পূর্ণিমাতিথি পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
568

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৩৭

তোমার আমাকে মানুষ মনে হয় না। আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করা যায় তাই না? তুমি কেনো বুঝতে পারো না তোমার জন্য কারো চিন্তা হয়। তোমার চিন্তায় কেউ অস্থির হয়ে ওঠে। তোমাকে এক মুহূর্ত দেখতে না পারলে আমার বক্ষঃস্থল চিন চিন ব্যথা হয়। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। সারা পৃথিবী এলোমেলো হয়ে যায়।

প্রথম দিকের কথাগুলো উনি রেগে বললেও পরে উনার কন্ঠে রাগের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এক রাশ ভালোবাসার অনুভূতি। অপ্রকাশিত ভালোবাসা। ভালোবাসলেই তা মুখে বলতে হবে তা নয়। নিজের কর্মের মাধ্যমে অপর পাশের ব্যক্তিটাকে নিজের ভালোবাসা বুঝানো সম্ভব। আমার এক হাত উনার বুকের বা পাশে রাখলাম। এবার উনি একদম স্থির হয়ে গেলেন। অনিমেষ তাকিয়ে আছেন আমার চোখের দিকে। পলক ফেলতেও যেনো ভুলে গেলেন।

___________________

গত দশ মিনিট যাবৎ ইফাদ স্যারের রুমে বসে আছি। কিন্তু স্যার আসার কোনো খবর নাই। ইফাদ স্যার উনার এসিস্ট্যান্টকে দিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে আসছেন। উনার এসিস্ট্যান্ট আমাকে এখানে বসতে বলে চলে গেছেন। স্যার একটা ইমপর্টেন্ট কাজে গিয়েছে এখনি চলে আসবে। আমাকে অপেক্ষা করতে বলছে। এই দশ মিনিটেই আমি বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। সারা রুম জুড়ে পায়চারি করছি। আজকে ত্রয়ীটাও আসেনি। তাই আমার একা একাই বোর হতে হচ্ছে। ত্রয়ী এখানে থাকলে স্যারের রুমটাকেও বাজার বানিয়ে ফেলতো। আরো মিনিট পাঁচেকের মতো অপেক্ষা করার পর স্যারের দেখা পেলাম।

স্যারকে দেখা আর ঘোড়ার ডিম দেখা আমার কাছে এক মনে হচ্ছে। অপেক্ষা জিনিসটা আমার বরাবরই বিরক্ত লাগে। স্যার কেবিনের দরজা ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে বলে,

সরি সরি ফর লেইট। সরি এগেইন তোমাকে অপেক্ষা করানোর জন্য। একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম।

আমি নিজের বিরক্তিটা প্রকাশ না করে আলতো হেসে বললাম, ইট’স ওকে স্যার। সরি বলার দরকার নেই। কাজ তো থাকতেই পারে।

স্যার নিজের গায়ের এপ্রোনটা খুলতে খুলতে বললেন, এই জন্যই তোমাকে এতোটা ভালো লাগে। তুমি সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নাও। অন্যের সুবিধা অসুবিধা বুঝার চেষ্টা করো।

ইফাদ স্যারের কথা শুনে আমি একটু অস্বস্থিতে পড়ে গেলাম। তবুও মেকি হেসে বললাম, স্যার কেনো ডেকেছিলেন?

ও হ্যাঁ বসো বলছি।

আমি ইফাদ স্যারের বিপরীত পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লাম।

তুমি হয়তো ভুলে গেছো তুমি আমাকে একটা টপিক বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলে। আমি সময়ের অভাবে ঐ টপিকটা নিয়ে আলোচনা করার সময় পাইনি। তো গতকাল আমি ঐ টপিকটা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু তুমি প্রেজেন্ট ছিলে না। স্টুডেন্ট কোনো টপিক বুঝতে না পারলে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। তোমাকে ঐ বিষয়টা বুঝানোর জন্যই ডাকা।

ধন্যবাদ স্যার। আমি ঐ টপিকের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।

চলো ক্যান্টিনে যাই।

কেনো স্যার?

