পূর্ণিমাতিথি পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
526

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪০

মাঝ রাতে রুদ্রকে ড্রয়িংরুমের সোফায় আয়েশ করে বসে থাকতে দেখে আমি চমকে ওঠলাম। এটা কী সত্যিই রুদ্র? নাকি আমার ভ্রম। আচ্ছা আমি স্বপ্ন টপ্ন দেখছি না তো? সপ্নই হবে। এটা রুদ্র হতেই পারে না। মাঝরাতে রুদ্র আমাদের বাসায় আসবে এটা অসম্ভব।

রুদ্র দিকে তাকিয়ে কানার মতো হাঁটতে গিয়ে চেয়ারে পা বেজে গেলো। রুদ্র আমার কাছে হওয়ায় রুদ্র আমাকে ধরে ফেললো। এবার বুঝতে পারলাম এটা স্বপ্ন না সত্যি। এটা বুঝা মাত্রই আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। যে লোক রাত ১০ টার পরে কাউকে ফোন দেয় না। সেই লোক নাকি মাঝ রাতে আমাদের বাসায় এসেছে। এটাও দেখার বাকি ছিল। পরমুহূর্তেই রুদ্রর ধমক শুনে কেঁপে ওঠলাম।

তুমি এতোটা কেয়ারলেস কী করে হতে পারো? এত বড় একটা চেয়ার সেটাও দেখতে পারছ না। এখন যদি তুমি এখান থেকে পড়ে যেতে কী হতে পারতো ভাবতে পারছো? তোমার কোনো আইডিয়া আছে আমি তোমাকে নিয়ে কতোটা টেনশনে থাকি? তুমি কবে একটু নিজের কেয়ার নিতে শিখবা?

রুদ্র আমার আরেকটু সন্নিকটে আসতেই কারো আসার শব্দ শুনে আমাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে যায়। হালকা একটু কেশে সোফায় গিয়ে বসে পড়েন। আব্বু আর ভাইয়া এসে রুদ্র বিপরীত পাশের সোফায় বসে। রুদ্র সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আব্বু রুমে চলে যাই। আব্বু হাই পেশারের রোগী। বেশি রাত জাগলে আবার প্রবলেম হয়। ভাইয়ার একটা ফোন আসায় ভাইয়াও ওঠে চলে যাই।

আম্মু অতি দ্রুত এসে রুদ্রর সামনে উপস্থিত হয়। আম্মুর হাতে সবজি কাটার ছুড়ি। আম্মু এখন রান্না করছে। রান্না করবেই না কেনো? একমাত্র বোনের একমাত্র ছেলে। তার উপর একমাত্র মেয়ের জামাই। কতো আদরে। তাহার খাতির যত্নের কী কমতি রাখতে পারে? অবশ্যই না। আম্মু ব্যস্ত হয়ে পড়ল রুদ্রকে জিঙ্গেস করতে। সে কী খাবে না খাবে? অবশ্য আম্মু সবই জানে। আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আম্মু আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে,

ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? দেখছিস তো ছেলেটা একা একা বসে বোরিং ফিল করছে। কোথায় একটু কথা বলবি তা না ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। হসপিটাল করে এতো পথ জার্নি করে আসছে কিছু লাগবে কি না এসবও তো জিঙ্গেস করতে পারিস। তোর মাথায় কোনোদিন বুদ্ধি সুদ্ধি হবে না।

আমি হাবলার মতো আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছি। আম্মু হঠাৎ এমন অদ্ভুত বিহেইভ করছে কেনো সেটাই বুঝতে পারছি না। আর উনাকে হসপিটাল করে এতোটা পথ জার্নি করে আসতে আমি বলেছিলাম। যত সব ঢং। আম্মু আরেক বার চোখ গরম করে তাকাতেই আমি সুর সুর করে গিয়ে রুদ্রর পাশে বসে পড়লাম। আম্মু চলে যেতে রুদ্র একেবারে আমার গা ঘেষে বসে পড়ে। আমি বিরক্তিরকর চাহনি উনার দিকে নিক্ষেপ করি।
আমি কাঠ কাঠ গলায় বলি,

আপনি এখানে কেনো এসেছেন? মাঝ রাতে কেউ কারো বাসায় আসে।

আমার বউ এখানে আর আমি এখানে আসবো না এটা হতে পারে? আমার শ্বশুরবাড়ি বাড়ি আমি যখন ইচ্ছে তখন আসবো তোমার কী?

