পূর্ণিমাতিথি পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
517

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৩৪

ধীরে সুস্থ চোখ খুলে তাকালাম। বাম হাতটা কেমন যেনো ঝিম ধরে আসছে। ঘাড় কাত করে বাম দিকে তাকালাম। রুদ্র আমার হাত ধরে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। বাঁচার আশা যখন ছেড়ে দিয়েছিলাম ঠিক তখনি রুদ্রকে দেখতে পাই। বাঁচার ক্ষীণ আশা জেগে ওঠে মনে। কিন্তু পরমুহূর্তেই শরীর অসাড় হয়ে আসে। তলিয়ে যাই পানির নিচে।

এই তো বউমার ঙ্গান ফিরেছে।

আচমকা কারো গলা শুনে চমকে ওঠলাম। রুদ্র ফট করে চোখ খুলে তাকাল। চোখাচোখি হলো দুজনের। আমি ঘাড় কাত করে ডান দিকে তাকালাম। মামুনি বিছানার এক পাশটায় বসে আছে। আংকেল চেয়ারে বসে আছেন। সোফায় দাদু, ফুফি আর ফুফির এক মেয়ে বসে আছে। এখানে উপস্থিত অনেকেই আছে। কিছু অপরিচিত কিছু অর্ধপরিচিত মুখ।

এতগুলো লোকের সামনে আমি শুয়ে আছি। ভাবতে কেমন লাগছে। আমি দ্রুত ওঠে বসতে নিলে মামুনি আমাকে ধমক দিয়ে পিছনে বালিশ দিয়ে আধশোয়া করে বসিয়ে দেয়। কিয়ৎক্ষণ রুদ্র আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হুট করেই রুদ্র এক ঘর লোকের সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আচমকা রুদ্রের কাজে আমি চমকে ওঠি। পরমুহূর্তেই এক ঘর লোকের সামনে রুদ্র আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। ভাবতেই লজ্জায় আমি মাথা নুইয়ে ফেললাম।

কারো দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস আমার হলো না। লজ্জা, অস্বস্তি আমাকে ঘিরে ধরেছে। রুদ্রকে দূরে সরানোর জন্য এই যে ধাক্কা দিচ্ছি। কিন্তু রুদ্রকে এক চুলও নড়াতে পারলাম না। বুঝতে পারছি না রুদ্র কী লজ্জা সরম বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন।

দরজা লাগানোর শব্দে বুঝতে পারলাম আমাদের স্পেস দিতে সবাই চলে গেছে। উনার হিম শীতল করা স্পর্শে আমি জমে গেলাম। উনার হাত পা অসম্ভব রকম ঠান্ডা। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই উনি বলে
ওঠলেন,

তুমি এতো কেয়ারলেস কেনো? তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখে আমার কী অবস্থা হয়েছিল তুমি জানো? দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এই বুঝি আমার নিশ্বাসটাও চলে গেলো। বার বার মনে হচ্ছিল তোমাকে হয়তো আমি হারিয়ে ফেলবো। তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছিল। তোমার কিছু হলে আমি কী নিয়ে বাঁচতাম? আমি মরেই যেতাম।

ঘাড়টা ভিজে ভিজে লাগায় আমি ঘাড়ে হাত দিলাম। উনি ফট করেই আমাকে ছেড়ে দিলেন। একদম রুমের বাইরে চলে গেলেন। আমি উনার যাওয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে হাতের আঙ্গুল দিকে তাকালাম। আঙ্গুলের ডগায় পানি চিকচিক করছে। আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এটা উনারই চোখের জল। উনার রুম থেকে চলে যাওয়ার কারণটাও আমার কাছে অজানা নয়। উনি নিজের অনুভূতি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

একটু পরেই মামুনি রুম আসলো হাতে খাবারের প্লেট। আমাকে দেখে মুচকি হাসলো। প্রতিত্তরে আমি মৃদ্যু হাসলাম। মামুনি খাবারের প্লেটটা নিয়ে আমার পাশে বসলো।

রুদ্র তোকে আজকাল চোখে হারাচ্ছে।

মামুনির কথা শুনে আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। মামুনি আলতো হেসে বলে,

হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। রুদ্র কোথায়? একটু আগে তো এখানেই ছিল।