সকাল থেকে এখনো খাওয়া হয় নাই। লাঞ্চ করতে করতে না হয় তোমাকে পড়াটা বুঝিয়ে দিব। তোমার কোনো সমস্যা আছে?

আমি এবার অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। এভাবে একজন টিচারের সাথে তো ক্যান্টিনে বসা যায়। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অস্বস্তিকর। যদি রুদ্র আমাদের দুজনকে এক সাথে ক্যান্টিনে দেখে তাহলে তো তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিবে। তৎক্ষণাত রিয়েক্ট না করলেও পরে আমার ওপর ঘূর্ণিঝড় চালিয়ে দিবে। স্যারকে না করে দিব। কিন্তু স্যারের মুখের ওপর তো এভাবে না করা যায় না। এটা বেয়াদবি হয়ে যাবে। অগত্যা স্যারের সাথে ক্যান্টিনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম।

_______________

খুব মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথাগুলো শুনছিলাম। হুট করে আমার ফোনটা বেজে ওঠায় আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখি রুদ্র কল দিয়েছে। কলটা কেটে দেওয়ার সাথে সাথেই আবার বেজে ওঠে। আমি স্যারের দিকে তাকাতেই স্যার ইশারায় ফোনটা রিসিভ করতে বললো। আমি জোর পূর্বক হেসে ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই অপর পাশ থেকে রুদ্রর কর্কশ কন্ঠ কর্ণগোচর হলো।

তোমার সাহস হলো কী করে আমার ফোন কেটে দেওয়ার। ক্যান্টিনে বসে দাঁত কেলানোর সাহস আমি বের করবো। পাঁচ মিনিটের মাঝে আমি তোমাকে আমার গাড়ির ভিতর দেখতে চাই।

কথাগুলো বলতে দেরি হলো কিন্তু উনার ফোনটা কাটতে দেরি হলো না। আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। উনি যে আমার ওপর ভীষণ রেগে আছেন সেটা উনার কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝা গেছে। উনি আমাদের দুজনকে এক সাথে দেখে জেলাসিতে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছেন। ইফাদ স্যারের প্রশ্ন শুনে বিষ্মিত হলাম।

বয়ফ্রেন্ড ফোন দিয়েছিল?

মুখ দিয়ে হুট করে বেরিয়ে এলো ‘না’ বোধক শব্দটা। নিজের দেওয়া উত্তরে নিজেই চমকে ওঠলাম। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। কারণ আমি তো মিথ্যা বলি নাই। রুদ্র তো আমার বয়ফ্রেন্ড নয় হাজবেন্ড। ইফাদ স্যার আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। উনার দিকে তাকাতেই আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। অস্বস্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। অস্বস্তি নিয়েই ফট করে দাঁড়িয়ে গেলাম। অতঃপর আমতা আমতা করে বললাম,

স্যার আজকে আমি আসি। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে পড়ে। আরো দেরি হয়ে গেলে মামুনি টেনশন করবে। স্যার তাহলে আমি আসি।

আচ্ছা যাও।

আসসালামু আলাইকুম।

আমি উনার কথা না শুনেই ব্যাগটা নিয়ে এক ছুটে ক্যান্টিন থেকে চলে এলাম।

________________

এতো কীসের হাসাহাসি ড. ইফাদের সাথে? আমার সাথে যখন কথা বলো তখন মনে হয় মুখে করলা দিয়ে রাখছে। ত্যাড়া কথা ছাড়া ভালো কথা বেরই হয় না। তুমি ইফাদের সাথে ক্যান্টিনে কেনো বসেছিল? আন্সার মি।

আমি উনার এক হাতের ওপর হাত রেখে বললাম, আমাকে নিয়ে জেলাস ফিল করার দরকার নেই। আমি তো আপনারই। ইফাদ স্যার শুধু আমাকে একটা টপিক বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এছাড়া আর কিছু না।