আমি রাগে হিশহিশিয়ে বললাম, মাঝ রাতে এই বাসায় এসে কী প্রমাণ করতে চাইছেন? আমাকে ছাড়া আপনি থাকতে পারেন না? আপনি বউ পাগল হয়ে গেছেন? আমার জন্য আপনার ভালোবাসা উতলায়ে পড়তাছে?

আমার কোমড় চেপে ধরে উনি আমাকে আরেকটু নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন। আমি উনার কাছ থেকে ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করছি। অস্বস্তিতে হাসফাস করছি। বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। কেউ যদি চলে আসে আর আমাদের এভাবে দেখে ফেলে তাহলে মান-সম্মান আর থাকবে না। সব প্লাস্টিক হয়ে যাবে। রুদ্র আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে মোহনীয় কন্ঠে বলেন,

এরকম একটা সুন্দরী বউ ঘরে থাকলে যে কেউই পাগল হবে।

উনি আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাইয়াকে এদিকে আসতে দেখে উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে সরে বসলেন। সেই সুযোগে আমি সেখান থেকে ওঠে চলে আসলাম।

_________________

জামাই আদর কাকে বলে? কত প্রকার? কী কী? সেটা আজকে উনি ভালো করেই টের পেয়েছেন। উনি রুমে এসেই চার হাত পা মেলে বিছানায় শুয়ে পড়েছেন।

তোমার মা আজকে আমাকে চার মাসের খাবার এক সাথে খাইয়ে দিছে। ওহ গড ব্যাঙের মতো না আমার পেটটাও ফেটে যায়।

উনার কথা শুনা মাত্র আমি হেসে দিলাম। উনি আধ শোয়া হয়ে বসলেন। আমার এক হাত ধরে টেনে উনার কাছে নিয়ে আসলেন। আমার কোমড় চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলেন,

আমার ওপর কী জাদু করেছো বলো তো? তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারি না। সবকিছু ফাঁকা লাগে।

আমার কী হলো আমি নিজেই বুঝতে পারলাম না। হুট করেই উনাকে প্রশ্ন করে বসলাম।

আপনি আমাকে ভালোবাসেন?

এই প্রশ্ন করাটা অনেকটা বাচ্চামো হয়ে গেলো। যেখানে উত্তরটা জানা সেখানে প্রশ্ন করাটা বৃথা। উনার উত্তরটা যে নেগেটিভ হবে সেটা তো আমি জানি।

ভালোবাসি কি না জানি না। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগে না। তোমাকে আগে সহ্য করতে পারতাম না আর এখন তোমাকে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুম আসে না। তুমি আমার বদ অভ্যাস হয়ে গেছো। প্রিয় বদ অভ্যাস যেটা ছাড়া এক মুহূর্ত আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না। তুমি আমার অস্তিত্বে মিশে গেছো। তুমিহীনা এই আমি প্রাণহীন। বেঁচে থাকার জন্য আমার তোমাকে প্রয়োজন। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য তোমাকে প্রয়োজন। কোনোদিন তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেলো জানবে এই হার্টের ড. এর হার্টটাও তুমি নিয়ে যাবে। যেদিন তুমি থাকবে না যেনো রেখো এই রুদ নামক ব্যক্তিটাও আর থাকবে না।

উনার মোহনীয় কন্ঠে আমি একটা ঘোরের মাঝে চলে গেলাম। নিজে থেকেই আমি উনার আরেকটু কাছে চলে গেলাম। উনার বুকের মাঝে মাথা রাখলাম। উনি আমার মাথায় শব্দ করে চুমু খেলেন। আবেশে আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরেই শুয়ে পড়লেন।

