পূর্ণিমাতিথি পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0
528

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪৩

খুব মনোযোগ দিয়ে রুদ্রর ছবি আঁকছি। আমি এতো ভালো আর্ট করতে পারি না। কোনোদিন সেরকম করে শেখাও হয়নি। ছবি আঁকি শখের বসে। হুট করেই আজকে ইচ্ছে হলো উনার ছবি আঁকার। আমি বরাবরই নিজের ইচ্ছেকে বেশি প্রাধান্য দেই। তাই তো পড়াশোনা রেখে ছবি আঁকতে বসেছি।

সিঁড়িতে ধুপ ধাপ পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম রুদ্র এসেছে। সেদিকে ভ্রু-ক্ষেপ করলাম না। নিজের সবটুকু মনোযোগ দিয়ে আমি ছবি আঁকতে ব্যস্ত উনি রুমে আসলেন উনার উপস্থিতি বুঝতে পেরেও কিছু বললাম না। উনি নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য নিজের হাতের ফাইলটা ধুপ করে আমার সামনে টেবিলে রাখলেন। আমি উনার দিকে তাকালাম না। যেনো আমার সব ধ্যান ঙ্গান এই ছবি আঁকার মাঝে।

উনি মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক ‘চ’ উচ্চারণ করলেন। তবুও আমার কোনো হেলদুল নেই। হঠাৎই উনি আমার সামনে থেকে খাতাটা টেনে নিলেন। আমি বিরক্ত হয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনার মুখ দেখে আমার বিরক্তি ভাবটা কেটে গেলো। উনি হয়তো এতক্ষণ খেয়াল করেননি যে আমি পড়াশোনা রেখে ছবি আঁকছিলাম। উনি হয়তো আগে থেকেই রেগে ছিলেন। উনার উপস্থিতি বুঝতে পেরেও কিছু বলি নাই দেখে রেগে গিয়েছিলেন। এখন তো আরো রেগে গেলেন।

উনার মুখ দেখে আমি চুপসে গেলাম। উনি খাতা থেকে দৃষ্ট সরিয়ে আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি ভয়ে গুটিশুটি মেরে বসে রইলাম। উনি রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,

পড়াশোনা বাদ দিয়ে ছবি আঁকা হচ্ছে। এতক্ষণ এমন একটা ভাব করছিলেন যেনো পড়াশোনা করে পৃথিবী উদ্ধার করে ফেলছেন। আপনি পড়াশোনা করবেন কেনো? আপনি তো সব পাড়েন। আপনি তো সবজান্তা। আপনার তো পড়াশোনা করার দরকার নেই। এতো বই টেবিলে সাজিয়ে রেখে লাভ কী? সব বই বিক্রি করে দিন। কষ্ট করে কলেজে যাওয়ার কী দরকার? কলেজে যাওয়াও বন্ধ করে দিন।

উনি রাগে গজ গজ করতে করতে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। উনার রিয়েকশন দেখে আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। আমি ভেবেছিলাম উনি কেমন রিয়েকশন দিবেন আর এখন কেমন রিয়েকশন দিলেন? উনি রেগে থাকলেও পড়াশোনা নিয়ে এভাবে কখনো কথা বলেন না। আজকে তো কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিতে বলছেন। হাউ স্ট্রেইন্জ।

_______________

আমি ডিনার করে রুমে আসতেই উনি গম্ভীর গলায় বলে ওঠলেন,

আমি সোজা সাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করি। তাই তোমাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সরাসরি বলছি ড. ইফাদের থেকে দূরে থাকবে। যতটা সম্ভব কথা কম বলবে। ক্লাসের বাইরে তো একদমি কথা বলবে না। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো?

না বোঝার মতো তো আপনি কিছু বলছেন না। আপনি পরিষ্কার বাংলা ভাষায় কথা বলছেন আর আমিও একজন বাঙালি তাই আপনার কথা না বোঝার মতো তো কোনো কারণ আমি দেখছি না। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না ইফাদ স্যারকে নিয়ে আপনার সমস্যাটা কোথায়? ইফাদ স্যার আপনার কোন পাঁকা ধানে মই দিয়েছে?

