা মাস এই টেনশন আমার মাথা থেকে নামবে না। দশ মাস টেনশন করতে হবে না এর আগেই আমি স্টোক করে তোমাকে বাঁধন মুক্ত করে দিয়ে যাব। আমি মরলেই বা তোমার কী? তোমার তো বাচ্চা লাগবে। সেটা তো পেয়েই গেছো। আমার কী নিজের বাচ্চার জন্য কষ্ট হয় না? নাকি তোমার আমাকে অনুভূতিহীন মানুষ মনে হয়? ঐ বাচ্চাটা তো আমারও ছিল। ওকে স্বপ্নের ঘর তো আমিও বেঁধেছিলাম। আমি কী বাচ্চা চাই না? খুব করে চাই। কিন্তু তোমার বিনিময়ে না। আমার জীবনে ফাস্ট প্রায়োরিটি তুমি। তুই কেনো বুঝিস না আমার সবকিছু ছাড়া চললেও তোকে ছাড়া চলবে না। আমার বাঁচতে হলে তোকে প্রয়োজন। তোর বাচ্চা চাই না? আমাকে মেরে তারপর তুই বাচ্চা নিয়েই সুখে থাকিস।

উনি কথাগুলো চিৎকার করে বললেন। আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছি। উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে গেলেন। আমি নির্বিকার চেয়ে আছি উনার যাওয়ার দিকে। উনার করা ‘তুই’ সম্বোধনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। উনি যতই রেগে থাকেন না কেনো কখনো আমার সাথে তুই তোকারি করেননি।

_________________

আমি উদাস হয়ে কলেজের ক্যান্টিনে বসে আছি। ত্রয়ী আমার হাতের ওপর আলতো করে হাত রাখে।

এখন মন খারাপ করে কী হবে? রুদ্র স্যারের এমন বিহেইভ করা কী স্বাভাবিক নয়? তুই তো জানিস উনি তোকে কতোটা ভালোবাসেন। এই কলেজের প্রত্যেকটা স্টু়ডেন্ট জানে রুদ্র স্যার কতোটা কঠোর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। উনার প্রতিটা কলিগ জানে উনি কতোটা শক্ত মনের মানুষ। এই প্রত্যেকটা মানুষ রুদ্র স্যারকে দেখেছে তোর জন্য ছটফট করতে, তোর জন্য কাঁদতে। তোকে স্বাভাবিক করার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেছেন। এরপরও তুই ভালো বিহেইভ স্যারের কাছ থেকে ভালো বিহেইভ কী করে আশা করিস?

তুই বিয়ে কবে করছিস?

কথা ঘুরাচ্ছিস?

না জানতে চাচ্ছি। আমার জন্যই তো ঐ দিন তোর বিয়েটা হতে গিয়েও হলো না।

আমার তো নিজেকে দোষী মনে হয়। মনে হয় আমার জন্যই তোদের এক্সিডেন্ট হলো। আমার জন্যই তোর বাচ্চাটা আর নেই।

এটা আমার ভাগ্যে লেখা ছিল। এতে কারো হাত নেই। আমি সবকিছু আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।

______________________

কেটে গেছে একটা সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহ রুদ্র আমার সাথে একটা কথাও বলেননি। কিন্তু আমার খেয়াল রাখার কথা উনি মোটেও ভুলেননি। নির্বিকার ভাবে উনি আমার সমস্ত খেয়াল রাখেন। যথাসাধ্য আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।

এখন বাঁজে প্রায় রাত ১০টা কিন্তু রুদ্রর রুমে আসার খবর নাই। অগত্যা আমিই রুদ্রকে খুঁজতে বের হলাম। মামুনির রুমে সামনে আসতেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। ভিতর থেকে অস্পষ্ট কিছু কথা ভেসে আসছে। দরজা খোলাই ছিল বিধায় ভিতরে কী হচ্ছে সেটা দেখতে আমার বেগ পেতে হলো না। রুদ্র মামুনির কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে আছেন। রুদ্র যে কাঁদছেন সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।

দেখ রুদ্র তুই রিয়াকে এভাবে এড়িয়ে চলতে পারিস না। এই সময় তোর সাপোর্ট রিয়ার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তুই এমন করলে কীভাবে হবে বাবা?