তুমি আসার কিছুক্ষণ আগেই রুম থেকে চলে গেলো।

এই ছেলেকে নিয়ে আর পারি না। কারো কথা
শুনে না। নিজে যা বলে তাই ঠিক। কিন্তু তোকে নিয়ে ভীষণ পসেসিভ। আমার মনে হয় আমার ছেলেটা তোকে ভালোবেসে ফেলেছে।

আমি মামুুনি দিকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকাই। মামুনি আলতো হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

তোকে পুকুর থেকে তুলে এনে পাগলের মতো চিৎকার করছিল। তোর ঙ্গান ফিরছিল না বলে পাগলামি করছিল। অস্থির হয়ে পড়েছিল। এর আগে আমি কখনো ওকে এতোটা ডেস্পারেট হতে দেখিনি। ড. আরাফ আয়মান রুদ্র যার মন নাকি পাথরের মতো। জটিল জটিল অপারেশন করতেও যার হাত কাঁপে না। তার নাকি আজকে একটা সামান্য ইনজেকশন পুশ করতে হাত কাঁপছিল। পরে তোর আংকেল ইনজেকশন পুশ করে। ভেজা জামা কাপড় নিয়েই তোর হাত ধরে বসেছিল। আমরা কেউ ঠেলেও ওকে ড্রেস চেইন্জ করতে পাঠাতে পারিনি। রুদ্রর এক কথা যতক্ষণ পর্যন্ত না তোর ঙ্গান ফিরছে ততক্ষণে সে এখান থেকে এক পা নড়বে না।

মামুনি আমার দিকে খাবার বাড়িয়ে দিতেই আমি কাচুমাচু মুখ করে মামুনির দিকে তাকালাম। উনি হয়তো এখনো খাওয়া দাওয়া করেননি। আমি কী করে খাই? মামুনি আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বলে,

কী সমস্যা খাচ্ছিস না কেনো? চুপচাপ হা কর।

মামুনি উনি কিছু খাননি। আমি কী করে উনাকে রেখে…..

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হুড়মুড়িয়ে রুমে মানুষ ঢুকে পড়ে। মানুষগুলোকে ভালো করে দেখে বুঝতে পারলাম একটু আগে যারা এসেছিলেন। দাদু রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

কী গো নাতবৌ আমার নাতিকে কিসের আঁচলে বাঁধছো? সে তো বউ ছাড়া কিছু বুঝে না। এই বুড়ো বউটাকেও ভুলে গেছে।

দাদুর কথা শুনে আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। এভাবে কেউ বললে আমার ভীষণ লজ্জা লাগে। দাদু এসে আমার পাশে বসে।

হয়েছে হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। লজ্জায় গাল দুটো তো লাল হয়ে গেছে। দোয়া করি সারাজীবন এমনি থাক। তোদের ভালোবাসা অটুট হোক। কারো নজর যেনো না লাগে। একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে যেমন বিশ্বাসের প্রয়োজন। তেমনি ভালোবাসারও প্রয়োজন হয়।

_______________

রুদ্র ল্যাপটপে কাজ করছে আর আমি বিছানায় শুয়ে আছি। আমাকে ছটফট করতে দেখে রুদ্র চিন্তিত কন্ঠে বলে,

কী হয়েছে এমন ছটফট করছো কেনো?

কথাটা বলতে বলতে রুদ্র আমার কপালের ওপর হাত রাখে। অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠ বলে,

সবসময় তোমার কেয়ারলেসপানা আমার আর ভালো লাগে না। এতো জ্বর তুমি আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করলে না।

রুদ্র আমাকে ছেড়ে দ্রুত ঔষধ নিয়ে আসেন। রীতিমতো আমাকে জোড় করে খাইয়ে দেন। লাইট অফ করে এসে শুয়ে পড়লেন। আমাকে ও টেনে শুইয়ে দিলেন। আলগোছা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। উনি ধমক দিয়ে বলে ওঠলেন,

কী হলো ঘুমাচ্ছো না কেনো? তোমার এখন রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন।

ঘুম আসছে না তো। আমার এখন আলাদা থাকা উচিত। আমার জ্বর হয়েছে যদি এটা ভাইরাল ফিভার হয় সেটা আপনার জন্য সমস্যা। আপনারাও হয়ে যাবে। আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন।

উনি এক টানে আমাকে উনার বুকের মাঝে নিয়ে যান। আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।