ইফাদের কাছে কেনো তুমি পড়া বুঝবে? আমাকে বললে আমি পড়া বুঝিয়ে দিতাম না।

আমার নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। উনি রাগে হিতাহিত ঙ্গান শুন্য হয়ে পড়েছেন। উনি ভুলেই গিয়েছেন ইফাদ স্যার আর উনি দুজন আলাদা দুই সাবজেক্ট এর টিচার।

________________

উনি কলেজে বিষয়টা নিয়ে এখনো রেগে আছেন। একটু আগেও ধমকে টমকে রেখে গেলেন। আমাদের কাজিন মহলের সবচেয়ে বেশি ঘাড়ত্যাড়া উনি। একবার যে বিষয়টা ঠিক করেন বা কোনো কিছুতে না করলে সেটার হ্যাঁ করার সাধ্য কারো নেই। ইফাদ স্যারের কাছ থেকে দুরত্ব বজায়া রেখে চলতে হবে। নাহলে রুদ্র আবার রিয়েক্ট করে বসবে।

আনমনে বইয়ের পাতায় নজর দিচ্ছিলাম। রুদ্রও ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেলকনিতে চলে যায়। বেলকনিতে টাওয়ালটা রেখে আবার রুমে আসেন। আমি উনাকে দেখে বলে ওঠলাম,

ডাক্তারবাবু আপনার মনে হয় না আপনি দিন দিন হিংসুটে হয়ে যাচ্ছেন।

উনি কিছু না বলে আমার হাত থেকে টান দিয়ে বইটা নিয়ে নিলেন সন্তপণে বইটা টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। কোনো রকম বাক্য ব্যয় না করেই ধপ করে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। আকস্মিক ঘটনায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললাম।

আমি আমার বউকে নিয়ে হিংসা করছি অন্যের বউকে নিয়ে নয়। নিজের বউকে নিয়ে হিংসা না করে কী বন্ধুর বউকে নিয়ে হিংসা করব? সুন্দরী বউকে অন্য কারো পাশে দেখলে তো হিংসা হবেই।

উনি আমার হাতটা নিয়ে উনার মাথার ওপর রাখলেন। নিভৃতে আমার উদরে মুখ গুঁজে দিলেন। আকস্মিক উনার স্পর্শে আমি বরফের মতো জমে গেলাম। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললাম। উনার প্রতিটা নিশ্বাস আমার উদর ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসছে। উনার বাকি কথাগুলো আর কর্ণপাত হলো না।

চলবে…………

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৩৮

উনি আমার হাতটা নিয়ে উনার মাথার ওপর রাখলেন। নিভৃতে আমার উদরে মুখ গুঁজে দিলেন। আকস্মিক উনার স্পর্শে আমি বরফের মতো জমে গেলাম। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললাম। উনার প্রতিটা নিশ্বাস আমার উদর ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসছে। উনার বাকি কথাগুলো আর কর্ণপাত হলো না। আমি অস্বস্তিতে হাসফাস করছি। আমি চট করে উনার মাথাটা আমার কোল থেকে নামিয়ে দূরে সরে গেলাম।

উনি শোয়া থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলেন। আমি উনার যাওয়ার দিকে নিভৃতে তাকিয়ে আছি। উনি কী আমার ওপর রাগ করলেন? কিন্তু আমি কী করতাম? আমি তো উনার এমন স্পর্শে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম।

________________

উনি কাউচে বসে গম্ভীর মুখে কিছু পেপারস দেখছিলেন। আমি উনার পাশে বসে পড়লাম। একটু দূরত্ব রেখেই বসেছি। নানা ভাবে উনার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু উনি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। উনার ধ্যান ঙ্গান সব এখন উনার হাতে থাকা পেপারসের মাঝে। আমি হালকা কেশে উনার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি ফিরেও তাকালেন না। আমি আশাহত হলাম। উনি এমন একটা হাব ভাব করছেন যেনো উনার হাতে থাকা পেপারসগুলো থেকে চোখ সরালেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি দুজনের মাঝের দূরত্ব গুছিয়ে উনার গা ঘেষে বসে পড়লাম। উনার বাম হাতটা টেনে ধরলাম। উনি এবার আমার দিকে ফিরে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বলে ওঠলেন,

সমস্যা কী? ডিস্টার্ভ কেনো করছো?