আম্মু ও এতো অবুঝ কেনো? ও কেনো আমাকে বুঝতে চায় না? আমিও তো একটা মানুষ। আমি আর এতো টেনশন নিতে পারছি না। ওর কাছে আমার অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। ও একটুও আমাকে বোঝার চেষ্টা করে না। ও বুঝতেই চায় না যে ওর জীবনের থেকে বেশি মূল্যবান আমার কাছে অন্য কিছু না। আম্মু ঐ সন্তানের বাবা তো আমিও ছিলাম। সবার সামনে আমার কষ্টগুলো মেলে ধরিনি বলে কী আমার কষ্ট হয়নি? ও তো চিৎকার করে কেঁদে নিজের কষ্টগুলো হালকা করতে পারে আমি তো তাও পারি না।

এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে। তোকে তো শক্ত হতে হবে। তোকেও রিয়াকে বুঝতে হবে। তুই বাবা হলেও ও মা। ও পাঁচটা মাস ওই বাচ্চাটাকে নিজের মাঝে বহন করেছে। সব সময় বাচ্চাটাকে অনুভব করেছে। তাই ওর যন্ত্রণাটাও বেশি। সবাই তো তোর মতো শক্ত মনের অধিকারি হতে পারে না। রিয়া অন্য কারো কষ্ট দেখলেও কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে পড়ে। সেখানে তো নিজের সন্তানকে হারিয়েছে। এই সময় রিয়াকে এভাবে এড়িয়ে না চলে ওর পাশে পাশে থাকা। ওকে সব সময় হাসিখুসি রাখা। আল্লাহ যা ভাগ্যে লিখে দিয়েছেন তা তো তুই খন্ডাতে পারবি না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।

_________________

রুদ্র এখন আমার সাথে স্বাভাবিক আচারণ করেন। আমি উনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কপালে পড়ে থাকা বেবি হেয়ারগুলো সন্তপণে সরিয়ে দিয়ে গভীর চুমু এঁকে দিলেন কপালে। আমি কোল থেকে মাথা সরিয়ে ওঠে বসলাম।

প্লিজ আজকে না ঘুমাই? একটুও ঘুম আসছে না। একদিন না ঘুমালে কিছু হবে না।

একদম না। আমি কোনো অনিয়ম বরদাস্ত করবো না। আমি তোমাকে যে চার্ট দিয়েছি তা ফলো করেই চলবে। একদিনও তার ব্যতিক্রম করবে না।

প্লিজ প্লিজ।

উনি কিছু একটা ভাবলেন তারপর বললেন, আচ্ছা যাও ঘুমাতে হবে না। তুমি এই প্লেটের সবগুলো ফ্রুটস এখনি খাবে।

না আমি খাব না আমি ঘুমাব। আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। এই দেখুন ঘুমের জন্য চোখ দুটো খোলা রাখতে পারছি না।

একবার ডিসিশান চেইন্জ করেছি আমার ডিসিশান আর চেইন্জ হবে না। আমি তোমার আর কোনো বাহানা শুনবো না। নাও ফিনিস ইট।

আমি কাচুমাচু মুখ করে খেতে শুরু করলাম।

________________

রুদ্রর এক দূর সম্পর্কের আত্নীয় বাড়িতে আসছেন। মহিলাটাকে একদম গ্রামের কুচুটে মহিলাদের মতো লাগে। যাদের নিজের সংসারের থেকে অন্যের সংসারে নজর বেশি। মহিলাটিকে দেখা মাত্রই আমি সালাম দিলাম। কিন্তু এতে এই কুচুটে মহিলার মন ভরলো না।

আজ কালকার মেয়েরা গুরুজনদের সম্মান করতেই জানে না। তোমার বউমা তো কোনো আদব কায়দাই জানে না। আমি ওর চাচি শ্বাশুড়ি কোথায় আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবে তা না মুখে মুখে সালাম দিচ্ছে।

আপনি তো মনে হয় খুব আদব কায়দা জানেন? আমি আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নত করবো না। তাতে আপনি আমাকে বেয়াদব ভাবেন বা অন্য কিছু ভাবেন তাতে আমার কিছু আসে যায় না।

উনি একটু থতমত খেয়ে গেলেন। ভাবেননি হয়তো আমি এভাবে উত্তর দিব।

তোমার তো সাহস তো কম না। আমার মুখে মুখে তর্ক করছো?

আমাকে যদি অবলা নারী ভেবে থাকেন তাহলে ভুল ভাবছেন। আপনি আমাকে যা তা বলে অপমান করবেন আর আমি মুখ বুজে সহ্য করে নিবো আপনার এই সহজ সরল বউমার মতো তাহলে ভুল ভাবছেন। আমার সাথে লাগতে আসবেন না।

চলবে……….