তুমি বুঝবে না। বোঝার কথাও না। তুমি তো আর আমার জায়গায় নেই তাই আমার সমস্যাটা তুমি বুঝতে পারবে না। তুমি যদি ছেলে হতে আর তোমার যদি আমার মতো সুন্দরী একটা বউ থাকতো তাহলে বুঝতে পারতে আমার সমস্যাটা ঠিক কোথাই।

আপনি ঠিক কী মিন করতে চাইছেন বলুন তো।

কিছু না। তোমাকে আমি যেটা বলেছি সেটা মনে রাখলেই চলবে। এখন ঘুমোবে আসো।

_____________

আজকে কলেজ আসছি। রুদ্র আসতে দিতে চাইছিল না। আমি জোর করেই আসছি। এমনি একদিন মিস করছি আর মিস করা যাবে না। কিন্তু অসাবধানতা বশত রুদ্র যেটার আশঙ্কা করছিল ঠিক সেটাই হয়ে গেলো। আমার মাথার সাথে ত্রয়ীর মাথা স্বজুড়ে লেগে যায়। আঘাত প্রাপ্ত স্থানে পুনরায় আঘাত পাওয়ার কারণে সাথে সাথেই ব্লিডিং শুরু হয়ে যায়। তখন ইফাদ স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন। ব্যথায় আমার চোখ মুখ কুচকে গেলো। একটু জুড়েই আওয়াজ করে ওঠলাম।

সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে। ত্রয়ী ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। ইফাদ স্যার এগিয়ে আসার আগেই রুদ্র কোথা থেকে যেনো ছুটে আসেন। উনি এসেই আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা ধরে চেক করা শুরু করে দিয়েছেন। রুদ্র অস্থির হয়ে বলে ওঠলেন,

এই তোমার কী বেশি ব্যথা করছে? দেখো একদম ভয় পেয়ো না। আমি আছি তোমার সাথে কিছু হবে না।

উনি আমার একটু ব্যথা পাওয়াতেই কেমন অস্থির হয়ে পড়েছেন। আমি ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু উনি যে প্রচণ্ড রকমের ভয় পাচ্ছেন সেটা উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। উনার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। এর মাঝে একজন নার্স ছুটে আসে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে। রুদ্রর হাতে ফাস্ট এইড বক্স দিতে গেলে রুদ্র সরে যায়। চোখের ইশারায় নার্সকে বলে ব্যান্ডেজ করে দিতে। নার্সটা একটু অবাক হয়ে তবু কিছু বলে না।

এদিকে রুদ্রর কান্ড দেখে আমার ব্যথার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। এতো বড় ডক্টর হয়েও নাকি সামান্য ব্যান্ডেজ চেইন্জ করতেও হাত কাঁপছে। এতক্ষণে খেয়াল হলো আমি এখন হসপিটালে আর উনি আমাদের ক্লাসে বসে এমন পাগলামো করে যাচ্ছেন। আমি একবার সবার দিকে চোখ ভুলালাম। সবার মুখের ভাব দেখে যতটুকু আন্দাজ করতে পারলাম কেউ রুদ্রর ব্যাপার নিয়ে মাথা গামাচ্ছে না সবাই এখন আমার মাথায় আঘাত পাওয়া নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। শুধু ইফাদ স্যার ছাড়া। উনার মুখে অন্য রকম একটা বিরক্তির ছাপ। উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনি রুদ্রর উপস্থিতি এখানে সহ্য করতে পারছে না। উনি আরো বেশি বিরক্ত উনার ক্লাসে পারমিশন না নিয়ে ঢোকার কারণে।

নার্সটা ব্যান্ডেজ চেইন্জ করে দিয়ে চলে যায়। আমার বিল্ডিং বন্ধ হতে দেখে রুদ্র শান্ত হয়। উনি আমার দিকে চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়ে বলে ওঠলেন,