কথাটা বলেই উনি আমার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বললাম,

আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেনো? আপনি কী আমার ওপর রেগে আছেন?

উনি আমার দিকে না তাকিয়ে ফাইল পত্র ঘাটতে ঘাটতে উত্তর দিলেন,

হঠাৎ তোমার কেনো মনে হলো আমি তোমার ওপর রেগে আছি?

তখনকার বিষয়টা নিয়ে।

আমি আর কিছু বলার আগেই উনি বলে ওঠলেন,

আমি ছোটো-খাটো বিষয় নিয়ে রাগ করি না। এখন আর আমাকে ডিস্টার্ভ করো না যাও পড়তে বসো।

আমি বিনা বাক্য বেয়ে উনার পাশ থেকে ওঠে চলে এলাম। স্টাডি টেবিলের চেয়ারটা টেনে ধপ করে বসে পড়লাম। ভাজ করা বইয়ের মাঝ থেকে একটা বই টেনে নিলাম। ইফাদ স্যারের অর্ধেক বুঝানো টপিকটা বুঝার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু পড়াতে কিছুতেই মনোযোগ বসাতে পারছি না। উনার অবহেলাগুলো যে আমায় বড্ড পুড়ায়। উনার একটা তুচ্ছ কথাও যে আমার ভিতরটা যে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় সেটা কী উনি বুঝতে পারেন না?

আমি মাথা নিচু করে পড়ছিলাম। উনি নিঃশব্দে এসে আমার পাশে বসলেন। আমার সামনে থেকে বইটা টেনে নিজের কাছে নিলেন। দক্ষতার সাথে পুরো বিষয়টা আমাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। নিশ্চুপ ভঙ্গিমাতে পুরু বিষয়টা বুঝে নিলাম। আমি একবারের জন্যও উনার দিকে তাকাইনি। বুঝানো শেষ উনি গম্ভীর গলায় বললেন,

নেক্সট টাইম কোনো টপিকস না বুঝলে আমার কাছে আসবা। অন্য কোনো ছেলের আশেপাশেও ঘেষবা না। যতই সে তোমার স্যার হোক।

উনি আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে রুম থেকে চলে গেলেন ডিনার করার জন্য। আমিও উনার পিছু পিছু ছুটলাম।

_______________

ডিনার শেষ মামুনির সাথে কিয়ৎক্ষণ কথা বলে রুমে চলে এলাম। রুমে এসে একটু বেশিই অবাক হলাম। উনি বিছানায় শুয়ে আছেন কিন্তু উনার পাশে কোনো কোলবালিশ নেই। উনি নিজে থেকে সরিয়েছেন? এটা অসম্ভব হয়তো উনি ভুলে গেছেন। আমি কাউচের ওপর থেকে কোলবালিশটা নিয়ে এসে বিছানার মাঝ বরাবর রেখে দিলাম। আমি বিছানায় ওঠে বসতেই উনি ধপ করে চোখ খুলে ফেললেন। নিজের পাশে কোলবালিশ আবিষ্কার করে হয়তো উনি ঈষৎ রেগে গেলেন। এক ঝটকায় কোলবালিশ অদূরে ছুঁড়ে মারলেন। উনার কর্ম কান্ডে আমার মুখটা হা হয়ে গেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

এটা আপনি কী করলেন? কোলবালিশটা ছুঁড়ে মারলেন কেনো?

তোমার সাহস হয় কী করে এই থার্ড পার্সনটাকে এখানে রাখার?