_________________

সকাল থেকে আম্মু ভীষণ ব্যস্ত উনি খাবেন আর কী না খাবেন এটা নিয়ে। অলরেডী দুই বার ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গেছে রুদ্রর। উনি আমার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে হাসছি। আমাকে খাবার নিয়ে জোড় করা। জোড় করে মুখে খাবার ঠুসে দেওয়া। দেখুন এখন কেমন লাগে। আম্মু একেকটা রেসিপি রান্না করছে আর রুদ্রকে খাইয়ে যাচ্ছে।

আব্বু অলরেডি বাজারে চলে গেছে। রুদ্র হসপিটালে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আম্মু সাফ সাফ না করে দিয়েছে এখন কোথাও যাওয়া চলবে না। আব্বুকেও অফিসে যেতে দেয়নি। ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে এসে সোফায় বসল। ভাইয়াকে দেখেই রুদ্র বলে ওঠে,

তোমার নাকে কী হয়েছে? গতকাল থেকে লক্ষ্য করছি নাকটা কেমন যেনো লাগছে।

কি আর হবে তোমার এই দজ্জাল বউ ঘুষি দিয়ে নাক ফাটিয়ে দিয়েছে। ভাই এই মাইয়ারে কেমনে সহ্য করো। মাইয়া মানুষ মানেই প্যারা। একে দেখে আমার বিয়ে করার সখ মিটে গেছে। সারাজীবন আবিয়াত্তা থাকবো তবুও কোনো মেয়েকে বিয়ে করবো না।

তোমাকে কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে হবে না। এক কাজ করো তুমি একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেলো।

কথাটা বলেই আমি ভাইয়ার দিকে দাঁত কেলিয়ে তাকাই। ভাইয়া মুখ কালো করে সোফায় বসে রয়েছে। ভাইয়া হয়তো ভুলে গিয়েছিলো আমার সামনে বেফাস কথা বলা মানেই ফেসে যাওয়া। ভাইয়া মুখ কালো করেই বলে,

তোর মতো মীর জাফর আমি জীবনে দেখি নাই।

চলবে………

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪১

আজকে দুই দিন হইছে রুদ্র সাথে ফিরে এসেছি। এসেই দুজন দুজনের কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। রুদ্র হসপিটাল নিয়ে বিজি আর আমি আমার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। রুদ্র আমাদের বাসা থেকে এসেই ময়মনসিংহ চলে গেছে। হসপিটালের জরুরি কাজের জন্যই ময়মনসিংহ যাওয়া। ওখানে গিয়েই উনি অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। রুদ্র এতোটাই ব্যস্ত যে এক মিনিটের মতো স্বস্তির নিশ্বাস নেওয়ার মতো সময় নেই। কিন্তু এতো ব্যস্ততার মাঝেও আমার প্রতি উনার খেয়াল রাখা, কেয়ার করা একটুও কমেনি। হয়তো কাছে থেকে নিজে এসব করতে পারেন না। তবে দূর থেকেই আমার খেয়াল রাখছেন। আমার প্রতি বিন্দুমাত্র অনীহা উনি দেখান না।
আমার কখন কী লাগবে সবকিছুর খেয়াল রাখছেন।

মামুনিকে ফোন করে আমার খাবারের নজরদারি করেন। টাইমে টাইমে আমাকে ফোন করে খাবারের কথা মনে করিয়ে দেওয়া। সারাদিন কর্ম ব্যস্ততার পরও আমার আবদার রাখতে রাতে আমার সাথে ফোনে কথা বলা। অন্যান্য কপোত কপোতীর মতো হয়তো ঘন্টার ঘন্টার ফোনে কথা বলেন না। তবে মিনেট পাঁচেক আমার সাথে যতটুকু কথা বলেন ততটুকুই আমার জন্য এনাফ।