আজকে কলেজে আসতে নিষেধ করছিলাম না? কিন্তু আপনি আমার কথা শুনবেন কেনো? আপনি তো এখন এডাল্ট নিজের লাইফের ডিসিশান নিজে নিতে শিখে গেছেন।

উনার ধমকে আমি কেঁপে ওঠলাম। ত্রয়ী কেঁদে কেঁদে এসে বলল, তার বেখেয়ালির জন্য এমন হয়েছে। উনি ত্রয়ীর কথা শুনলেন না। সবার সামনে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি লজ্জায় অস্বস্তিতে রুদ্রর বুকে মাথা গুঁজে দিলাম। উনাকে যদি বলি নামিয়ে দিতে উনি আমার কথা শুনবেন না। উল্টো দু চারটা ধমকও দিয়ে দিতে পারেন।

________________

উনি বাসায় আসার পর থেকে আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। আমার খেয়াল রাখাই কোনো ত্রুটি উনি রাখেনি। যখন যেটা দরকার সেটা হাতের কাছে এগিয়ে দিচ্ছেন। সময় মতো খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সমস্তটা করছেন নিঃশব্দে। মুখ দিয়ে টু শব্দও করছেন না। আমি উনার সাথে কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু উনি উনার সিদ্ধান্তে অটল আমার সাথে কথা বলবেন না।

উনি আমাকে মেডিসিন খাওয়াতে আসলে আমি উনার হাত ধরে টান দিয়ে আমার ওপরে ফেলে দেই। আচমকা এমন হওয়াতে উনি নিজেকে সামলাতে না পেরে আমার ওপর পড়ে যান। উনি আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে ওঠতে নিলেই সাথে সাথেই আমি উনার কলার চেপে ধরি। কলার চেপে ধরে উনাকে নিচে ফেলে আমি উনার ওপর ওঠে আসি মুখ সিরিয়াস ভাব নিয়ে বললাম,

এই ছেলে আপনার এতো ভাব কোথা থেকে আসে? হ্যাঁ? দেখছেন না এই সুন্দরী রমনী আপনার সাথে কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। আপনি জানেন না সুন্দরী রমনীদের উপেক্ষা করলে অভিশাপ লাগে। রূপের অভিশাপ।

উনি একটু কাত হয়ে আমাকে উনার নিচে ফেলে দেন। উনার কলার থেকে হাত দুটো ছাড়িয়ে আমার হাত দুটো উনার এক হাতে বিছানার সাথে চেপে ধরেন। আরেক হাত দিয়ে কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলেন,

এই সুন্দরী রমনীর রূপের অভিশাপে তো সেই কবেই আমি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছি।

চলবে………

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪৪

আজকে আর কলেজে যাওয়া হয়নি। কলেজের ‘ক’ উচ্চারণ করতেই উনি আমার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এই দৃষ্টি উপেক্ষা করে আর কলেজে যাওয়ার কথা বলার সাহস আমার হয়নি।সারাদিন রুমে শুয়ে বসে কাটানো যায় নাকি। উনার বুক সেলফে হাত দেওয়া হয়নি কোনোদিন। উনি বারণ করেছেন তেমনটা নয় কিন্তু। সময়ের অভাবে কখনো বুকসেলফটা দেখা হয়নি।

আমি বই প্রেমি হওয়া সত্ত্বেও থাকে থাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা বইগুলো কখনো ছুঁইয়ে দেখা হয়নি। বিছানায় বসে ডিসাইড করছিলাম কোন বইটা পড়া যায়। এখানের বেশির ভাগের বই-ই মেডিক্যালের বই। সাইন্স ফিকশন। পৃথিবীর বিখ্যাত অমর মনীষীদের আত্নজীবনী আর বিজ্ঞান ভিত্তিক বই। এতো এতো বইয়ের মাঝে আমার নজর আটকে গেলো এক কোণে থাকা হুমায়ূন আহমেদ কৃষ্ণপক্ষ উপন্যাসের বইটাই। আমি বরাবরই উপন্যাস প্রেমী।

