পূর্ণিমাতিথি পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
744

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৩১

আমি কাঠ কাঠ গলায় বললাম, আপনাকে উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।

উনি আমার প্রশ্নে অতিরিক্ত মাত্রাই রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে উনি হিতাহিত ঙ্গান শূন্য হয়ে পড়লেন। এক টানে উনি আমাকে সিট থেকে উনার কোলে বসিয়ে দিলেন। আচমকা উনার কাজে আমি বিষ্মিত, শিহরিত। বিষ্ময়ে আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। উনি রাগে ফুস ফুস করছেন।

হঠাৎ উনার বলিষ্ঠ হাত জোড়া আমার কোমড় চেপে ধরে। উনার হাতের ছোঁয়া আমার কোমড়ে পেতেই আমার শরীরটা বরফের মতো জমে গেল। উনি আমার খুব কাছে চলে এলেন। উনার নিশ্বাস আমার চোখে মুখে পড়ছে। উনি দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,

আমাকে বলতে বাধ্য নও তো কাকে বলতে বাধ্য? হুম? ঐ ইফাদকে? ঐ ইফাদের আশেপাশেও যদি তোমাকে দেখি তো একদম মেরে ফেলবো বলে দিলাম।

উনার হাত জোড়া আমার কোমড় থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,

আমি কাকে বলতে বাধ্য সেটা নিশ্চয়ই আপনাকে বলবো না। আমি কার সাথে কথা বলবো, কার সাথে মিশবো সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। নিশ্চয়ই আপনি ঠিক করে দিবেন না আমি কার সাথে কথা বলবো আর না বলবো, কার সাথে মিশবো আর না মিশবো। আপনার অধিকার খাটানো বন্ধ করুন আমার লাইফে। আপনি বুঝতে পারছেন না আপনি আমার লাইফে অনধিকার চর্চা করছেন?

দেখো রিয়া আমাকে রাগিয়োও না। আমার রাগানোর ফল তোমার জন্য নিশ্চয়ই সুখকর হবে না। তুমি আমার স্ত্রী। তোমার ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব আমার।

প্লিজ বন্ধ করুন আপনার দায়িত্ব পালন। এই
‘দায়িত্ব’ শব্দটা শুনতে শুনতে আমি হাঁপিয়ে গেছি। দায়িত্ব শব্দের বেড়াজালে পড়ে আমার লাইফটা হেল হয়ে গেছে। এই দায়িত্ব শব্দটা আমি আর নিতে পারছি না। বন্ধ করুন আপনার দায়িত্ব পালন। অনেক পালন করেছেন আপনার দায়িত্ব। এবার আমাকে মুক্তি দিন। ওপস সরি আপনি না আমার আপনাকে মুক্তি দেওয়া উচিত। আমি নামক দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে আপনাকে মুক্ত করে দেওয়া উচিত। আজকে থেকে আপনাকে মুক্ত করে দিলাম। আর আমি নামক বুঝা আপনাকে বইতে হবে না। শেষ বারের মতো আমাকে আমার বাসায় রেখে আসুন।

উনি আমাকে উনার কোল থেকে ছুঁড়ে ফেলার মতোই সিটে রাখলেন। কোমড়ে হালকা ব্যথাও পেয়েছি। উনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন। উনি জুড়ে জুড়ে নিশ্বাস নিচ্ছেন। উনি প্রচণ্ড স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ করছেন। ভয়ে আমি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি।

৩০ মিনিটের রাস্তা আজকে ২০ মিনিটে চলে এসেছি। বাসার সামনে আসতেই উনি গাড়ি থেকে নেমে আমাকে টেনে গাড়ি থেকে নামান। টানতে টানতে বাসার ভিতরে নিয়ে যান। কলিংবেল না বাজিয়ে উনার কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাসায় প্রবেশ করলেন। রুমে যাওয়ার পথেই মামুনির সাথে দেখা। মামুনি উনাকে অনেক প্রশ্ন করেন। উনি এতো রেগে আছেন কেনো? আমাকে এভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কেনো? উনি মামুনির কথাগুলো উপেক্ষা করে আমার হাত ধরে টানতে টানতে রুমে নিয়ে আসলেন। মামুনিও রুদ্রের পিছন পিছন আসেন। রুদ্র আমাকে নিয়ে রুমে এসেই ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেন।