উনার ঢাকায় ফিরতে আরো তিন চার দিন লাগবে। তাই রুদ্র আমাকে আমাদের বাসায় চলে যেতে বলেছে। উনি এখন এখানে নাই আর আমি একা একা কলেজে যাব সেটা উনি হতে দিতে পারেন। একদমি না। আমাদের বাসায় চলে গেলে ভাইয়া কলেজে দিয়ে আসতে পারবে আবার নিয়েও আসতে পারবে।

আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। ভাইয়া আমাকে নিতে আসছে। ভাইয়া নিজেও জানে না কী প্যারা নিতে আসছে। একবার শুধু বাসাই যায় ভাইয়ার জীবন জ্বালাময়, প্যারাময় করে দিব।
বুইড়া হয়ে গেছে এখনো বিয়ে করে না। মেয়েদের লাইন লাগিয়ে দিব আমারও দেখার আছে বিয়ে না করে যায় কই?

মিনিট দশেকের মাঝেই কলিংবেল বেজে ওঠলো বুঝতে পারলাম ভাইয়া এসেছে। আমি ব্যাগ হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হলাম। মামুনিকে বলে ভাইয়ার সাথে বেরিয়ে এলাম। ভাইয়া ব্যাগ নিয়ে আগে আগে হাঁটছে আর আমি ভাইয়ার পিছন পিছন হাঁটছি। ভাইয়াকে জ্বালানোর জন্য আমি একটু উচ্চ স্বরেই গেয়ে ওঠলাম,

বাবা আমার কী বিয়ে হবে না? বাবা…..

ভাইয়া পিছন ফিরে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমি চুপ করে গেলাম। ভাইয়া সামনে তাকাতেই আমি হেসে দিলাম।
ভাইয়াকে কিছুদিন ধরে আব্বু বিয়ের কথা বলছে। কিন্তু তার এক কথা। সে এখন কিছুতেই বিয়ে করবে না। ভাইয়াকে বিয়ের কথা বলতেই এখন ভাইয়া রেগে যাচ্ছে।

_______________

গত মিনিট বিশেক যাবৎ জ্যামে আটকে আছি। এতক্ষণ ধরে জ্যামে আটকে আছি কিন্তু জ্যাম ছাড়ার নাম গন্ধ নেই। অসহ্য লাগছে। এত বোরিং টাইম পাস করা যায়। ভাইয়াকে একটু জ্বালালে কেমন হয়? হুট করেই ভাইয়াকে জ্বালানোর একটা আইডিয়া মাথায় চলে আসলো। আইডিয়াটা মন্দ না। আমি গাড়ির জালানা দিয়ে মাথা বের করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। হঠাৎ করে দেখতে পেলাম অতিব সুন্দরী রমনী বসে আছে একটা ছেলের বাইকের পিছনে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা। দুজনকে একসাথে মানিয়েছেও। আমি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

ভাইয়া দেখ তো মেয়েটা দেখতে অসাধারণ না? তোমার বউ হলে কিন্তু মন্দ হবে না।

ভাইয়া আমার দিকে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে বলে, তোর কোনো কমনসেন্স নেই। দুজনকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রেমিক প্রেমিকা। আরেক বেডার প্রেমিকাকে ধরে বেধে আমার বউ বানিয়ে দিচ্ছিস।

তুমি আমাকে বকা দিলে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। আপু,, এই আপু।

ভাইয়া আমার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে আমাকে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি তো আমিই ভাইয়াকে না জ্বালালে তো আমার পেটের ভাত হজম হবে না। ঐ আপুটা ইশারায় জিঙ্গেস করলো আমি তাকে বলছি কী না? আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালাম। ভাইয়া আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমি মিষ্টি হেসে বললাম,

আপু তোমাদের যুগলবন্দিটা অসাধারণ। তোমরা দুজন মেইড ফর ইচ আদার। সারাজীবন এমনিই হাসিখুশি থেকো।