বইটা নেওয়ার জন্য বুকসেলফের কাছে গেলাম। বইটা সবার উপরে থাকে থাকায় কিছুতেই হাত গিয়ে নাগাল পাচ্ছি না। একটা চেয়ার নিয়ে এসে চেয়ারে ওঠে বইটা হাতে নিলাম। বইটা হাতে নেওয়ার পর পরই কেমন যেনো একটা প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে। এই উপন্যাসটা পড়ার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। কিন্তু আম্মুর জন্য পড়া হয়ে ওঠেনি।

বেলকনিতে রাখা ডিভানে আরামসে শুয়ে পড়লাম। বইটা ওপেন করতেই বইয়ের ভিতর থেকে কিছু কাগজ বেরিয়ে এলো। কাগজ বললে ভুল হবে ছবির মতো লাগছে। কৌতূহল বশত ছবিগুলো হাতে নিলাম। ছবিগুলো আমার চক্ষুগোচর হওয়া মাত্রই দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এলো। চোখ দুটো অশ্রুতে টই টম্বুর হয়ে ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে। মাথা ভন ভন করছে।

একটা মেয়ের সাথে রুদ্রর কিছু হাস্যজ্জ্বল ছবি। জানি মেয়েটা রুদ্রর প্রাক্তন প্রেমিক অরি আপু। অরি আপু দেখতে মাশাল্লাহ। উনার রুপের প্রশংসা যতই করি ততই কম হবে। এই জন্যই হয়তো রুদ্র অরি আপুর প্রেমে পাগল ছিল। অরি আপু যতই রুদ্রর প্রাক্তন হোক না কেনো আমি তো রুদ্রর সাথে উনাকে মানতে পারছি না। আমি ব্যতীত অন্য কাউকে আমি রুদ্রর পাশে কল্পনাও করতে পারি না। আমি বরাবরই নিজের জিনিস নিয়ে পজেসিভ। যা আমার তা আমারই। তার দিকে কারো নজর আমি সহ্য করতে পারি না। আর যদি সেটা হয় আমার প্রিয় জিনিস তাহলে সেটার দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও আমি সহ্য করতে পারি না।

এই মুহূর্তে রুদ্রর পাশে আমি অরি আপুকে সহ্য করতে পারছি না। তাদের এই ক্লোজ ছবিগুলো আমার অন্তর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। বুকের ভিতর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সেই আগুনে সবকিছু আমার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে ইচ্ছে করছে।

একটা লাইটার নিয়ে এসে এক এক করে ছবিগুলো জ্বালিয়ে দিতে লাগলাম। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সেই আগুনে পুড়ছে রুদ্র আর অরি আপুর ভালোবাসাময় স্মৃতিগুলো। সেই সাথে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে আমার।

কোনো মেয়েই তার হাজবেন্ডের পাশে অন্য মেয়েকে সহ্য করতে পারে না। সেখানে আমি কী করে পারবো? ডাক্তারবাবু আপনার এই হাসি আমার বুকের মাঝখানটাই গিয়ে লাগছে। কই আমি তো কোনোদিন আপনার এই স্নিগ্ধ হাসি দেখিনি। এই স্নিগ্ধ হাসি কী শুধু অরি আপুর জন্যই বরাদ্দ নাকি এই স্নিগ্ধ হাসির মালিকানা শুধু অরি আপুর নামে? যে অরি আপু চলে যাওয়ার সাথে সাথে হাসিটাও নিয়ে গেছে। আমি কী আপনার এক টুকরো স্নিগ্ধ হাসির কারণ হতে পারি না? নাকি সেই অধিকার আমার নেই? হিংসা জিনিসটা বরাবরই আমি ঘৃণা করতাম। আজকে আমার ভীষণ হিংসে হচ্ছে অরি আপুকে। আপনার ভালোবাসার একমাত্র ভাগীদার কেনো অরি আপু হলো? আপনার একটু ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার কী আমার নেই? অন্তদহনে অনেক জ্বলেছি। এবার আপনাকেও অন্তদহনে জ্বলতে হবে। এতোদিন রিয়ার ভালোবাসা দেখেছেন এখন থেকে রিয়ার ইগ্নোরেন্স দেখবেন ডাক্তারবাবু।