এতদিন তো এটাই আপনার জানু, সোনা, কলিজা ছিল। আজকে এটা থার্ড পার্সন হয়ে গেলো? আমি ভাবলাম আপনি হয়তো কোলবালিশটা মাঝখানে রাখতে ভুলে গেছেন।

তোমাকে এতো ভাবতে কে বলেছে? ভেবেছিলে যখন এটা ভাবতে পারলে না আমি ইচ্ছে করেই সরিয়ে রাখছি।

আমি…..

হুসস আর কোনো কথা নয়।

উনি আমার হাত ধরে টেনে শুইয়ে দিলেন। উনি আমার অতি সন্নিকটে এসে শুয়ে পড়েন। আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে উনি আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরেন। আমার শরীর বরফের ন্যায় জমে গেলো। শিঁড়দাড়া দিয়ে হিম শীতল বাতাস বয়ে গেলো। বিষ্ময়ে আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। উনার চোখের চাহনি শীতল। উনার গাড় কালো রঙের চোখের মনির দিকে তাকিয়ে আমি সম্মোহনী হয়ে গেলাম। আমার ঘোর লেগে গেলো। উনার চোখের পলক পড়তেই আমার ঘোর কেটে গেলো। উনার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বারের মতো উনার এই বেসামাল প্রখর চোখের দিকে তাকানোর সাহস আমার নেই। উনার কাছ থেকে ছাড়া পাবার জন্য নড়াচড়া করতেই উনি প্রখর কন্ঠে বলে ওঠলেন,

একদম নড়াচড়া করবে না। যেভাবে আছো এভাবেই থাকবে। নিজেও ঘুমাও আর আমাকেও ঘুমাতে দাও।

কথাটা বলেই উনি চোখ দুটো বন্ধ করে নিলেন। কিন্তু আমার চোখ জোড়া বন্ধ হলো না। আমার দৃষ্টি উনার এলোমেলো চুল আর উনার চোখ জোড়াতেই আটকে আছে। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হলো। সময় অতিবাহিত হচ্ছে সেই সাথে ঘুরছে ঘড়ির কাটা। ঘড়ির কাটা ১১ টার ঘর পেরিয়ে ১২ টার ঘরে পা দিয়েছে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। আমার দৃষ্টি আটকে গেলো উনার কানের পাশের কালো কুচকুচে তিলটাই। দৃষ্টি বেসামাল হয়ে আসছে। চেয়েও চোখ ফেরাতে পারছি না।

উনি তো এখন ঘুমিয়ে আছেন। উনার তিলটা যদি একটু ছুঁয়ে দেই তাহলে কী খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে? আমার ওষ্ঠ্য জোড়া যদি উনার তিলটা স্পর্শ করে দেয় তাহলে কী খুব বড় অন্যায় হয়ে যাবে?

আজকে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। দুজনের মাঝে দূরত্ব ক্ষীণ হয়ে আসলে। দুজন দুজনের এতোটাই কাছে যে উনার প্রতিটা নিশ্বাস প্রশ্বাস আমার নাক, মুখ, চোখ ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমি মাথাটা উঁচু করে পর পর তিনটা চুমু খেলাম উনার কানের পাশের কালো তিলটাই। অতঃপর উনার থেকে একটু দূরত্ব বজায় শুয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলাম।

__________________

ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে কলেজ থেকে ফিরেই ওয়াশরুমে চলে ওলাম শাওয়ার নেওয়ার জন্য। রুদ্র আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছেন আর উনি গিয়েছেন ইলান ভাইয়াদের বাসায়। মামুনি ইলান ভাইয়াদের পরিবারের সবাইকে লাঞ্চের করার জন্য দাওয়াত করেছেন। ইলান ভাইয়া এতদিন ধরে আসবো আসবো করেও শেষ মহুর্তে বেঁকে বসেছেন। উনি এতোটা রাস্তা ড্রাইভ করে আসতে পারবেন না। উনার হাত, পা, নাক, মুখ সব ব্যথা করছে। এতোটা রাস্তা উনার পক্ষে ড্রাইভ করে আসা অসম্ভব।