আপুটা মিষ্টি হেসে বললো, দোয়া করো।

অবশ্যই।

এবার ভাইয়াটা এদিকে ফিরে তাকাল। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, ধন্যবাদ পিচ্চি। আমরা দুজন মেইড ফর ইচ আদার নাকি জানি না। তবে ও আমার জীবনে এসে আমার জীবনটা পরিপূর্ণ করে দিয়েছি। আমাদের একসাথে পথ চলা প্রায় তিন বছরের। এই তিন বছরে ও কখনো আমার হাত ছেড়ে যায়নি। সব সময় আমার পাশে থেকেছে।

ভাইয়া আপনাদের মতো ভালোবাসার মানুষগুলো দেখতেও ভালো লাগে।

ঐ রাস্তার গাড়িগুলো ছেড়ে দেওয়ায় আপু আর ভাইয়াটা চলে গেলো। যাওয়ার আগে আমাকে বাই বলে গেলো। আমি এবার ভাইয়ার দিকে দাঁত কেলিয়ে তাকালাম। ভাইয়া বুকে হাত দিয়ে বসে আছে।

তোর জন্য না জানি আমি কোনদিন হার্ট এ্যাটাক করে ফেলি।

হার্ট এ্যাটাক করলেও সমস্যা নেই আমার জামাই দিয়ে তোমাকে ফ্রী চিকিৎসা করিয়ে দিব। আমি অনেক মহান ব্যক্তি বুঝছো। তোমার মতো খানদানী ফকিরদের একটু হেল্প করতেই পারি।

একের পর এক মেয়ে দেখিয়ে আমি ভাইয়াকে বিরক্ত করে যাচ্ছি। হঠাৎই আমার চোখ আটকে গেলো একটা মেয়ের ওপর। আমি এর আগে এতো সুন্দর মেয়ে দেখিনি। আপুটা সবদিক দিয়েই পারফেক্ট। এক কথায় অসাধারণ। ভাইয়াকে মেয়েটাকে দেখানোর পর ভাইয়া একটা কথায় বলেছিল,

মাশাল্লাহ।

এরপর ভাইয়া আর কোনো কথা বলেনি। নির্বিকার তাকিয়ে আছে ঐ আপুটার দিকে। আপুটাও আড় চোখে বার বার এদিকে তাকাচ্ছে। ততক্ষণে জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। আমি গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে আপুটার দিকে তাকিয়ে বললাম,

আপু আপনাকে আমার ভাইয়ার অনেক পছন্দ হয়েছে।

আপুটা কিছু বললো না শুধু মুচকি হাসলো আমি ভাইয়ার দিকে তাকালাম ভাইয়ার ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি। তার মানে ভাইয়ার মেয়ে পছন্দ হয়েছে। নাহলে এতক্ষণে আমাকে দুই তিনটে ধমক মারতো।

_________________

রুদ্রকে একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু উনি কল রিসিভ করছেন না। দশ বারের মাথায় কল রিসিভ করলেন।

সরি, সরি,, সরি পিচ্চি। ফোনটা গাড়িতে ছিল আর আমি হসপিটালে ছিলাম তাই তোমার কল রিসিভ করতে পারিনি। প্লিজ রাগ করো না। সরি এগেইন।

ইট’স ওকে। এতোবার সরি বলতে হবে না। আমি আপনার কে হই যে আপনার ওপর রাগ করবো। আপনার ওপর রাগ করার কোনো অধিকার আমার নেই।

পিচ্চিটার বুঝি অভিমান হয়েছে? তো মহারানীর রাগ ভাঙানোর জন্য এই অধম কী করতে পারে?

আমার অভিমান ভাঙাবেন আপনি? আপনার এতো সময় আছে? আপনি তো মহা ব্যস্ত এই অতি তুচ্ছ রমনীর অভিমান ভাঙানোর সময় কী আপনার হবে?