হুশশ। আর কোনো নয় চুপচাপ ঘুমাও।

হঠাৎই উনার ফোনটা বেজে ওঠলো। উনি এখানেই বসে ফোনটা রিসিভ করলেন।( উনার একটা কথায় আমার কর্ণগোচর হলো প্রীলিয়ে মারা গেছে।

চলবে,,,,,

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৩৫

হঠাৎই উনার ফোনটা বেজে ওঠলো। উনি এখানেই বসেই ফোনটা রিসিভ করলেন। উনার একটা কথায় আমার কর্ণগোচর হলো প্রীলিয়া মারা গেছে। কথাটা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে।

প্রীলিয়া আপু মারা গেছে? কীভাবে? এটা আদো সত্যিই? এটা কীভাবে সম্ভব? রুদ্র ফোনে কথা বলা শেষ করতেই আমি রুদ্রর দিকে তাকালাম। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই রুদ্র আমার ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে চুপ করিয়ে দেয়। মোলায়েম কন্ঠ বলে,

তুমি অসুস্থ। তোমার রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন।
তোমাকে টেনশন করতে হবে না। প্রীলিয়া কীভাবে মারা গেছে সেসব তোমার না ভাবলেও চলবে। শুধু মনে রাখবে সমাজ থেকে আবর্জনা দূর হয়েছে। স্বার্থপর মানুষদের সাথে এমনি হওয়া উচিত। এখন চুপচাপ ঘুমাও।

আমি উনার কথার বিপরীতে আর কিছু বললাম না। উনাকে এখন কিছু বললেই ধমকে ওঠবেন। প্রীলিয়া আপু মারা গেছে এটা শুনে খারাপ লাগছে তবে একজন মানুষ হিসেবে প্রীলিয়া আপু আমার মামাতো বোন এটার জন্য না। প্রীলিয়া আপু আমার সাথে অনেক অন্যায় করেছে যা ক্ষমার অযোগ্য।

___________

আজকে আমরা ঢাকায় ফিরে এসেছি। আরো দুই একদিন থাকার কথা ছিল কিন্তু প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুর সংবাদ শুনেই ঢাকাই ফিরে আসা। প্রীলিয়া আপু স্বার্থপর হতে পারে আমরা তো নই। প্রীলিয়া আপু হয়তো অনেক অন্যায় করেছে। কিন্তু আমরা তো মনুষ্যত্বহীন নই। তাই ঢাকাই ফিরে আসা। একটা কথা প্রচলিত আছে। ‘কুকুর যদি তোমাকে কামড় দেয় তাহলে কী তুমিও কুকুরকে কামড় দিবে?

ঢাকায় এসেই প্রথমেই রওনা দেই প্রীলিয়া আপুদের বাসার উদ্দেশ্যে। বাসায় পৌছাতেই শরীরের ভিতর কেমন যেনো একটা করে ওঠলো। ভিতরটা অস্থির অস্থির লাগছে। নিজেকে স্থির রাখার প্রচেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি। রুদ্র হয়তো আমার পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরেছেন। তাই তো পিছন থেকে এসে আমাকে ধরে আসস্থ করেন। বাসায় প্রবেশ করতেই মামির হৃদয় বিধারক কান্না কর্ণগোচর হয়। মামি চিৎকার করে কাঁদছে। মামির কান্নার শব্দের নিচে সবার কান্নার শব্দ চাপা পড়ে গেছে।

এই মানুষটার জন্যই এতক্ষণ ধরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বার বার শুধু এটাই মনে হচ্ছিল এই মানুষটা কীভাবে সহ্য করবে নিজের একমাত্র মেয়ের মৃত্যু। মামা আর প্রীলিয়া আপু আমাকে দেখতে না পারলেও মামি আমাকে ভীষণ আদর করতো। মামির ভালোবাসার টানেই আমি এই বাসায় বার বার ছুটে আসতাম।

রুদ্র আমাকে নিয়ে প্রীলিয়া আপুর ডেড বডির কাছে যান। আমার আর রুদ্রর পিছনে মামুনি, আংকেল, রিদি আপু, নিয়াম ভাইয়া সবাই এসেছেন। নিধিকে বাসায় রেখে আসা হয়েছে। প্রীলিয়া আপুর লাশটা দেখার পর আমার অন্তর আত্না কেঁপে ওঠলো। কী ভয়ানক মৃত্যু হয়েছিলা প্রীলিয়া আপুর। মুখ থেতলে গেছে। দেখতে ভয়ংকর লাগছে। আমি ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলাম। রুদ্র আমাকে শক্ত করে ধরে। আমি উল্টো ঘুরে রুদ্রর বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে দেই।