রুদ্রর ডাকে হুশ এলো। ছবিটা প্রায় পুড়ে গিয়েছিল। হাতে লাগার আগেই রুদ্র ছবিটা হাত থেকে ফেলে দিয়েছেন। হাতে হালকা একটু ছ্যাকা লেগেছে। কিন্তু এই ব্যথা উপলব্ধি হচ্ছে না। কারণ এই ব্যথার থেকেও মনের ব্যথা আজ প্রখর।

তুমি এতোটা কেয়ারলেস কী করে হতে পারো? আমি যদি এখন না আসতাম কী হতো ভাবতে পারছো? এই সব কী পুড়াচ্ছিল? আগুন এখনি তোমার উড়নায় লেগে যাচ্ছিল। যদি উড়নায় লেগে যেতো তাহলে…….

তাহলে আর কী হতো আমি আগুনে ঝলসে যেতাম। আমার কোনো অস্তিত্ব থাকতো না।

শাট আপ। আরেকটা কথাও বলবে না। মৃত্যুকে তুমি হেলাফেলা মনে করো। হাত দেখি দাও।

দেখতে হবে না।

উনি আমার কথা শুনলেন না। জোড় করে হাত টেনে নিলেন। হাত লাল হয়ে গেছে।

হাতের কী অবস্থা করেছো দেখতে পাচ্ছো? আসো অয়েনমেন্ট লাগিয়ে দেই।

আমি ঝাড়া মেরে উনার কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম।

লাগবে না অয়েনমেন্ট। আমারটা আমি বুঝে নিব। আমি নিজের খেয়াল রাখতে জানি। আপনাকে আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না।

কথাগুলো বলে এক দন্ড উনার সামনে দাঁড়ালাম না। সোজা রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি উনার সাথে তো এমন বিহেইভ করতে চাইনি। হুট করে আমার কী হলো আমি নিজেও বুঝতে পারলাম না। আজকে উনি হসপিটাল থেকে অনেক আগেই এসেছেন। হয়তো আমার জন্যই। সারাদিন উনার আশেপাশে যায়নি। উনার সাথে টু শব্দও করিনি। উনি অবশ্য আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি পাত্তা দেয়নি।

ডিনার করার পর পাক্কা দুই ঘন্টা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখেছি। অবশ্য ডিনার করার সময় উনি আমাকে প্রচুর জ্বালিয়েছেন। আমি উনার বিপরীত মুখী হয়ে বসায় বার বার পা দিয়ে খোঁচাচ্ছিলেন। দুই ঘন্টা পর মামুনি এসে টিভি অফ করে দেয়। আমাকে বকাঝকা দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিল।

রুমে এসে দেখি উনি বিছানায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছেন। আমি উনাকে না দেখার মতো করে গিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ওয়াশরুম থেকে এসে উনার সামনে ঘুরঘুর করছি। কিন্তু উনি একবারের জন্যও আমার দিকে তাকালেন না। আমার রাগ হলো ভীষণ রাগ। আমি ঠাস করে রুমের লাইট অফ করে দিলাম। উনিও সাথে সাথেই ল্যাপটপটা অফ করে বেড সাইড টেবিলে রেখে দিলেন।

আমি বিছানায় শুতে গেলেই উনি আমার হাত টেনে ধরেন। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি ধমক দিয়ে বলে ওঠেন,

একদম না। একদম হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করবে না। সারাদিন ধরে তোমার অনেক ভাব দেখেছি।

উনি এক বার বাম দিকে তাকালেন। তারপর আমার দুই গালে উনার দুই হাত রেখে শান্ত স্বরে জিঙ্গেস করেন, কী হয়েছে? এমন করছো কেনো?