একটু থেমে অভিমানী গলায় বললাম, আপনি কী বুঝতে পারেন না কেউ একজন আপনার ফোনের অপেক্ষায় সারাদিন বসে থাকে? আপনার কন্ঠস্বর কর্ণগোচর করার জন্য কারো বক্ষঃস্থলে চিন চিন ব্যথা হয়? আপনার চিন্তায় সারাদিন বিভোর থাকে কেউ একজন। নাকি আপনি বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকেন।

অভিমানী পাখি এতো অভিমান করলে চলে? তোমাকে তো বুঝতে হবে তোমার বর একজন ডক্টর। তার ওপর কত দায়িত্ব। তোমার বরের ওপর আস্তা রেখে বেঁচে আছে কতগুলো পরিবার। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমার কী ইচ্ছে করে না তোমার সাথে একটুখানি সময় কাটানোর। তোমার কোলে মাথা রেখে রাত জেগে গল্প করতে। কিন্তু আমি নিরুপায়। নিজের দায়িত্ব তো আমি অবহেলা করতে পারি না। বুঝতে পারছো আমার কথা?

হুম। আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?

হ্যাঁ বলো।

অরি আপুর সাথে কী আপনার এখনো যোগাযোগ হয়?

হুট করেই উনি চুপ করে গেলেন। উনি নিশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কর্ণগোচর হচ্ছে না। নিস্তব্ধ পরিবেশে বিকট একটা আওয়াজ হলো। পর পর কয়েকটা গাড়ির চাকার শব্দ হলো। আমার আর কিছু কর্ণগোচর হলো না। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি থমকে গেলাম।

চলবে………

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪২

হুট করেই উনি চুপ করে গেলেন। উনি নিশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কর্ণগোচর হচ্ছে না। নিস্তব্ধ পরিবেশে বিকট একটা আওয়াজ হলো। পর পর কয়েকটা গাড়ির চাকার শব্দ হলো। আমার আর কিছু কর্ণগোচর হলো না। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি থমকে গেলাম। ফোনটা হাত থেকে পরে গেলো।

উনার কিছু হয়নি তো এই ভাবনা মাথায় আসতেই আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। বিছানার ওপর থেকে দ্রুত ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। উনাকে অনবরত ফোন করতে লাগলাম। কিন্তু বার বার ফোন বন্ধ বলছে। টেনশনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।

আমি চিৎকার দিয়ে আব্বু-আম্মুকে ডাকলাম। আমার চিৎকার শুনে ছুটে আসলো ভাইয়া আব্বু-আম্মু। ভাইয়া বার বার জিঙ্গেস করে যাচ্ছে। কী হয়েছে? আমি চিৎকার কেনো করলাম? কথা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কথাগুলো যেনো সব আমার গলায় আটকে আসছে। যেনো কেউ আমার গলা চেপে ধরে আছে। আমি ঠোঁট নাড়িয়ে কোনো মতে রুদ্রর কথাটুকু বললাম। ভাইয়া কতটুকু আমার কথা বুঝলো তা আমার বোধগম্য হলো না।

ভাইয়া পরমুহূর্তেই কাউকে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। যতটুকু বুঝলাম ভাইয়া রুদ্রকে ফোনে ট্রাই করছে। রুদ্রকে ফোনে না পেয়ে ভাইয়া ছুটে নিজের রুমে চলে গেলো। কিযৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই ভাইয়া হাতে করে একটা ডায়েরী নিয়ে আমার রুমে আসলো।
ডায়েরী থেকে কারো নাম্বার ফোনে তুলল। ভাইয়া ফোন করতে করতে বেলকনিতে চলে গেলো।