উনি যে আলসেমির জন্য আসতে চাচ্ছেন না সেটা রুদ্র ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল। তাই তো রুদ্র আনতে গেছে। বেশ সময় নিয়ে শাওয়ার নিলাম। ওয়াশরুমের দরজায় নক পড়তেই। মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে বেরিয়ে এলাম। উনি ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে দাঁত কটমট করতে করতে কিছু একটা বললেন। কিন্তু আমার কর্ণগোচর হলো না।

আমি পরিপাটি হয়ে সবার সাথে দেখা করতে গেলাম। সবার সাথে কুশল বিনিময় করলাম। রুনা আপু ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার দরুন রুনা আপুর পেটটা অনেকটাই ফুলে ওঠেছে।

ইলান ভাইয়ার আম্মু হাসতে হাসতে মামুনিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

ভাবি আমার আর তর সইছে না। কবে যে বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসবে আর আমি ওকে নিয়ে খেলবো। প্রহর যেনো কাটছেই না। এখনি তো নাতি নাতনি নিয়ে খেলার বয়স।

চলবে…..

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৩৯

ভাবি আমার আর তর সইছে না। কবে যে বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসবে আর আমি ওকে নিয়ে খেলবো। প্রহর যেনো কাটছেই না। এখনি তো নাতি নাতনি নিয়ে খেলার বয়স।

আর আমার মায়ের এখন তার বাচ্চা বউমাকে নিয়ে খেলার সময়।

উনি চুলে হাত চালিয়ে সোফায় আয়েশ ভঙ্গিতে বসতে বসতে কথাটা বললেন। আমি উনার কথাটা শোনা মাত্রই রাগে ফুসে ওঠলাম। রাগে নাক ফুলিয়ে বললাম,

আমাকে একদম বাচ্চা বলবেন না। আমি মোটেও বাচ্চা নই।

তুমি তো বাচ্চাই। তুমি জানো না ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু।

আমার বয়স মোটেও ১৮ বছরের নিচে না। আমার বয়স ১৮ বছর ১০ মাস ২৮ দিন ৪ঘন্টা।

মাঝখান থেকে ইলান ভাইয়া রসিকতার সুরে বলে, তুমি বাচ্চা হবে কেনো? তুমি তো ৪৫ বছরের যুবতি।

আমি গাল ফুলিয়ে ইলান ভাইয়ার দিকে তাকাই। তারপর ধুপ ধাপ পা ফেলে নিজের রুমে চলে আসি।

_____________

ছাদের রেলিংয়ের ওপর বসে আছি। আমার দৃষ্টি ঐ দূর আকাশের জলমল করা তারার দিকে। ইলান ভাইয়ারা কিছুক্ষণ আগেই চলে গেছে। আমার পিছনে রুদ্রর উপস্থিতি অনুভব করতে পারছি। রুদ্র আমার হাত ধরে ফেললেন। আমাকে রেলিং থেকে নামানোর আগেই বলে ওঠলাম,

প্লিজ একটু থাকি না। প্রতিদিন তো আর বসি না। আমার নিজের ওপর ভরসা আছে। এখান থেকে পড়বো না।

উনি নিঃশব্দে পিছন থেকে এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি উনার কাজে মুচকি হাসলাম। উনার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি উনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। উনি গলার স্বর নিচু করে বললেন,

মন খারাপ?