উনি আমাকে রেখে সারা রুম জুড়ে পায়চারী করছেন। টেবিলের ওপর থেকে পানির বোতল নিয়ে মাথায় ঢেলে দেন। আমি ভয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। উনাকে এতোটা রেগে যেতে আমি আগে কখনো দেখিনি। উনাকে দেখে আমার ভীষণ ভয় করছে।

আচমকা উনি আমার দুই বাহু চেপে ধরেন। আমি ভয়ে দুপা পিছিয়ে গেলাম। উনি আমাকে নিজের সাথে চেপে ধরলেন।

আমাকে আর এখন ভালো লাগে না? অন্য কাউকে ভালো লাগে? এজন্যই আমার কাছ থেকে মুক্তি চাও? শুনে রাখো মুক্তি তুমি কোনো দিনই পাবে না। আমাকে তোমার ভালো লাগুক আর লাগুক তোমার আমার সাথেই থাকতে হবে। দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেলোও তোমার আমার কাছ থেকে মুক্তি নেই। তুমি সেদিনই মুক্তি পাবে যেদিন আমি এই বাসা থেকে লাশ হয়ে বেড়িয়ে যাব।

উনার ফোন বেজে ওঠতেই উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। ফোনের স্কিনের নামটা দেখেই উনি বেলকনিতে চলে গেলেন। বেলকনিতে যেতেই উনার একটা কথায় কর্ণকুহর হলো।
‘ও পালালো কীভাবে? তারপর আর কোনো কিছু বোধগম্য হলো না। কিছুক্ষণ পরেই উনি রেগে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।

_______________

আজকে কলেজে আসতেই ত্রয়ী আমাকে চেপে ধরে। ও আমার বিয়ের ব্যাপার জেনে গেছে। যেটা এতোদিন ধরে আমি ওর কাছ থেকে লুকিয়ে গিয়েছিলাম। আমি কলেজে যেতেই কতক্ষণ গাল ফুলিয়ে বসে রইল। আমার সাথে কথা বলবে না। যখন দেখলো আমি ওর রাগ ভাঙানোর কোনো প্রচেষ্টায় করছি না। আমি নিজের মতোই বসে আছি তখন ও নিজেই এসে কথা বললে।

আমি তোর এতোটাই পর যে আমাকে তোর বিয়ের খবরটা দিলি না। তোর বিয়ে নিয়ে আমার কতো প্লেন ছিল স্বপ্ন ছিল। তুই আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিলি। হে পাষাণ নারী আপনি আমার মনটা ভেঙে দুই টুকরো করে দিলেন।

পরিস্থিতি ছিল না তোকে বলার মতো। আমি আমার লাইফের কোনো কিছু তোকে ছাড়া করি বল? আমার জীবনের এতো ইম্পর্টেন্ট একটা অধ্যায় তোকে ছাড়া নিশ্চয়ই করতাম না? পরিস্থিতি এমন ছিল যে কাউকে বলতে পারিনি। তুই আমার বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলি? আমি জানতাম মানুষ নিজের বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখে আর তুই? অন্যের বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখলে এমনি হয়।

তুই জানিস না মেয়েরা নিজের বিয়ের থেকেও নিজের বেস্টফ্রেন্ডের বিয়ে নিয়ে বেশি স্বপ্ন দেখে। আমি কেমন হতভাগা নিজের বেস্টফ্রেন্ডের জামাইকে এখনো দেখতে পেলাম না। আচ্ছা জামাইকে না দেখা তোর জামাই সম্পর্কে কিছু বল। ভাইয়া তোকে নিশ্চয়ই অনেক ভালোবাসে?