কিছুক্ষণ পর বেলকনিতে কিছু পড়ার শব্দ শুনে আমি আম্মু আর আব্বু ছুটে গেলাম। ভাইয়ার ফোনটা তিন টুকরো হয়ে বেলকনিতে ছড়িয়ে আছে আর ভাইয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বু-আম্মু অনবরত জিঙ্গেস করে যাচ্ছে কী হয়েছে? কিন্তু ভাইয়া কোনো কথা বলছে না। যেনো ভাইয়া বাক শক্তিহীন হয়ে গেছে। আমি ভাইয়াকে দু হাতে আঁকড়ে ধরে জিঙ্গেস করে যাচ্ছি, কী হয়েছে? রুদ্রর কোনো খবর পাওয়া গেছে কী না? ভাইয়া আমার দিকে অশ্রু সিক্ত চোখে তাকাল। আমি ভাইয়ার অশ্রু সিক্ত চোখ দুটো দেখে দু পা পিছিয়ে গেলাম। শুধু একটা কথায় মনে হচ্ছে রুদ্রর কিছু হয়নি তো? আম্মু আরেক বার জিঙ্গেস করতেই ভাইয়া ভাঙা ভাঙা গলায় উত্তর দেয়।

কোন ডক্টরের গাড়ির ওপর নাকি গাছ পড়েছে। গাড়ি থেতলে গেছে। গাড়ির ভিতর যে ডক্টরটা ছিল তিনি আর বেঁচে নেই। উনারও সারা শরীর থেতলে গেছে। অক্ষি কোঠর থেকে চোখ দুটো বেরিয়ে এসেছে। পা দুটো কেটে………..

আর কিছু আমার কর্ণগোচর হলো না। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসলো। মুহূর্তের মাঝেই ঢলে পড়লাম।

________________

ঙ্গান ফিরলে নিজের চোখের সামনে শুভ্র রঙটা ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম। মস্তিষ্কে শুধু একটা কথার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। রুদ্রর কিছু হয়নি। রুদ্রর কিছু হতে পারে না। কিছুক্ষণ পর অনুভব করতে পারলাম। আমার মাথা কেউ আলতো হাতে সন্তপণে নিজের বক্ষঃপিঞ্জরে চেপে ধরে আছে। নাকে ঠেকছে খুব পরিচিত একটা পারফিউমের স্মেল। মাথাটা তুলে লোকটার মুখ দেখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। মাথাটা ভার ভার লাগছে। মাথা তুলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মাথা তুলার বৃথা চেষ্টা না করে ঘাড় কাত করে মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম। কাঙ্ক্ষিত মুখটা দৃষ্টিগোচর হতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি থমকে গেলাম।

আমি এক হাত বাড়িয়ে রুদ্রর গালের এক পাশে হাত রাখলাম। কী নিষ্পাপ মুখশ্রী। এই ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে আমি এক জনম কাটিয়ে দিতে পারবো অনায়সে। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না রুদ্র আমার চোখের সামনে শুয়ে আছে। আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে উনাকে দেখতে লাগলাম। আমি হালকা নড়েচড়ে ওঠতেই রুদ্রর চোখ দুটো উন্মুক্ত হয়ে গেলো। রুদ্র আমার সামনে উপস্থিত আছে এটা আমার অনুভূত হতেই সমস্ত ব্যথা যন্ত্রণা উপেক্ষা করে দ্রুত ওঠে বসলাম। আমাকে তড়িঘড়ি করে ওঠে বসতে দেখে রুদ্রও আমার সাথে ওঠে বসলো। উনি কিছু বলার আগেই আমি দু হাতে উনার মুখটা আগলে নিলাম।

এটা আপনিই না? আপনিই তো আমার সামনে বসে আছেন তাই না? আপনার কিছু হয়নি? কোনো এক্সিডেন্ট ফেক্সিডেন্ট আপনার হয়নি?

রিল্যাক্স আমার কিছু হয়নি।

আমি জানতাম আপনার কিছু হতে পারে না। আপনি আমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারেন না। জানেন ভাইয়া বলছিল আপনার নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনি আর নেই। এটা শোনার পর আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আপনার কিছু হলে আমি সত্যিই মরে যেতাম। আপনাকে ছাড়া এই পৃথিবীর অক্সিজেনও আমার কাছে বিষাক্ত লাগে। বিশ্বাস করুন আপনার কিছু হলে আমি সত্যিই মরে যেতাম।

উনি আমার অধর জোড়ায় আঙ্গুল রেখে চুপ করিয়ে দিলেন।

হুশশশ। চুপ একদম চুপ। আর কোনো কথা নয়। আমার কিছু হয়নি আমি একদম ঠিক আছি। আই’ম অল রাইট। ইচ্ছে করছে থাপড়ায়া তোমার গাল লাল করে দেই। আমার সামনে বার বার মরে যাওয়ার কথা বলতে তোমার বুক কাঁপছে না?