আমি আবার উনার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই উনি এক হাত দিয়ে আমার কোমর চেপে ধরেন। আমাকে নিজের সাথে চেপে ধরেন।

একদম দূরে যাওয়ার চেষ্টা করবে না। সারাদিন অনেক দূরে দূরে থেকেছ। এখন সময় কাছাকাছি থাকার। বাই এনি চান্স তুমি আমার কাছে থাকার জন্য এরকম করছো না তো? আই মিন তুমি দূরে যাওয়ার চেষ্টা করবে আর আমি তোমাকে কাছে টেনে নিব।

আমি নাক ফুলিয়ে উনার দিকে তাকাই। আমার নাক ফুলানো দেখে উনি হেসে দিলেন।

কুল কুল এতো রাগার কিছু হয়নি। আমি তো যাস্ট মজা করছিলাম। রাগলে কিন্তু তোমাকে মন্দ লাগে না। এই ধরো রাগলে তোমার নাকটা লাল হয়ে যায়।

ছাড়ুন তো আপনি আমাকে।

একদম ছাড়ব না। পারলে তুমি নিজেকে ছাড়িয়ে নাও। কী হয়েছে তোমার? বলবে না আমায়? কেউ কিছু বলেছে তোমায়? তুমি কী কোনো কারণে আমার ওপর রেগে আছো?

চলবে…………..

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪৫

একদম ছাড়ব না। পারলে তুমি নিজেকে ছাড়িয়ে নাও। কী হয়েছে তোমার? বলবে না আমায়? কেউ কিছু বলেছে তোমায়? তুমি কী কোনো কারণে আমার ওপর রেগে আছো? আমি কী কোনো ভুল করেছি যার জন্য তুমি আমার ওপর রেগে আছো?

আমি নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলাম। উনাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে দিলাম। হঠাৎ এভাবে কেঁদে দেওয়ায় উনি হকচকিয়ে গেলেন। পরক্ষণেই অস্থির হয়ে পড়লেন। আমাকে এভাবে কাঁদতে উনি কখনো দেখেননি। তাই হয়তো একটু বেশিই অস্থির হয়ে পড়েছেন।

এই তুমি কাঁদছো কেনো? কী হয়েছে তোমার?

আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না। আপনার সব ভালোবাসা অরি আপুর জন্য তাই না?

‘অরি’ নামটা শুনেই মনে হল উনি থমকে গেলেন। হাত আটকে গেলো আমার চুলের ভাজে। আমি উনাকে ছেড়ে দিয়ে ওঠে বসলাম। উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

আমি তো শুধু আপনার অভ্যাস অরি আপু আপনার ভালোবাসা। আপনার ভালোবাসা, হাসি, সুখ সবই তো অরি আপুর।

উনি আমার বাহু চেপে ধরে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলেন, কী তখন থেকে অরি আপু, অরি আপু করে যাচ্ছো? অরিকে চিনো তুমি? কতটুকু জানো ওর সম্পর্কে?

অরি আপু আপনার প্রাক্তন। উনার হাত জোড়া থেমে গেলো। উনি আমাকে ছেড়ে একটু দূরে সরে বসলেন। উনি অন্য দিকে তাকিয়ে বার কয়েক বার নিশ্বাস নিলেন। আমার দিকে না তাকিয়েই আমাকে জিঙ্গেস করলেন,

এসব তুমি জানলে কী করে? তোমাকে অরির কথা কে বলেছে?

আপনি আজও আমাকে কিছু বলবেন না? প্রত্যেক বার আপনি খুব সূক্ষ্ম ভাবে প্রশ্নটা এড়িয়ে যান। আমি আর এসব মানতে পারছি না। আজ আপনি সব আমাকে বলবেন নাহলে সত্যি সত্যি আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাব।