উহু।

তাহলে এমন করছো কেনো? কেমন উদাসীন নিস্তব্ধ। আমি জানি তোমার মন খারাপ থাকলেই এখানে এসে এভাবে বসে থাকো।

আজকে আমার মন একটুও খারাপ না। আমি তো নিজের জীবনের হিসেব মিলাতে ব্যস্ত। জানেন জীবনটা অনেকটা অংকের মতো। অংকে যেমন একটু ভুল করলেই অংক শেষ। জীবনেও একটু ভুল করলে সেই ভুলটাই পারে আপনার জীবন ধ্বংস করে দিতে। অংকে যেমন প্রথম একটু ভুল হলে শেষে আর হিসাব মিলানো সম্ভব হয় না। তেমনি জীবন গঠনের শুরুতেই যদি ভুল করা হয়। তাহলে সেই জীবনের হিসাব কখনোই মিলবে না।

কী ব্যাপার আজকে এতো গম্ভীর টাইপ কথা বার্তা? বাচ্চাটা আজকে বড় মানুষের মতো কথা বলছে।

বাদ দেন এসব কথা। রুনা আপুকে কি কিউট লাগে তাই না? দিনকে দিন যেনো রুনা আপুর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। আচ্ছা আমি যদি প্রেগনেন্ট হই তাহলে আমাকেও কী রুনা আপুর মতোই গুলুমুলু লাগবে?

তোমার মাথায় যেসব ভাবনা চিন্তা ঘুরছে সেগুলো ঝেড়ে ফেলে দাও। বাচ্চা-কাচ্চার কথা মাথাতেও আনবে না। তোমার এখনো বেবি নেওয়ার বয়স হয়নি। বাচ্চা বাচ্চার মতোই থাকো। একদম বড় হওয়ার চেষ্টা করবে না আর নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস করো।

আপনার মনে হয় না আপনি একটু বেশিই ভাবছেন? আদোও কী আমাদের মাঝে বেবি নেওয়ার সম্পর্ক আছে? থাক বাদ দেন সেসব কথা। আমি কিছুদিনের জন্য বাসায় যেতে চাই।

তুমি কী এখন রাস্তায় আছো?

বুঝতে পারলাম উনি ফাজলামো করছেন। আমি সিরিয়াস হয়ে বললাম,

দেখুন আমি মোটেও মজা করার মুডে নাই। আমি সিরিয়াস। প্লিজ না করবেন না। যাস্ট কয়েকটা দিনের জন্য যাব। এখানে আর ভালো লাগছে না। কিছুদিন নিজের মতো থাকতে চাই। প্লিজ যেতে দিন না।

উনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

আচ্ছা যাও।

সত্যি?

হুম।

ধন্যবাদ।

আমি এক দৌড়ে নিচে চলে যেতে গিয়েও ছাদের দরজার কাছ থেকে ফিরে এলাম। উনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম,

আপনাকে একটা কথা জিঙ্গেস করি?

বল।

প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুটা কী নিতান্তই এক্সিডেন্ট নাকি এখানে অন্য কোনো রহস্য আছে?

কিছু কথা না জানাই ভালো। কিছু জিনিস আড়ালে থাকাই ভালো। রহস্যময় জিনিস সামনে চলে আসলে অনেকের জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। তুমি নিচে যাও।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। উনি যেটা ডিসাইড করেন বলবেন নাহ সেটা সারাদিন জিঙ্গেস করলেও বললবেন না। তাই উনার সাথে বেকার কথা না বাড়িয়ে নিচে চলে এলাম। নিজের সমস্ত জিনিস গুছিয়ে নিলাম। আগামীকাল শুক্রবার থাকাই কলেজ নেই। সকাল সকাল ঐ বাসাই চলে যাব।

_____________

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কেউ দরজা খুলে দিচ্ছে না। একটু আগেই রুদ্র আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। উনাকে বাসায় আসতে বললে উনি বলেন উনার কার সাথে দেখা করার কথা আছে। তাই আমি আর কথা বাড়ালাম না। উনাকে জোড় করে যে কোনো কাজ করানো যাবে না সেটা এতোদিনে আমি বুঝে গেছি। যখনি দরজাই পাঞ্চ মারতে যাব ঠিক তখনি দরজাটা খুলে যায় আর পাঞ্চটা লাগে সোজা ভাইয়ার নাকে। ভাইয়া নাকে ধরে চিৎকার মারে আর আমি হা করে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। কয়েক সেকেন্ড লাগলো আমার ব্যাপারটা বুঝতে। আমি কোনো রকম বিচলিত হলাম না। ভাইয়াকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে যেতে যেতে মুখ ভেংচিয়ে বললাম,