আমার ভালো লাগায় সে, তার ভালো না লাগায় আমি। তার বিরক্তিতে আমি, আমার সস্থিতে সে। আমার ভালোবাসায় সে, তার ঘৃণায় আমি।

এসব কী বলছিস?

তার কাছে শুধুই আমি দায়িত্ব। সে আমাকে নিজের দায়িত্ব ছাড়া আর কিছু মনে করে না। আমাকে একা ছাড়তে সে ভয় পায়। আমাকে কোনো ছেলের সাথে দেখলে সে রেগে যায়। আমার ওপর সে সব ধরনের অধিকার ফলায়। কিন্তু তবু আমি তার দায়িত্ব।

আমি তোকে গাধা ভাবতাম। কিন্তু আমার এখন মনে হচ্ছে তোর গাধা হওয়ার যোগ্যতাও নাই। তোকে যদি গাধা বলি তাহলে গাধাকে অপমান করা হবে। তোকে যদি ভালো নাই বাসে শুধু দায়িত্বই মনে করে তাহলে তোকে একা ছাড়তে কেনো ভয় পাবে? তোকে কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখলে কেনো রেগে যাবে? তোকে নিয়ে কেনো এতো পসেসিভ হবে? গাধা ভাইয়া তোকে ভালোবাসে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারে না। কিছু মানুষ মুখে না কাজের মাধ্যমে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে। ভাইয়ার রাগের আড়ালেই তোর জন্য এক অসীম ভালোবাসা রয়েছে।

শুরু হয়ে গেলো ত্রয়ীর ভালোবাসা নিয়ে ঙ্গান দেওয়া। আমি জানতাম ত্রয়ী ভালোবাসা নিয়ে একটু অভিজ্ঞ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ত্রয়ী ভালোবাসার ওপর পিএইচডি করে আসছে। আমি ত্রয়ীর বকবকানির হাত থেকে বাঁচাতে বইয়ে চোখ বুলাতে ব্যস্ত। ঠিক তখনি রুদ্র আমার পাশে এসে বসে পড়ে। আচমকা উনার আগমনে আমরা দুজনেই চমকে ওঠি। আমরা দুজনেই চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। রুদ্র আমাদের দুজনের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে,

এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? আমাকে দেখে কী এলিয়েন মনে হচ্ছে?

আমরা দুজনেই মাথা নাড়িয়ে না বলি। ত্রয়ী রুদ্রের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,

আপনি আমার স্যার আবার রিয়ার খালাতো ভাই। আপনার কাছে তো রিয়ার নামে বিচার দেওয়ায় যায়?

অবশ্যই।

রুদ্রর কথায় মনে হলো ত্রয়ীর সাহসটা বেড়ে গেলো।

এই বেয়াদপ মহিলা আমাকে রেখে একা একা বিয়ে করে ফেলেছে। বিয়েতে কী আমি বেশি খেয়ে ফেলতাম? এক পিস রোস্ট আর এক প্লেট পোলাওই তো খেতাম।

চলবে…….

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৩২

রুদ্রর কথায় মনে হলো ত্রয়ীর সাহসটা বেড়ে গেলো।

এই বেয়াদপ মহিলা আমাকে রেখে একা একা বিয়ে করে ফেলেছে। বিয়েতে কী আমি বেশি খেয়ে ফেলতাম? এক পিস রোস্ট আর এক প্লেট পোলাওই তো খেতাম। বলুন এটা কী ঠিক করছে আমার সাথে? বিয়েতে দাওয়াত তো দিলোই না। তার ওপর বিয়ের এতোদিন হয়ে গেলো আমাকে একটা বারের জন্যও জানালো না বিয়ের কথা। আমাকে অন্য কারো কাছ থেকে জানতে হয় ওর বিয়ের কথা।