আমার আর অরির পরিচয়টা হয়েছিল কলেজে পড়াকালীন। পরিচয় বললে ভুল হবে ও নিজে এসে শুধু আমার পরিচয় জেনে নিয়েছিল। আমি ওর সম্পর্কে কিছু জিঙ্গেস করি নাই। ইনফ্যাক্ট নামটা পর্যন্ত জিঙ্গেস করি নাই। হুট করে আমি কারো সাথে মিশে যেতে পারি না। অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতেও আমার ভালো লাগে না। অরির সাথে মিশার বা ওর পরিচয় জানার কোনো ইচ্ছে অথবা প্রয়োজন আমার ছিল না। কারণ আমাদের একটা ফ্রেন্ড সার্কেল ছিল। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেল মোট পাঁচ জনের। রুনা আর ইলানকে তো চিনোই। আরো দুজন আছে। তারা দেশের বাইরে থাকে। আমি বরাবরই পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম। প্রয়োজন বাদে আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের বাইরের কারো সাথে আমি কথা বলতাম না। আমি ক্লাসে কখনো আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের কারো সাথে বসতাম না। কারণ ফ্রেন্ডরা একসাথে বসলে কথা হবেই এটা স্বাভাবিক। কথা নাহলে সেটা অস্বাভাবিক। আর ক্লাস চলাকালীন কেউ আমাকে ডিস্টার্ব করুক সেটা আমার পছন্দ ছিল না। আমার অপছন্দের কাজটাই অরি করতো। আমাকে ক্লাসে অরি বরাবরই ডিস্টার্ব করতো। প্রচণ্ড ডিস্টার্ভ করতো। বিরক্ত হয়ে স্যারকে বিচার দিতে গিয়েও দিতাম না। কারণ একটা মেয়ে আমাকে ডিস্টার্ব করে ব্যাপারটা হাস্যকর। একদিন আমি কড়াকড়ি ভাবে নিষেধ করে দেই আমাকে যেনো ক্লাসে বিরক্ত না করে। ক্লাসে বিরক্ত করা ছেড়ে দিলে নতুন ওয়েতে আমাকে বিরক্ত করা শুরু করে। কলেজ শেষে আমি লাইব্রেরীতে বসে বই পড়তাম। আমার ঐ দুই বন্ধু হোস্টেলে থাকতো। তাই তারা কলেজ ছুটি হওয়ার পর পরই চলে যেতো। কারণ সময় মতো না গেলে খাবার পাবে না। রুনা আর ইলান যেতো ঘুরতে। তাই আমি একাই লাইব্রেরীতে বসে বই পড়তাম। লাইব্রেরীতে এসে বিরক্ত করা শুরু করে। অরি আমার পাশে বসে বক বক করতো। এভাবে কিছুদিন চলে। ও একা একাই কথা বলতো। আমি কখনো অরির কথার প্রতিত্তর করতাম না। প্রথম কিছু দিন ভীষণ বিরক্ত হতাম। বিরক্তি প্রকাশও করতাম কিন্তু ও আমার বিরক্তিটাকে পাত্তা দিত না। আস্তে আস্তে ওর বক বক করাটা আমার ভালো লাগতে শুরু করে। ওর বক বক শোনা আমার রোজকার রুটিন হয়ে গিয়েছিল। হুট করে ও একদিন আমাকে প্রোপোজ করে বসে।

উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম উনার পরবর্তী কথাগুলো শোনার জন্য। উনি কিছু বলছেন না দেখে অধৈর্য হয়ে আমিই বলে ওঠলাম,

কী হলো চুপ করে গেলেন কেনো? এরপর কী হলো সেটা বলুন? আপনি কী অরি আপুর প্রোপোজেল এক্সেপ্ট করেছিলেন?

কথাটা বলার পর আমি বুঝতে পারলাম আমি কতটা বোকামি করেছি। প্রোপোজেল এক্সেপ্ট না করলে প্রাক্তন প্রেমিকা কীভাবে হবে?আসলেই আমি বিখ্যাত আবাল। তাই তো আবাল মার্কা আবাল মার্কা প্রশ্ন করি। উনি আমার দিকে মৃদু হেসে বলেন,

সহ্য করতে পারবে পরের কথাগুলো। কষ্ট হবে না তোমার? কেনো পুরোনো ঘটনা ঘেটে নিজের কষ্ট বাড়াতে চাইছো?