মামা সিঁড়ির কাছটায় বসেছিল। এতক্ষণ আমাদের লক্ষ্য না করলেও এখন ঠিকই দেখতে পান। আমাদের দেখা মাত্রই আমাদের দিকে ছুটে আসেন। আমাকে ধাক্কা দিয়ে রুদ্রর থেকে সরিয়ে দেন। রুদ্রর কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,

আমি জানি তুমিই আমার মেয়েকে মেরেছো। পুলিশ অফিসার একে এরেস্ট করুন। তুমি ছোটবেলা থেকেই আমার মেয়েকে সহ্য করতে পারতে না আর এখন তো…..

রুদ্র নিজের কলারটা মামার হাত থেকে ছাড়ানোর আগেই আব্বু এসে ধাক্কা দিয়ে মামাকে দূরে সরিয়ে দেন। আব্বু চিৎকার করে বলেন,

অনেক সহ্য করেছি তোমাদের অন্যায় আবদার। তোমাদের অন্যায় আবদার পুরণ করতে গিয়ে আমার মেয়েকে কষ্ট দিয়েছি। এখন রুদ্রর বিরুদ্ধে আর একটা উল্টা পাল্টা কথা বললে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। নিজের মেয়েকে ভালো করে মানুষ করতে পারনি। জেদী, বদমেজাজী, উগ্র মেয়ে ছিল। লাই দিয়ে দিয়ে মেয়েকে তো একেবারে মাথায় তুলে ফেলেছিলে। মেয়ের কোনো অন্যায়ই তো তোমার চোখে পড়তো না। তোমার মেয়ে ড্রিংকস করে ড্রাইভ করে এক্সিডেন্ট করেছে। এখানে রুদ্রর…..

রুদ্র আব্বুকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলেন। যেটা শোনার পর আব্বু চুপ করে যায়।
রুদ্র দুই পকেটে হাত গুঁজে দিয়ে মামার দিকে তাকিয়ে বলেন,

তো মিস্টার আহম্মেদ আপনি কী যেনো বলছিলেন? আমি আপনার মেয়েকে মেরেছি? আমি আপনার মেয়েকে ছোটবেলা থেকে সহ্য করতে পারতাম না এটা একদম ঠিক কথা। ওর মতো অহংকারী মেয়েকে কারোরই সহ্য হবে না। আপনি কিছু একটা বলতে গিয়ে আটকে গেলেন। আপনি প্রীলিয়া মারার কারণটা বলতে গিয়েও আটকে গেলেন। আচ্ছা আপনি যখন বলতে পারছেন না তাহলে আমিই বলছি। শুনুন পুলিশ অফিসার মিস প্রীলিয়া আমার ওয়াইফকে বার বার হত্যা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। গাড়ি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় আমার স্ত্রীর খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে মারতে চেয়েছিল। সেই পরিকল্পনাও সফল হয়নি আমার বন্ধুর জন্য। তাই প্রীলিয়ার সব রাগ ক্ষোভ গিয়ে পড়ে আমার বন্ধুর ওপর। প্রীলিয়া এতোটাই প্রতিহিংসা পরায়ণ যে আমার বন্ধুকেও হত্যা করার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনায় সফল হয়ে গিয়েছিল। আপনারা তো জানেনই সেই ব্যাপারটা। আপনিই তো আমার বন্ধুর কেইসটা হ্যান্ডেল করছিলেন। ড. ইলানের কেইস। লাস্ট মুহূর্তে কেউ একজন এসে ইলানকে হসপিটালে নিয়ে যায়। হসপিটাল থেকেও ইলানকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আটকে রাখে। ইলান সেখান থেকে নিজের জীবন নিয়ে কোনো মতে পালিয়ে আসে। মি. আহম্মেদ আমি ইচ্ছে করলে আপনার মেয়ের বিরুদ্ধে কতগুলো কেইস ঠুকে দিতে পারতাম আপনার ধারণা আছে। আমি ওকে বাঁচার জন্য সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রীলিয়া নিজেই সেই সুযোগটা কাজে লাগায়নি।