রিয়া তোমার সাথে এটা একদমি উচিত করেনি। রিয়ার উচিত তোমাকে ডাবল ট্রিট দেওয়া।

আগে জানতাম সব সময় বিপরীত ধর্মী দুইটা মানুষের বিয়ে হয়। কিন্তু রিয়ার বেলায় সেই নিয়ম পাল্টে গেলো। রিয়া তো কিপ্টা রিয়ার জামাই আরো বেশি কিপ্টা। বজ্জাত লোক একটা। এতোদিন হইছে বিয়ে করছে। কিন্তু নিজের শালিদের খোঁজ খবর নিবে না।

রুদ্র ত্রয়ীর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। রুদ্র রিয়েকশন দেখে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। ত্রয়ীর মার কাছে মামা বাড়ির বিচার দিচ্ছে। ত্রয়ী যখন জানতে পারবে যার কাছে আমার হাজবেন্ডের নামে বিচার দিচ্ছে সেই-ই হাজবেন্ড। তখন ত্রয়ীর রিয়েকশন কেমন হবে? ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। রুদ্র দুই তিন বার কেশে গলাটা একটু পরিষ্কার করে বলে,

যার নামে এতো মহান মহান বাণী বলছো। তাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে করছে না?

কে বলছে দেখতে ইচ্ছে করছে না? অবশ্যই দেখতে চাই। ঠিকানা জানলে এখনি গিয়ে দেখা করে আসতাম। পাতালে থাকলে পাতালেই গিয়ে দেখা করে আসতাম।

তাই নাকি? তোমাকে কষ্ট করে পাতালে গিয়ে দেখা করতে হবে না। যাকে দেখার এতো ইচ্ছে সে তোমার সামনেই বসে আছে।

মানে?

আমিই রিয়ার হাজবেন্ড। ড. আরাফ আয়মান রুদ্র।

কথাটা শুনা মাত্রই ত্রয়ী লাফিয়ে ওঠে। আচমকা এমন ভয়ানক কথা বার্তা ত্রয়ীর হজম হচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটা ত্রয়ীর বোধগম্য হতে সেকেন্ড বিশেক লাগলো। ব্যাপারটা বোঝা মাত্রই ত্রয়ী আমতা আমতা করে বলে,

স্যার বাসায় আমার অনেক কাজ। আজকে মেহমান আসবে তো। আম্মু একা একা সব করতে পারবে না। আমি আসি স্যার।

ত্রয়ীর কথাটা আমার কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই আমি ত্রয়ীর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাই।
যে মেয়ে নাকি জীবনে এক গ্লাস পানি ঢেলে খায় না। সে নাকি তার মাকে সাহায্য করবে। সাহায্যের নামে সব গোছানো জিনিস এলোমেলো করে দিবে। বেশ বুঝতে পারছি ত্রয়ী রুদ্রর থেকে পালানোর জন্য মিথ্যা বলছে। ত্রয়ী কথাগুলো বলেই নিজের ব্যাগটা নিয়ে কোনো রকম দৌড়ে পালালো। যেনো এখান থেকে গেলেই সে বাঁচে। যাওয়ার আগে অবশ্য আমাকে চোখ রাঙিয়ে যেতে ভুল করেনি। এর মানে সে আমাকে পড়ে দেখে নিবে।

__________________

বাসায় এসেছি মিনিট বিশেক হয়েছে। রুদ্রর আমার সাথে আসার কথা ছিল না। কিন্তু আংকেলের জরুরি তলবে হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় আসতে হয়েছে। উনার দাদু অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর উনি আমাকে দেখতে চেয়েছেন। আংকেলরা দুই ভাই বোন। আংকেল শহরে থাকে আর আংকেলের বোন গ্রামে। আর আংকেলের মা উনার বোনের কাছে থাকে। উনার নাকি শহরের ইট, পাথরের দেয়ালে বন্দি হয়ে থাকতে ভালো লাগে না। উনি যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন মুক্ত পাখির মতো বাঁচতে চান। গ্রামের নির্মল হাওয়ায় বাঁচতে চান।