প্লিজ আপনি বলুন। সবটা না জানলে আমার কষ্ট বাড়বে বই কমবে না। এখন যদি না জানি তাহলে আক্ষেপ থেকে যাবে। রোজ আমি একটু একটু করে জ্বলবো। রোজ রোজ জ্বলার থেকে একবারে জ্বলা ভালো না।

উনি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলেন, তুমি বড্ড জেদী। যেটা করবে বলে ঠিক কর। ঠিক সেটাই কর। ও আমাকে প্রোপোজ করেছিল সবার সামনে ক্যান্টিনে। তাই ওকে রিজেক্ট করতে পারিনি। সবার সামনে একটা মেয়েকে রিজেক্ট করা সেই মেয়েটার জন্য কতোটা অসম্মান জনক তুমি নিশ্চয়ই বুঝো। আমি কিছু না বলে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসি। এরপর কেটে যায় কিছুদিন। এর মাঝে অরি আর আমার সামনে আসেনি ইনফ্যাক্ট কলেজেও আসে নাই। হয়তো এভাবে কিছু না বলে বেরিয়ে যাওয়ায় হয়তো ওর ইগোতে লাগে। এদিকে আমি ওকে ভীষণ ভাবে মিস করা শুরু করি। ওর প্রতি একটা এট্রাকশন কাজ করা শুরু করে। ওর বক বক এক সময় বিরক্ত লাগতো। ঐ সময় ওর বক বক শোনাটা নেশায় পরিণত হয়ে যায়। ওর সাথে কোনো ভাবে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। কেমন একটা ডিপ্রেশনে ভুগ ছিলাম। ওর বান্ধবীরাও ওর কোনো খোঁজ দিচ্ছিল না আমাকে। এদিকে সবাই আমাকে বলছিল অরির প্রোপোজেল এক্সেপ্ট করে নিতে। অরি সব দিকে দিয়েই পারফেক্ট। আমার জন্য একদম পারফেক্ট। কলেজের সেরা সুন্দরী ছিল অরি। সবাই বলতো কলেজের সেরা সুন্দরী তোমাকে প্রোপোজ করেছে আর তুমি তাকে রিজেক্ট করছো। ওর প্রতি আমারও একটা ভালো লাগা কাজ করতো আর বন্ধুদের পীড়া পীড়িতে আমি রাজি হয়ে যায় প্রোপোজেল এক্সেপ্ট করার জন্য। এটাই হয়তো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আবেগের বশে মস্ত বড় একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। অরি বান্ধবীকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে অরির নাম্বার নিয়েছিলাম। এর ক্রেডিট অবশ্য নাইমের। ও মেয়েদের সাথে খুব সহজে মিশে যেতে পারতো। অরিকে ফোন দিয়ে আমি সরাসরি আই লাভ ইউ বলে দেই। তখন থেকেই আমাদের প্রণয়ের সূচনা। এরপর থেকে শুরু হয় লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করা, ফোনে কথা বলা, কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যাওয়া। এসব করে পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে যাই। এতে আমার আফসোস ছিল না। কারণ ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকলে আর কী চাই? এভাবে কেটে যায় কলেজের দিনগুলো টেস্ট পরীক্ষায় ভয়াবহ রকম রেজাল্ট খারাপ হয়। আব্বু ভীষণ বকা দেয়। পড়াশোনা নিয়ে আবার সিরিয়াস হয়ে যাই। এর ফলে অরিকে আগের মতো সময় দিতে পারতাম না। বুঝতে পারছিলাম অরি আমার কাছ থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম পরীক্ষার পর পুরোটো সময় ওকে দিব। পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসে অরির সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন হয়ে যায়। ভালো ভাবে সবগুলো পরীক্ষা কম্পলিট হয়ে যায় আমি আবার অরির সাথে যোগাযোগ করি। সবকিছু আগের মতোই চলতে থাকে। দুজনেই মেডিক্যাল এডমিশন কোচিংয়ে ভর্তি হই।

উনি একটু থামলেন। উনার চোখে অভি চিকচিক করছে। উনি ঠোঁট কামড়ে ধরে অন্যদিকে তাকালেন। আমার বুকের ভিতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনের মাঝে একটাই প্রশ্ন জাগছে উনি কী এখনো অরি আপুকে নিজের জীবনে ফিরে পেতে চান?

চলবে………..