মামা এবার অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, অফিসার আপনার হয়তো আর বুঝতে বাকি নেই আমার মেয়ের এক্সিডেন্ট এই ছেলেই করিয়েছে। এই ছেলের কথার দ্বারাই তা প্রমাণ হয়ে গেছে। আপনি এরেস্ট করুন।

আপনার কথায় তো আমি উনাকে এরেস্ট করবো না। আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে? নেই তো। আপনার কথায় আমি একজন ভদ্রলোককে হ্যারাস করতে পারি না। ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন ড. রুদ্র গত দুই দিন ধরে ঢাকার বাইরে ছিলেন। আপনার মেয়ে ড্রাংক ছিল। আউট অফ কনট্রোল হয়ে এক্সিডেন্ট করেছেন। এখানে ড. রুদ্রর কোনো হাত নেই।

____________

প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুর আজকে দুই দিন হয়ে গেছে। ঐদিন প্রীলিয়া আপুর জানাযার পর পরই আমরা চলে আসি। আমার হাতের কলমটায় টান পড়ায় আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। রুদ্রর কর্কশ গলা শুনে মাথা তুলে রুদ্রর মুখের দিকে তাকাই।

তোমাকে কতদিন বলেছি না কলম কামড়াবে না। এটা বদ অভ্যাস।

আমি কী সব সময় কলম কামড়াই। টেনশন হলে একটু কামড়াই।

তো এতো কীসের টেনশন তোমার?

প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুটা আমার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আমরা যা দেখছি আসলে তা নয়। কিছু তো আছেই। যা আমাদের সবার দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে।

পড়াশোনা তো সব বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছ। পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। এসব কথা তোমাকে না ভাবলেও চলবে। এই ছোট মাথায় এতো চাপ নিয়ো না। আর হ্যাঁ নেক্সট টাইম কলম কামড়াবে না।

টেনশন হলে কী করবো?

রুদ্র আমার কথা কর্ণপাত না করে চলে গেলো। বেশ বুঝতে পারছি রুদ্র আমার কাছ থেকে কিছু আড়াল করছে। কিন্তু সেটা কী আমাকে জানতেই হবে? আব্বুর সাথে একবার দেখা করা দরকার।

চলবে………..

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৩৬

আব্বু আমি তোমার কাছ থেকে কিছু জানতে চাই। আমার কিছু প্রশ্ন ছিল। যেগুলোর উত্তর আজকে আমার চাই। আজকে আমার সব প্রশ্নের উত্তর তুমি দিবে বল।

তোমাকে আমি আগেই বলতে পারছি না প্রশ্নের উত্তর দিব কী না। আগে তোমার প্রশ্নগুলো শুনি তারপর ভেবে দেখবো উত্তর দেওয়ার কথা।

আব্বু প্লিজ না করো না। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আব্বু আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি তুমি ভাইয়া এবং আমার থেকেও বেশি প্রীলিয়া আপুকে প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছ। কিন্তু কেনো? এমনটা নয় যে আমরা জানি না যে তুমি আমাদের ভালোবাসো। আমরা জানি তুমি আমাদের ভীষণ ভালোবাসো। নিজের থেকেও বেশি আমাদের ভালোবাসো। আমাদের জন্য হাসতে হাসতেও নিজের জীবনটা দিয়ে দিতে পারো। কিন্তু তুমি কেনো প্রীলিয়া আপুর সামনে দেখাতে তুমি আমাদের ভালোবাসো না? আমার এবং ভাইয়ার প্রিয় জিনিসগুলো যদি প্রীলিয়া আপুর ভালো লাগতো তাহলে তুমি সেগুলো প্রীলিয়া আপুকে দিয়ে দিতে। আমার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল যে ছেলের ঐ ছেলে আমার সাথে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে প্রীলিয়া আপুকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিল। তবুও তুমি কিছু বললে না। চুপচাপ সবকিছু মেনে নিলে। বিনা বাধায় ওদের এ্যাংগেইজমেন্ট হয়ে যেতে দিলে। ভাইয়া রিয়েক্ট করেছিল বলে তুমি ভাইয়াকেও থামিয়ে দিলে। এই নয় যে আমি রুদ্রর সাথে অসুখী। রুদ্রর মতো মানুষ হয় না। উনাকে পেয়ে আমার জীবন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আমি অনেক ভাগ্যবতী উনার মতো একজন লাইফ পার্টনার পেয়েছি। কিন্তু আব্বু আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো জানা খুব প্রয়োজন। প্লিজ আব্বু আজকে সব বলো।