এখন সবাই মিলে দল বেঁধে গ্রামে যেতে হবে। মামুনি ব্যাগ ট্যাগ গোছানো শুরু করে দিয়েছে
আমার মাঝে ব্যাগ গোছানোর কোনো তাড়া নেই। এই না যে আমার যাওয়ার ইচ্ছে নাই। আমার এসব ব্যাগ ট্যাগ গোছানো অসহ্য লাগে। ব্যাগ গোছানোর কাজটা তো আমি উনাকে দিয়ে করাবো। আমি অলস ভঙ্গিতে বিছানার ওপর বসে আছি। উনি শাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে গেছেন। উনি বের হলেই আমি শাওয়ার নিতে যাব।

ফোনে টুং টাং আওয়াজ করে মেসেজ আসছে। মেসেজগুলো ত্রয়ীই পাঠাচ্ছে। আমাকে তখন কিছু বলতে পারেনি বলে এখন মেসেজ করে জ্বালিয়ে মারছে। আমি ভাবলেশহীন ভাবে মেসেজের রিপলাই দিচ্ছি। ত্রয়ী ১০টা মেসেজ দিলে আমি একটা দিচ্ছি।

ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ হতেই আমি লাফিয়ে ওঠলাম। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে উনি বের হয়ে আসছেন। আমি বিছানা থেকে নেমে এক পা এক পা করে উনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। উনি প্রথমে খেয়াল না করলেও পরে উনি ঠিকই খেয়াল করলেন আমি উনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। উনি ভ্রুচকে তাকান আমার দিকে। উনি বিরক্তি নিয়ে বললেন,

ফাজলামো বাদ দিয়ে শাওয়ার নিয়ে এসো। আমাদের এখনি বের হতে হবে। তুমি যদি রেডি হতে লেইট করো তাহলে তোমাকে রেখেই চলে যাব।

আমি উনার কথাটা পাত্তা না দিয়ে বললাম, আপনি এতো সুন্দর নাহলেও পারতেন ডাক্তারবাবু। আপনাকে এতো সুন্দর হতে কে বলেছিল? আফটার শাওয়ার লুক আপনাকে……..

আমি কথাটা অসমাপ্ত রেখেই ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। আমার কথা বার্তা আর কাজ কর্মে উনি অনেকটাই ঘাবড়ে গিয়েছেন। আমি আরেক পা এগিয়ে যেতেই উনি দু পা পিছিয়ে গেলেন। উনার অবস্থা দেখে আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। ফিক করে হেসে দিলাম। হাসতে হাসতে বললাম,

ডাক্তারবাবু আপনি সত্যিই ভীতু।

উনি চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছেন আমার মতিগতি। আমি ওয়াশরুমে চলে এলাম।

_________________

আপনি একটু রুম থেকে যান তো।

উনি ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করছিলেন। উনি ল্যাপটপের স্কিনেই দৃষ্টি রেখে বলেন,

আমি এখন রুম থেকে যেতে পারবো না। দেখছো না কাজ করছি।

প্লিজ যান না। আমি শাড়ি পড়বো।

‘আমি শাড়ি পড়বো’ কথাটা শোনা মাত্রই উনি আমার দিকে তাকালেন।

হঠাৎ শাড়ি কেনো পড়বা?

শাড়ি পড়বো না কেনো? প্রথম বারের মতো শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। প্রথম বারের মতো দাদি শ্বাশুড়ির সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আমাকে শাড়ি পড়তে হবে না? আমাকে দেখে মনে হতে হবে না যে আমি আপনার বউ।

শাড়ি পড়লেও তুমি আমার বউ শাড়ি না পড়লেও তুমি আমার বউই থাকবা। দাদুর সাথে তোমার প্রথম বার দেখা হচ্ছে না। এর আগেও অনেক বার দেখা হয়েছে।

যখন দেখা হয়েছিল তখন তো আর আমি আপনার বউ ছিলাম না। এখন আমি আপনার ওয়াইফ। তাই আমাকে শাড়ি পড়তেই হবে।