রং টাইমে রং জায়গাই এন্ট্রি নিলে এমনি হবে। বলদ একটা।

খালাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে বলে বেঁচে গেছিস। শ্বাশুড়িটা যদি খালামনি না হয়ে অন্য কেউ হতো। তাহলে তোকে শ্বশুর বাড়ির সামনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বের করে দিতো।

আমি ইন্টিলিজেন্ট বুঝছো। তাই এমন একটা বাসার বউ হইছি যে বাসার পিছনের দরজা নাই। তাই বাসা থেকে বের করে দেওয়ারও টেনশন নাই। চোখের সামনে থেকে বিদায় হও তো। তোমাকে দেখে আমার নাক চুলকাচ্ছে।

মানুষ ঠিকই বলে শয়তান কোনোদিন ভালো হয় না। কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না তেমনি শয়তানকে যতই ভালো মানুষের গলায় ঝুলিয়ে দাও না কেনো সে কখনো ভালো হবে না। আমার নাকটা ভেঙে দিলি না। আমি আজকে একটা অভিশাপ দিলাম তোকে তোর ছেলের নাক বুচা হবে।

আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বললাম, শকুনের দোয়ায় গরু মরে না। আম্মু কই?

তুই নিজে খোঁজে নে। আমার ঠেকা পড়ছে না বলতে।

ভাইয়া হাত দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে রুমে চলে গেলো। আমি ভাইয়ার যাওয়ার দিকে বিরক্তকর চাহনি নিক্ষেপ করে আম্মুকে ডাকতে শুরু করলাম।

আম্মু, আম্মু, আম্মু।

আম্মু তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে এলো।

রিয়া কখন এলি। কেমন আছিস? আজকে আসবি আমাকে আগে বলবি না। তোর স্বাভাবটা এখনো চেইন্জ হলো না। বাসায় আসলেই আগে আমাকে চাই।

আমার এই বাজে স্বভাব কোনো দিন যাবে না। তোমারও তো এক সাথে একশটা প্রশ্ন করা অভ্যাসটা এখনো পরিবর্তন হয়নি। আমি আসছি অনেকক্ষণ। কিন্তু তোমারই তো পাত্তা নাই।

আমি ওয়াশরুমে ছিলাম।

আমি যদি আগে বলে দিতাম তাহলে তো আর তুমি এতোটা সারপ্রাইজড হতে না। আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। আর আমি অনেক ভালো আছি। তুমি কেমন আছো।

তোকে দেখার পর খারাপ থাকি কীভাবে? কতদিন ধরে তোকে দেখি না। কিছু দিন ধরে তোকে দেখার জন্য মনটা আনচান করছিল।

আমি তোমার মন পড়তে পারি। তাই তো তোমার মন পড়ে চলে এসেছি। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছি।

আগে ফ্রেশ হয় কিছু খেয়ে নে। তারপর তোর কথা শুনবো।

__________

ভাইয়া আমার বিছানার ওপর পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে সাউন্ড দিয়ে গান শুনছে। গানের তালে তালে পা নাচাচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ পর পর বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করছি ভাইয়ার দিকে। কিন্তু সেদিকে ভাইয়ার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

ভাইয়া তুমি যাবে এখান থেকে। নাহলে মোবাইল ছুড়ে মেরে তোমার মাথা ফাটিয়ে দিব।

ফোনটা হাতে নিতেই ফোনটা বেজে ওঠে। আমি ফোন রিসিভ করতে নিলেই ভাইয়া বলে ওঠে,

তোর লজ্জা সরম নাই। ভাইয়ের সামনে জামাইয়ের সাথে কথা বলবি। আমি তোর গুরুজন। আমাকে রেসপেক্ট করে এখান থেকে বিদায় হ।

আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করতে করতে চলে গেলাম।

চলবে…….