তুমি এখন বড় হয়েছ। সবকিছু জানার অধিকার তোমার আছে। তোমার মামাকে দেখে যা মনে হয় তোমার মামা আসলে তেমন
নয়। উনি ভীষণ অহংকারী একজন মানুষ। প্রীলিয়ার মতোই স্বার্থপর। বাবা-মায়ের গুণগুলোই তো সন্তান পায়। প্রীলিয়াও তোমার মামার মতোই জেদী আর একরোখা। নিজের জেদ বজায়া রাখার জন্য সবকিছু করতে পারে। কাউকে খুন করতেও পিছপা হবে না। যেমনটা প্রীলিয়া নিজের জেদ বজায়া রাখার জন্য তোমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। তোমার বয়স যখন তিন বছর তোমার একটা খেলনা প্রীলিয়া কেঁড়ে নিয়েছিল। সেটার জন্য তুমি চিৎকার করে কাঁদছিলে। প্রীলিয়া বদ মেজাজি আর অহংকারী থাকাই রুদ্র ওকে সহ্য করতে পারতো না। রুদ্রর পিছন পিছন সব সময় তুমি থাকতে। রুদ্রকে ছাড়া তুমি কিছুই বুঝতে না। তুমি ছোটবেলায় দেখতে অনেকটা পুতুলের মতো ছিলে। তুমিই ছিলে রুদ্রর খেলার পুতুল। তোমাকে খাইয়ে দেওয়া ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া সব রুদ্র করতো। প্রীলিয়াকে সহ্য করতে পারতো না আর প্রীলিয়া তোমাকে কাঁদাচ্ছে এটা দেখে রুদ্র ভীষণ রেগে যায়। প্রীলিয়ার হাত থেকে খেলনাটা কেড়ে নিয়ে প্রীলিয়াকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এটা নিয়ে তোমার মামা ভীষণ রাগারাগি করে। রীতিমত তেড়ে আসে রুদ্রকে মারার জন্য। তোমার আংকেল তোমার মামার অসভ্যতামো দেখে রেগে চলে যান রুদ্রকে নিয়ে। তোমার মামার সাথে সব সম্পর্ক নষ্ট করে দেন। কিন্তু আমি চাইলেও সেটা করতে পারতাম না। আমার মাথায় ছিল তখন ঋণের বোঝা। তোমার মামার কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আমি ধার নিয়েছিলাম। তাই তো তোমার মামার সব অন্যায় আবদার আমার মেনে নিতে হতো। তোমার মামার আবদার মেনে না নিলে আমাকে তোমাদের নিয়ে গাছ তলায় গিয়ে দাঁড়াতে হতো। তখন তোমাদের জীবনটা এতো সুন্দর হতো না।

এ্যাংগেইজমেন্টের দিন চুপ থাকার কারণই কী এটাই ছিল?

না। অনেক আগেই আমি তোমার মামার সব টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছি। তোমার মামা আমাকে বলেছিল, আমি যদি কোনো রকম সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা করি তাহলে তোমাকে আর তোমার ভাইকে মেরে ফেলবে। আমি জানতাম তোমার মামার জন্য এসব কিছু অসম্ভব নয়। প্রীলিয়ার অন্যায় আবদার পুরণ করার জন্য তোমার মামা সবকিছু করতে পারে। সেই ভয়েই আমি চুপ ছিলাম আর শাওনকেও কোনো রকম সিনক্রিয়েট করতে দেইনি।

রুদ্র এসব কিছু জানে?

হ্যাঁ আমি বলেছি কিছুদিন আগে।

প্রীলিয়া আপুর এক্সিডেন্টটা কী রুদ্রই করিয়েছে?

না। কিন্তু আমার মনে হয় প্রীলিয়ার মৃত্যু পিছনের রহস্য রুদ্র জানে। কিন্তু সবার সামনে সেই রহস্য ফাস করতে নারাজ।

আচ্ছা আব্বু আমি আসি।

এখনি চলে যাবি?