একদম না। তুমি শাড়ি পড়বে। তোমাকে দেখে মনে হয় না তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। গ্রাউন বা অন্য কোনো ড্রেস পড়লে তোমাকে দেখে এইট নাইনের বাচ্চা মনে হয়। কিন্তু শাড়ি পড়লে তোমাকে বড় বড় লাগে। পরে দেখা যাবে গ্রামের মহিলারা তোমার জন্য ফটাফট বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে আসছে। আমি তোমাকে নিয়ে একদম রিস্ক নিতে পারবো না।

________________

এট লাস্ট আমার উনার পছন্দ করা জামা পড়েই আসতে হয়েছে। উনি আমাকে শাড়ি পড়ে আসতে দেননি। আমিও উনাকে শর্ত দিয়েছিলাম উনি যদি ব্যাগ গুছিয়ে দেন তাহলে আমি শাড়ি পড়ে আসবো না। উনি আমার শর্ত শোনা মাত্রই রাজি হয়ে গেলেন।

আমরা সবাই এখন বাসে বসে আছি। উনি আর আংকেল গাড়ি করে যেতে চাইলে। আমি আর মামুনি জেদ ধরি বাসে করে যাবো। অগত্যা উনাদের আমাদের সাথে বাসে করেই যেতে হচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত আর উনি ল্যাপটপ কাজ করতে ব্যস্ত।

আমি উনার দিকে তাকালাম অনেক বার। কিন্তু উনি একবারের জন্যও আমার দিকে তাকালেন না। আমি অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আচমকা ব্রেক কষায় আমি সামনে দিকে হেলে পড়তে নিলেই এক জোড়া বলিষ্ঠ হাত আমার কোমড় চেপে ধরে।

চলবে…….

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৩৩

আমি উনার দিকে তাকালাম অনেক বার। কিন্তু উনি একবারের জন্যও আমার দিকে তাকালেন না। আমি অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আচমকা ব্রেক কষায় আমি সামনে দিকে হেলে পড়তে নিলেই এক জোড়া বলিষ্ঠ হাত আমার কোমড় চেপে ধরে। আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকাই। উনি নিষ্ফলক আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকাতেই উনি আমাকে বড় সড় একটা ধমক দিয়ে বলে ওঠলেন,

এতো বড় হয়ে গেছো এখানে নিজেকে সামলাতে পারো না। কিছু পারো বা না পারো জেদটা ঠিকই ধরতে পারো।

আমি উনার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললাম, আমাকে সামলানোর জন্য তো আপনি আছেন।

উনি আমার দিকে বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। আমি অনিমেষ তাকিয়ে আছি উনার দিকে। উনার আঙ্গুলের ডগা ব্যস্ত কিবোর্ডে। উনার চোখের দৃষ্টি ল্যাপটপের স্কিনে। আমার দৃষ্টি আটকে আছে তো উনাতেই। আজকে উনাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। উনার ওপর থেকে চোখ ফেরানোই দায়। আজকে উনি স্কাই কালার একটা শার্ট পড়েছেন আর কালো প্যান্ট। হাতে ব্রাউন কালার ফিতার একটা ঘড়ি। সামনের চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ইচ্ছে করছে উনার কপালের চুলগুলো একটু গুছিয়ে দেই। কিন্তু নিজের ইচ্ছাটাকে সংবরণ করলাম।

কাজ করার মাঝে মাঝে উনি ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরছেন। এই সাধারণ কাজটাও যেনো অসাধারণ লাগছে। ইশ আমার বরটা এতো সুন্দর না হলেও পারতো। কারো নজর যেনো না লাগে। উনি এবার ল্যাপটপের স্কিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,

চুলগুলো ঠিক করে দাও তো। প্রচণ্ড ডিস্টার্ভ করছে। ঠিক মতো কাজ করতে দিচ্ছে না।

উনার কথা শুনে আমি হা করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি কী মাইন্ড রিড করতে পারেন? নাহলে আমার মনের কোণের জাগা সুপ্ত ইচ্ছেটা উনি কীভাবে জানলেন? আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে উনি আবার বলে ওঠলেন,