আমি উনার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

তোমার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি রাস্তার পাশের মোটামুটি বড় সাইজের গাছ মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে। একচুয়ালি এই রাস্তাটার দু পাশেই সারিবদ্ধ ভাবে গাছ লাগানো। চোখের পলক ফেলার আগেই গাছটা ভেঙে একটা গাড়ির ওপর পড়ে যায়। আচমকা এমন ঘটনাই আমি স্তম্ভিত হয়ে যায়। দ্রুত ব্রেক কষতে গিয়ে আমার ফোনটা জানালা দিয়ে ছিটকে বাইরে পড়ে যায়।

আমার গাড়ির সাথে সাথেই আরো কয়েকটা গাড়ি থামে। সবাই ডিউটি শেষে বাসায় ফিরছিল। তাদের মাঝেই একজন পুলিশকে ফোন দেয়। আমরা কয়েক জন মিলেই গাছটা সড়ানোর ট্রাই করছিলাম। ততক্ষণে পুলিশ চলে আসে পুলিশ স্টেশনটা পাশেই ছিল। এতকিছুর মাঝে আমি তোমাকে ফোন করার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। যে লোকটার এক্সিডেন্ট হয়েছিল তিনিও একজন ডক্টর ছিলেন। আমাদের সিনিয়র ডক্টর। অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আকস্মিক উনার এমন যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছে না।

উনার ওয়াইফ আছে?

হ্যাঁ স্যারের ওয়াইফ আছে। উনাকে আমি যত বার দেখছি তত বারই উনাকে ভীষণ শান্ত দেখছি। কখনো কারো সাথে ঝগড়া করতে দেখি নাই। কারো সাথে কখনো উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি। উনি নিচু স্বরে নমনীয় কন্ঠে কথা বলেন। আর আজকে উনার এক অশান্ত রূপ দেখে আসলাম পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছেন।

এটাই তো স্বাভাবিক। উনার জায়গায় তো আজকে আমিও থাকতে পারতাম এটা ভাবতেই আমার বুক কেঁপে ওঠছে।

কার এক্সিডেন্ট হইছে এটা না শুনেই মাথা টাথা ফাটিয়ে বসে আছো। যদি সত্যিই এটা আমি হতাম তাহলে না জানি তুমি কী করতে?

একদম বাজে কথা বলবেন না। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আপনি একদম ঠিক আছেন।

মাথায় চিন চিন ব্যথা অনুভব হতেই মুখ দিয়ে অস্পষ্ট ভেসে এলো আহ। আমি মাথা চেপে ধরলাম। আমাকে কুকিয়ে ওঠতে দেখে রুদ্র আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

মাথা কী বেশি ব্যথা করছে? ডক্টর ডাকবো?

আপনি এতো ব্যস্ত হবেন না। আমি একদম ঠিক আছি।

কতটুকু ঠিক আছো তা তো দেখতেই পাচ্ছি। দুই দুইবার মাথায় আঘাত পেলে।

আমি পুনরায় উনার বুকে মাথা এলিয়ে দিলাম। উনিও পরম যত্নে আমাকে দু হাতে আঘলে নিলেন।

তুমি কবে নিজের খেয়াল নিতে শিখবে বলো তো? আজকে যদি তোমার মাথা বেলকনির রেলিংয়ে না লেগে তুমি বেলকনি থেকে পড়ে যেতে তাহলে কী হতো ভাবতে পারছো? এটা ভাবলেই আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপে। আল্লাহর রহমতে আজকে একটুর জন্য তোমার বড় কোনো দুর্ঘটনা হয়নি।

চলবে…….