হ্যাঁ। এখান থেকে কলেজে যেতে হবে। আজকে তো কলেজে যাওয়া হলো না তাই ত্রয়ীর কাছ থেকে সব নোট নিব দেন বাসায় যাব।

একা যাবি? আমিও তোর সাথে যাই চল।

না তোমাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো। আব্বু তোমার পিচ্চিটা আর পিচ্চি নেই সে এখন বড় হয়ে গেছে। একা পথ চলতে পারে।

বাবা মার কাছে সন্তান কখনো বড় হয় না। তুই তো আমার পিচ্চি রাজকন্যা। সাবধানে যাবি আর পৌছে আমাকে একটা ফোন দিবি।

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আম্মুর সাথে দেখা করে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ভাইয়াকে মেসেজ করে দিলাম। এবার ভাইয়ার মনের প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলবে।

________________

বাসায় আসতে আসতে বিকাল হয়ে গেলো। বাসায় এসেই আগে শাওয়ার নিয়ে নিলাম। ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম। পাক্কা এক ঘন্টা জ্যামের জন্য আটকে ছিলাম। বিরক্তির চরম মাত্রাই পৌছে গিয়েছিল।

টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই বার কয়েক বার কেউ দরজায় নক করলো। হাতের টাওয়ালটা চেয়ারে রেখে দরজার দিকে অগ্রসর হলাম। দরজা খুলে দিতেই মামুনি আমার দিকে নিজের ফোনটা বাড়িয়ে দিল। আমি জিঙ্গাসু দৃষ্টিতে মামুনির দিকে তাকাই।

রুদ্র ফোন করেছে। নে কথা বল।

মামুনির সামনে রুদ্রর সাথে কথা বলবো ভাবতে জানি কেমন লজ্জা লাগছে। আমি নিজেকে ধাতস্থ করে ফোনটা হাতে নিলাম। ফোনটা কানের কাছে নিতেই নিশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনতে পেলাম না। আমি হ্যালো বলতেই রুদ্র ফোন কেটে দিল। কি থেকে কি হলো কিছুই আমার বোধগম্য হলো না। আমি মামুনির দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিলাম।

কী হলো?

রুদ্র ফোন কেটে দিয়েছে।

রুদ্র তোর ওপর ভীষণ রেগে গেছে। তুই তো রুদ্রকে বলেই ঐ বাসায় যেতে পারতি। কলেজের নাম করে কেনো গেলি? রুদ্র তোকে ফোন করতে করতে অস্থির হয়ে ওঠেছিল। কিন্তু তোরে ফোনে কিছুতেই কল ঢুকেছিল না। পরে ত্রয়ীকে কল করে জানতে পারে তুই তোদের গিয়েছিস। এটা জানার পরই তোদের বাসায় যেতে চেয়েছিল। কিন্তু হসপিটাল থেকে কল আসায় হসপিটাল চলে যেতে হয়েছে। আবার নিশ্চয়ই ঝগড়া করেছিস। তোদের দুজনকে নিয়ে আর পারি না। এক সাথে থাকলে সারাদিন ঝগড়া করবি। আর দূরে গেলে দুজন দুজনকে চোখে হারাস।

মামুনি বকবক করতে করতে চলে গেলো। আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লাম।

_________________

আংকেল কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছে। মামুনির শরীর খারাপ লাগছিল তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে। আমি রুদ্রর জন্য অপেক্ষা করছি। রুদ্র এখনো বাসায় ফিরেনি। ড্রয়িংরুমে বসে পড়ছিলাম। হঠাৎ করে কলিংবেল বেজে ওঠায় তাড়াতাড়ি করে ওঠতে গিয়ে সোফা থেকে ঠাস করে পড়ে গেলাম। তেমন একটা ব্যথা পাইনি। তাড়াতাড়ি করে ওঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দরজা খুলতেই রুদ্র হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে হাতে থাকা ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দেয়। আমার বাহু দুটো খুব শক্ত করে চেপে ধরে। রাগে হিশহিশিয়ে বলে,

তোমার আমাকে মানুষ মনে হয় না। আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করা যায় তাই না? তুমি কেনো বুঝতে পারো না তোমার জন্য কারো চিন্তা হয়। তোমার চিন্তায় কেউ অস্থির হয়ে ওঠে। তোমাকে এক মুহূর্ত দেখতে না পারলে আমার বক্ষঃস্থল চিন চিন ব্যথা হয়। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। সারা পৃথিবী এলোমেলো হয়ে যায়।

চলবে……..