এভাবে হা করে বসে আছো কেনো? তাড়াতাড়ি করো।

___________

কিছুক্ষণ আগেই বাস থেকে নেমেছি আমরা। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি আমরা। এখান থেকে ভ্যানে করে অথবা রিক্সায় করে বাকিটা পথ যেতে হবে। আংকেল আর রুদ্র ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু পর পর উনি আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। ভয়ে আমি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করাটা উনার কাছে বিরক্তিকর। উনার মতে লাইফের প্রতিটা মিনিটের মূল্য অনেক। একটা মিনিট অপচয় মানে অনেক কিছু। উনি যে আমার ওপর ক্ষেপে আছেন সেটা উনার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

গাড়ি ছাড়া বাসে করে আসার আইডিয়াটা আমারই ছিল। পরে মামুনি আমার সাথে তাল মিলিয়েছে। আমাকে হয়তো ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিতেন। প্ল্যান ক্যান্সেল করে দিতেন। কিন্তু মামুনির বেলায় তো সেটা সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়েই এসেছেন। মামুনিকে তো কিছু বলতে পারবেন না। তাই সবটা রাগ আমার ওপরই দেখাবেন।

আংকেল রুদ্রের হাতে ব্যাগটা দিয়ে এগিয়ে গেলেন রিক্সার খোঁজার জন্য। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই কাঙ্ক্ষিত জিনিস নিয়ে ফিরে আসলেন আংকেল।

____________

বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে রুদ্রর দাদুর বাড়ি এসেছি। বিশাল এক বাড়ি। উনার দাদা সখ করে এই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। সবাই মিলে এক সাথে এই বাসায় থাকবে। সবারই নিজের নিজের জীবনের জন্য সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

আসার পর থেকেই আমাকে গ্রামের মহিলারা ঘিরে বসে আছে। একেক জন একেক রকম প্রশ্ন করছে। অস্বস্তি আমারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। হু হা ছাড় কোনো উত্তর দিচ্ছি না। এই বাসার আমি রুদ্র দাদু আর উনার ফুফিকে ছাড়া আর কাউকে চিনি না। কিছুক্ষণ পরেই মামুনি ধরে ধরে রুদ্রর দাদুকে নিয়ে আসে। বয়সের বাড়ে নুইয়ে পড়েছেন। গায়ের সেই উজ্জ্বল রং হারিয়ে গেছে। আগের মতো সেই শক্ত পোক্ত চেহেরা আর নেই। লাঠি নিয়ে হাঁটতে হয়। আমি উনার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে উনি আমাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দেন। আমাকে চোখের ইশারায় বসতে বলেন। আমিও ভদ্র মেয়ের মতো বস পড়লাম। উনাকে আমার সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। আমার চিবুক ধরে বলেন,

মাশাল্লাহ। রুদ্রর বউ না যেনো একটা পরী। আমার তো তোমাকে ছোটবেলা থেকেই পছন্দ ছিল। খুব করে চাইতাম তুই যেনো রুদ্রের বউ হোক। আল্লাহ আমার মনের ইচ্ছেটা পুরণ করেছে।

আমি লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললাম। তখনি সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন রুদ্র। রুদ্রকে দেখেই দাদু বলে ওঠে,

চাঁদের লাহান সুন্দর বউ পাইছো বলেই তো এই বুড়ির কথা ভুলে গেছে। একবারের জন্যও এই বুড়ি দাদির কথা মনে পড়ে না? তুই না বলতি আমি তোর প্রথম বউ। দ্বিতীয় বউকে পেয়ে প্রথম বউকে ভুলে গেলি।

রুদ্র কিছু না বলে চুলে হাত চালিয়ে মুচকি হাসে।

_______________

এতক্ষণে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।ধম বন্ধ হয আসছিল। এতো মামুষের ভীড়ে আমি একা কখনোই থাকি নাই। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে এসে আমি স্কাপ খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। হঠাৎ করে পিছনের দিকের একটা পিন আটকে গেলো। কোনো ভাবেই পিনটা ছাড়াতে পারছি না। হুট করে কোথা থেকে রুদ্র চলে এলো। উনি খুব সুন্দর করে পিনটা ছাড়িয়ে দিলেন। উনি গম্ভীর গলায় বললেন,

আত্ননির্ভরশীল হতে শিখো। নিজের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করার চেষ্টা করে।তোমাকে আগলে রাখার জন্য সারাজীবন তোমার পাশে কেউ থাকবে না।

আমি কিছু না বলে টান দিয়ে উনার হাত থেকে পিনটা নিয়ে নিলাম। অতঃপর মুখ ভেংচি দিয়ে চলে আসলাম।

________________

রাতের আকাশে মিটিমিটি তারা জ্বলছে। আমি আর রুদ্র ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। দুজনেই চুপ চাপ। উনি হঠাৎই প্রশ্ন করেন।

মন খারাপ?

উহু।

তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি?

জ্বী বলুন।

তোমার মনে হয় না আমার সাথে বিয়ে হয়ে তোমার লাইফটা নষ্ট হয়ে গেছে?

সেটা মনে হবার তো কোনো কারণ নেই। আপনি একজন খুব ভালো হাজবেন্ড। আপনার দায়িত্ব পালনে কোনো রূপ ত্রুটি আপনি রাখেন না। আমার যখন যা চাই আমি মুখ ফুটে বলার আগে আপনি নিয়ে আসেন। আপনি আমার কোনো অভাব রাখেননি। হয়তো আমাকে ভালোবাসেন না। আমি এই যুগের মেয়ে হলেও একটা কথা খুব বিশ্বাস করি জীবনে বিয়ে একবারই হয়। কিন্তু আপনি তো আমার সাথে ভালো নেই। আমার সাথে আপনি দম বন্ধকর পরিস্থিতিতে আছেন। তাই হয়তো আপনাকে মুক্তি দিয়ে দিব। তবে ভাববেন না রিয়ার মুখে এক মনে আরেক। বাকি জীবনটা আমি একাই কাটিয়ে দিব।

এই মেয়ে তোমাকে এতো কথা বলতে কে বলেছে? তোমাকে বলেছি না তোমার মুক্তি নেই। আমাকে ভালো লাগুক আর না লাগুক তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। আমি তো প্রশ্নগুলো এমনি করছি তোমার উত্তর যদি হতো আমার সাথে বিয়ে হয়ে তোমার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে তবুও আমি তোমাকে ছাড়তাম না

উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই জানো না। আজকে তোমাকে সব বলবো। এই কথাগুলো আমি কারোও কাছেই শেয়ার করি না। আমার একটা অতী……..

উনার কথার মাঝেই মামুনি ডেকে ওঠলো। আমি উনার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললাম, আমি আপনার কথা পড়ে শুনবো। মামুনি ডাকছে আসি।

_________________

এ বাড়ির পিছনে একটা বিশাল পুকুর রয়েছে। আমি হাঁটতে সেই পুকুর পাড়ে চলে এলাম। সময়টা এখন দুপুর। সবাই ঘুমাচ্ছে। এই দুপুরবেলা ঘুমানোর অভ্যাসটা আমার একদমি নেই। আনমনে পুকুরের পাড়ি দিয়ে হাঁটছিলাম। আচমকা একটা গর্তে পা পড়ে গেলো। টাল সামলাতে না পেরে আমি পুকুরে পড়ে গেলাম। সাতার না জানার কারণে এখান থেকে ওঠা আমার পক্ষে অসম্ভব। আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছি পানির নিচে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই বুঝি নিশ্বাসটাও আমার সাথে বেঈমানি করে চলে গেলো। বাঁচার আশা আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে।

চলবে………..